‘পাগল’ কথাটা সাধারণত আমি সচেতন ভাবে এড়িয়ে যাই। কারণ একটা অশ্রদ্ধা এর মধ্যে লুকিয়ে আছে। কিন্তু যাদের যে কথাগুলো বলতে চাইছি তাদের কথাগুলো মানুষের কাছে ‘প্রলাপ’ বলেই পরিচিত। সেরকম কয়েক টুকরো প্রলাপ শোনাই।
★
গ্রামের চেম্বারে বসে আছি। বাইরে হইচইটা হঠাৎ একটু বেড়ে গেল। তারপর যেন মহিলা কন্ঠে একটা কান্নার আওয়াজও পেলাম। যাই হোক এগুলোকে পাত্তা দিই না। সাইকিয়াট্রিস্টরা অনেকটা সাধু সন্ন্যাসীর মত, শোক তাপের ঊর্ধ্বে উঠে যায়।
কিছুক্ষণ বাদে এক রোগী জরিনা বিবি এলেন। আটপৌরে পোষাকে সাধারণ ঘরের মহিলা। ডিপ্রেশনের রুগী। কথায় কথায় জিজ্ঞাসা করলাম বাইরে হইচই হচ্ছিল কেন। বললেন একটা মেয়ে খাবার চাইছিল, ক্ষিধে পেয়েছে বলে। সবাইকে বিরক্ত করছিল। তাই একটু পাউরুটি মিষ্টি খাওয়ালাম।
তারপর একটু চুপ করে থেকে বললেন “নিজের কষ্ট সহ্য করা যায়, অপরের কষ্ট কি সহ্য করা যায় ডাক্তারবাবু?”
★ ★ ★
স্ত্রী স্বামীকে নিয়ে চেম্বারে ঢুকলেন। স্ত্রীই বললেন ওনার স্বামীর কি কি সমস্যা হচ্ছে। অবসাদ, হতাশা, আত্মহত্যার চিন্তা ইত্যাদি। এবার আমি অমল বাবুকে জিজ্ঞাসা করলাম কি সমস্যা। উনি বললেন ডায়াবেটিস, হাই প্রেশার, কিডনির সমস্যা, চোখের সমস্যা ইত্যাদি। আর এর পরেও কি মন ভালো রাখা সম্ভব।
তারপর নিজের শরীরটার দিকে হাত দেখিয়ে বললেন, ” কি জানেন তো ডাক্তারবাবু। এই শরীরটা একটা জামার মত। একটু ছিঁড়ে যাচ্ছে আর আমি তালি দিচ্ছি। তালি দিতে দিতে একসময় দেখলাম জামাটাই আর নেই শুধু তালিগুলোই দেখা যাচ্ছে।”
★ ★ ★
জাহির। আমার চিকিৎসক জীবনের একেবারে প্রথম দিককার রুগী। অদ্ভুত একটা টেনে টেনে কথা বলে সাথে চোখের মুদ্রা। স্কিজোফ্রেনিক। স্ত্রীকে সন্দেহ করায় সে একটা সময় বিরক্ত হয়ে বাচ্চাকে নিয়ে বাপের বাড়ি চলে গেছে। জাকির মাঝে মাঝেই তাকে ফিরিয়ে আনতে যায়। ব্যর্থ হয়ে ফিরে আসে। সন্দেহ আরো দানা বাঁধে।
ওষুধ ঠিকঠাক খায়না। তবে যে কোনো কারনেই হোক এখনো মাঝে মাঝে আমাকে দর্শন দিয়ে যায়। সেদিনও এসেছে। সেই টেনে টেনে কথা। ভালো আছে, শুধু মাথার ভারী ভাবটা কমিয়ে দিতে হবে।
ওষুধ বুঝে উঠে পড়ে দরজা অর্ধেক খুলে আবার ঘুরে দাঁড়াল, “চললাম ডাক্তারবাবু। দেখা হবে জান্নাতে।” তারপর একটা ছোট্ট বিরতি দিয়ে যোগ করল ” ভালো লোকরা জান্নাতেই যায়।”
অসাধারণ,,,, সমাজের কাছে যেটা প্রলাপ,,, সেটাই হয়তো তাদের জগৎ।।।