🩸রক্ত সঞ্চালনের ইতিহাস: মেডিসিন না মার্ডার? পর্ব ১

একটা অত্যন্ত ভালো বইয়ের নাম ঝেড়ে আমার এই গল্পের শিরোনাম বানালাম। অধিকাংশ গল্পই সেখান থেকে টোকা। তবু বুক রিভিউ বলতে পারছি না কারণ এদিক ওদিক থেকে আরো কিছু ঝেড়েছি। তার সাথে নিজের দু’ এক চিমটে। একটা অত্যন্ত প্রয়োজনীয় চিকিৎসা পদ্ধতি কেমন করে আমাদের হাতে এলো তার গল্প শোনানোর একটা দুর্বল প্রচেষ্টা করেছি মাত্র।

বিধিবদ্ধ সতর্কীকরণ দিয়ে শুরু। রক্তপাতের গল্প শুনলে যাঁদের অস্বস্তি হয় তাঁরা প্লিজ এই গল্প পড়বেন না। বিজ্ঞানের প্রয়োজনে অ্যানিম্যাল এক্সপেরিমেন্টেশনের যাঁরা বিরোধী তাঁরাও চোখ সরিয়ে নিতে পারেন।

১৭৯৯ এর ডিসেম্বর। আমেরিকার প্রথম প্রেসিডেন্ট জর্জ ওয়াশিংটন সকালে ঘুম থেকে উঠলেন ভীষণ রকমের ধরা গলা নিয়ে।সক্কাল সক্কাল চিকিৎসক এলেন। নিদান দিলেন রক্তমোক্ষণের। তার বহু বছর আগে থেকেই অসুস্থ হলেই শরীর থেকে রক্ত বের করে ফেলা একটা স্বীকৃত চিকিৎসা পদ্ধতি। প্রথমে আঠারো আউন্স (প্রায় হাফ লিটার) রক্ত বের করা হলো। পেশেন্ট এর অবস্থার কোনো উন্নতি হলো না। দফায় দফায় চার চারবার প্রেসিডেন্ট এর শরীর থেকে রক্ত বের করা হলো। অবস্থার কোনো হেরফের তো দূরের কথা রাত দশটা নাগাদ প্রেসিডেন্ট ওয়াশিংটন মারা গেলেন। মৃত্যুর কারণ অসুস্থতা নাকি অতিরিক্ত রক্তক্ষরণ এ নিয়ে ইতিহাসবিদেরা দ্বিধা বিভক্ত। তবে চিকিৎসায় গাফিলতির দায়ে সেকশন ৩০৪এ দেওয়া বা ডাক্তার পেটাই অথবা তার হাসপাতাল ভাঙচুরের কোনো খবর পাওয়া যায় নি।

জর্জ ওয়াশিংটনের গল্প শোনানোর কারণ আছে।
রক্ত সঞ্চালনের ইতিহাস শোনাতে গেলে রক্তমোক্ষণের গল্প বলতেই হয়। আর শোনাবোই যদি, সবচেয়ে বিখ্যাত ব্যক্তিত্বের কথা কেনো শোনাবো না। TRP-র খিদে আর কী!

কেটে ফেটে গেলে রক্ত বেরোবে সে হয়তো সবারই জানা ছিল ধরে নেওয়া যেতে পারে। কিন্তু পরিকল্পিত ভাবে রক্ত বের করতে গেলে তো রক্ত সংবহনতন্ত্র সম্পর্কে ধারণা থাকতে হয়। সে ধারণা আমাদের প্রথম আসে ইংলিশ চিকিৎসক ডা: উইলিয়াম হার্ভের কাজ থেকে। সেটা ছিল ১৬২৮ সাল। তার আগে চার দশক ধরে ইউরোপে বিজ্ঞানীরা শব ব্যবচ্ছেদ করে চলেছেন। মূলত মৃত্যুদণ্ড প্রাপ্ত অপরাধীদের শরীর নিয়েই চলতো সে সব পরীক্ষা নিরীক্ষা।

আজকের গল্পটা যথাসম্ভব ভয়ঙ্কর করতে আমি বদ্ধ পরিকর। অতএব উইলিয়াম হার্ভে কিভাবে শবদেহ পেতেন তা একটু শোনাতেই হয়। মাত্র একটা উদাহরণ দেবো। একটু হয়তো ধান ভানতে শিবের গীত টাইপস্ হয়ে যাবে। কিন্তু “লেখক বিদ্যে ফলিয়েছে” বলে প্লিজ ক্ষমা করে দেবেন।

ষোড়শ থেকে অষ্টাদশ শতাব্দীতে লন্ডনের বহুল পরিচিত জেলখানা ছিল নিউগেট। সেখান থেকে ফাঁসির আদেশ পাওয়া আসামীদের অন্তিম শাস্তি প্রদানের জন্য নিয়ে যাওয়া হতো টাইবার্ণ বলে পশ্চিম লন্ডনের একটি জায়গায়। ঠিক অক্সফোর্ড রোড আর এজওয়ার স্ট্রীট যেখানে মেশে। এখন যেখানে মার্বেল চার্চ রয়েছে। নিউগেট থেকে টাইবার্ণ তিন কিলোমিটার রাস্তা আসামীদের সাজিয়ে গুছিয়ে নিয়ে যাওয়া হতো ঘোড়ায় টানা খোলা গাড়িতে। রাস্তার দুপাশে থাকতেন অসংখ্য দর্শনার্থী। টিকিটও বিক্রি হতো বলে শোনা যায়। একদিকে কেউ কেউ আসামীদের “গুড ডাইং” উইশ করতেন। আবার অনেক মা তাঁদের বাচ্চার গালে মৃত্যুমুখী মানুষের হাত ছুঁইয়ে নিতেন। তাতে নাকি ক্যানসার আটকাতো। যাইহোক, অন্তিম কাজ সম্পন্ন হতো দশ বারো ফুট উঁচু তিনপায়া এক বিশাল টুলের মতো একটা কাঠামোয়। একে বলা হতো টাইবার্ণ ট্রী। এখানে একসাথে চব্বিশ পঁচিশ জনকে জনসমক্ষে ঝোলানো যেত। সবাই যে সঙ্গে সঙ্গে নিথর হয়ে যেতেন তা নয়। কারো কারো প্রায় ঘন্টা খানেক লেগে যেত। দর্শনার্থীরা প্রবল উৎসাহে সে দৃশ্যের স্বাক্ষী থাকতেন। সামনের সারির টিকিটের দাম বেশি থাকতো কি না জানা নেই। যাইহোক যমে-মানুষে টানাটানির পর যম যখন জিতে যেতেন তখন শুরু হতো ডোমে-ডাক্তারে টানাটানি। ডোমেদের কাছে দরদাম করে বডিগুলো কিনে নিতেন হার্ভে, বয়েল (Boyle), হুক (Hooke) ইত্যাদি গবেষক-চিকিৎসকেরা। সব মৃতের পরিবার যে বিজ্ঞানের অগ্রগতির স্বার্থে দেহ ব্যবহার হচ্ছে ভেবে খুশি হতেন তা নয়। তাদের ধারণা ছিল মৃত্যুদণ্ডের চেয়েও বড় শাস্তি মৃতদেহ কাটাছেঁড়া হওয়া। কারণ তাতে নাকি পুনরুজ্জীবন (resurrection) এর আর কোনো চান্স থাকতো না।

হার্ভে প্রমুখ চিকিৎসকের কল্যাণে মানবদেহে রক্ত সংবহন রহস্য উন্মোচিত হবার সাথে সাথে বহু শতাব্দী প্রাচীন কিছু ধ্যানধারণা তুমুল চ্যালেন্জের মুখে পড়ে। যেমন দ্বিতীয় শতকের প্রভাবশালী চিকিৎসক গ্যালেন (Galen), অ্যারিস্টটল প্রস্তাবিত হিউমার তত্ত্ব জন্য যিনি প্রসিদ্ধ করে তুলেছিলেন। বলা হয়েছিল মানবশরীরে রক্ত আছে বটে তবে তার বিশেষ সংবহন হয় না। পাকস্থলীতে খাদ্য রান্না (“cooked”) হয়ে পৌঁছে যায় ছাঁকাই মেশিন লিভারে। সেখানে তৈরী হয় রক্ত। হার্টের কাজ খানিকটা ফার্নেস বা চুল্লির মতো। চুল্লির প্রয়োজনীয় জ্বালানী হলো লিভার থেকে আসা বিশুদ্ধ রক্ত। নিশ্বাসের হাওয়া হলো সেই চুল্লি থেকে নির্গত ধোঁয়া। এই সব ধ্যান ধারণা পাল্টে আমরা জানলাম সুসংহত একটি সংবহনতন্ত্রের কথা যাতে হার্ট আছে, শিরা-ধমণী আছে ইত্যাদি।

মানবশরীরে রক্ত সঞ্চালনের অনেক আগে থেকেই পরীক্ষামূলক ভাবে প্রাণী থেকে প্রাণীতে রক্তের আদানপ্রদান ঘটানো হয়েছিল। প্রথম পছন্দের প্রাণী ছিল সারমেয়। কারণটা বোধহয় রাস্তাঘাটে ওরাই সবচেয়ে বেশী ঘুরে বেড়াতো। ১৬২৮-এ হার্ভে শবদেহে রক্ত সংবহনতন্ত্রের বর্ণনা দেওয়ার আঠাশ বছর পর অর্থাৎ ১৬৫৬ সালে ক্রিষ্টোফার রেন( Wren) লণ্ডনে এক অদ্ভুত পরীক্ষা করলেন। তখন তাঁর বয়স মাত্র চব্বিশ। অক্সফোর্ডে পড়াশুনা করছেন। রেন একটি কুকুরকে কষে বেঁধে তার শিরায় খানিকটা ওয়াইন ঠুঁসে দিলেন। কুকুরটা নাকি দৃশ্যত নেশাগ্রস্ত হয়ে পড়লো। পরিস্থিতি সামাল দিতে রেন তাকে একই ভাবে খানিকটা বমি হওয়ানোর ওষুধ (crocus metallorum) ঠুঁসে দিলেন। কিছুক্ষনের মধ্যেই কুকুরটা বমি করতে করতে মারা গেল। ফল যাই হোক না কেনো, রেন অন্তত:পক্ষে প্রমাণ করতে পারলেন শিরায় কোনো তরল দিলে তা মাথায় বা শরীরের অন্য অংশে পৌঁছে যায়। অভূতপূর্ব সাফল্যে উৎসাহিত রেন ও তাঁর সঙ্গী সাথীরা এর পরবর্তীতে কুকুরের শিরায় কখনও আফিম, কখনও বিয়ার, কখনও দুধ আবার কখনও বা আর একটি প্রাণীর রক্ত চালাতে থাকলেন। বছর খানেকের মধ্যে তাদের নজর গিয়ে পড়লো মানব শরীরে সঞ্চালন উপর। প্রথম চেষ্টা চললো এক অধস্তন গৃহভৃত্যের উপর। ফল ভালো হলো না। রেন ভয় পেয়ে থেমে গেলেন।

ওদিকে ইংলিশ চ্যানেলের ওপারের দেশটি চুপ বসে থাকার নয়। ক্যাথলিক ফ্রান্স আর প্রোটেস্ট্যান্ট ইংল্যান্ডের মধ্যে রেষারেষি যে শুধু ধর্মীয় আচারে, যুদ্ধক্ষেত্রে আর ফুটবলের মাঠে সীমাবদ্ধ ছিল তা নয়। হাড্ডাহাড্ডি লড়াই ছিল বিজ্ঞানের আঙিনাতেও। অ্যানিম্যাল এক্সপেরিমেন্টেশনে তারা সামান্য পিছিয়ে থাকলেও মানব শরীরে সঞ্চালনের ব্যাপারে ইংল্যান্ডকে টেক্কা দিলেন।

কিন্তু আজ সারমেয় সন্চালনেই শেষ করবো। বাকিটা পরের পর্বে। সেদিন থাকবে টানটান জমজমাট সরি রক্তজমাট করা পাল্প ফিকশন। ঠান্ডা মাথায় মার্ডারের গল্প। লেখক স্বপনকুমারের বদলে কাঞ্চনকুমার।

দ্বিতীয় পর্বের প্রিভিউ:

“লোকটা বেশ বাজে রকমের পাগলামি করছিল। রক্ত গরম হয়ে গেলে নাকি মানুষ ওরকমই বাঁদরামি করে। তাই তাকে ঠান্ডা করতে তার শরীরে দিয়ে দেওয়া হলো ন’আউন্স তাজা ভেঁড়ার রক্ত। প্রথম দিন সহ্য হয়ে গেল। দ্বিতীয় দিনও সে মানিয়ে নিল। ডাক্তারবাবুরা দাবি করলেন মাথা ঠান্ডা হয়ে গেছে। পাগলামিও কমেছে। কিন্তু তৃতীয় দিনে……”

সঙ্গে থাকুন।

চিত্রঋণ: গুগল

চিত্রসূত্র:
1. William Harvey (1578-1657): রক্ত সংবহন তন্ত্রের আবিস্কর্তা
2. Tyburn Tree

মূল তথ্যসূত্র:
Holy Tucker: Blood Work- A Tale of Medicine or Murder in the Scientific Revolution