মেডিকেল কলেজ ডেমোক্রেটিক স্টুডেন্টস অ্যাসোসিয়েশনের (MCDSA) লড়াই এর ৪৮ বছর, শ্রমিক কৃষক মৈত্রী স্বাস্থ্য কেন্দ্রের ৩০ বছর এবং শ্রমজীবী স্বাস্থ্য উদ্যোগের ২৫ বছরের পথ চলার যৌথ উদযাপন ছিল ৭ এপ্রিল সোমবার মেডিকেল কলেজে।
১৯৭৭ সালের মার্চ মাসে যখন ছত্তিশগড়ের দল্লী রাজহরায় সংগঠিত হচ্ছে খনি শ্রমিকদের আন্দোলন, এক ই সময়ে কলকাতায় ২১শে মার্চ মেডিকেল কলেজ ডেমোক্রেটিক স্টুডেন্টস অ্যাসোসিয়েশন (MCDSA) এর পথচলা শুরু। বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন শাসকের বিরুদ্ধে ঘাত-প্রতিঘাত বা সমঝোতায় বাকি সংগঠনগুলি হারিয়ে গেলেও, মেডিক্যাল কলেজে গণতন্ত্র ও ছাত্রস্বার্থের অতন্দ্র প্রহরী হয়ে কাজ করে চলেছে MCDSA। অনেক লড়াইয়ের সাক্ষী ৪৮ বছরের ঐতিহ্যবাহী এই সংগঠন।
১৯৯৫ সালে ২০ মার্চ কানোরিয়া জুট সংগ্রামী শ্রমিক ইউনিয়নের স্বাস্থ্য কর্মসূচি শ্রমিক কৃষক মৈত্রী স্বাস্থ্য কেন্দ্রের আনুষ্ঠানিক উদ্বোধন, পথ চলা শুরু MCDSA র প্রতিষ্ঠা দিবসে- ২১ মার্চ। পঁচিশ বছর আগে ১৯৯৯সালের নভেম্বর মাসে গড়ে ওঠে চিকিৎসক অচিকিৎসক এবং স্বাস্থ্যকর্মী দের সংগঠন শ্রমজীবী স্বাস্থ্য উদ্যোগ। শ্রমিক ইউনিয়ন বহুধাবিভক্ত হয়ে গেলে এই সংগঠন স্বাস্থ্য কেন্দ্র পরিচালনার দায়িত্ব নেয়। মুরগির চালাকে বেড়া দিয়ে ঘিরে শুরু হয়েছিল চেঙ্গাইলে শ্রমিক কৃষক মৈত্রী স্বাস্থ্য কেন্দ্রের চিকিৎসা পরিষেবা। আজ পশ্চিমবঙ্গের বিভিন্ন প্রান্তে ১২ টি স্বাস্থ্য কেন্দ্রের সাঙ্গে যুক্ত শ্রমজীবী স্বাস্থ্য উদ্যোগ। শ্রমজীবী স্বাস্থ্য উদ্যোগ স্বাস্থ্য পরিষেবার বিকল্প মডেল তৈরির কাজে, ব্যবসায়ীকরণের বিরুদ্ধে সবার জন্য স্বাস্থ্যের জন্য প্রচার আন্দোলনে এবং সামাজিক ন্যায়ের সংগ্রামে নিরলস বিরামহীন কাজ করে চলেছে।
ভোপালের গ্যাসপীড়িতদের পাশে থাকার জন্য জনস্বাস্থ্য আন্দোলন, ছত্তিশগড় খনি শ্রমিক আন্দোলন, কানোরিয়া জুট সংগ্রামী শ্রমিক ইউনিয়নের লড়াই আর শ্রমিক কৃষক মৈত্রী স্বাস্থ্য কেন্দ্র এবং শ্রমজীবী স্বাস্থ্য উদ্যোগের মধ্যে সাধারণ যোগসূত্র হল মেডিকেল কলেজ ডেমোক্রেটিক স্টুডেন্টস অ্যাসোসিয়েশন। MCDSA র সদস্য সংগঠকরাই বিভিন্ন জায়গার প্রান্তিক মানুষের সংগ্রাম এবং সকলের স্বাস্থ্যের দাবিতে আন্দোলনের পাশে গিয়ে দাঁড়িয়েছেন।
অনুষ্ঠান শুরু হয় প্রথম বর্ষের ছাত্র ঋতম বর্মণের সুললিত কণ্ঠে সেই সুপরিচিত গানটি দিয়ে, যে গান ছাত্র জীবনের স্বপ্ন সংগ্রাম ভালবাসার সঙ্গে একাত্ম হয়ে আছে- “আমি শুনেছি সেদিন তুমি /সাগরের ঢেউ এ চেপে/নীল জল দিগন্ত ছুঁয়ে এসেছ… “
মেডিকেল কলেজ ডেমোক্রেটিক স্টুডেন্টস অ্যাসোসিয়েশনের জন্ম থেকে শুরু করে ভোপালের জনস্বাস্থ্য আন্দোলন, ছত্তিশগড়ের শহীদ হাসপাতাল, শ্রমিক কৃষক মৈত্রী স্বাস্থ্য কেন্দ্র এবং শ্রমজীবী স্বাস্থ্য উদ্যোগের ইতিহাস এক দীর্ঘ ক্যানভাসে আলোচনা করেন ডঃ অমিতাভ চক্রবর্তী, শ্রমজীবী স্বাস্থ্য উদ্যোগের একজন প্রতিষ্ঠাতা-সদস্য। ড্রাগ অ্যাকশান ফোরাম গড়ে ওঠা, যুক্তিসঙ্গত চিকিৎসার আন্দোলন, বাংলাদেশে জাফরুল্লা চৌধুরীর গণস্বাস্থ্য কেন্দ্র, ডেভিড ওয়ার্নারের বই ‘যেখানে ডাক্তার নেই’ এর গুরুত্ব এবং গণস্বাস্থ্যের প্রশ্নে অনেকগুলি জরুরি বিতর্কের উল্লেখ করেন ডঃ চক্রবর্তী।
শ্রমিক কৃষক মৈত্রী স্বাস্থ্য কেন্দ্র ও শ্রমজীবী স্বাস্থ্য উদ্যোগের অন্যতম প্রতিষ্ঠাতা ডঃপুণ্যব্রত গুণ সার্বজনীন স্বাস্থ্যের অধিকার ও আন্দোলন নিয়ে আলোচনা করেন এবং গণস্বাস্থ্যের প্রশ্নে গুরুত্বপূর্ণ ধারণা গুলি ব্যাখ্যা করেন। সার্বজনীন স্বাস্থ্যের তিনটি মডেল কে উল্লেখ করে ডঃ গুণ বলেন পৃথিবীর কোন পুঁজিবাদী দেশেই রাষ্ট্র কখনো স্বতঃপ্রণোদিত হয়ে সার্বজনীন স্বাস্থ্য পরিষেবা চালু করেনা। স্বাস্থ্যের সমানাধিকারের দাবি তে আন্দোলন বা সমাজতান্ত্রিক দুনিয়ার ভয় রাষ্ট্রকে বাধ্য করে এই অধিকার দিতে। ইংল্যান্ড, কিউবা, ফ্রান্স, জার্মানি, নরওয়ে প্রভৃতি দেশের সার্বজনীন স্বাস্থ্যপরিষেবা কে তিনি উদাহরণ হিসাবে দেখান। তিনি বলেন শ্রমজীবী স্বাস্থ্য উদ্যোগের স্বাস্থ্য পরিষেবা সরকারি উদ্যোগে সার্বজনীন স্বাস্থ্যের কোন বিকল্প নয়, কম খরচে যুক্তি সঙ্গত চিকিৎসার মডেল তৈরি করে তাঁরা সরকারি খরচে সার্বজনীন স্বাস্থ্যের দাবি কে শক্তিশালী করতে চান। টেলি মেডিসিন বা আর্টিফিশিয়াল ইন্টেলিজেন্স নির্ভর চিকিৎসার চেয়ে তিনি বেশি গুরুত্ব দেন স্বাস্থ্য কর্মীর প্রশিক্ষণে। তিনি বলেন রোগীর কাছে রোগনিরাময়কারীর স্পর্শের কোন বিকল্প নেই।
ডঃ দেবাশিস হালদার গণ স্বাস্থ্যের বিভিন্ন দিক নিয়ে আলোচনা করেন। তিনি বলেন বিভিন্ন এলাকায় সাধারণ মানুষের জন্য সুলভ ক্লিনিক চালানো স্বাস্থ্য পরিষেবার দাবি গুলি মেটাতে পারবে না বরং ক্লিনিক গুলি থেকে জনস্বাস্থ্য আন্দোলন গড়ে তোলার রসদ পাওয়া যায়। স্বাস্থ্যের বাস্তব অবস্থা জানতে সাহায্য করে এই ক্লিনিক গুলি। সরকারি উদ্যোগে জন স্বাস্থ্য পরিষেবাই স্বাস্থ্য আন্দোলনের মূল লক্ষ্য।
মেডিকেল কলেজের প্রথম ও দ্বিতীয় বর্ষের ঋতব্রত দাস , রঘুনাথ চ্যাটার্জী , সাত্ত্বিক দাস , শৌর্য মুখার্জী ও অর্পণ গোস্বামী জনস্বাস্থ্য, সার্বজনীন স্বাস্থ্য পরিষেবা ও সরকারের দায়িত্ব সম্পর্কে সুচিন্তিত বক্তব্য রাখেন। ডঃপুণ্যব্রত গুণ সার্বজনীন স্বাস্থ্য আন্দোলন শক্তিশালী করার জন্য স্বচ্ছ্ব ধারণা তৈরি করার প্রয়োজনীয়তার কথা বলেন এবং এর জন্য ছাত্রদের সঙ্গে নিয়মিত আলোচনা ও অভিজ্ঞতা আদান প্রদানের প্রতিশ্রুতি দেন।
এই অনুষ্ঠানের শুরুতে ডঃপুণ্যব্রত গুণ, ডঃ বিপ্লব সরকার এবং ডঃ দীপঙ্কর জানা শ্রমিক কৃষক মৈত্রী স্বাস্থ্য কেন্দ্রের ৩০ বছর এবং শ্রমজীবী স্বাস্থ্য উদ্যোগের ২৫ বছরের পথ চলার স্মারক হিসাবে একটি বই প্রকাশ করেন, যা স্বাস্থ্য আন্দোলনের এক গুরুত্বপূর্ণ দলিল- ‘সংঘর্ষ ও নির্মাণের আখ্যানঃ শ্রমিক কৃষক মৈত্রী স্বাস্থ্য কেন্দ্রের ৩০ বছর’।
এই অনুষ্ঠানের অন্যতম প্রাপ্তি হল গণ সঙ্গীত শিল্পী রঙিলী বিশ্বাস এবং বিপুল চক্রবর্তী – অনুশ্রী চক্রবর্তীর গান। হেমাঙ্গ বিশ্বাসের বেশ কিছু অপরিচিত গান শোনান রঙিলী বিশ্বাস, যে সব গান মানুষের অধিকার অর্জনের সংগ্রামে অনুপ্রেরণা যোগায় । বিপুল চক্রবর্তী – অনুশ্রী চক্রবর্তীর গান সত্তরের দশকের শেষ থেকেই দেশি বিদেশি সাম্রাজ্যবাদ ও রাষ্ট্রীয় শোষণের বিরুদ্ধে প্রতিরোধে প্রতিস্পর্ধায় স্মরণীয় হয়ে আছে। প্রতিবাদের বলিষ্ঠ প্রত্যয় ও পরিবর্তনের শপথ নিয়ে শেষ হয় এই বিশেষ অনুষ্ঠান।
নিরবচ্ছিন্ন সংগ্রাম ও সংগ্রামী সংহতির স্মারক হিসাবে অনুষ্ঠানে অংশগ্রহণকারীদের প্রত্যেককে একটি গণসঙ্গীত সঙ্কলন উপহার দেওয়া হয়।
ছাব্বিশ হাজার হঠাৎই চাকরিহারা শিক্ষক-শিক্ষিকার কথা মাথায় নিয়ে— অমীমাংসিত অভয়াকাণ্ডের কথা মাথায় নিয়ে— গাজায় নিশ্চিহ্ন হতে-থাকা শহরগুলো মাথায় নিয়ে, সেদিন মেডিক্যাল কলেজে ডাক্তার-বন্ধু আয়োজিত তাঁদের সভায় গান গাইতে গিয়েছি।
কী গান গাইব এমনদিনে? বরাবরই আমাদের গানকে একটি ভিন্ন পরিসরে রাখতে চেয়েছি— যে পরিসরটি তথাকথিত সব পরিসরের বাইরে। তার জন্য উপযুক্ত এই মঞ্চ। কিন্ত, আমরা (আমি ও অনুশ্রী) প্রস্তুত কি? আজকের কথা লিখেছি অনেক— গেয়েছি কি?
এইসবই ভাবতে ভাবতে মেডিক্যাল কলেজে ঢুকলাম। হাসপাতালের ব্যস্ততা চারিদিকে। কতশত রোগী আর রোগী-পরিবারের লোকজন। মৃত্যুর সঙ্গে যুঝতে-থাকা তারা প্রত্যেকে। পুরানো এক অশ্বত্থগাছের তলে গিয়ে দাঁড়ালাম কিছুক্ষণ। চায়ের ভাঁড় হাতে নিয়ে কবেকার এক মেডিক্যাল কলেজের কথা মনে পড়ল। সে ৮-এর দশকের কথা। জুনিয়ার ডাক্তারদের আন্দোলনের সে কথা। স্বাধীন এক পরিসর রচনা করবার সেইসব দিন। পুরনো অথচ মর্মরিত সেই কথা যেন অশ্বত্থের পাতায় পাতায়। ভেসে এল পুরনো কত বন্ধুর মুখ, কন্ঠস্বর।
হলে ঢুকতেই, দেখি, ব’সে আছেন বন্ধু পূণ্যব্রত গুণ— ব’সে আছেন বন্ধু অমিতাভ চক্রবর্তীও। ঝাঁকে ঝাঁকে নতুন ছেলেমেয়েদের উপস্থিতিতে গমগম করছে হল। আমরা গান গাইতে উঠে দু’কথা বললাম। বললাম যে মিথ্যে আশ্বাসের গান গাইনি কখনও। আকাঙ্ক্ষার-ই কথা গানে গানে রাখতে চেয়েছি বরাবর। সুসহ আর সুন্দর এক পৃথিবী চেয়েছি সবার জন্য। আজও সেই চাওয়া— আজও গাই, ‘রাস্তা পেরিয়ে রাস্তা’…
অশেষ ধন্যবাদ জানাই আপনাকে, গোপা মুখার্জী! আপনার লেখার অনুষঙ্গে এতসব কথা মনে এল।
বিপুলদা, পুণ্যদার ব্যবস্থাপনায় সেদিন বিকেলে আপনার আর অনুশ্রীদির অবিরাম লড়াই, সুন্দর সমাজের স্বপ্নে বিভোর কিছু প্রিয় মানুষের সংগ্রাম- ভালোবাসা আর শ্রমজীবী মানুষের গৌরবময় আন্দোলনের গল্প শোনার সৌভাগ্য হল। আপনারা সেই কবে থেকেই দুর্গম থেকে দুর্গমতর রাস্তা পেরিয়ে সূর্যমুখীর স্বপ্ন নিয়ে এগিয়ে চলেছেন সূর্য অভিযানে – ‘ জীবনের জন্য ভালোবাসার জন্য ‘ । শ্রমজীবী স্বাস্থ্য উদ্যোগ আর MCDSA র জন্য এই দুর্লভ সুযোগ টা পেলাম, সঞ্চয়ে থাকল এক আশ্চর্য অপরাহ্ন, মায়াবী সন্ধ্যা। খুব ভাল থাকুন আপনারা দুজন। আরো অনেক অনেক গান সৃষ্টি করুন, স্বাধীন পরিসর তৈরির সংগ্রাম শক্তিশালী হয়ে উঠুক, এমন করেই ভালবাসার বন্ধনে জড়িয়ে রাখুক আমাদের সবাই কে।
অপূর্ব লেগেছে আপনাদের গান। সবটা ধরে রেখেছি facebook live এ। বারবার শুনছি।
এই অনুষ্ঠানে থেকে এবং সমগ্র অনুষ্ঠানটি উপভোগ করে সমৃদ্ধ হয়েছি। শিল্পীদের গান শুনে রোমাঞ্চিত হয়েছি। MCDSA এর ৩০ বছরের পথ চলা এবং শ্রমজীবী স্বাস্থ্য উদ্যোগের ২৫ বছরের এই পথচলা র কাহিনী মনকে প্রভাবিত করেছে। কুর্নিশ জানাই এই উদ্যোগের সাথে যুক্ত সকল মানুষকে। 🙏🙏🙏