এ বছরের সেপ্টেম্বর মাস থেকে ভিলাইতে শুরু হয়েছে শ্রমিক আন্দোলন। দালাল ইউনিয়নের ওপর ভরসা রাখতে পারেনি শ্রমিকরা। কেবল দুর্গ জেলার ভিলাই নয় আরও বিস্তৃত অঞ্চল জুড়ে ছড়িয়ে পড়েছে এই আন্দোলন। রাজনন্দগাঁও জেলার রিওয়াগহন, টেড়েসরা, দুর্গ জেলার দুর্গ, ভিলাই, কুমহারী, রায়পুর জেলার উরলা, মহাসমুন্দ, বালোদাবাজার, সর্বত্র কারখানাগুলোয় শ্রমিকরা নতুন সংগঠন গড়ে তুলেছে। কত কত নতুন সংগঠন। প্রগতিশীল ইঞ্জিনীয়ারিং শ্রমিক সংঘ, প্রগতিশীল সিমেন্ট শ্রমিক সংঘ, ছত্তিশগড় কেমিক্যাল মিলস মজদুর সংঘ। লোহার কারখানা ছাপিয়ে আন্দোলন ছড়িয়ে পড়ছে অন্যান্য শিল্পের সঙ্গে যুক্ত কারখানাতেও। শুধু ভিলাইতেই বত্রিশটা কারখানায় সংগঠন তৈরি হয়েছে। এই পরিস্থিতিতে শংকরের নাওয়া খাওয়ার সময় নেই বললেই চলে। ভিন্ন ভিন্ন কারখানায় গড়ে উঠলেও শ্রমিকদের দাবী দাওয়া একই। যে নয় দফা দাবী ওঠানো হয়েছে তার মধ্যে প্রধান হল স্থায়ী কারখানায় স্থায়ী চাকরী। এই সব কারখানায় নব্বই শতাংশ শ্রমিকই অস্থায়ী শ্রমিক। তাছাড়া আছে বেতন বৃদ্ধির দাবী। তারা যা বেতন পায় তা দিয়ে মূল্যবৃদ্ধির বাজারে দিন গুজরান প্রায় অসম্ভব। যে সব শ্রমিক সংগঠনে যুক্ত হয়েছে তাদের কাজ থেকে বের করে দেওয়ার প্রতিবাদ এবং সেই সব শ্রমিককে পুনর্বহাল করার দাবীও জানানো হয়েছে। এই দাবীগুলো আপাতদৃষ্টিতে নিরীহ মনে হলেও শাসক দলের কাছে এ দাবী মেনে নেওয়া মানে যেন আগুনে নিজের হাত নিজেই আগুনে পুড়িয়ে ফেলা।
খনিজ সম্পদের আকর এই ছত্তিশগড়। তার ওপর এখানকার সরল আদিবাসীদের সস্তায় শ্রমিক হিসাবে খাটিয়ে নেওয়ার সুযোগ থাকায় দেশি বিদেশী শিল্পপতিদের চারণ ভূমি হয়ে উঠেছে এই অঞ্চল। এই অবস্থায় যদি শ্রমিকদের এইসব দাবীদাওয়া মেনে নিতে হয় তাহলে এই সস্তা শ্রমের মুনাফা লোটা সম্ভব হবে না। শিল্পপতিরাও উৎসাহ হারাবে। এই সর্বনাশ কি হতে দেওয়া যায়? এই সব কিছুর মূলে ওই লোকটা। কারখানার মালিকরা জেরবার হচ্ছে শ্রমিকদের ধর্মঘটের কারণে। কাজেই তারাও সংগঠিত হচ্ছে। কোনও কারখানা বন্ধ হলে তার অর্ডার অন্য কারখানায় তৈরি হচ্ছে। পুলিশ, প্রশাসন, সব রাজনৈতিক নেতারাই মালিকদের সমর্থনে এগিয়ে এসেছে। এই অবস্থায় এই আন্দোলনকে স্লথ করতে হলে ওই লোকটাকে জেলে ভরা দরকার। শংকরকে আবার জেলে যেতে হলে।
শুভ-র কাজ এখন অনেকটাই লেখাপত্র সম্বন্ধীয়। তার সাথে ডাক্তারি তো আছেই। ১৯৯০ সালে ভিলাইয়ের শ্রমিকদের সংগ্রাম শুরু হওয়ার সাথে সাথে, বিভিন্ন পত্রিকা থেকে সেই সংগ্রামের উপর লেখার অনুরোধ আসতে শুরু করে। আলাদা আলাদা পত্রিকার জন্য লেখা অসম্ভব। তাই শুভ ইংরেজিতে প্রতিবেদন তৈরি করার কথা ভাবতে শুরু করল। প্রথম ইস্যু বের হল। ‘ছত্তিশগড়: শান্তিপূর্ণ শ্রমিকদের সংগ্রামের ওপর রাষ্ট্রীয় সন্ত্রাস’। বাড়িতে তৈরি সাইক্লোস্টাইলে মুদ্রিত এই বুলেটিন বার করা যথেষ্ট শ্রমসাধ্য এবং সময়সাপেক্ষ প্রক্রিয়া। দ্বিতীয় প্রতিবেদনটি বের হল। তৃতীয় প্রতিবেদনের মাধ্যমে, বুলেটিনটির নামকরণ করা হয়েছিল ‘ভিলাই থেকে আপডেট’ (Update from Bhilai)। শুভ পরে এই বুলেটিনের নাম দিল ‘ছত্তিশগড় থেকে আপডেট’ (Update from Chhattishgarh)।
নিয়োগী প্রায়ই বলেন যে ইতিহাসের দুটি প্রধান ইঞ্জিন হল শ্রেণী সংগ্রাম আর জাতীয় মুক্তি আন্দোলন। এই দু’য়ের সমন্বয় পরিবর্তনের ক্ষেত্রে একটা গতি সঞ্চারিত করতে পারে। শংকর দেখেছেন এক নয়া ছত্তিশগড়ের স্বপ্ন,“যেখানে সবাই পানীয় জল পাবে/ যেখানে প্রতিটি ক্ষেত সেচ পাবে/ যেখানে প্রতিটি হাত কাজ পাবে/ যেখানে কৃষক তার ফসলের উপযুক্ত দাম পাবে/ যেখানে প্রতিটি গ্রামে একটি হাসপাতাল থাকবে/ যেখানে প্রতিটি শিশুর লেখাপড়ার জন্য একটি স্কুল থাকবে/ যেখানে প্রত্যেকে জমি এবং একটি বাড়ি পাবে/ যেখানে দারিদ্র্য, শোষণ ও পুঁজিবাদ থাকবে না.”
এমন ছত্তিশগড় কবে হবে? ভাবতে ভাবতে ক্লান্ত শরীর ঘুমে ঢলে পড়ল লোকটা, জেলের মধ্যে।