দু’বছর আগে খবর পাই, নিউ ইয়র্কের সেন্ট্রাল পার্ক থেকে ডাক্তার জেমস ম্যারিয়ন সিমস-এর একটা স্ট্যাচু সরিয়ে দেওয়া হয়েছে। কিছু মানুষ সেই স্ট্যাচুর গায়ে লিখে এসেছিল RACIST, অর্থাৎ বর্ণবিদ্বেষী। আমাদের দেশে ডাক্তার বা বৈজ্ঞানিকদের স্ট্যাচু বানানোর চল তেমন নেই—থাকলেও তাঁদের শহরের একেবারে কেন্দ্রে খাতির করে রাখা হয় না। বিধানচন্দ্র রায়ের কথা আলাদা, তিনি কেবল ডাক্তার হিসেবে খাতির পান, এমন নয়। তাই সিমস সাহেবের এমন স্থানচ্যুতিতে প্রথমে খারাপই লেগেছিল।
স্ত্রীরোগ-বিদ্যায় “সিমস’ স্পেকুলাম” বলে একটা যন্ত্র এখনও খুব কাজে লাগে। সেটা এই সিমস সাহেবেরই সৃষ্টি। আর মেডিক্যাল কলেজে মাস্টারমশাইদের কাছে গল্প শুনেছিলাম, চমৎকার মানুষ ছিলেন ডাক্তার সিমস—মেয়েদের দুঃখে তাঁর প্রাণ কাঁদত। বাচ্চা হবার সময়ে মায়ের যোনিপথ ও প্রস্রাবের থলির মাঝখানটা কখনও কখনও ছিঁড়ে যায়, অনেকের সেই ছিদ্রটি আর সারে না। তখন সেই রোগিণীর যোনিদ্বার দিয়ে প্রস্রাব নির্গত হতে থাকে—ফলে জীবন দুর্বিষহ হয়ে যায়। (পাদটীকা ১) এই ভয়াবহ রোগটি সারানোর জন্য যে বিশেষ অপারেশন প্রয়োজন, সেটি প্রথম সফলভাবে করেন ডাক্তার সিমস। তাঁরই স্ট্যাচু সরানো হল? (তথ্যসূত্র ১)
স্ট্যাচু সরানো ভুল হয়েছে কিনা সেটা এককথায় বলা শক্ত। এতদিন আমরা চিকিৎসাশাস্ত্রের উন্নতির এক সরলরৈখিক বিবরণ পড়ে এসেছি, তাই এমন খবর আমাদের চমকে দেয়।
ডাক্তার সিমস-এর চিকিৎসক হিসেবে নৈপুণ্য নিয়ে কোনও প্রশ্ন নেই। তাঁর কাজগুলি যে চিকিৎসাশাস্ত্রকে এগিয়ে দিয়েছে, মানুষের কষ্ট লাঘব করেছে, সে নিয়েও কোনও সন্দেহ নেই। কথা হল, কেমন করে তিনি তাঁর আবিষ্কার করেছেন? কী উপায় তিনি গ্রহণ করেছিলেন অপারেশনের হাত পাকানোর জন্য?
স্থান আমেরিকা যুক্তরাষ্ট্র, সময় কাল ১৮৪৫ থেকে ১৮৪৯ সাল। এই কয়েক বছর ধরে অনেকগুলি ট্রায়াল অপারেশনের করার পরে ডা. সিমস তাঁর বিখ্যাত অপারেশনের সঠিক পথটি অনুধাবন করেন এবং অপারেশনে সাফল্যমণ্ডিত হন। তিনি আলাবামা স্টেটে ডাক্তারি করতেন। আলাবামা নামটি গুরুত্বপূর্ণ। তখনও আমেরিকাতে দাসপ্রথার অবসান হয়নি। আব্রাহাম লিংকন প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হতে বাকি আছে দেড় দশক।
হার্পার লির যুগান্তকারী গ্রন্থ ‘টু কিল এ মকিং বার্ড’ বইটির পটভূমি ছিল আলাবামা স্টেটের ছোট্ট এক শহর! এই সেদিনও সেখানে কালো মানুষদের জন্য আলাদা গির্জা রাখা হত। আর কালো দাসেরা যেকোন সময়ে শিকার হত জনরোষের।
যারা আমেরিকা যুক্তরাষ্ট্রের গৃহযুদ্ধের (১৮৬১-১৮৬৫) ইতিহাস পড়েছেন তাদের নিশ্চয়ই মনে পড়বে যে, ১৮৬১ সালে লিংকন প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হলে তাঁর বিরুদ্ধে অন্য স্টেটগুলোকে সংগঠিত করে দক্ষিণের এই আলাবামা স্টেট। দাসমালিকদের আশঙ্কা ছিল লিংকন দাসপ্রথা বিলুপ্ত করতে পারেন। আলাবামা-র রাজধানী মন্টোগোমারি-তে দাসপ্রথার সমর্থক দক্ষিণের সাতটি স্টেট মিলিত হয়, এবং আমেরিকা যুক্তরাষ্ট্রের বাইরে যাবার প্রক্রিয়া হিসেবে এক ‘কনফেডারেশন’ গড়ে তোলে।
অর্থাৎ যে সময় ডা. সিমস তার ডাক্তারি গবেষণা করছেন সেই সময়ে আমেরিকা যুক্তরাষ্ট্রে দাসপ্রথা রমরমিয়ে চলছে। সিমস-এর স্টেট আলাবামা-তে দাসপ্রথার উগ্র সমর্থক ছিল অনেক। আবার ডাক্তারি প্র্যাকটিস করার আগে ডাক্তার সিমস থেকেছেন সাউথ ক্যারোলিনা স্টেটে। এটি আরেকটি দাসপ্রথার সমর্থক দক্ষিণের স্টেট। সাউথ ক্যারোলিনা স্টেট সর্বপ্রথম লিংকনের ইউনাইটেড স্টেটস থেকে নিজেকে পৃথক ঘোষণা করে, আর এখান থেকেই দাসপ্রথার সমর্থক সৈন্যরা সব থেকে বেশি সংখ্যায় গৃহযুদ্ধে গিয়েছিল। ডা. সিমসকে নিয়ে আলোচনা করতে গিয়ে এই পরিপ্রেক্ষিত মনে রাখলে সুবিধা হবে, ডা. সিমসকে বিচার করাও সহজ হবে।
কী করেছিলেন ডাক্তার সিমস? আগেই উল্লেখ করেছি সন্তান জন্মের সময়ে কোনও কোনও দুর্ভাগা মায়ের প্রস্রাবের থলি ও যোনির মধ্যে একটা সংযোগ হয়ে যেত। তিনি তা সারিয়ে স্বাভাবিক করার শ্রেষ্ঠ অপারেশনটি খুঁজছিলেন। তখনও পর্যন্ত চালু অপারেশনগুলো খুব ভাল ফল দিত না।
সঠিক অপারেশন খুঁজে বের করার জন্য ডা. সিমস-এর কিছু পরীক্ষা-নিরীক্ষা করা দরকার ছিল। যেহেতু মানুষের শরীরের এই অংশটা অন্য যে কোনও জীবের চাইতে অনেকটাই আলাদা, কুকুর-বাঁদরের ওপরে পরীক্ষা করে লাভ ছিল না। তাই তিনি ‘সহজতম’ কাজটিই করেন। কয়েকজন কৃষ্ণাঙ্গ ক্রীতদাসীকে নিয়ে তিনি তাঁদের শরীরের ওপরে অপারেশন করে করে সঠিক অপারেশনের পথ বুঝতে পারেন। যেহেতু ‘সবাই জানে’ কৃষ্ণাঙ্গদের ব্যথা লাগেনা, তাই তিনি এমনকি অপারেশনের সময়ে অ্যানাস্থেসিয়া দেবার প্রয়োজনও বোধ করেননি, এরকম একটা কথা চালু আছে। সেটা ঠিক কিনা বুঝতে গেলে অ্যানাস্থেসিয়া চালুর ইতিহাসটা একবার ঝালিয়ে নেওয়া দরকার।
ডা. সিমস কাজ মূল কাজটা করেছিলেন ১৮৪৫ থেকে ১৮৪৯ সালে, আর ক্লোরোফর্ম দিয়ে অ্যানাস্থেসিয়া প্রথম আসে ১৮৪৭ সালে। যখন ব্রিটিশ ডাক্তার জন স্নো রাণী ভিক্টোরিয়া-র সন্তান জন্মের সময় তাঁর ওপরে ক্লোরোফর্ম প্রয়োগ করেন তখন সেটা সমস্ত মহলে গৃহীত হয়, সে হল ১৮৫৩ সাল। (পাদটীকা ২)। তার সামান্য আগে, ১৮৪৬ সালে ইথারের সাহায্যে অ্যানাস্থেসিয়া প্রথম করে দেখান বোস্টন শহরের এক দাঁতের ডাক্তার। তাই অ্যানাস্থেসিয়া না-দেবার অপরাধে হয়তো ডা. সিমস-কে দায়ী করা ঠিক হবে না। কিন্তু এই নারীদরদী ডাক্তারের কাছেও নারী মানে ছিল শ্বেতাঙ্গিনী, এই অভিযোগ তোলা খুব অন্যায্য হবে না হয়তো।
ডাক্তার সিমস এই অপারেশন করার ট্রায়াল হিসেবে এক-একজন কৃষ্ণাঙ্গ ক্রীতদাসীর শরীরে কুড়ি-ত্রিশবার অপারেশন করেছিলেন। অপারেশনের লম্বা সময় জুড়ে রোগীদের চারপেয়ে জন্তুর মতো হামাগুড়ি অবস্থায় থাকতে হত। অন্তত এক ডজন ক্রীতদাসীর ওপর পরীক্ষামূলক অপারেশন করেছিলেন ডা. সিমস। তাঁরা অপারেশন চাননি, এমন কথা জোর দিয়ে বলা যায় না। যে রোগটির জন্য অপারেশন করা সেটা একটি দুর্বিষহ অবস্থা। সিমস নিজে ক্রীতদাসীদের কাছে অপারেশনের অনুমতি নিয়েছেন বলে জানিয়েছেন। (তথ্যসূত্র ২) তবে তার সত্যাসত্য বিচার করা কঠিন। আর যদি অনুমতি নেওয়া হয়েও থাকে, সেই সময়ে দক্ষিণের স্টেটের এক দাসের থেকে কী অবস্থায় ও কী বুঝিয়ে সেই অনুমতি নেওয়া হয়েছিল তা জানার এখন আর কোন উপায় নেই। সিমস-এর নাম জগদ্বিখ্যাত হল, আর এই বারোজনের নাম কেউ জানল না। শুধু তিনজনের নাম পরে ঐতিহাসিকেরা খুঁজে বের করেছেন—লুসি, বেটসি আর অ্যানার্কা।
এই অপারেশনের আগে ডা. সিমস ক্রীতদাসদের ছোট ছোট বাচ্চাদের ওপরেও আরেকটা অপারেশন করে হাত পাকিয়েছিলেন বলে অভিযোগ। কিন্তু সেই কাজটায় মূলে ভুল ছিল বলে তাঁর উদ্দেশ্য সফল হয়নি, এবং ডা. সিমস সেটা নিয়ে বিশেষ লেখেননি। সেই সময় ধারণা ছিল, সদ্যোজাত বাচ্চার মাথার আকৃতি তার টিটেনাস রোগের জন্য দায়ী। বাচ্চার মাথার আকৃতি বদলানোর জন্য খুলিতে ফুটো করে মাথার হাড় ‘ঠিক করে’ দিতেন ডা. সিমস। বাচ্চাটি প্রায় সব ক্ষেত্রেই মারা পড়ত। এতে লাভ কিছু হয়নি, কারণ বাচ্চার মাথার আকৃতির সঙ্গে টিটেনাসের বিন্দুমাত্র সম্পর্ক নেই। (তথ্যসূত্র ৩) জানিনা এই বাচ্চাদের মা বাবার থেকেও ডা. সিমস অনুমতি নিয়েছিলেন কিনা।
এটা ভাবার কারণ নেই যে আমেরিকায় ক্রীতদাস প্রথা আইনত নিষিদ্ধ হবার পর থেকে ডাক্তারদের চোখে সাদা আর কালো রোগী সমান হয় গেছে। এখনও আমেরিকা যুক্তরাষ্ট্রে কোভিড-১৯ এ আক্রান্ত হয়ে মৃতদের এক-চতুর্থাংশ হল কালো মানুষ, যদিও ওদেশের মোটামুটি এক-অষ্টমাংশ মাত্র কালো মানুষ। এখনও বাচ্চা জন্মের সময় কালো মায়েদের মৃত্যুহার সাদা মায়ের মৃত্যুহারের আড়াই গুণ বেশি। (তথ্যসূত্র ৪)
এখনও আমেরিকা যুক্তরাষ্ট্রে অনেক ডাক্তারের ধারণা, কালো বা অন্যান্য অশ্বতকায় ও দরিদ্র মানুষেরা চিকিৎসা করার সময় তাঁরা নিজেরা পুরো পয়সা দিতে পারেন না। সুতরাং তাঁদের শরীরের ওপর দু-চারটে পরীক্ষা-নিরীক্ষা করা যেতেই পারে। ওটাই দরিদ্র মানুষের পয়সা মেটানোর উপায়। (তথ্যসূত্র ১)
আমেরিকায় তাও এসব জানার একটা ব্যবস্থা আছে। সেখানে ডাক্তার, স্বাস্থ্যকর্মী ও রোগীদের সামাজিক-মানসিক প্রবণতা জানতে তাঁদের ওপর সমীক্ষা করা হয়, সরকারীভাবে সেই সমীক্ষার বিভিন্ন তথ্য নিয়ে বিশ্লেষণ করা হয়।
আমাদের দেশে সে সবের বালাই নেই। এদেশের চিকিৎসক, বা এদেশের গোটা স্বাস্থ্যব্যবস্থাই যে দরিদ্র, বিশেষ করে দরিদ্র ও জনজাতির মানুষদের স্বচ্ছল নাগরিকদের সঙ্গে সমান চোখে দেখে না, সেটা জানার জন্য সমীক্ষা করারও হয়তো প্রয়োজন নেই।
পাদটীকা
১) চিকিৎসাশাস্ত্রের ভাষায় একে বলে মূত্রস্থলী-যোনি-নলি (vesico-vaginal fistula)
২) কলেরা যে জলের মাধ্যমে ছড়ায় সেটা প্রতিষ্ঠিত করেন এই ডা. জন স্নো
চিত্র পরিচিতিঃ ডা. সিমস–এর এই স্ট্যাচুটি সরানো হয়েছে
তথ্যসূত্রঃ
১) New York City Just Removed a Statue of Surgeon J. Marion Sims From Central Park. Here’s Why. Olivia B. Waxman. Time. APRIL 17, 2018 https://time.com/5243443/nyc-statue-marion-sims/ ১৯ সেপ্টেম্বর, ২০২০ তারিখে দেখা)
২) The medical ethics of Dr J Marion Sims: a fresh look at the historical record. L L Wall, Journal of Medical Ethics: 32(6), 2006, p 346–350
৩) ‘I can do the child no good’: Dr Sims and the enslaved infants of Montgomery, Stephen C. Kenny. Social History of Medicine. Vol 20(2), P 223-41, 2007
৪) How this Black doctor is exposing the racist history of gynecology. Maura Hohman. TODAY. June 30, 2020. https://www.today.com/health/racism-gynecology-dr-james-marion-sims-t185269 ১৯ সেপ্টেম্বর, ২০২০ তারিখে দেখা)