আমার ইশকুল বেলা পালটে পালটে পাঁচ পাঁচ খানা বিদ্যালয়ে ছড়ানো। কোনওটিতে এনসিসি ছিল না।
এর পর কলেজ।
প্রথম কলেজ বেলুড় রামকৃষ্ণ মিশন বিদ্যামন্দির। সে’খানে প্রথম এনসিসি। সেনা বাহিনীর কেতা মাফিক সেই বুক চিতিয়ে দাঁড়ানো, প্রথা মাফিক সাবধান বিশ্রাম, লেফট রাইট, তেইজ চল, ডাহিনা বাঁয়ে কিম্বা পিছে মুড়। আর মাঝে মাঝে জাস্ট ঊর্ধ্বতন ক্যাডেট কয়েক পা দৃপ্ত ভাবে এগিয়ে আরও ঊর্ধ্বতন কাউকে(অধিকাংশ ক্ষেত্রেই তিনি অছাত্র) চেঁচিয়ে কী সব প্রায় দুর্বোধ্য কথা (হিন্দিতে অবশ্যই) নিবেদন। সপ্তাহে একদিন। কয়েক মাস পরপর কিঞ্চিৎ মজুরিও জুটত এই কসরতের জন্য। একবার দু’বার থ্রি নট থ্রি রাইফেল সহযোগে টার্গেট প্র্যাক্টিসও হয়েছিল খটাখট শব্দ করে। ম্যাগাজিনে পাঁচটা বুলেট থাকত।
সেই থেকে মেলায় গেলেই এয়ার গানে বেলুন ফাটানো বাল্যকালাবধি অপচেষ্টার ইতি ঘটে। বুঝে যাই, আমি আছি বঞ্চিতের হতাশের দলে।
এ’খানে একটা জিজ্ঞাস্য আছে আমার। প্রতিবেশী বাংলা দেশে এনসিসি না থাক কিন্তু সেনা প্যারেডের এই সব কম্যান্ড কি বাংলায় দেওয়া হয়? বাংলাদেশী পাঠক কেউ জানালে জ্ঞান বাড়ে।
যাই হোক, কাহিনীতে ফিরি। এই প্রকরণের মধ্যে দিয়ে আমি বৎসরান্তে একটি প্রোমোশনও পেলাম। যদ্দুর খেয়াল হয়, ল্যান্স নায়েক।
তারপর মেডিকেলে চান্স পাই। মেডিকেল কলেজে। পুরোনো ভালোবাসায় ক্লাসমেটদের মধ্যে আর কেউ ছিল কিনা মনে পড়ে না, আমি নাম লেখালাম বাইশ নম্বর বেঙ্গল ব্যাটালিয়নে। জামা প্যান্ট বেল্ট জুতো নাম সই করে সাড়ম্বরে রিসিভ করলাম। প্যারেডে গেছিলাম মোটে একদিন। সহ ক্যাডেট ছিলেন ন্যাশনাল মেডিকেল কলেজের গৌতম দা’। গৌতম ব্যনার্জি। নামকরা সাইকিয়াট্রিস্ট।
বেলুড়ে প্যারেড হত নিজেদের খেলার মাঠে। এ’খানে প্যারেড হবে ময়দানে। পাড়ার ডোবা থেকে পুঁটি মাছটির যেন বঙ্গোপসাগরে পড়ে খাবি খাওয়ার উপক্রম। প্রথম দিনেই নিজের প্রাক্তন ল্যান্স নায়েকগিরি জাহির করতে গিয়ে কর্তাদের বিষ নজরে পড়লাম। শাস্তি বাবদ দৌড়টৌর সেরে অভিমানাহত বত্রিশ ইঞ্চি মফস্বলি বুকের ছাতি প্রায় বাইশ ইঞ্চিতে হ্রাসপ্রাপ্ত।
ফিরেই ডিসিশন আর নয়। বন্ধুরাও বোঝালো…
প্যারেড সাধনে মৃত্যু সে’ তোমার নয়, অসংখ্য কুকীর্তি মাঝে মহানন্দময় লভিবে মৃত্যুর সাধ, ইত্যাদি।
আমি ভাবলাম নাটক শেষ। ভুল ভেবেছিলাম। যবনিকা আবার উঠল ছয় বছর বাদে। ঊনআশি সালের শেষ দিকে। হোস্টেলে বাবার চিঠি এল। মা বাবা তখন মুর্শিদাবাদের সালারে। বাবা আবার চিঠি দিতেন রিপ্লাই পোস্টকার্ডে, যাতে নয়নমণি পুত্রের উত্তর দেওয়াটা আংশিক গ্যারান্টেড হয়।
‘…. বাড়িতে স্থানীয় থানা হইতে পুলিস হানা দিয়াছিল। তাহাদের কথা অনুযায়ী কাজ না করিলে আমাকে পুনরায় এত্তালা করিবে এবং সম্ভবত তোমাকে গ্রেপ্তার করিবে। জানি না আমাকেও করিবে কিনা। অতএব তুমি অবিলম্বে সরকারি মাল তোশাখানায় জমা করিয়া পারিবারিক ভুলুণ্ঠিত সম্মান পুনরুদ্ধার করিবে।’
চিঠি পড়ে আমার আক্কেল গুড়ুম। বাড়ি ফিরে বাবাকে আশ্বস্ত করে এলাম।
ব্যাপার কী? সেই যে আধ যুগ আগে দু’সেট খাকি জামা প্যান্ট মোজা আর এক জোড়া মোজা ও জুতো, একটি টুপি পিতলের ব্যাজ ও রঙিন পালকসহ, সই করে নিয়েছিলাম।
সরকার বাহাদুরের তরফে এনসিসি ডিপার্টমেন্ট হাতের কাছেই মেডিকেল কলেজেই আমি, অথচ সেই আমার খোঁজটি মাত্র না করে বাড়ির ঠিকানায় থানাপুলিশ করেছে।
আমার তো মাথায় হাত। কিছুই নেই। হয় তো থাকলেও থাকতে পারত। কিন্তু সঙ্গগুণে সবই অবলুপ্ত। ব্যাপার হল, আমার বন্ধু আর জুনিয়র চেলা Rafi এবং আমি দু’জনেই পালা করে পরে সে’সব কবেই ছিঁড়ে ফেলেছি। রফিকে কত বলতাম। সে বারণ না শুনে ওই মিলিটারি মোজা পায়ে দিয়ে চটি না পরে বাথরুমে যেত।
তখনও কলকাতায় শীতকালে শীত পড়ত। গরমজামাহীন আমরা দু’জন সেই খাকি ফুলহাতা জামা আর ফুলপ্যান্ট পরে কাটিয়েছি কত না শীতার্ত দিন রাত। ধোয়াধুয়ির বালাই ছিল না, বলাই বাহুল্য। জামাকাপড় ধোয়ার ব্যাপারে আমার আর রফির, শুধু আমাদের কেন হোস্টেলমেট অনেকেরই একটা থিয়োরি ছিল। জামাকাপড়ের ময়লা হয় মূলত দু’রকমের। ভোলাটাইল… মানে উদ্বায়ী। আর অনুদ্বায়ী … পেনিট্রেটিং।
তো আমরা চূড়ান্ত ময়লা জামা কাপড় না কেচে দু’তিন মাস ফেলে রাখতাম। থিয়োরি অনুযায়ী উদ্বায়ী ময়লা উবে যেত, আর পেনিট্রেটিং ময়লা ঢুকে যেত সুতোর গভীরে। না ধোয়া সেই সব পরিধেয় আমাদের শ্রীঅঙ্গে ঝলমলাতো আবার।
আজ স্বীকার করতে লজ্জা নেই তখন আমাদের চামড়ার লোমকূপ আঁকড়ে বাস করত চাম-উকুন [(Pediculosis corporis) (Pediculosis vestimenti, Vagabond’s diseaseও বলা হয়) পিউবিক অঞ্চলের উকুন (Pediculosis pubis) (Crabs)]।
আমার ফেসবুকের বন্ধু তালিকায় আছে, নাম বলছি না, আমার সহপাঠী গা চুলকোচ্ছে বলে দেখাতে গেছিল প্রফেসর রঞ্জিত পাঁজাকে। তিনি তার ত্বক থেকে চিমটে দিয়ে সেই পোকা তুলে মাইক্রোস্কোপের তলায় রেখে তাকে দেখিয়ে ছিলেন। সেই রাক্ষস মতান্তরে এলিয়েন সদৃশ দানবকে দেখে আমার সেই বন্ধুর আউটডোরেই সটান পতন ও মুর্ছা ঘটেছিল। স্যার বলেছিলেন, ভিখিরি ভবঘুরেদের গায়ে থাকে বটে, কিন্তু এত থাকে না।
মূল কাহিনী থেকে সরে গেছি। কাহিনীতে ফিরি।
ওই রকম নির্বিচার ব্যবহার বেশ কিছুদিন সহ্য করার পর আমার সেই আধা সামরিক পোষাক আশাক সাধনোচিত ধামে গমন করেছিল। রফি বোধহয় ওই পাঁচকিলো ওজনের জুতো, তার আবার চামড়া দিয়েই তৈরি ফিতে, তা’ও পরেছিল পায়ে কিছু দিন। মোটমাট পুরোটাই সহমরণে গেছিল।
ইতিমধ্যে বাবার রিমাইন্ডার লেটার। দেওয়া আশ্বাসের কী হল?
আমি মেডিসিন আউটডোর লাগোয়া এনসিসি অফিসে ঘোরাঘুরি করে বুঝলাম ধরেকরে বা শাস্ত্রমতে মূল্য ধরে দিয়ে কিছু করা যাবেনা। ফেরত দিতেই হবে। অবশেষে তাঁদেরই একজন পরম দয়াপরবশ হয়ে হদিশ দিলেন।
কলাকাতাতেই রয়েছে চোরাবাজার(?) বলে ফুটপাথস্থ এক মার্কেট। আমি সম্ভবত রফিকেও সঙ্গে নিয়ে সেই বাজারে গিয়ে অবাক।
আসল নকল মিলিয়ে পুরোনো কুড়োনো জিনিসের অভাবিত সে’ এক বাজার। এত দিন কলকাতাবাসেও সেই সমুদ্রের খোঁজ পাইনি আমি। সেখানে তুচ্ছ এনসিসির জামাজুতো তো ছাড়, চাইলে মেজর জেনারেলদের কাঁধে লাগানো অপার্থিব সব তারকাও কিনতে পাওয়া যায়। যাই হোক, সে’খান থেকে আইটেম মিলিয়ে লুপ্তধন কিনে পরের দিনই ফেরৎ দিয়ে অভিশাপ মুক্ত হয়েছিল তৎকালীন সমর অভিলাষী আত্মবিশ্বাসহীন এক আদ্যন্ত বেকুব যুবক।
সেই হারানো টুপির রঙিন পালকটি এখনও তার ভীরু স্বপ্নে উড়ে আসে কখনও কখনও।