“দূর হতে ভেবেছিনু মনে —
দুর্জয় নির্দয় তুমি, কাঁপে পৃথ্বী তোমার শাসনে।
তুমি বিভীষিকা, …. ”
মৃত্যুঞ্জয়; রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর।
কবিতার শেষে এসে ভুয়োদর্শী কবি নিজেকে ‘মৃত্যু-চেয়ে বড়’ ঘোষণা করেছেন। এই উপলব্ধিতে পৌঁছতে গেলে যে পর্যায়ের মেধা, মনন, জ্ঞান, বোধ, প্রজ্ঞা, পরিণমন, আবেগ ও অনুভূতি থাকতে হয়, তার কিঞ্চিৎ ভগ্নাংশও আমার নেই। ঘটনা পরম্পরাও তুলনীয় নয়। কিন্তু নিভৃতবাসের তৃতীয় দিন থেকে কবিতাটির পংক্তিগুলো আমার বারবার মনে পড়ছিল। জানি বাড়াবাড়ি, তবুও পড়ছিল। সঞ্চয়িতা হাতের কাছে না থাকায় গুগল খুঁজে বের করে পাঠও করেছি কয়েকবার।
আর পড়লাম গল্পগুচ্ছ। না, গুগল থেকে নয়। কাছাকাছিই ছিল। অনেক দিন পর আবার পড়ছি। কিছু পড়া, কিছু না পড়া ছোটগল্পগুলো নতুন করে অনুধাবন করছি। তার সঙ্গে পত্র-পত্রিকা, দুটি সংবাদপত্র খুঁটিয়ে পড়া। এইভাবেই সতেরো দিন কেটে গেল। তবে শেষ সাতদিন যাবৎ একটু অধৈর্য হয়ে পড়ছিলাম।
অবশেষে বন্দীদশা ঘুচল। সতেরো দিন পরে গতকাল ঘর থেকে বেরোলাম। বাড়ি থেকে বেরোলাম। একসাথে খাওয়া দাওয়া করলাম। সকাল ন’টার কিছু পরেই ফোন করলাম মহকুমা প্রশাসনের কন্ট্রোল রুমে। ওঁদের কী পরামর্শ, জানার জন্য। মোবাইল নম্বর। কেউ ধরলেন না। কিছু সময় পরে-পরে আরও দু’বার। নাঃ। অথচ, সকাল ন’টার থেকে কন্ট্রোল রুম খোলে বলেই জানি। অবশেষে দশটা বেজে ছাব্বিশ মিনিটে কন্ট্রোল রুম থেকে আমাকে ফোন করলেন। বললেন, এখন সকাল দশটা থেকে খোলে। আমি অবশ্য ন’টা তেইশ থেকে দশটা ষোলোর মধ্যে তিনবার ফোন করেছি। যাই হোক, আমার বিষয়টি জানালাম। ওখান থেকে হিসেব-নিকেশ করে বললেন — হ্যাঁ, আজকেই আমি বের হতে পারব। বাড়ির সামনে যে বিজ্ঞপ্তিটা টাঙ্গানো ছিল, তার কথা জিজ্ঞেস করায় প্রথমে আমাকে বলা হলো খুলে রাখতে। তা রাখতেই পারতাম। এমন কিছু বড় সমস্যা নয়। কিন্তু যাঁরা আমাকে দেখবেন, সরকারি বিজ্ঞপ্তি আমি নিজে হাতে খুলছি, তাঁরা ভাবতেই পারেন এটা আমার দিক থেকে ন্যায়সঙ্গত হলো কিনা। বিষয়টি বুঝিয়ে বলার পর তাঁরা আসবেন বলে জানালেন। কিছুক্ষণ পর গাড়ি এসে বিজ্ঞপ্তিটি খুলে নিয়ে গেল। আমি এবং আমরা মুক্ত হলাম। ওঁদের কাছেই জানলাম, এখন আর কোথাও ‘কনটেইনমেন্ট জোন’ বিজ্ঞপ্তি সাঁটানো হচ্ছে না। অথচ, কয়েকদিন আগেও কোন বাড়িতে করোনা পজিটিভ ধরা পড়লে পুরো এলাকা বাঁশ দিয়ে আটকে দেওয়ার মতো অযৌক্তিক সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে, যা এলাকাবাসীর মধ্যে প্রবল আতঙ্ক তৈরি করেছে।
তবে এখানে একটি বিষয়ের উল্লেখ করা প্রয়োজন। মহকুমা প্রশাসন কিন্তু প্রথম দিন থেকেই মোটামুটি নিয়মিত খোঁজখবর নিয়েছে। প্রায় প্রতিদিনই ফোন করে কেমন আছি, বাড়ির অন্যরা কেমন আছে, উপসর্গ বাড়লো কিনা — এ সমস্ত জিজ্ঞেস করেছেন। স্থানীয় স্বাস্থ্য দপ্তর থেকে কয়েকদিন ফোনে খবর নিয়েছেন। জেলাশাসকের দপ্তর থেকেও একদিন ফোন এসেছিল। এদের প্রত্যেককে এই সুযোগে ধন্যবাদ জানাই।
আর বিশেষ ভাবে বলতে হয় আত্মীয়-বন্ধু, পাড়া-প্রতিবেশী, সহকর্মী-সহযোদ্ধা, ছাত্র-ছাত্রী, অভিভাবক-অভিভাবিকা, স্বজন-শুভানুধ্যায়ীর কথা। করোনা সংক্রমণের প্রথম দিন থেকে আমাদের দেশে এক ভয়ঙ্কর সংকট তৈরি হয়। তা হলো রোগী এবং রোগীর পরিবারকে সামাজিকভাবে বয়কট করা। একঘরে করে দেওয়া। যেন তাদের ছায়া মাড়ালেও অন্যেরা সংক্রমিত হয়ে পড়বেন। ইদানিং এ প্রবণতা একটু কমলেও সমস্যাটা কিন্তু আছেই। আমার অভিজ্ঞতা কিন্তু একেবারে বিপরীত। খবরটা শোনার পরে ফোন এবং হোয়াটসঅ্যাপ মারফত বেশ কয়েকজনকে জানিয়েছিলাম। প্রধান কারণ ছিল ইতোমধ্যে যাঁরা আমার সংস্পর্শে এসেছেন তাঁদেরকে জানানো। তারপর থেকে প্রচুর মানুষ ফোন করে পাশে থাকার আশ্বাস দিয়েছেন। সাহস যুগিয়েছেন। আমাকে এবং আমার পরিবারকে। পাড়ার প্রায় প্রত্যেকটি বাড়ি থেকে ফোন করে বা আমার বাড়ির সামনে এসে ডাক দিয়ে সঙ্গে থাকার বার্তা দিয়ে গেছেন। শুধু বার্তা দেওয়াই নয়, সত্যিই সঙ্গে ছিলেন। বাজার করা হোক বা মুদিখানার জিনিস, মেয়েদের পড়াশোনা সংক্রান্ত প্রয়োজন হোক বা সাংসারিক খুঁটিনাটি — কোনকিছু নিয়েই কোন সমস্যা হয়নি এই সতেরো দিন। সহমর্মী অনেকেই বাইরে থেকে দেখা করে গেছেন। ইচ্ছে করেই কারো নাম উল্লেখ করছি না। অবধারিত ভাবে সেক্ষেত্রে কারো কারো নাম বাদ পড়ার সম্ভাবনা থেকে যায়। আন্তরিক ধন্যবাদ ও কৃতজ্ঞতা জানাই সবাইকে।
এখন মোটামুটি সুস্থই বলা যায়। আর কয়েক দিনের মধ্যে দুর্বলতা পুরোপুরি কেটে যাবে বলে মনে করছি।
(ক্রমশ)
▪পুনশ্চ : গুপী গাইন বাঘা বাইন সিনেমার শেষ দৃশ্যে হাল্লা রাজার “ছুটি ছুটি” বলে চিৎকার করে রাজপ্রাসাদ ছেড়ে বেরোনোর সেই বিখ্যাত দৃশ্য মনে পড়ে গেল। স্ক্রিনশটটা দিয়েই দিলাম।