একবছর আগে
সারাদিন বড় শ্রম হয়েছে| সন্ধ্যে শেষে ফিরছিলাম দমদম স্টেশন দিয়ে| রেলস্টেশনের বাজারে শীতের ফল ফুল থরে থরে সাজানো| বিক্রেতারা দাম হাঁকছে| ক্রেতারা চেঁচাচ্ছে| দরদস্তুর করছে| সস্তা দামে সরেস ফলটি লুফে নিয়ে হাসতে হাসতে ছুটছে বউ বাচ্চার কাছে| স্বপ্ন —সন্তানসন্ততি ফল চুষে তৃপ্ত হবে, পুষ্ট হবে| স্টেশনবাজার তখন আমার ভরাকলসির স্বপ্নবাজার|
এরই মাঝে সেদিন সবচেয়ে হাসিমুখ ফলওয়ালি গভীর ঘুমে কাত| যুবতী অঙ্গগুলো ছড়ানো এলোমেলো| মানুষের ভিড়ে যে কোনো মুহূর্তে চেপ্টা হয়ে যেতে পারে তার ফ্যাকাশে ফর্সা পা হাত| তবু দেখো — ক্রেতাকে নস্যাৎ করে আপন পসরা সাজিয়েও কেমন বেমক্কা ঘুম মারছে ফলবতী! অন্যদিন কত হাসে আমার পানে চেয়ে| এত হাসে যে আমি বলি —-ওরে হাঁস প্যাকপ্যাক করে হাসিস না আর| ক্রেতা পাশ কাটাবে তোর ঘন হাসিতে| ভাববে, বিক্রিতে খেয়াল নেই তোর| হাঁস হেসে বলত —-কোটার বিক্রি শেষ হলে নয় হাসি পায় নয় ঘুম পায় গো দিদি| কিছুতে অনেক বিক্রিতে মন দিতে পারি না| সেদিনও ভরাবাজারে তার ঘুম দেখে নিশ্চিত হলাম —নিজের হিসেব মত বিক্রির কোটা তার শেষ| বুঝতাম ফলবতী আমার বড়ো confident —সরেস ফলও আনতো — বিকোতও প্রচুর এবং দ্রুত| নিত্য হাসতে হাসতে রেলগাড়িতে ফিরত| সেদিন কেন জানি –তার ঘুমন্ত গোমড়া মুখ এতো লোকের মাঝে আমাকে কেমন একা করে দিয়েছিল| একেবারে হঠাৎই| খুব একা — বন্ধুর হাসি না দেখে| সেই বোধহয় তার সাথে শেষ দেখা|
বাড়ি ফিরলাম| খানিক রাঁধলাম বাড়লাম| তারপর সেই দুখী মনটাকে নিয়ে লন্ড্রি চললাম| কাঁধে শাড়ি ভর্তি বিশাল ব্যাগ| সাইজে বড় বলে, বেড়াতে যাওয়ার ব্যাগেই নিয়েছিলাম লন্ড্রির কাপড়| বড় বড় শ্বাস নিচ্ছি| মাঝপথে ধেয়ে এল সব্জিওয়ালা| আমার আরেক মহব্বতের মানুষ| নাম –কোকিল কিংবা দিলরুবা| একমাত্র রোজগেরে ছেলেটার রক্তমাখা শরীর পুড়িয়ে দুদিন পর যে হাসতে হাসতে হিন্দি গান ধরে খরিদ্দারের সাথে, তার তো ওমন নামই হবে বলুন? যে কথা হচ্ছিল —- হাঁফাতে দেখে আমার ব্যাগখানা জাপটে ধরে সে বললে —এত শাড়ি নিয়েছেন কেন? অনেকদিনের জন্য যাচ্ছেন নাকি? -কোথায় যাচ্ছেন? এতদিন কী করবেন সেখানে? -এত রাতে —? আমাকে যেতে দেখে কী উদভ্রান্ত প্রেম রাস্তার ধারে বসে থাকা এক বিক্রেতার! ভাবছিল —দিদি যাচ্ছে না –দিদি চলে যাচ্ছে| হাতখানি আমার পেঁচিয়ে ধরেছিল মহব্বতী সব্জিওয়ালা| উত্তরের অপেক্ষাও নেই| শুধু প্রশ্ন আর প্রশ্ন| আমার চলে যাওয়ায় লুকোনো ত্রাস ফুটছে| মনের মধ্যে থাকে যে চোখ, সেই চোখে| টগবগ| টগবগ| আমার যাওয়া না যাওয়ায় এতো চিন্তা কখন জমল তোর ভাই ওরে, আর কেমনে যাই?
★★★★
দিন সাতেক আগে —
কষ্ট হচ্ছিল ফলবতী হাঁসের জন্য| কাউকে না বলে অটো করে গিয়েছিলাম দমদম স্টেশনে| নাহ! ট্রেন চালু হবার পরও আসেনি| ফলের ঝুড়ি বসানোর জায়গায় পুরু ধুলো| কোন জায়গায় যে তার বসার ছোট বালিশ রাখত, টিফিন বাক্স সমেত থলিটা নামিয়ে রাখত– কেন চিনতে পারি না আমি? সেকী চিহ্ন হারিয়ে গেছে বলে? আর আমার কোকিল? সে তো আছে আমার বাজারে| এখনো সবজির পসরা নিয়ে আসে সে| তবে ডাকেও না –গায়ও না| চেনেই না আমাকে| বাঁচবে বলে শুধু বেচে যায় ক্ষিপ্র| ফসল উৎপাদনে ঘাটতি নেই তবু সবজির দাম কেন চড়া তা নিয়ে মাঝে মাঝে টুকরো আর্তরব কেবল শোনা যায় প্রিয় ফসলকুমারের গলায়| এত মৃদু যে বুঝতেই পারি না কোকিল কাঁদছে নাকি দিল হারিয়েছে দিলরুবা?
এরপর মেলা হবে —
কত যেন সংখ্যাটা ঘোষণা করলেন সরকার? ১৭৯? আরে বলুন না পঞ্চাশহাজারের পুজোর পর এবার মেলার exact সংখ্যাটা কী? সেখানে পিঠে হবে|
পুলি হবে ক্ষীর কিংবা গুরমাখা নারকেল পুর দিয়ে|
ইলিশ রাঁধার কম্পিটিশন হবে|মহামান্য নাগরিকরা খাবেন আর শাড়ি পাঞ্জাবির চ্যালেঞ্জ খেলবেন|
আপত্তি করব কেন ভাই? জীবন যাদের কাছে চ্যালেঞ্জ তাদের তো কোনো খবরই দিতে পারলাম না আপনাদের| দেখছেন না –আমার mentally challenged বাচ্চাগুলোও হারিয়ে যাচ্ছে| আমার কোল থেকে — স্কুল থেকে লক্ষযোজন দূরে চলে যাচ্ছে তারা?
আপনি কেন সময়কে বৃথা হতে দেবেন ভাই?
খেলুন —| আরে মজা লাগবে –খেলুন|
শাড়ি কোট এবং last of all পিওর লেদার কাবুলি কিংবা চপ্পল মারামারির খেলা|আরে ওই ওই লেংগী লেংগী খেলা আর কী|
দুটো অনুরোধ —
রসালো খেলার নাম কখনো ভুলবেন না আর খেলতে একদম লজ্জা পাবেন না| কেমন?