আকাশে পাখিদের উড়তে দেখেছেন? কী ভাবছেন ? আপনাদের সঙ্গে মশকরা করছি ? না, না। তেমন কিছু নয়। পাখিদের উড়ান নিয়ে যদি খুব সহজ কয়েকটি প্রশ্ন করি তাহলে আমাদের অনেকেরই কিন্তু ঘুম ছুটবে। এইটুকু পড়ার পর যদি পাখিদের ওড়ার কায়দাটা পরখ করতে একটু ফাঁকা জায়গায় গিয়ে দাঁড়ান তাহলে দেখবেন , যে ঢঙে চড়াই উড়ছে তার থেকে শালিখ পাখিদের ওড়ার ভঙ্গিমা বিলকুল আলাদা। পায়রা মাটি থেকে যে উচ্চতায় ওড়ে টুনটুনি পাখির কখনোই সেই উচ্চতায় ওড়ার প্রয়োজনই হয়না। উড়ান ভঙ্গিমার এমন ফারাক ঘটার পেছনে একাধিক শারীরবৃত্তীয় এবং আহার্য সম্পর্কীয় বিষয় যুক্ত আছে। তবে মাটির ওপরে যে উচ্চতাতেই তারা ডানা ঝাপটে খ-পথে বিচরণে অভ্যস্ত হোক না কেন, ওড়াউড়ির পথ আগলে দাঁড়িয়ে থাকা যে কোনো রকম বাধা, তা সে নিছক প্রাকৃতিক হোক অথবা মানুষের তৈরি, তাদের আপন আনন্দে উড়ে চলার ছন্দকে বিলকুল ব্যাহত করে। অথচ মানুষ নিরন্তর পাখিদের ওড়ার পথে আকাশছোঁয়া হর্ম্যমালা নির্মাণ করে চলেছে তাঁদের কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠা করতে। এমন বাড়ির সারি পাখিদের ওড়ার স্বাধীনতা কেড়ে নেবারই সামিল, বিশেষ করে ছোটখাটো চেহারার পাখিরাতো বটেই বছরের বিশেষ সময়ে ডানা মেলে দূরদূরান্তের পথে পাড়ি দেওয়া পরিযায়ী পাখিরাও পড়তে চলেছে মহা সমস্যায়।খুব সম্প্রতি সৌদি আরবের শাহী সরকারের তরফে দেশের বিস্তৃত মরুভূমির বুকে নিওমের ১০৫ মাইল দীর্ঘ এলাকা জুড়ে গগনচুম্বী অট্টালিকা সারি গড়ে তোলার কথা ঢাকঢোল পিটিয়ে ঘোষণা করছে।
বলাবাহুল্য এই রাজকীয় প্রকল্প রূপায়ণের পেছনে প্রধানত যে ভাবনা কাজ করেছে,তাহলো ২০২৯ সালে অনুষ্ঠিতব্য এক আন্তর্জাতিক ক্রীড়া প্রতিযোগিতাকে মাথায় রেখে নয়া বসতি স্থাপনের ইচ্ছে। আগাগোড়া বহুমূল্য বিশেষ ধরনের কাঁচ দিয়ে তৈরি করা হবে প্রাচীরের মতো খাড়া, আকাশের দিকে মাথা তুলে দাঁড়িয়ে থাকা এইসব বাড়িগুলো। সরকারিভাবে এই প্রকল্পের নাম দেওয়া হয়েছে The Line. প্রকল্পের সাথে বিশ্ববাসীর পরিচয় করিয়ে দিতে গিয়ে বলা হয়েছে – ‘দ্যা লাইন হলো ভবিষ্যতের দিকে তাকিয়ে গড়ে তোলা এক আশ্চর্য আশাবাদী নগরায়ন প্রকল্প। এই প্রকল্পের কাজ শেষ হলে তা হবে পৃথিবীর বিস্ময়। মরুভূমির বাস্তু পরিবেশকে অস্বীকার বা উপেক্ষা করে নয়, এই প্রকল্প স্থাপত্যবিদ্যার নবতম উদ্ভাবন এবং বাস্তু পরিবেশকে সংরক্ষণ করেই রূপায়িত হবে।’ কিন্তু এই আপ্তবাক্যে মোটেই সন্তুষ্ট নন পরিবেশবিদ থেকে শুরু করে আম জনতার একাংশ। দুপক্ষের আলোচনা চলুক প্রকল্পের ভালোমন্দ,উচিৎ অনুচিতের দ্বন্দ্ব নিয়ে, আমরা বরং সেই অবসরে দ্যা লাইন প্রকল্পের কথা আর একটু বিশদে জেনে নিই।সময়ের চাহিদার সঙ্গে তাল মিলিয়ে আগামীর কথা মাথায় রেখেই লোহিত সাগর বা রেড সি’র একেবারে উত্তর প্রান্তে অবস্থিত তাবুক প্রদেশের নাইওম বা নিওম অঞ্চলে গড়ে তোলা হবে এই স্বপ্ন নগরী। আজ থেকে ৮ বছর আগে ২০১৭ সালে যুবরাজ মহম্মদ বিন সালমান এই প্রকল্পের সূচনা করেন। রুক্ষ, পাথুরে মরুভূমির ২৬৫০০ বর্গ কিলোমিটার এলাকা জুড়ে শুরু হয় এক আশ্চর্য মায়ানগরীর নির্মাণ পর্ব। চমকে দেয়ার মতো নির্মাণ হবে নিওমে– থাকবে এক ভাসমান শিল্প কমপ্লেক্স,বিশ্ব বাণিজ্য হাব, বিশ্বের নানান প্রান্ত থেকে ধেয়ে আসা পর্যটকদের থাকার জন্য বিলাসবহুল সব রিসর্ট ও হোটেল এবং সম্পূর্ণভাবে নবীকরণ যোগ্য শক্তিকে কাজে লাগিয়ে নির্মিত হবে একটি রৈখিক নগরী বা Linear City। সৌদি আরবের শাহী সরকারের দাবি এই মায়া বসতিতে ৪৬০,০০০, জনের কর্মসংস্থানের সুযোগ সৃষ্টি হবে । সাথে সাথে দেশের GDP বাড়বে $ ৪৮ বিলিয়ন ডলার। সব দেশেই কোনো প্রকল্প রূপায়ণের আগে এমন সব স্বপ্নকল্প সুখের কথা সরবে ঘোষণা করা হয়, অনেক অনেক পরিবর্তনের আভাস দেওয়া হয়। সৌদি আরবের শাহী সরকারের তরফ থেকেও এমন কথাই বারংবার প্রচার করা হচ্ছে বিগত কয়েক বছর ধরে। বলা হয়েছে – “এইটি হলো পরিবর্তনশীল ভাবী পৃথিবীর ভাবনাকে সামনে রেখে, সময়ের থেকে বেশ কয়েক কদম এগিয়ে যাবার ও দেশকে বাকি দুনিয়ার তুলনায় এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার লক্ষ্যে এক আশাবাদী প্রকল্প।”
মরুভূমির বুকে সবুজের সমারোহে ভরা ১০৫ মাইল দীর্ঘ এক রৈখিক ভূখণ্ড জুড়ে গড়ে তোলা হবে ১৬৪০ ফিট উচাই বিশিষ্ট সব কাঁচ দিয়ে মোড়া আশ্চর্য সব শিসমহল যেখানে মাথা গোঁজার ঠাঁই পাবে ৯ মিলিয়ন মানুষ। নিওম হবে এক গ্লোবাল রেসিডেন্স্ বা বিশ্ব বসতি। আরাম, বিলাস, স্বস্তি, নিরাপত্তা, পরিবেশানুগ শান্তির জীবন সবকিছু খুঁজে পাবেন আবাসিকরা। আর কি চাই!
প্রশ্ন উঠেছে এই প্রকল্প রূপায়ণের নানান বিষয় নিয়ে। মরুভূমির বুকে শহর বানাতে গিয়ে সবুজকে ধ্বংস করে ফেলার কোনো অভিযোগ এক্ষেত্রে যে নেই তা বলা বাহুল্য। তাহলে? সমস্যা কোথায়? নিওম’কে ঘিরে এক মায়ানগরী গড়তে গিয়ে ইতিমধ্যেই প্রায় ২০০০০ মানুষকে তাঁদের বাপ পিতামহের ভিটে ছাড়া করা হয়েছে রীতিমতো গায়ের জোরে। এই মানুষেরা হলেন যাযাবর হাউইটাট গোষ্ঠীর মানুষজন।এই গোষ্ঠীর নেতা আব্দুল রহিম আল- হুয়াইতি তাঁদের মরুভূমির বাসভূমি থেকে বলপূর্বক উৎখাত করার বিরুদ্ধে প্রতিবাদে সরব হয়েছেন। শাহী প্রশাসনের পক্ষ থেকে তাঁকে নিবৃত্ত করার নানান চেষ্টা চলছে। আব্দুলের বক্তব্য খণ্ডনের জন্য সরকারের তরফ থেকে নিয়োগ করা হয়েছে আমেরিকার জন সম্পর্ক স্থাপন বিশেষজ্ঞ প্রতিষ্ঠান Ruder Finn কে। দুইপক্ষের লড়াইয়ের দিকে তাকিয়ে রয়েছে সকলে। থমকে গেছে স্বপ্ন বসতি স্থাপনের কাজ।
সাম্প্রতিক সময়ে পরিবেশবাদী সংগঠনের তরফ থেকে তোলা হয়েছে গুরুতর এক অভিযোগ। তাঁদের মতে এই নয়া বসতি স্থাপন করা হচ্ছে পরিযায়ী পাখিদের পরিযান পথকে আড়াল করে। পাখিদের উড়ান পথ বরাবর এমন দীর্ঘ নগরায়ন প্রকল্প রূপায়ণের ফলে মুক্ত আকাশে পাখিদের অবাধ উড়ানের স্বাধীনতা খর্ব করা হবে। সাধারণত পাখিরা উড়তে উড়তে বহু পথ পাড়ি দেয় তাদের উড়ান পথের ভূগোলকে মাথায় রেখে। যে পথে তারা আবহমান কাল ধরে এক দেশ থেকে ভিন্ দেশে পাড়ি জমায় সেই পথের মাঝে এমন পরিবর্তন পাখিদের কেবল বিভ্রান্ত করবে না, তাদের অস্তিত্বকেই বিপন্ন করবে। প্রাকৃতিক উপাদানগুলো এক আশ্চর্য সংবেদনশীল বন্ধনে নিবিড়ভাবে বাঁধা থাকে। সেই বাঁধন আলগা হলে বা ছিঁড়ে গেলে তাকে আবার আগের অবস্থায় ফিরিয়ে আনা মোটেই সহজ নয়। শহর গড়তে গিয়ে এমন বিপর্যয় ডেকে আনা বাঞ্ছনীয় নয় বিশেষ করে এমন এক প্রেক্ষাপটে যখন জীববৈচিত্রের সংকটের তীব্রতা বেড়ে চলেছে অবিশ্বাস্য গতিতে। মরুভূমির বুকে কংক্রিটের জঙ্গল না পাখিদের অবাধে উড়ানের স্বাধীনতা? আমরা সবাই সেই সিদ্ধান্তের অপেক্ষায় রইলাম। ওদের উড়তে দাও অবাধে, আনন্দে আত্মহারা হয়ে…..।
ঋণ স্বীকার
নিওম প্রকল্প সংক্রান্ত বিভিন্ন রিপোর্ট।
মে ০৩,২০২৫.
জলের সংস্থান হচ্ছে কিভাবে?
কিছুই থেমে থাকবেনা স্যার! আমরা চক্রব্যুহে ,বেরোনার পথ নেই।
এই মুহূর্তে সবচেয়ে আলোচিত নির্মাণ প্রকল্প। পেট্রো ডলারের দৌলতে সব পরিস্থিতিকে নিজেদের মতো করে নেবার চেষ্টা। চক্রব্যুহই বটে। বাঁচার চেষ্টা, বাঁচানোর চেষ্টা করে যেতে হবে তবুও।
জীব বৈচিত্র্য ও প্রকৃতি আজ সর্বক্ষেত্রে কঠিন সংকটের সন্মুখীন। আজ মানুষের অনন্ত আকাংখার সকল পরীক্ষা র ক্ষেত্র রূপে প্রকৃতির উপর ক্রমাগত আঘাত আসছে। হয়তো বা নিজেদের অস্তিত্ব টিকিয়ে রাখতে এই জীব জগত ও বিকল্প কিছু উপায় খুঁজে নেবে নয়তো বা বিলুপ্ত হবে। আমরা ও চাই অন্ততঃ খোলা আকাশে পাখিরা অবাধে বিচরণের রাস্তাটা খুঁজে নেবে
মতামতের জন্য ধন্যবাদ। আসলে এই লেখাগুলোর মধ্য দিয়ে পারস্পরিক সংলাপের একটা মুক্ত পরিসর তৈরি করতে চাই। একটা খোলামেলা বাতাবরণ তৈরি না হলে এই সমস্যার মোকাবিলা করা কঠিন। আমাদের মতো নগণ্য মানুষের পক্ষে কিছুই পরিবর্তন করা সম্ভব হবে না। কেবল আওয়াজ তুলে যেতে হবে। সমীক্ষায় দেখা গেছে যে পৃথিবীতে পাখিদের সংখ্যা কমছে।