এটা যোফিয়ার গল্প। সেই যোফিয়া যে নিজের দেশের প্রধানমন্ত্রী নির্বাচন করতে পারে কিন্তু নিজের দেহের ওপর অধিকার দাবি করতে পারে না। না, না, এটা ভারতের গল্প না। এটা পোল্যান্ডের গল্প। ঋত্বিক ঘটক বলতেন “মেলোড্রামা ইস মাই বার্থ রাইট”। সন্তানের জন্মের পর ভারতের মা এবং পাশ্চাত্যের মা দুজনের চোখেই আনন্দে জল আসে। কিন্তু পোল্যান্ডের গল্প অন্যরকম। সেখানে সন্তানসম্ভবা যোফিয়ার বুক ধড়ফড় করে। নিজের অজান্তেই এবং কিছুটা অনিচ্ছাতেই সে মা হতে চলেছে। চিন্তা কোনো অংশে কম নয় মিলারের। মিলার এবং যোফিয়া একই কলেজের তৃতীয় বর্ষের ছাত্রছাত্রী। আমি এখানে কারো নৈতিক চরিত্র বিচার করতে বসিনি, স্বাধীনতা এবং স্বেচ্ছাচারিতাকে এক করে দেখতে বসিনি কিংবা অতি সপ্রতিভ হয়ে কারুর হয়ে ওকালতি করতে আসিনি। একজন ডাক্তারের কাছে যোফিয়া যা মেরিও তা। এমনিওসেন্টোসিস করে ধরা পড়েছে যে তার সন্তানের ডাউনস্ সিনড্রোম আছে। কিন্তু সেও মুখ বন্ধ করে রেখেছে।
কিন্তু এদের মুখ বন্ধ কেন? লোকলজ্জা? পরিবারের ভয়? নাকি অন্য কিছু? ধর্ম। হ্যাঁ ধর্ম। কেউ হয়ত বলবে অটোক্রেসি বা টাইরানি। কিন্তু একে বলে ফ্যাসিবাদ। ১৯৮০’র দশকের শেষ থেকেই কমিউনিস্টদের বিরুদ্ধে বিরোধীদের এক করার প্রয়াসে নেমে ছিল চার্চ। ১৯৮৯-তে কমিউনিজমের পতনের পর সরকার এবং চার্চ একসাথে হরিহরআত্মা হয়ে গর্ভপাতকে বেআইনি ঘোষণার চেষ্টায় ছিল। ১৯৯৩ সালে অনেক আন্দোলন সত্বেও পাশ হয় নতুন আইন। গুরুতর কোনো ফিটাল ডিফেক্ট, ধর্ষণ, ইনসেস্ট এবং মায়ের জীবনের কোনো ক্ষতির আশঙ্কা থাকলে তবেই ১২ সপ্তাহের মধ্যে গর্ভপাত বৈধ।
২০১৬ সালে অর্দো ইউড়িস নামক এক আইনি সংস্থা নতুন বিল আনে যেখানে সব সম্ভবনাতেই গর্ভপাত বেআইনি ঘোষণা করা হয়। একমাত্র ব্যতিক্রম হল প্রসবের সময় অনিচ্ছাকৃতভাবে শিশুর মৃত্যু মায়ের জীবন বাঁচানোর জন্য। ২০১৫ সালে ক্ষমতায় আসা পি আই এস পার্টির চেয়ারম্যান কাজিনস্কি বলেন,” We will strive to ensure that every pregnancy which are very difficult, when a child is sure to die, is severely deformed end with the mother given birth so that the child can be baptized, buried and have a name”। এই বিলে এমন বলা হয় যে গর্ভপাত করলে ডাক্তার এবং মহিলাটির কারাবাস পর্যন্ত হতে পারে। কিন্তু এরপর যা ঘটে তা ইতিহাস।
নির্বাচনের ৩ দিন আগে পোল্যান্ডের রাস্তায় নামে ১,১৬,০০০ মানুষ। দেশজুড়ে পালন হয় ব্ল্যাক মনডে। বৃষ্টির মধ্যে ওয়ার্সতে ক্যাসল স্কোয়ারে হাজির হয় ২৪,০০০ মানুষ। পোল্যান্ডের এই জনসমাবেশ শুধু তাদেরই নয় বরং গোটা স্বাস্থ্য আন্দোলনের ইতিহাসেই বিরল। এর তিন দিন পর ৪২৮ জনের মধ্যে ৩৫২ জন এই আইনের বিরুদ্ধে ভোট দেয়। কাজিনস্কি হার মানতে বাধ্য হয়। কিন্তু ২০১৯ এ আবার ক্ষমতায় ফেরে পি আই এস।
গুটম্যাচার ইনস্টিটিউটের তথ্য অনুযায়ী যে দেশগুলোতে গর্ভপাত বৈধ সেই দেশে ৩৪/১০০০ এবং যেই দেশগুলোতে অবৈধ সেখানে ৩৭/১০০০ হারে গর্ভপাত হয়। ৩০০০ এরও বেশি মহিলার মৃত্যু হয় প্রতি বছর এই কারণে। ফেডারেশন ফর উইমেন অ্যান্ড ফ্যামিলি প্ল্যানিং-এর কর্ণধার ক্রিস্টিনা কাচপুরা জানান ২০১৬-তে পোল্যান্ডে ১০৫৫ মহিলার আইনি ভাবে গর্ভপাত হয় আর বেআইনি ভাবে ১,৫০,০০০ জনের।
উদার গর্ভপাত নীতির জন্য পোল্যান্ডের পঞ্চাশোর্ধ মহিলারা সমর্থন করলেও তাদের পরবর্তী প্রজন্ম এই বিষয় চুপ। তারা নিজেরা মুখ খুলতে নারাজ এমনকি তাদের মেয়েদেরও মুখ বুঝে সহ্য করতে শিখিয়েছে। এইখানে দেখার বিষয় যে এই পঞ্চাশোর্ধ মহিলারা কমিউনিজমের উদার নীতি দেখে বড়ো হয়েছিলো।
তারা শুক্রবারে গর্ভপাত করে রোববার আবার চার্চে প্রার্থনা করতেও যেত। এখন সেই দিন অতীত।
এবার পি আই এস সরকারের কিছু নতুন পদক্ষেপের কথা আপনাদের বলি যা তাক লাগিয়ে দেবে। “মর্নিং আফটার পিলের” নাম এখন হয়ে গেছে পূর্বকালীন গর্ভপাত বড়ি, পাঠ্যপুস্তকে ভ্রুনের নাম বদলে করা হয়েছে আজাত শিশু এবং আর এক অভিনব পদক্ষেপ হল ভ্রূণের ছবির পাশে হিটলারের ছবি দেওয়া। অর্থাৎ গর্ভপাত আর জেনোসাইড এক।
এবার বলবো নিজেদের কথা। হয়ত আপনাদের এইটা শুনতে ভালো লাগবে। নোবেল প্রফেশনের সাথে যুক্ত ৩০০০ ডাক্তার আবার সরকারের এই উদ্যোগকে স্বাগত জানিয়ে স্বাক্ষর অভিযান করেছেন। সত্যি নোবেল শব্দের এতো বড়ো অপমান আর কেউ করেছে !! ২০১৪ তে বগদা চিজা নামক এক ধর্মান্ধ কুসংস্কারাচ্ছন্ন ডাক্তার এক মহিলাকে জানানোর প্রয়োজন বোধ করেন নি যে তার ভ্রূণের গঠনগত ত্রুটি আছে এবং গর্ভপাত ১২ সপ্তাহের মধ্যে না করায় সেই মহিলা নিরুপায় হয়ে পরে। জন্মের মাত্র ৯ দিনের মধ্যেই শিশুর মৃত্যু হয়।
এই মুহূর্তে পোল্যান্ডে ১০০০ – ৪০০০ ডলারে বেআইনি ভাবে গর্ভপাত হয় যেখানে মানুষের গড় আয় ১২০০ ডলার। বেআইনি গর্ভপাত এখন পোল্যান্ডে ইন্ডাস্ট্রির আকার নিয়েছে। ওয়ার্স বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক আগাতা চেল্সতোস্কার মতে এদের আয় বছরে প্রায় ১০০ কোটি ডলার।
কিন্তু যোফিয়া আর মেরির গল্পের শেষটা অন্যরকম। যোফিয়া একটি ডাচ সংস্থার ওয়েবসাইট – উইমেন অন ওয়েভস থেকে পরামর্শ নিয়েছে। আরথ্রোটেক বলে ওর ঠাকুমার আর্থ্রাইটিসের একটা ওষুধ কিনে এনেছে। এটা NSAID ও মিসপ্রস্তল এর কম্বিনেশন। এর অবর্টিফাইক্যান্ট কাজ আছে কিন্তু সেরকম পেটেন্ট নেই। মিলারের সাথে একা ঘরে বসে যখন ও ওষুধ খাচ্ছিল তখন ওর সাথে ফোনে কথা বলছিল উইমেন অন ওয়েভসের এক প্রতিনিধি। যোফিয়া কেঁদে ফেলে। কারণ ফোনের ওইপারে বসে থাকা মহিলা তার ছেলের সাথে খেলতে খেলতেই ওর সাথে কথা বলছিল। যোফিয়ার মনে হল ও খুনি নয়। ও মা হতে পারে। মেরি আবার ৪০০ মাইল পেরিয়ে সীমানা টপকে চলে গেছে জার্মান ডাক্তার রুদজিনস্কির কাছে। তিনি গর্ভপাত করতে করতেই ফোনে পোল্যান্ডের অন্যান্য গর্ভবতী মহিলাদের বিভিন্ন পরামর্শ দেন। বার্লিনের আরেকটি সংস্থা সিওশিয়া বসিয়া পোল্যান্ডের মহিলাদের জার্মানিতে গর্ভপাতের ব্যবস্থা করে ৪০০ থেকে ৪৫০ ডলারে। এতো কিছুর মধ্যে বলতে ভুলেই গেছিলাম যে ২০১৬ সালের সেই ব্ল্যাক মন্ডেতে যোফিয়ার ৭০ বছরের দিদাও এসেছিল। ১৯৫৬ থেকে কমিউনিজমের অন্তর্গত পোল্যান্ডে তাকে গর্ভপাতের এই কুসংস্কার ও অত্যাচার দেখতে হয়নি। সেদিন সে যোফিয়াকে বলেছিল ,” আমি এখানে এসেছি তোমার জন্য, তোমার ভবিষ্যৎ প্রজন্মের জন্য”
আপনারা হয়ত ভাববেন পোল্যান্ডের গল্প কেন বললাম। পৃথিবীর কোনো প্রান্তেই কোনও ধর্ম বোধহয় নেই যে নারীকে সম্মান করে এবং মর্যাদা দেয়। শুধু পোল্যান্ডে কেন আয়ারল্যান্ড, ক্যারিবিয়ান এবং লাতিন আমেরিকার বহু দেশে এই একই রকম বঞ্চনার শিকার হতে হয় মেয়েদের। ২০১৬ সালে আয়ারল্যান্ডে মাত্র ২৫ জনের আইনি ভাবে গর্ভপাত হয় এবং ৩২৬৫ জনকে ইউ কে-তে গিয়ে গর্ভপাত করাতে হয়। ফ্যাসিজমের কথা না হয় বললাম না। ওটা লিখে শেষ করা কঠিন। তবে আপনারা চাইলে জ্যাসন স্ট্যানলির লেখা পড়তে পারেন
সূত্রঃ ওয়াশিংটন পোস্ট, ফরেন পলিসি, টাইম ম্যাগাজিন
(যোফিয়া ও মেরি চরিত্র দুটি কাল্পনিক)
নারী স্বাধীনতা ও এক বৃদ্ধা…
দীপঙ্করের লেখা :-
ধূসর রাস্তা ভোরের বৃষ্টিতে গাঢ় নীল হয়ে ঝকঝক করছে । দূরে একটা দিনমজুর নেতাজীর মূর্তি পরিস্কার করছে । ছেলেরা নেতাজীর জন্যে মালা গাঁথছে । বিরাট বিরাট বাক্সে গান বাজছে “বর এলো মাদল বাজায়ে ” । বাজার সরগরম । মাছকুটুনীরা ডাকছে “ ও বাবুরা ইদিকে এসো তোমারটা কেটে দিই – ছোট হলে পনেরো – বড় হলে দশ ট্যাকা ” অর্থাৎ নেতাজীর ছুটি চমৎকার জমেছে । রবির চায়ের দোকানে বহুতলের নাগাল এড়িয়ে এক টুকরো রোদ এসে পড়েছে । দোকানে ছুটির সকালে আড্ডা চলছে । রবিবাবু সুকৌশলে দোকানের পেরেকে ঠেকিয়ে দুধের প্যাকেট ফুটো করে চা প্রস্তুতির জোগাড় করছেন । আড্ডাবাজদের পরিচয় দিয়ে রাখা যাক । এরা সবাই ছাত্রছাত্রীরা । দেশিকোত্তম বা দিশী , পঞ্চম বা পচুই , ধণ্বন্তরী বা ধেনো , চলিষ্ণু বা চুল্লু , মেয়েরা যথাক্রমে টমেটো শর্মা সে সদ্য পশ্চিম বঙ্গে পড়তে এসেছে তবে টটামট বাংলা বলতে পারে , চঞ্চরী বা ভোম্রা , আহ্বানীয় বা হাবু , ঋতম্ভরা বা ঋমি । টমেটো হিন্দিভাষী হলে হবে কি বর্তমানে বাংলা নিয়ে পড়ছে । ও দিশী কে বল্লো
“ দিশী তু পুরো ঝুঠে হ্যায় – পুরা চন্দ্ররেণু আছিস – পত্রিকায় বরেণবাবুর লেখাটা পুরা ঝেড়ে দিয়েছিস –” আহ্বানীয়া বা হাবু কাঁকুই দিয়ে নিজের দীর্ঘ চিকুর বাঁধছিলো । তাই দেখে চুল্লু বললো “ এবার আমুও লম্বা লম্বা চুল রাখবো ”
হাবু মুখে চিরুনী পুরে চমৎকার কায়দায় উত্তর দিলো “ রাখ না ! কে বারণ করছে ?রাখে তো অনেকেই……” ।
“ তোরা এতো সময় পাস কোথায় রে ? তেল শ্যাম্পু আঁচড়ানো …” ধেনোর সবিষ্ময় জিজ্ঞাসা ।
এরমধ্যে একজন পক্ককেশ তীক্ষ্ণনাসা চোখে উচ্চ ক্ষমতার উপনেত্র বৃদ্ধা এসে বসেছেন । উপনেত্রের ভেতরে দুটো বড়ো বড়ো চোখ । অতি ফর্সা – ক্ষীণতনু – স্বল্প কেশ – অত্যন্ত ভুলো – অন্যমনস্ক ভীত ধরনের এক ভদ্রমহিলা ।
বাচ্চারা অবাক চোখে তাকালো । ভদ্রমহিলা ভারী অপ্রস্তুত ভাবে ভেবেচিন্তে বললেন
“ আমি শিউলি” আসলে কিন্তু উনি গায়ত্রী … পৃথিবী থেকে চলে যাওয়ার আগে আগে হঠাৎ ওনার মনে হচ্ছে – উনি শরতের শিউলি । উনি আজকাল মাঝেমাঝে সবই ভুলে যান । টমেটো তৎক্ষণাৎ বলে উঠলো
“ যারা খেজুর রস পাড়ে তাদের শিউলি বলে – আমি জানি ”
ভোম্রা লবনাক্ত আম্রবেতস চুষছিলো সে শিউলির নতুন মানেটা শুনে বিষম খেয়ে বিষম কাশতে থাকে ।
ঋমি বলে “ আমি যেভাবে ইচ্ছে সাজবো – সেটা আমার স্বাধীনতা – সেটা নারীমুক্তির প্রথম ধাপ – বুঝলি ? এভাবে সাজবে না .. এটা পরবে না … এটা করবে না .. এসব বিধিনিষেধের দিন শেষ … আমরা এখন স্বাধীনতার দিকে পা বাড়াচ্ছি….. তোদের ওসব বিধিনিষেধ শিকেয় তুলে রাখ .. যতো সব এমসিপি ….”
এমন সময় আরেক জন উলোথুলো পাজামা পাঞ্জাবি পরা টিকালো নাক – পাকা চুলো গায়ে চাদর – বয়স্ক মানুষ হন্তদন্ত এসে হাজির । আমরা এনাকে চিনি সকলের হীরকমামা । প্রায়ই বাচ্চাদের সঙ্গে সময় কাটান । বৃদ্ধাকে দেখে বললেন “ কী মুশকিল দিদি – তুমি কাউকে না বলে কয়ে এসে এই চায়ের দোকানে বসে আছো ? এদিকে সবাই .. বোঝো কান্ড ! …… ও রবিবাবু আমার দিদিটাকে একটা চা দিন …আমাকেও ” শিউলি দেবী ভয়ানক অস্বস্তিতে পড়ে নাক খুঁটতে থাকেন । “ আসলে আমার দিদি মাঝেমাঝে বাড়ি থেকে বেরিয়ে পড়ে আর বাচ্চা ছেলে মেয়েদের দেখলে তাদের কাছে যেতে চায় । হয়তো সবাইকে নাতি নাৎনি মনে করে …”
পচুই এতোক্ষনে মুখ খোলে
“ হুঁঃ তোদের নারীমুক্তি মানে তো ঐ ব্রা পোড়ানো ….. ব্রা না পরে রাস্তায় ঘোরা সিগারেট ফোঁকা আর …. ঐসব …” শিউলিদেবী কিছু একটা বলবেন ভাবছেন … মুখচোরা স্বভাবের জন্য ইতস্ততঃ করছিলেন । ভোম্রা বললো
“ ঠাম্মা তুমি কিছু বলবে ? বলো না ?” বৃদ্ধা বলতে চেষ্টা করেন – থেমে থেমে – তারপর ভাষা হারিয়ে বাচ্চাদের মুখের দিকে তাকিয়ে অন্যমনা হয়ে যান । টমেটো ভাঙা ভাঙা বাংলায় বলে “ না মানে আমাদের জামাকাপড় তো আমরা নিজেদের সুবিধেমতো…. ….. যদি ওগুলো মানে বুবসগুলো খুব বড়ো হলে দৌড়ঝাঁপ করা … অসুবিধে … হবে … ”
মেয়েরা একটু থতমত খেয়ে যায় – ওরা এই যুক্তিটা ঠিক এভাবে ভাবে নি । শিউলিদেবী অন্যদিকে তাকিয়ে নিজের গলায় হাত ঘসতে থাকেন । চশমার ফাঁকে ওনার চোখদুটো কেমন অর্থশূণ্য হয়ে পড়ে । হীরকমামা প্রিন্স হেনরির প্যাকেট থেকে তামাক বার করে সিগারেট রোল করছিলেন । ধরিয়ে নিয়ে বলেন
“ ঊনিশশো আটষ্ট্টি সালে নিউইয়র্কের রাস্তায় নিউইয়র্ক গ্রুপ অফ লিবারেল উইমেন পুরুষ যৌনতার বিরুদ্ধে দৃষ্টি আকর্ষণ করার জন্যে ব্রেসিয়ের পোড়ায় – উদ্দেশটা কিন্তু অন্য ছিলো অথচ পুরুষতান্ত্রিক সংবাদমাধ্যম এটাকে অন্য ভাবে প্রচার করলো ”
বাচ্চারা সমস্বরে বলে উঠলো “ তাহলে ওরা কি উদ্দেশ্য এটা করেছিলো দাদু ?”
হীরকমামা ওনার বুড়ি দিদিকে টেনে রোদ্দুরে বসিয়ে – সিগারেটে একটা টান দেন
“ আসলে প্রথমে আন্দোলনটা হয়েছিল মেয়েদের যৌন স্বাধীনতা – অবাঞ্ছিত গর্ভ নষ্ট করার দাবিতে – সেটা কিন্তু শেতাঙ্গিনীদের আন্দোলন ছিলো … দিদি তুমি তো সকালে উঠে খাওনি কিছু.. একটা বিস্কুট খাও ? ”
বুড়ি অতি বাধ্য বালিকা কন্যার মতো ঘাড় নাড়েন । ঋমি উঠে দুটো বড়ো বড়ো বিস্কুট এনে দ্যায় । উনি বিস্কুটদুটো দুহাতে নিয়ে কি করবেন ভেবে পান না । দিশী এসে একটা বিস্কুট নিয়ে বলে
“ ঠাম্মা হাঁ করো …” বুড়ি লাজুক হেসে বিস্কুটে কামড় দ্যান । সিগারেটে টান দিয়ে আকাশে চোখ তুলে হীরকমামা বলতে থাকেন
“ প্রাচীন যুগে তো লিপস্টিক ছিলো না – তবে অনেক আগে সম্ভবতঃ গ্রীসের সম্রাট আইন করেন যে প্রত্যেক দেহোপজীবিনীকে ঠোঁটে লাল রং লাগাতে হবে নাহলে সোওওজা জেল আরও অবাক কান্ড যে কোনও ঠোঁটে রং করা মহিলা যদি বিয়ে করে তাহলে তাকে ধরা হবে সে ডাইনীবিদ্যার সাহায্যে পুরুষের মন জয় করেছে – ডাইনীবিদ্যা মানে – উইচক্র্যাফ্ট বোঝো তো ?”
বাচ্চাদের চোখ তখন কপাল ছাড়িয়ে আকাশে ওঠার জোগাড় । গায়ত্রীদেবী তখন খুব মন দিয়ে একটা কাক একটা কুকুরের ল্যাজে ঠোক্কর মারার চেষ্টা করছে – সেটা দেখতে ব্যস্ত । হীরকমামা বলতে থাকেন
“ তারপর জাপানের সম্রাট একই রকম আদেশ জারি করেন ”
ভোম্রা ব্যস্ত হয়ে বলে
“ কিন্তু নারীমুক্তি ?” হীরকমামা সিগারেটটা ফেলে কাবুলি জুতোর তলায় পিষে নেভালেন । ভোম্রাকে পাত্তা না দিয়ে বলে যেতে থাকেন
“ তখন মেয়েদের গর্ভপাত করানোর অনুমতি ছিলো না । অর্থাৎ কোনও ধর্ষিতা গর্ভবতী হলেও সে গর্ভপাত করাতে পারবে না – কোনও নারীর কোনও যৌন ইচ্ছে অনিচ্ছা স্বাধীনতা কিচ্ছু নেই । ছিলো না । আজও আছে কিনা জানি না । তোমরা সিমন দ্য ব্যোভেরির নাম শুনেছো ?” হাবু বলে “ মনে হচ্ছে শুনেছি ” হীরকমামা প্রিন্স হেনরি
( আসলে উচ্চারণটা অঁরি )র প্যাকেটে হাত বোলাতে বোলাতে বলেন “ ওনার লেখা বইটার নাম ‘দ্য সেকেন্ড সেক্স’ – একটু বিষয়টা বলি ? মেয়েদের এমন ভাবে মানুষ করা হয় যে তারা ভাবতে শেখে মেয়েদের কাজ শুধুমাত্র স্বামীর উপার্জিত টাকায় জীবনযাপন আর সন্তান পালন করা ”
“ এটা কোন দেশের বই?”
“ ফরাসী”
“ ওদেশেও এই অবস্থা ?” বাচ্চাদের সমবেত বিষ্ময়জ্ঞাপন !
“ হ্যাঁ এদেশেও বলা হয় পুত্রর্থে ক্রিয়তে ভার্যা – ক্রিয়তে মানে করা হয় , অর্থাৎ পুত্র উৎপাদনের জন্যেই বৌ – দ্যাখো এখানেও পুত্র – কন্যার কথা বলা নেই । তারপর শেখানো হয় যে যদি তোমার উপার্জন বা সম্মান পুরুষের থেকে বেশী হয় তাহলে হয় তোমার স্বামী বা প্রভু তোমাকে ছেড়ে চলে যাবে নাহলে তোমার স্বামী জুটবে না । ১৯৪৯ সালে লেখা – ১৯৫৮ সালে বইটার ইংরেজী অনুবাদ হয় তারপর রাস্তায় শুরু হয় নারীবাদী আন্দোলন । প্রথমে কেবলমাত্র মধ্যবিত্ত শেতাঙ্গিনীদের মধ্যেই এই আন্দোলন সীমাবদ্ধ ছিল । এটাকে নারীবাদী আন্দোলনের প্রথম তরঙ্গ বা ফার্স্ট ওয়েভ বলা হয় । এরা নারীর রাজনৈতিক অধিকার রক্ষা এবং অত্যাচারের অবসান দাবী করেন , সংসারের অত্যাচার এবং যৌন হেনস্থার বিরুদ্ধে পথে নামেন ”
পচুই উশখুশ করছিলো । হীরকমামা প্রিন্স হেনরি তামাকের প্যাকেটটা ওর হাতে তুলে দিলেন ।
“ বাব্বা এতো চমকে দেওয়ার মতো বই – আজও তো আমাদের এই শিক্ষা দিয়েই বড়ো করা হয় … ” টমেটোর চোখমুখে বিষ্ময় থৈ থৈ করে । হীরকমামা দ্বিতীয় কাপ চায়ে চুমুক দিয়ে পচুইএর কাছ থেকে তামাকের প্যাকেট নিয়ে বলতে থাকেন “ এর পর দ্বিতীয় তরঙ্গ তৃতীয় তরঙ্গ এক এক করে নারীমুক্তি আন্দোলনের ঢেউ এসে পৃথিবীর বুকে আছড়ে পড়ে । এর পর কালার্ড মানে কালোরাও এই আন্দোলনে সামিল হয় – মূল বক্তব্য কিন্তু সেই নারীর স্বাবলম্বন ব্যাপারটাই থাকে । অর্থাৎ শ্রমের সম অধিকার – সমান মজুরি – যৌন স্বাধীনতা – মানে সমলিঙ্গের প্রেম – ক্রস ড্রেসার – ট্র্যান্স জেন্ডার – ঐ ইয়ে সেক্স ওয়ার্কার – মানে গিগোলোরাও এবং – পুরুষতান্ত্রিক নিয়মকানুন থেকে মুক্তি এবং….” মামু আবার চায়ে চুমুক দিলেন
“ অথচ আজকের অনেক মেয়েই নারী স্বাধীনতা বলতে কেবলমাত্র ধূমপান – ইচ্ছে মতো সাজপোশাক..এটাকেই ধরে নিয়েছে ”
বাচ্চারা শুনতে থাকে । বুড়ি দিদি দূরে কোথাও তাকিয়ে থাকে । ওনার সামনে এসে একটা শালিখ বসে ঘাড় ঘুরিয়ে ওনাকে নিরীক্ষণ করে “ চলো পিড়িং ফুরুৎ করে…..” বলে উড়ে চলে যায় ।
“ আজও মেয়েরা মনে করে পয়সাওয়ালা স্বামী চাই – সুন্দর মুখ চারটে গয়নাই আমার সম্পদ – অথচ ভাবে না আমি স্বাবলম্বী হবো… আবার বিপরীতে নিম্নতম আয়ের পরিবারে মেয়েরা শ্রমের কাজ করে মাটি কাটে – পাথর বয় এবং ক্রীতদাসীর মতো জীবন কাটায় – এটাও না – সমদায়িত্ব সমমর্যাদাই কাম্য ”
হাবু মানে আহ্বানীয়া বলে
“ আমরা নিজেদের সুন্দর দেখাতে চাইবো না ?”
হীরকমামা বলেন “ নিশ্চয়ই – কিন্তু পুরুষের ঠিক করে দেওয়া পথে নয় – ঠোঁটে রং মেখে – শুধু সাজপোশাক দিয়ে নয় । শিক্ষায় সুন্দর হও – শরীরের চর্চা করে শরীরে সুন্দর হও – সাহসী হও – তোমাদের মধ্যেও তো কেউ কেউ বেশ মোটা কিন্তু পরেছো ভীষণ দামী কোম্পানির জামাকাপড় – এটাই বুঝি স্বাধীনতা ? ব্যায়াম করে সুন্দর হও – সৌন্দর্য স্বাস্থ্যেই থাকে ” হীরকমামা কাপ নামিয়ে রেখে ওনার দিদির মাথায় হাত রাখেন
“ দিদি তুমি কি ইস্কুলে পড়েছো ? ”
শূণ্য দৃষ্টিতে তাকিয়ে বৃদ্ধা মাথা নাড়েন – না ।
“ দিদি তুমি কলেজে পড়েছো ?” দিদি ওপর নিচে মাথা নাড়েন । “ কি পড়েছো ডাক্তারি ?” বৃদ্ধা শূণ্য দৃষ্টিতে তাকিয়ে বলেন “ হ্যাঁ ”
“ দিদি প্রাইভেটে ম্যাট্রিক দিয়ে ডাক্তারি পড়েছে – আমাদের সব ভাইবোনের রান্না করে কলেজে যেতো … জামাইবাবুকে যখন ভালবেসে বিয়ে করে তখন জামাইবাবু ভাইবোনের দায়িত্ব পালনের জন্য পড়াশোনা ছেড়ে সিনেমা হলের ম্যানেজারি – পাহাড়ে পাহাড়ে ওভারসিয়ারি এইসব করছে … আমার দিদি গয়না পরেনি .. সাজেনি … মাথা উঁচু করে চলেছে । আমার কাছে নারী স্বাধীনতা মানে আমার দিদি ..”
হীরকমামা তাঁর বৃদ্ধা স্মৃতিহীনা দিদিকে ধরে ধরে নিজের বাড়ির দিকে হাঁটতে থাকেন । বৃদ্ধার পায়ে পায়ে নেড়ি কুকুরগুলো চলতে থাকে ।