আজ উদয়দার মারফত খবর পেলাম, Soi দি ব্যাকুল হয়ে খোঁজ করছে আমার। ফেসবুক খুলিনি দীর্ঘদিন। আজ হঠাৎ সই’দি-কে উত্তর দেব বলে এ পাড়াতে এসে দেখি, সইদিদির মতোই আরো বেশ কিছু প্রিয়জন উদ্বিগ্ন।
এবং এইবার, আমার লজ্জা লাগছে বহুত। কান ঝোলানো বিড়ালের মতো লটপটে লজ্জা। কিংবা পায়ের ফাঁকে ল্যাজ সিঁধিয়ে রাখা কুতুয়া মাফিক কুঁই কুঁই। ইস!ইস! ইস! কি বিচ্ছিরি ব্যাপারটাই না হলো! এইসব মুহূর্তে আমার আহ্লাদের সাথে সাথে ইদানিং মরমে মরে যেতে ইচ্ছে হয় বারেবার। এই যে এই অসম্ভব ভালোবাসা, কিংবা এই যে আশ্চর্য স্নেহ, আদর, অথবা গলা জড়িয়ে ধরা ইয়ারি-খিস্তি, এগুলোর কোনটারই কি যোগ্য আমি সত্যি সত্যিই? আমার যে কেবলই মনে হয়, এ বড় অপাত্রে দান! মনে হয়, এ বুঝি মুকুলের মতো পূর্বজন্মের সোনার কেল্লার অবশিষ্ট গুপ্তধন। ফেলুদা, তোপসে, জটায়ু, ডঃ হাজরা সব্বাই হাত ধরে আছে স্রেফ ওই পূর্বজন্মের পুণ্যিটুকুর কারণে।
আসলে, আমি চিরকেলে পালিয়ে যাওয়া একটা মানুষ। বারেবার এবং বরাবর আমি খেলার মাঝে পালিয়ে এসেছি দান অসমাপ্ত রেখে, তুমুল আড্ডা থেকে থুতনি বুকে ঠেকিয়ে সন্তর্পণে সরে পড়েছি গুটিগুটি। আমার এই আপনি-নিরুদ্দেশের রোগটি চিরন্তন এবং চিরকালীন। এ বরং আমারই থাক। আমার নিজস্ব নিশ্চিন্দিপুর।
যাক গে যাক। এসব ন্যাকাচন্ডী কথাবার্তা শুনতে আপনাদের গা রিরি করছে নিশ্চয়ই। আমারও, মাক্কালি বলছি, সোচ্চারে এসব বলতেও পিত্তি জ্বলে যাচ্ছে বহুত। সুতরাং মোটের ওপর এককথায় ধরে নিন, আমি পালিয়েছি। এবং আমি পালিয়েছি, কারন আমার মাথায় ব্যামো আছে। আর তাই, সেইসব বাদ দিয়ে এইবার কাজের কথা শুনুন বরং।
“কোভিড নাইন্টিন সে আজ পুরা দেশ লড় রাহা হ্যায়”, এ কথা তো বোধকরি জানেনই। সঙ্গে, একথাও মনে রাখবেন, অধিকারের দাবিতে দীর্ঘদিন বাদে সোচ্চার হয়েছে কৃষক। মনে রাখবেন, একের পর এক চাকরি পরীক্ষা এবং নিয়োগে ঘোষিত হচ্ছে স্থগিতাদেশ। মনে রাখবেন, ফিক্সড ডিপোজিটে সুদের হার তলানিতে। মনে রাখবেন, যাঁরা বসে বসে মাইনে পাচ্ছে বলে আপনাদের গাত্রদাহ, সেই সরকারি শিক্ষকদের হাত দিয়েই লক্ষ লক্ষ শিশু প্রতিনিয়ত খাদ্য, বস্ত্র কিংবা মাস্ক, স্যানিটাইজার পাচ্ছে। এবং মনে রাখবেন আরো একখানি কথা। B.Ed. ট্রেনিংয়ে শেখানো হয়, কীভাবে দুষ্টু ছাত্রদের দুষ্টুমি করা থেকে বিরত করতে তাদের মনোযোগকে অন্যত্র ‘চ্যানেলাইজড’ করা উচিত। সোশ্যাল মিডিয়া কিন্তু এক্কেবারে সেই চ্যানেলাইজড উষ্মা প্রশমনের খুড়োর কল। দেশের অবস্থা দেখে উদমা রাগ হলো, ফেসবুকে লিখে দিলাম। লিখলাম বিপ্লবাত্মক কবিতা, সাঁটালাম আগুনখোর গদ্য। লিখেই লাইক লাভ গুনতে বসলাম। খানিক তক্কো করলাম। আর শেষমেশ তিন বান্ধবীর ছবিতে ছুঙ্কুমুঙ্কু কথা লিখে ঘুমোতে গেলাম। আঃ, তৃপ্তি। অনেক বিপ্লব হয়েছে।
এই তৃপ্তি থেকে বেরিয়ে আসুন।
আমি ফেসবুকে শেষবার যখন এসেছিলাম, তখন এক সুহৃদ বলেছিলেন, “তোমার লেখায় আজকাল বড় হতাশা। তুমি ভাই ফ্রাস্ট্রেটেড হয়ে গেছ।” সত্যিই তাই। আমার মাইরি কোনো দায় নেই মজারু কথা লিখে আপনাকে এন্টারটেইন করার। আমি সজারুর মতোই সূঁচ ফুটিয়ে জাগিয়ে রাখতে পছন্দ করি। এবং হতাশা যদি আপনাকেও সত্যিই ছুঁয়ে না থাকে, তাহলে আপনি একটি জড়বস্তু। অথবা গাধা।
যাক সে কথাও। কোভিড শুরু হওয়ার পর মাস্ক পরার অভ্যেস সামান্য হলেও বেড়েছে। রাস্তায় থুতু ফেলা সামান্য হলেও কমেছে। হাঁচি বা কাশির সময় কনুইয়ের উল্টো পাশ দিয়ে নাক মুখ ঢাকার প্রবণতাও একটু হলেও বেড়েছে। এবং তার চাইতেও আশ্চর্য হলো, বিভিন্ন সংবাদপত্রে নাকি লিখেছে যে, এইসব কারণে টিবি রোগের প্রকোপ কমে গিয়েছে। দ্ব্যর্থহীন ভাষায় বলে রাখি, সংবাদপত্রের এই তথ্যটি একটু বেশিই ‘অপটিমিস্টিক’। এই মাস দুয়েকের মাস্ক ব্যবহারে টিবি কমে যায় না। সংবাদপত্র বা প্রতিবেদক সম্ভবত মাটির কাছাকাছি থাকেন না। থাকলে বুঝতেন, বাস্তব পরিস্থিতি ঠিক এর উল্টো। এবং বেশ কিছুটা ভয়েরও।
কোভিড যেদিন থেকে দেশে এসেছে, সেদিন থেকে কাশি বা ঘুষঘুষে জ্বরের উপসর্গ নিয়ে মানুষ হাসপাতালে আসা কমিয়ে দিয়েছে আচমকা।
কারণ? কারণ খুব সোজা। যদি বাইচান্স পরীক্ষাতে কোভিড ধরা পড়ে, তবে ঘেঁটি ধরে একঘরে করে দেওয়া হবে তৎক্ষণাৎ। উদয় হবে –বাড়ির সামনে বাঁশের ব্যারিকেড, আঙুল তুলে পাড়াপড়শী অসহযোগ। উল্টোদিকের বাড়ির পুরুষ/ মহিলা ফেসবুকে পোস্ট দেবেন , “আমাদের পাড়াতেও একটা করোনা ঢুকলো। আমি তো শেষ। দোয়া করবেন ফ্র্যান্ডস।” সঙ্গে একটা করুণ ইমোজি।
এসব ঝকমারিতে যায় কে? কোভিডে মৃত্যুর হারও তো খুবই কম। সুতরাং, চেপে যাও চুপচাপ।
এবং এখানেই মুশকিল। এই একই উপসর্গ, টিবিতেও হয়। ফলত, অনেক টিবি রোগীকে ধরা যাচ্ছে না রোগের সূচনালগ্নেই।
দ্বিতীয় একটা কারণও আছে আলবাত। দীর্ঘদিন লকডাউন চলেছে। সরকারি হাসপাতালে রোগীরা আসে দূর দূরান্ত থেকে। ঠেলা চেপে, নদী পেরিয়ে, বাসে ঝুলে, গাড়ি ভাড়া করে। সেসবও ব্যাহত ছিল বেশ খানিকটা।
দুয়ে মিলে, ফল হলো কী? রোগী এলো কম। আর তাই, রোগ ধরা পড়লো কম। আর আপনি আহ্লাদে উত্তেজিত হলেন এই ভেবে যে, টিবি কমে গেছে।
আজ্ঞে না স্যার। নো ম্যাডাম। প্রতিটি ফুসফুসের টিবি রোগী, তার চিকিৎসা শুরু না হওয়া পর্যন্ত বছরে দশ থেকে পনেরো জনকে সংক্রামিত করে চলে। সেই দশ পনেরো জন থেকে, আরো দশ পনেরো ইন্টু দশ পনেরো জন।অর্থাৎ, ওই যে রোগীরা হাসপাতালে এলো না, ভয়ে কিংবা অসুবিধায়, তারা কিন্তু ছড়িয়েই চলেছে, ছড়িয়েই চলেছে রোগ। নিঃশব্দে। এর সঠিক পরিসংখ্যান পাবেন বছর পাঁচেকের মধ্যেই। কারণ, টিবি খুব ধীরে ধীরে শরীরকে আক্রমণ করে। যুদ্ধ জিতে গিয়েছেন বলে মাসল ফোলাচ্ছেন যখন, তখন আদতে আপনার পাছার কাপড় চুপিচুপি খেয়ে নিচ্ছে টিবির ব্যাকটেরিয়া। পুরো নগ্ন করতে সময় লাগবে খানিক।
আমি দীর্ঘদিন ধরেই এসব লিখে এসেছি। আবারও বলছি। যদি ভেবে থাকেন আপনি বড়লোক, আপনার গাড়ি আছে, আপনি হাবিব-এ চুল কাটান এবং আপনি অবসরে পদ্য লেখেন বলে আপনার টিবি হবে না, তাহলে আপনি মূর্খের স্বর্গে বাস করছেন। প্রতি কুড়ি সেকেন্ডে একজন করে লোক টিবি রোগে মারা যায় এই দুনিয়ায় বছরের পর বছর ধরে। এরা সবাই ভিখারি ভ্যাগবন্ড নয়। আর হ্যাঁ, ইন্টারনেট সার্চ মেরে দেখুন। টিবি, একাই, বছরের পর বছর ধরে, করোনার চাইতেও ঢের বেশি হত্যা করে চলেছে। উদ্ধত, প্রত্যয়ী হত্যা।
ছোট্ট একটা তথ্য দিই। গত পাঁচমাসে, আবারো বলি, স্রেফ গত পাঁচমাসে এগারো জন ফেসবুকের বন্ধু-মানুষ ইনবক্সে আমায় টিবি রোগ হয়েছে বলে জানিয়েছেন। মাথায় রাখবেন, এরা সক্কলে উচ্চ মধ্যবিত্ত। মাথায় রাখবেন এগারো জনের বাইরেও শয়ে শয়ে টিবি রোগীর চিকিৎসা করেছি আউটডোরে।
ভয় পাওয়ার সময় এসেছে। খুব ভয় পাওয়ার। কোভিডের কারণে মুড়ি মুড়কির মতো এন্টিবায়োটিক ব্যবহৃত হয়েছে। ভবিষ্যতে টিবি যে শুধু আরো ভয়াল সংখ্যা নিয়ে যে ফেরত আসতে চলেছে তাই না, ড্রাগ রেজিস্টান্ট টিবির সংখ্যাও বাড়তে চলেছে। মিলিয়ে নেবেন।
স্বাস্থ্য দপ্তর যদিও হাত গুটিয়ে বসে নেই। পশ্চিমবঙ্গের জেলায় জেলায় শুরু হয়ে গেছে ‘এক্টিভ কেস ফাইন্ডিং’। রোগী যদি হাসপাতালে নাও আসে তো কুছ পরোয়া নেহি, স্বাস্থ্যদপ্তর ঘরে ঘরে গিয়ে খোঁজ নেবে, বাড়িতে কারো কাশি আছে কিনা, ঘুষঘুসে জ্বর আছে কিনা। কোন কোন বাড়িতে যাবে? কোন পাড়ায়? তারও ম্যাপ আছে। যেখানে যেখানে কদিন আগেও টিবি রোগীর সংখ্যা বেশি ছিল, অথচ এখন কম… সেই সব জায়গায়।
এসব টেকনিক্যাল বিষয়ের কথা থাক। আসল কথাটা বলি। প্লিজ, এই যে এতজন সব্যসাচীকে এত্তো এত্তো ভালোবাসেন, এই আপনারা, যদি সত্যিই ভালোবেসে থাকেন, তবে সেই ভালোবাসার দোহাই, আপনার সন্তান সন্ততির দোহাই,
হাঁচি বা কাশির সময় রুমাল বা কনুইয়ের উল্টো দিক দিয়ে নাক মুখ ঢেকে হাঁচবেন/ কাশবেন।
দুই সপ্তাহ বা তার বেশি এক নাগাড়ে কাশি হলে নিকটবর্তী সরকারি স্বাস্থ্যকেন্দ্রে যাবেন
যেখানে সেখানে কফ থুতু ফেলবেন না। অন্য কেউ ফেলছে দেখলে প্রতিবাদ করুন। নিজের চিকিৎসা নিজে নিজেই এন্টিবায়োটিক খেয়ে করবেন না।
এগুলো নাগাড়ে করে যেতে হবে। নাগাড়ে। তবেই আশা আছে। লড়াইয়ে থাকুন।
(টিবি নিয়ে বিশদে জানতে গেলে আমার ওয়ালে ‘ বেয়াড়া ব্যাকটেরিয়া’ লিখে সার্চ মারুন।)
ভালো থাকুন। সুস্থ থাকুন। আমায় ফেসবুকে দেখতে না পেলে চিন্তা করবেন না। অবসর সময়ের সবটুকু দিয়ে আমি গল্পের বই পড়ছি ; ফেসবুকের বেস্টসেলার বইয়ের মোহ কাটিয়ে, সত্যিকারের বই। তাতে যে কি অসম্ভব রকমের তৃপ্তি, সে বলে বোঝানো অসম্ভব। সুতরাং, ফেসবুকে খুব কমই যাতায়াত থাকবে।
আর ইয়ে, ভুলে যাবেন না আমায়। হ্যাঁ? বেশ খোঁজখবর টবর নেবেন। আমার সত্যিই ভারী আদুরে রকমের আহ্লাদ হয়।
টিকা নিয়েছি করোনার। ক্ষতি হয়নি কিছু। সুযোগ যখন আসবে, নির্দ্বিধায় নিয়ে নিন।
বহুদিন পরে। ভালো থাকবেন।