আমার ভুলে মারা গিয়েছিলেন এক রাপচারড এক্টোপিক প্রেগন্যান্সির রোগিনী। আজ থেকে ৩২ বছর আগে, ১৯৮৭-র ডিসেম্বর মাসের শেষ সপ্তাহে।
এক বছর হয়েছে সবে শহীদ হাসপাতালে যোগ দিয়েছি। তখন হাসপাতালে ডাক্তার বলতে শৈবালদা (জানা) আর আমি। আশিসদা (কুন্ডু) পারিবারিক কারণে বাংলায় ফিরে এসেছেন, ফিরেছেন চঞ্চলাদিও (সমাজদার)। বিনায়কদা (সেন) শহীদ হাসপাতাল ছেড়ে গেছেন নিজের স্বেচ্ছাসেবী সংস্থা গঠনের প্রস্তুতি নিতে। মেডিকাল কলেজে দুবছর সার্জারিতে হাউস জব করে গিয়েছিলাম বলে শল্যচিকিৎসার দায়িত্বে আমি। শৈবালদা মেডিসিন ও অবস্ট্রেটিক রোগী/গিনীদের দায়িত্বে। সকালে অপারেশন ৭টা থেকে, তারপর দুজন মিলে ওর্য়াডে রাউন্ড দিয়ে ৯-৩০টা থেকে আউটডোরে ১২-৩০টা অবধি। বিকেলে আবার ৪-৩০টা থেকে ৭-৩০টা অবধি আউটডোরে, দিনের শেষে আবার রাউন্ড দিয়ে কোর্য়াটারে ফেরা।
এর মধ্যে মোপেড চালানো শিখতে গিয়ে পা ভেঙ্গে শৈবালদা বিছানায়। একা হাসপাতাল চালাচ্ছি। সকালে আউটডোরে কাজ করার সময় দুজন রোগী এলেন পেটের নীচে ডানদিকে ব্যথা নিয়ে—এপেন্ডিসাইটিস। আউটডোর সেরে দুজনের এপেন্ডিসেক্টমি সেরে বিকেলের আউটডোরে বসতে যাব, এক মহিলা এলেন পেটে ব্যথা নিয়ে তলপেটে ডানদিকে, পেটে হাত ছুঁইয়ে দেখে নিলাম ডানদিকে ব্যথা—এপেন্ডিসাইটিসই হবে! রাইলস টিউব (নাক দিয়ে পাকস্থলীতে ঢোকানো নল) আর আই ভি ফ্লুইড (অন্তঃশিরা দ্রবণ) চালাতে বলে দিলাম, অপারেশন করতে হলে আউটডোরের পর করব।
রাতের রাউন্ডে গিয়ে দেখি রোগিনীর পেট ব্যথা কম, নাড়ীর গতি-রক্তচাপও ভালো। মুখে খেতে চাইছেন। তাহলে অপারেশন করব না, ফ্লুইড চলুক, মুখে অল্প জল দেওয়া হোক।
ঘুমিয়ে পড়েছি, মাঝ রাতে কর্ত্যবরতা নার্স জানালেন, রোগিনী নড়াচড়া করতে গিয়ে ফ্লুইড খুলে ফেলেছেন। ঘুম চোখে জেনে নিলাম পালস-বিপি ঠিক আছে, তাহলে মুখে খেতে দেওয়া হোক। উঠে রোগিনীকে দেখে আসিনি।
দেখতে যেতে হল ভোর রাতে, রোগিনী তখন গ্যাস্প করছেন। তখন কিছু করার ছিল না।
মহিলা ঝরন-দল্লী খনির রেজিং শ্রমিক, স্বামী-স্ত্রী দুজনেই লোহাপাথর ভাঙ্গার কাজ করতেন। মহিলা ছিলেন ছত্তিশগড় মাইন্স শ্রমিক সংঘের এক মুখিয়া (নির্বাচিত প্রতিনিধি)। স্বামী-স্ত্রী দুজনকেই চিনতাম।
আকস্মিক ঘটনাক্রমে অবাক স্বামী-হাসপাতালের কর্মীরা।
আমি জিজ্ঞাসাবাদ করলাম, যে জিজ্ঞাসাবাদ করা হয়নি মহিলা বেঁচে থাকতে। দুমাস তাঁর মাসিক ঋতুচক্র বন্ধ ছিল। তারপর হঠাৎ করে পেটে ব্যথা—এক্টোপিক প্রেগন্যান্সি ফেটেই এমনটা হয়। ঠিকঠাক ইতিহাস নিয়ে সঙ্গে সঙ্গে অপারেশন করলে তিনি বেঁচে যেতেন।
আমি স্বামীর মুখোমুখি হলে অপরাধবোধে ভুগতাম, তারপর যে সাত বছর দল্লী-রাজহরায় ছিলাম। পরের দিনই হাসপাতালের কর্মীদের নিয়ে বসে আমার ভুল স্বীকার করেছিলাম, যদিও আমি ভুল করেছি এমনটা তাঁরা বুঝতে পারেননি আমি বলার আগে। শংকর গুহ নিয়োগীর সঙ্গে কথা বললাম, অনেকটা গির্জায় গিয়ে পাপ-স্বীকারের মত আর কি!
তবে এরপর আর কোনদিন কোন মহিলার চিকিৎসা করার সময় তার মাসিক ঋতুচক্রের ইতিহাস নিইনি এমনটা হয়নি। এখন ২৫ বছর কাজ করি যেখানে, সেই শ্রমিক-কৃষক মৈত্রী স্বাস্থ্য কেন্দ্রে তো প্রত্যেক মহিলার বিস্তারিত মাসিক ঋতুচক্রের ইতিহাস নেওয়া হয়, প্রতিবার জেনে নেওয়া হয় তাঁর শেষ মাসিক ঋতুচক্র কবে শুরু হয়েছিল। যে ঘটনাটা বললাম তেমন কিছু ঘটাতো দূরের কথা, গর্ভাবস্থায় যেসব ওষুধ দেওয়া বা যেসব পরীক্ষা করা ভ্রূণের পক্ষে ক্ষতিকর, সেগুলোকেও আমরা এড়িয়ে যেতে পারি এর ফলে।
এটা বোধহয় অস্বাভাবিক প্রেজেনটেশন। সাধারণত ruptured ectopic pregnancy তে পেটে বেথা, রুগীর ঝটপটানি আর দ্রুত ফেকাসে হয়ে যাওয়া এবং অবশ্যই মাসিকের ইতিহাস।
তীব্র ব্যথা – নাড়ি দ্রুত আর রক্তচাপ নিম্নগামী না হলে কেউই ধরতে পারবেন না । এই জন্যই পরীক্ষা নিরীক্ষার কদর বাড়ছে । একটা মৃত্যু ডাক্তারের মন ভেঙে দিয়ে যায় ।
দুটো ব্যাপার।
১. এমন করে নিজের ভুল স্বীকার করতে, নিজের ভুলের চিনচিনে ব্যথা এত বছর বাদেও অনুভব করার জন্যে যেটা প্রয়োজন – সেটা মহানুভবতা আর আত্মসমীক্ষার বোধ।
২. মানুষমাত্রেই ভুল হয়, আর চিকিৎসকরাও মানুষ – একথাটা চিকিৎসকরা মেনে নিতে পারলে আখেরে সবারই ভালো। ভুল চাপা দেওয়া, ভুল অস্বীকার করা – তার জন্যে বহুমূল্য আয়োজন চারপাশে। ভুল হয়েছে স্বীকার করা গেলে, সম্ভবত, পরিজনেও বোঝেন – এবং বিশ্বাসের একটা জায়গা তৈরী হতে পারে।
মহিলা রোগি পেলেই আমিও প্রথমেই শেষ মাসিকের দিন জিজ্ঞাসা করি। ডাক্তারি জীবনের শুরুতেই দু-তিনবার ঠকেছি।
I am really grateful tobe a part of this group . Thanks a lot .
I am really greatful to be a part of this group . Thanks a lot .