(পূর্বপ্রকাশিতের পর)
শ্বেতীর এই খামখেয়ালি আচরণ মাথায় রেখেও বলছি, অনেক ক্ষেত্রে দেখা যায় থমকে গেছে অসুখটা। বাড়ছে তো না-ই, এমনকী বহু চিকিৎসায় আর কমছেও না। কোনো নতুন দাগ হচ্ছে না, যে দাগটা বা দাগগুলো আছে সেগুলোও আর আয়তনে বাড়ছে না, কেটে-ছড়ে গেলেও, সে-জায়গাগুলো দিব্যি সেরে যাচ্ছে, সাদা না হয়ে।
লিউকোডার্মা
লিউকোডার্মা মানেই কিন্তু শ্বেতী নয়। অথচ শিক্ষিত সমাজে প্রায় অভিন্ন অর্থেই ব্যবহৃত হয় শব্দ দুটো। সাদা বাংলায় লিউকোডার্মা শব্দটার অর্থ সাদা দাগ। তা সে সাদা দাগ পুড়ে গিয়ে বা কোনো কেমিক্যাল (অ্যাসিড বা ক্ষার) লেগে হতে পারে, আবার জ্বর-ফোস্কা সেরে গিয়েও হতে পারে। কপালে লাগাবার বিন্দি বা টিপের আঠায় থাকা একটা রাসায়নিক থেকে কপালে সাদা দাগ হতে পারে। পায়ের চপ্পলের থেকেও হতে পারে সাদা দাগ। কোমরে শক্ত করে শাড়ি, ধুতি বা পাজামা বাঁধার জন্য সাদ দাগ হতে পারে। এগুলো সবই লিউকোডার্মার উদাহরণ। এগুলো শ্বেতী নয়।
এই পর্যায়ের শ্বেতীকে বলে স্থিতিশীল শ্বেতী। এর অর্থ হল ত্বকের রং কারখানায় আশেপাশে কোনো ‘স্টক’ নেই। রিজার্ভারেই যদি টান পড়ে, রঙের যোগদান দেবার একমাত্র উপায় হল আমদানি। কোথা থেকে আনা হবে রং? কীভাবে আনা হবে? সেটা জানতে হলে ত্বক-শল্য চিকিৎসা বা সহজ ইংরেজিতে স্কিন সার্জারির প্রসঙ্গে আস্তে হবে। জানতে হবে দু-চার কথা। প্রথমেই বলে রাখি, এটা প্লাস্টিক সার্জারির নয়, কস্মেটিক সার্জারিরও নয়। ত্বকের কিছু অসুখ, যেটা ওষুধে কমছে না, সেসব ক্ষেত্রে প্রয়োগ করা হয় এই বিশেষ ধরনের শল্য চিকিৎসা। এবং করে থাকেন ত্বক-বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকরাই। শ্বেতীর ক্ষেত্রে ত্বক-শল্য চিকিৎসায় খুলে গেছে এক নতুন আশার দিগন্ত।
যেখানে একেবারে প্রথমে বলা গল্পের ওই শৈবাল, সুদর্শন, শবনম বা রামেশ্বর প্রসাদের অসুখ সারিয়ে দেওয়া যায়।
ডার্মাব্রেশন কথাটার মধ্যে দুটো কথা আছে। এক, ডার্মা বা ত্বক এবং দুই, অ্যাব্রেশন বা ছড়ে যাওয়া। পরিকল্পিতভাবে চিকিৎসার উদ্দেশ্য করা এই ডার্মাব্রেশন পদ্ধতিটা অনেক দিন ধরেই পরিচিত ছিল চিকিৎসকমহলে। ১৯৬১ সালে স্ট্যারিকো প্রথম লক্ষ্য করলেন ডার্মাব্রেশন করা হয়েছে এমন ত্বকে, লোমের গোড়ায় ফলিকল থেকে রঞ্জক কোষ মেলানোসাইট ছড়াতে শুরু করছে এপিডার্মিস বা উপরি ত্বকে। ১৯৮৩ সালে সুজি আর হামাদা এই ডার্মাব্রেশনের সঙ্গে প্রয়োগ করলেন ৫-ফ্লুরোইউরাসিল নামে একটা ওষুধ। ফলও মিলল আশাপ্রদ।
রামেশ্বর রসাদের ঠোঁটের দাগের জন্য সেরা পদ্ধতি হল মাইক্রোপিগ্মেন্টেশন। একটা বিদ্যুৎ বা ব্যাটারিচালিত যন্ত্রের সাহায্যে অতি দ্রুত ঘূর্ণায়মান সুচের মাধ্যমে ত্বকের গভীরে প্রবেশ করানো হয় এক ধরনের রং। রাসায়নিকভাবে এরা আয়রন অক্সাইড। ব্যান্ডেজ লাগে না, রক্তপাত হলেও খুব সামান্য, সাদা দাগ সেরে যায় সঙ্গে সঙ্গেই। তবুও এ-পদ্ধতিটার কিছু সীমাবদ্ধতা আছে। যেমন শরীরে প্রবেশ করানো ওই রাসায়নিক রঙকে শরীর গ্রহণ নাও করতে পারে। অথবা প্রয়োজনের চেয়ে বেশি কালো বা নীলচে হয়ে যেতে পারে অংশটা। তবে তৎক্ষণাৎ ফল দেবার ব্যাপারে এই পদ্ধতিটা অপ্রতিদ্বন্দ্বী।
ত্বক-প্রতিস্থাপন বা স্কিনগ্রাফটিং-এর ব্যাপারটা বহু বছর ধরে চলে আসছে। শোনা যায় প্রাচীন ভারতেও এর প্রচলন ছিল। আর শ’দুয়েক বছর আগে (১৮০৪) ভেড়ার গায়ে করা পরীক্ষামূলক গ্রাফটিং তো লিপিবদ্ধ ইতিহাস। তারপর বহু পরীক্ষা-নিরীক্ষা। ১৮২৩-এ এল প্রথম অটোলোগাস গ্রাফটিং। অর্থাৎ নিজের শরীরের ত্বক নিজের শরীরে অন্য অংশে প্রতিস্থাপন।
এই ত্বক-প্রতিস্থাপন ব্যাপারটার সঙ্গে জড়িয়ে আছে কার্ল থিয়ার্শ এবং ওলিয়ের-এর নাম। আলাদা আলাদাভাবে এঁরাই প্রথম স্প্লিট থিকনেস গ্রাফটিং সফলভাবে করতে সক্ষম হন উনিশ শতকের শেষদিকে। এই পদ্ধতিতে উপরি-ত্বক (এপিডার্মিস) এবং অন্তঃ-ত্বক (ডার্মিস)-এর কিছুটা প্রতিস্থাপন করা হয় প্রয়োজনীয় অংশে। তবে শ্বেতীতে ত্বক-প্রতিস্থাপনের ব্যাপারে পথিকৃৎ কিন্তু ভারতীয় ত্বক-বিজ্ঞানী ডাঃ প্রাণনাথ বেহল। তিনি সেই গত শতাব্দীর ষাটের দশকের প্রথম দিকে মেডিক্যাল চিকিৎসায় অ-ফলপ্রসূ এমন শতাধিক রোগীর দেহে ওই থিয়ার্শ-ওলিয়ের গ্রাফটিং করে সাড়া ফেলে দেন। কারণ প্রতিস্থাপিত ত্বক যে রং প্রতিস্থাপনেও সাহয্য করতে পারে, সেই ধারণাটা জোরালো হয়ে ওঠে ডাঃ বেহলের গবেষণাকাজে।
পরবর্তী দশক-গুলোতে ঢেউ ওঠে সাদা দাগ তথা শ্বেতীতে ত্বক-প্রতিস্থাপনের বিভিন্ন রকমের পদ্ধতি প্রয়োগের। খুলে যায় সম্ভাবনার নতুন দিগন্ত। অভিশাপের মতো এঁটে-বসা সাদা দাগকে সারিয়ে তুলতে বিশ্বজুড়ে চলতে থাকে বহু রকমের গবেষণা। ত্বক-প্রতিস্থাপনে ব্যবহৃত হতে থাকে সাকশন ব্লিস্টার পদ্ধতি। সাফল্য আসে তাতেও। অবেশেষে এল আজকের জনপ্রিয়তম পদ্ধতি পাঞ্চ গ্রাফটিং।
১৯৭২ সালে নরম্যান ওরেনট্রাইখ এক কৃষাঙ্গ অভিনেত্রীর চিকিৎসা করতে গিয়ে প্রথম এর প্রয়োগ করেন। ভদ্রমহিলার গালে তাঁর ছোটবেলায় কোনো একটা ত্বক-রোগের চিকিৎসায় ভিনিগারে ডোবানো একটা তামার পয়সা ব্যবহার করা হয়েছিল। ফল হয়েছিল ভয়াবহ। রাসায়নিক দহন (কেমিক্যাল বার্ন) হয়ে বিশ্রীভাবে পুড়ে যায় জায়গাটা। সেরে যাবার পর, থেকে যায় একটা সাদা দাগ।
ওরেনট্রাইখ ১ এবং ২ মিমি ব্যাসের পাঞ্চ ইন্সট্রুমেন্টের প্রয়োগে ন’টি গ্রাফট বসিয়ে দেন ওই সাদা দাগে। অচিরেই রং ফিরে আসে সেই সাদা দাগে। তৈরী হয় ইতিহাস। তারপর লাবুওনো, বোনাফে, ফ্যালাবেলা, ওয়েস্টারহফ, বোয়েরসমা—এমন বহু চিকিতসাবিজ্ঞানী ক্রমান্বয়ে উন্নত করে তোলেন পদ্ধতিটিকে। আলো ফেলে দেখেন এর বিভিন্ন দিকগুলোকে।
কীভাবে করা হয় পাঞ্চ গ্রাফটিং?
রোগী বা রোগিণীর শরীরের ঢাকা থাকে এমন কোনো অংশ, যেমন উরু বা পশ্চাদ্দেশ থেকে ছোট ছোট বৃত্তাকৃতি ত্বক পাঞ্চ যন্ত্রের সাহায্যে কেটে নেওয়া হয়। এই ছোট ছট গ্রাফটগুলো আসলে রং বা পিগমেন্টের যোগদান দেয় শ্বেতীগ্রস্ত অংশে। সেখানে ওই একই যন্ত্রের সাহায্যে তৈরি করে নেওয়া হয় ছোট-ছট বৃত্তাকার গর্ত। আর স্বাভাবিক অংশ থেকে কেটে-নেওয়া গ্রাফটগুলো বসিয়ে দেওয়া হয় ওই গর্তে। খাপে খাপে। এবং ধাপে ধাপে। ড্রেসিং থাকে দিন কয়েক। তারপর ড্রেসিং খুলে প্রতীক্ষার পালা। তিন-চার সপ্তাহের মধ্যেই প্রতিস্থাপিত গ্রাফটগুলো থেকে রং বা পিগমেন্ট ছড়াতে শুরু করে শ্বেতীর ত্বকের বেসাল স্তরে। খালি চোখে ধরা পড়ে রঙের এক-একটা ছোট ছোট বলয়। ধীরে ধীরে আয়তনে বাড়তে থাকে এই বলয়গুলো। মিশে যেতে থাকে একটা অন্যটার সঙ্গে। এইভাবে একদিন মিলিয়ে যায় শ্বেতীর সাদা দাগ। দুঃস্বপ্ন-শেষের ভোরবেলার মতো।
১০টা জরুরি কথা
- শ্বেতী মানেই সাদা দাগ, কিন্তু সাদা দাগ মানেই শ্বেতী নয়।
- শ্বেতী আদৌ ছোঁয়াচে নয়।
- শ্বেতীর সঙ্গে কুষ্ঠরোগের কোনো সম্পর্কই নেই।
- শ্বেতী সঙ্গে লিভারের অসুখের বা পেটের রোগের কোনো সম্পর্ক নেই।
- শ্বেতী হবার সঙ্গে খাদ্যাভ্যাসের কোনো সম্পর্ক নেই।
- শ্বেতীরোগী নির্ভয়ে টক,ঝাল, মিষ্টি খেতে পারেন।
- ভিটামিন-সি খাওয়া শ্বেতীতে নিষিদ্ধ নয়। দুধ খাওয়াও বারণ নয়।
- বাবা অথবা মায়ের শ্বেতী থাকলে সন্তানের যে শ্বেতী হবেই, তার কোনো মানে নেই।
- শ্বেতী শুরুতেই চিকিৎসা করান।
- বেশিরভাগ সময়েই ওষুধেই সারে শ্বেতী।
ত্বক শল্য চিকিৎসা শ্বেতীর চিকিৎসায় নতুন দিগন্ত খুলে দিয়েছে।
আরও পদ্ধতি
আজকাল ত্বকের এপিডার্মিস (যার মধ্যে থাকে রঞ্জক কোষ মেলানোসাইট) কালচার করা হচ্ছে। এবং ব্যবহৃত হচ্ছে শ্বেতীর চিকিৎসায়। আবার শুধু রঞ্জক কোষ কালচার করাও সম্ভব হয়েছে গবেষণাগারে, নতুন আশার আলো মিলছে সেখান থেকেও। আর ক্লোনিং? সেও তো সম্ভাবনার এক সোনার সিংহদুয়ার।
ভবিষ্যৎ
জেনেটিক ইঞ্জিনিয়ারিং মানবসভ্যতাকে কোথায় নিয়ে যাবে সেটা বলা সত্যিই মুশকিল। কল্পবিজ্ঞান আর বাস্তবের সীমারেখাকেই মুছে ফেলছে সে। ডায়াবেটিস, হাইপারটেনশন, ক্যানসার, হার্টের অসুখের মতো শ্বেতীও হয়তো একদিন নির্ভুল্ভাবে আটকে দেওয়া যাবে গর্ভস্থ ভ্রূণ অবস্থাতেই। পৃথিবী থেকে চিরদিনের মতো মুছে যাবে এই বর্ণহীন অভিশাপ। আসুন, সেই দিনের অপেক্ষায় জেগে থাকি।
চমৎকার লেখা। এ রোগটির সঙ্গে জড়িয়ে থাকে এক সামাজিক লজ্জাবোধ। আজকাল অনেকেই হয়তো জানেন, রোগটি ছোঁয়াচে নয়, কিন্তু শরীরের দৃশ্যগোচর জায়গায় সাদা দাগ নিয়ে ঘুরে বেড়াতে, ভুগতে থাকা মানুষ বেশ অস্বস্তি বোধ করেন। আবার ওষুধে দীর্ঘ চিকিৎসায় কারো কারো ধৈর্যচুতিও ঘটে। এমন একজনকে ব্যক্তিগত ভাবে চিনি। যিনি মাঝপথে ক্ষান্ত দিয়েছেন।
তাদের কাছে এই লেখাটি যথেষ্ট আশার সঞ্চার করবে।
Amer Mayer thik sai abostha.dr.lahirir patient.2017a last dekhano.bises Karone ar agote pari ni tokhon.akhon chai ses korte.settle abosthai ache dag guli.r bare ni.ai lekhata pore khub ichcha korche ar ses Korte.pl help me.
Vitiligo, psoriasis, eczimaতে হোমিওপ্যাথি ভরসা ।
Thanks so much for the blog post.
I like the valuable information you provide in your articles.
Hi there, after reading this amazing paragraph i am as well delighted to share my knowledge here with friends.
Thanks so much for the blog post.
আমার ছোট বোনের মুখে এই সাদা দাগটা আছে, যার জন্য ওর বিয়ে শাদী দেওয়া যাচ্ছে না। কিভাবে আপনাদের সাহাহ্য পেতে পারি। আমি বাংলাদেশ থেকে বলছি