টমির নাম টমি ছিল না। এমন কী তার ছোটো বেলার বাড়ি বা পাড়ার ডাকনামও সন্তু বা বিলু এই গোছের কিছু ছিল হয় তো। কিন্তু শ্রীমান সমীর সান্যাল স্কুলে পৌঁছে বিনা আয়াসে টমি হয়ে গেল।
সেই সুদূর অতীতে তার জিভের একটু আড় ছিল। কথা পরিষ্কার করে বলতে পারত না। নাম জিজ্ঞেস করলে বলত, আমার নাম ট্রী টমির টান্যাল। সেই থেকে বিদ্যালয়ের ছাত্রমহলে তার ডাকনাম হয়ে গেল টমি। আর এই জাতীয় ডাকনাম, সবাই জানে যত প্রতিবাদ করা যায় ততই চেপে বসে। টমির প্রতিবাদ সত্ত্বেও কাজেই সে সমীর থেকে সর্বজনবিদিত টমি হয়ে গেল।
ওই একই স্কুল থেকে ওরা ছ’জন একসাথে মেডিকেল কলেজে ঢুকেছিল আমাদের ব্যাচে। তো ওর সেই পুরোনো বন্ধুরা ওকে টমি বলে ডাকাডাকি করতেই আমরা মানে নামকরা ওঁচারা এক্কেবারে লুফে নিলাম নামটা। টমি, যথারীতি এ’বারও প্রতিবাদ করেছিল। লাভ হল এই যে ক্লাসের মেয়েরাও জেনে গেল আর অভ্যেস করে ফেলল ওর এই নামটা।
টমি মাঝে মাঝে আমার কাছে দুঃখ করে বলত,
ধ্যাৎ নাম দিবি দে, তাই বলে কুকুরের নাম?
আমি সান্ত্বনা দিতাম, আহা কুকুর বলে কি মানুষ না। তা’ ছাড়া ভেবে দ্যাখ্, এলেবেলে নয়, সাহেব কুকুর।
ভারি সরল, মজলিশি ছেলে ছিল আমার এই বন্ধুটি। আগেই হয় তো অনেকটাই জানতাম তবু পরে জানা বহু সাব অল্টার্ন গালাগালি এই টমির কাছে শেখা।
সে বুঝেও বুঝতে চাইতই না এই কথাগুলি সবার সামনে ব্যবহার্য নয়। মেয়েদের সামনে এমনকি একটু জুনিয়র স্যারদের সামনেও সে অনায়াসে সেই সব আপাত অশ্লীল কথা অক্লেশে বলে ফেলত। আর ওর দিলখোলা স্বভাবের জন্য কেউ কিছু মনেও করত না। ও’র এই ব্যাপারটা পরিচিতরা একরকম মেনেই নিয়েছিল শেষমেশ।
অনেক প্যারোডি গান জানত আমাদের টমি।
তার মধ্যে খুবই আবেগ দিয়ে ‘পুরানো সেই দিনের কথা’-র সুরে একটা প্যারোডি ও প্রায় নিজের সিগনেচার সং বানিয়ে ফেলেছিল।
সেই গানের কথাগুলো, ফেসবুক বন্ধুদের কাছে যথাসম্ভব শ্লীলভাবে পেশ করছি। অনেকে বিশেষ করে প্রাক্তন হোস্টেলবাসীদের অনেকে হয়তো গানের কথাগুলো জানেনও।
সব পাঠকের কাছে, বিশেষ করে মেয়েদের কাছে অগ্রিম ক্ষমা ভিক্ষা করছি।
রবীন্দ্রনাথের কাছে ক্ষমা চাওয়ার প্রশ্নই নেই। তিনি এই সব তুচ্ছ পার্থিব আবিলতার অনেক ওপরে এক আলোকময় অস্তিত্ব।
টমির গানের গলা বেশ ভালো ছিল। সে গলা ছেড়ে টেবিল বাজিয়ে গাইত,
– কে যায় বাছা, দুলিয়ে পাছা, উদাস করে মন
ও তার বুকের ওপর আপেল জোড়া … তলায় বৃন্দাবন।
আমাদের এই গান গাইবার সাহস ছিল না। গ্রামের ভীরু হরমোনতাড়িত ছেলেরা বিভোর হয়ে শুনতাম শুধু টমির গাওয়া গান আর তাল মেলাতাম।
আমি যখন প্রেমে পড়লাম শ্রীমতী সুনন্দার, সে তথাকথিত সুন্দরী মোটেই ছিল না। এই এখনকার মতই পৃথুলা আলুভাতে টাইপের চেহারা। ক্লাসের অনেকেই আড়ালে ঠোঁট বাঁকিয়েছিল হয় তো। কিন্তু আমিই বা চেহারায় কোন কার্তিক!
একমাত্র টমিই বলেছিল অসঙ্কোচে, যাক বাবা, ক্লাসের একটা মেয়েরই বিয়ে হবে না ভেবেছিলাম। অরুণাচল গতি করে দিল।
সমীর পরবর্তী কালে মস্ত চোখের ডাক্তার হয়েছে।
টমির সাথে আমার শেষ দেখা, বছর পনেরো আগে সার্ভিস অ্যাসোসিয়েশনের মিটিংএ।
সে’খানে সুনন্দাকে দেখে টমি আবার অসঙ্কোচ।
আরে স্শালা, সুনন্দাকে দেখতে কী লাগছে রে! তুইই তো জিতে গেলি অরুণাচল।
তার আক্ষেপে বুঝলাম, বন্ধুর তন্বী জীবনসঙ্গিনী, সুনন্দার সাইজ অতিক্রম করে বয়া আকৃতি ধারণ করেছে। বৃত্ত সম্পূর্ণ হল।
এই বার ডাক্তারের কথা বলি।
তারও অন্য একটা ভারি রাশভারী নাম ছিল। সত্যেন্দুবিকাশ। সেই উনিশশ’ একাত্তরে আমাদের সময়ে এগারো ক্লাশের হায়ার সেকেন্ডারি পাশ করে ডাক্তারি পড়তে ঢুকতে হত বলে একটা অর্থহীন বছর নষ্ট করা হত প্রিমেডিকেল বলে একটা কোর্স পড়িয়ে। পড়ানো হত প্রেসিডেন্সি, মৌলানা আজাদ, গুরুদাস,আর মেয়েদের জন্য বেথুন ইত্যাদি কলেজে। তা’তে ডাক্তারি এমনকি মানবদেহ সংক্রান্ত কিছুই না পড়িয়ে পড়ানো হত ইংরেজি বাংলা, ফিজিক্স কেমিস্ট্রি ইত্যাদি।
তখন আমরা না ঘর কা না ঘাট কা। কাজেই মেডিকেল কলেজ হোস্টেলে ঢুকবার ছাড়পত্র পেতাম না গ্রাম থেকে আসা ছাত্ররা। প্রেসিডেন্সিতে প্রিমেডিকেল পড়ার সূত্রে সত্যেন্দুবিকাশ জায়গা পেয়েছিল হিন্দু হোস্টেলে। হিন্দু হোস্টেলে ঠাঁই পেয়েছিল শিবু আশিস কেশব আরও অনেকেই। কিন্তু ওরা ঝাঁক বেঁধে থাকত একই ব্লকে। সত্যেন্দুর ব্লকে ও ছিল একমাত্র ডাক্তারির ছাত্র।
অবধারিতভাবে সেই ব্লকের অন্য ছাত্ররা সিনিয়র জুনিয়র সবাই মিলে ও’কে ডাক্তার বলে ডাকা শুরু করল। ও আপত্তি করেছিল। তার পরিণতিতে নামটা স্থায়ী হয়ে গেল শুধু নয়, অন্য ডাক্তারি পড়া ক্লাসমেটরাও ওকে এই নামে ডাকা অভ্যেস করে ফেললাম। অনেক পরে, তখন সত্যেন্দু ডাকাবুকো সিনিয়র হাউসস্টাফ, স্পষ্ট মনে আছে এক দুই বছরের ছোট সদ্য পাশ করা ছেলেমেয়েরাও ওকে ডাক্তারদা’ বলে ডাকছে। অথচ কী আশ্চর্য যারা ডাকছে তারাও কিন্তু তখন ডাক্তার।
মেডিকেল কলেজের প্রথম বছরগুলোতে আমরা যারা মফসসলের, একটু আলাদা থাকতাম ইংরিজি মাধ্যম থেকে আসা ছেলেমেয়েদের থেকে। আবার আমাদের মধ্যেও ছিল দু’রকমের ছেলে। এক দল ছিলাম তিলে খচ্চর। তা’দের মধ্যেও শিবু আশিসরা ছিল অন্যদের থেকে হয়তো বা একশ’ গুণ বেশি মেধাবী। শিবু তো একদম শেষে ক্লাসে ধারাবাহিক ভাবে ফার্স্ট হতে বাধ্য হল।
ডাক্তার কিন্তু ছিল অত্যন্ত টিমিড ছেলে। ভদ্র বিনীত শুধু নয়, সদা সঙ্কুচিত। মনে পড়লে লজ্জা হয় এখন, সেই সেকেণ্ড থার্ড ইয়ারে, আমার বলা দুষ্পাচ্য কবিতার লাইন, আমি বিছানায় শুয়ে ডিকটেশন দিচ্ছি, আর নিরপরাধ ডাক্তার মাথা গোঁজ করে ডিকটেশন নিচ্ছে। তাকে দিয়ে এই কাজটা করানো হচ্ছে বন্ধুত্বের দাবীতে। যেন আমি স্বয়ং রবীন্দ্রনাথের সমকক্ষ কেউ। আর ডিকটেশন নিচ্ছে, ভক্তজন।
ক্ষমাহীন সেই সব অপরাধের জন্যই হয় তো সঠিক অর্থে কাব্যদেবী আমার কাছে কখনও এলেন না।
ডাক্তার এখন সত্যিই মস্ত ডাক্তার। কিন্তু এ’টাও আমার নিয়তি যে সে সময়ের খুব বন্ধুদের সাথে আমার কোনও যোগাযোগ নেই। অথচ তখন সব সময় কাছাকাছি থাকতাম।
সেই রকমই এক সঙ্গে ময়দানের বইমেলায় গেছি আমি আর ডাক্তার।
মাইকে গিটারের রবীন্দ্রসঙ্গীতের সুর মিশে যাচ্ছে গোধূলিতে। ডাক্তার, আমাদের অতি ভদ্র লাজুক ডাক্তার, আমার হাত চেপে ধরল। অরুণাচল, শিগগিরি এ’খান থেকে ফিরে চলো। এই জায়গা ভালো না।
আমি অবাক হয়ে তাকালাম, কেন, কী হল?
বিপন্ন ডাক্তার বলল, ওই শোনো, টমির ওই খারাপ গানটা বাজাচ্ছে এরা।
শুনলাম, ময়দানে ভাসছে গিটারের সুর, পুরানো সেই দিনের কথা…
অপাপবিদ্ধ , শহুরে চাতুরী না বোঝা, আগে রবীন্দ্রসঙ্গীত না শোনা, গ্রামের ছেলে ডাক্তার শুনতে পাচ্ছে টমির গাওয়া -কে যায় বাছা… ইত্যাদি।