একেবারে প্রথম থেকে, অর্থাৎ গত বছর ডিসেম্বরের শেষ থেকে এখনো পর্যন্ত করোনা সংক্রমণ, তার বিস্তার, অতিমারির গতি প্রকৃতি, চিকিৎসা, প্রতিরোধ, প্রতিষেধক, অতিমারি-সঞ্জাত সামাজিক ও অর্থনৈতিক বিপর্যয় মোকাবিলায় সরকারের দৃষ্টিভঙ্গি — সমস্ত বিষয়ে কিছু অস্পষ্টতা, কিছু অস্বচ্ছতা ছিল এবং আছে। তবে একটি বিষয় নিয়ে কোন অস্পষ্টতা নেই, তা হলো — নোভেল করোনা বা সার্স কোভিড ২ (Novel Corona or SARS COVID 2) এমন একটি ভাইরাস, যার ১) সংক্রমণ ক্ষমতা অত্যন্ত বেশী, ২) মারণ ক্ষমতা কম, ৩) দ্রুত পরিবর্তনশীল। এরকম একটি আনকোরা রহস্যময় ভাইরাসের সঙ্গে লড়তে গেলে প্রয়োজন প্রচুর তথ্যের। তার জন্য দরকার সংক্রমিত এবং সম্ভাব্য সংক্রমিত ব্যক্তিদের পরীক্ষা ও ধারাবাহিক পর্যবেক্ষণ এবং প্রয়োজনমতো বিচ্ছিন্নকরণ। সরকার সেই চেষ্টা করছেন ঠিকই, কিন্তু বলা বাহুল্য, তা নিতান্তই অপ্রতুল। কোভিড-টেস্ট যেটুকু হচ্ছে, তা প্রধানত শহরাঞ্চলে। গ্রামাঞ্চল যথারীতি নজরদারির অনেকটাই বাইরে। সমীক্ষা (‘সেরো সমীক্ষা’ বা ‘sero servey’। সারা দেশের প্রায় সব রাজ্যের অনেকগুলো জেলার শহর ও গ্রামাঞ্চলে এই সমীক্ষা হয়েছে এবং হচ্ছে। এতে আপাত সুস্থ মানুষের রক্ত সংগ্রহ করে তাতে নোভেল করোনা ভাইরাসের অ্যান্টিবডি আছে কিনা, তা পরীক্ষা করে দেখা হয়। অ্যান্টিবডি পাওয়া গেলে বুঝতে হবে, ঐ ব্যক্তি কখনও নোভেল করোনায় সংক্রমিত হয়েছিলেন।) বলছে, আমাদের দেশে করোনা-পরীক্ষার ফল অনুসারে কোভিড সংক্রমিতের সংখ্যা যা দেখা যাচ্ছে, প্রকৃত সংখ্যা তার কয়েক গুন। অর্থাৎ, অজান্তেই দেশের বহু মানুষের সংক্রমণ হয়েছে, আবার ঠিকও হয়ে গেছে। পরীক্ষা প্রক্রিয়ার মধ্যেই তাঁদের আনা যায় নি। কিন্তু রোগ বিস্তারের ক্ষেত্রে তাঁদের কিছু ভূমিকা থেকে গেল। সমস্যা এখানেই।
যত দিন যাচ্ছে, মানুষের মধ্যেও একই সাথে গা-ছাড়া এবং বেপরোয়া মনোভাব তৈরি হচ্ছে। সরকার টেস্টের ব্যবস্থা ক্রমশ বাড়াচ্ছে ঠিকই, মানুষের মধ্যেই অনীহা তৈরি হয়েছে। একটি বড় কারণ, দীর্ঘ লকডাউনে কর্মহীন থাকার পর যাঁরা নতুন করে কাজ শুরু করেছেন, পুরনো পেশাকে আঁকড়ে ধরে আবার মাথা তোলার চেষ্টা করছেন বা বাধ্য হয়ে পেশা পরিবর্তন করে দাঁতে দাঁত চেপে লড়াই করছেন, ছোট বড় বেসরকারি ক্ষেত্রে মুখ বুঁজে কম বেতনে কাজ করছেন, কয়েক মাসের মধ্যে মধ্যবিত্ত থেকে নিম্নবিত্ত, নিম্নবিত্ত থেকে দরিদ্র বা এক ধাক্কায় দারিদ্র্য সীমারও নীচে নেমে গেছেন — তাঁরা স্বাভাবিকভাবেই টেস্ট করাতে ভয় পাচ্ছেন। পজিটিভ হলে সপরিবার আড়াই সপ্তাহ গৃহবন্দী। তার মানে আবার কর্মহীন হওয়ার আশঙ্কা, আবার হন্যে হয়ে নতুন কাজ খোঁজা। শুধু কি তাই? অনেকেরই হয়তো বাড়িতে বসে পুরো পরিবারের জন্য এই আড়াই সপ্তাহের খাদ্যের সংস্থানই করে ওঠা সম্ভব হবে না। সরকার হয়তো বলবে সরকারি সেফ হোমের কথা। কিন্তু সে তো পরিবারের সবার জন্য নয়। এতকিছু চিন্তা ভাবনা করেই কোভিড টেস্ট করিয়ে পুনরায় চূড়ান্ত অনিশ্চয়তার মধ্যে কেউ যেতে চাইছেন না। সরকার এবং স্থানীয় প্রশাসন প্রায় বল প্রয়োগের নীতি নিচ্ছে, কিন্তু আনুষঙ্গিক বিষয়গুলোকে গুরুত্ব দিচ্ছে না।
আবার ইদানীং দেখছি, কোভিড নির্ণয় পদ্ধতি এবং ফলাফল নিয়ে অনেকের মধ্যে ব্যাপক অনাস্থা তৈরি হয়েছে। ফেসবুক – হোয়াটসঅ্যাপে টেক্সট-অডিও-ভিডিও ঘুরপাক খাচ্ছে, বিভিন্ন রাজ্যে নাকি ইচ্ছে করে বেশী বেশী পজিটিভ কেস দেখানো হচ্ছে। এগুলো সবই ভুয়ো পোস্ট। ফেক নিউজ। ‘গুগল ফ্যাক্ট চেক’ করলেই বেরিয়ে আসবে। অদ্ভুত ব্যাপার হলো, যখন পজিটিভ কেস কম পাওয়া যাচ্ছিল, তখন যাঁরা বলছিলেন চক্রান্ত, এখন সংখ্যাবৃদ্ধির পর তাঁরাই বলছেন, এটাও চক্রান্ত। হ্যাঁ, যে কোনো পরীক্ষা-নিরীক্ষায় বা সমীক্ষায় বিজ্ঞানসম্মতভাবেই ‘শতকরা ভুল’-এর একটি হিসেব থাকে। চেষ্টা করা হয়, সেই ভুলকে সম্ভাব্য ন্যূনতম মাত্রায় নামিয়ে আনার। আমরা নিশ্চয়ই আশা করতে পারি, অন্তত রোগ নির্ণয়ের ক্ষেত্রে যথাসম্ভব বিজ্ঞানসম্মত পদ্ধতি অনুসৃত হচ্ছে। ‘অন্তত’ বললাম এই কারণে, যে — নির্ণয় পরবর্তী চিকিৎসা এবং রোগ প্রতিরোধ-প্রতিবিধানে যথেষ্ট অবিজ্ঞান এবং অব্যবস্থা আছে । এ ক’দিনে সেটা আরও ভালো করে বুঝলাম।
(ক্রমশঃ)