“প্রথম পর্ব”
স্বাস্থ্যবিষয়ক যেকোনো সঙ্কটের মুহূর্তে, অর্থাৎ যেমম ধরুন মহামারী বা অতিমারীর সময়ে, পুরোনো বিতর্ক চাগিয়ে ওঠে – সে সঙ্কটের মোকাবিলা হবে কোন পথে? শুধুই আধুনিক চিকিৎসাবিজ্ঞান বা মডার্ন মেডিসিন, নাকি বাকি সব চিকিৎসাপদ্ধতিও – যাদের একত্রে আয়ুশ বলে ধরে নেওয়া হয় – যথাযথ গুরুত্বের সাথে বিবেচিত হবে? সাম্প্রতিক কোভিড পরিস্থিতিও ব্যতিক্রম নয়।
একটিমাত্র চিকিৎসাপদ্ধতিকেই আধুনিক চিকিৎসাবিজ্ঞান বলে দাগিয়ে দেওয়ার মধ্যে, নিশ্চিতভাবেই, একধরণের, উন্নাসিকতা রয়েছে – এর মধ্যেকার অন্তর্নিহিত বার্তাটিই নিজেদের শ্রেষ্ঠত্বের – কিন্তু, আজ সেই বিতর্কের মধ্যে ঢুকছি না। আয়ুশের অন্তর্গত সবকটি শাখাপ্রশাখা নিয়েও আলোচনা করব না – আজ কথা বলব শুধু হোমিওপ্যাথি নিয়েই।
কোভিড নিয়ে আতঙ্কের পরিস্থিতি উদ্ভূত হওয়ার আগেই দেশের সরকার বিশেষ একটি হোমিওপ্যাথি ওষুধকে প্রতিষেধক হিসেবে চিহ্নিত করেছিলেন – সেই চিহ্নিত করার ব্যাপারে সব হোমিওপ্যাথ একমত ছিলেন, এমনও নয়। যাঁরা ভিন্নমত ছিলেন, তাঁদের বক্তব্যের মূল কথা ছিল, হোমিওপ্যাথি ঠিক ওইভাবে সবার জন্যে একই ওষুধ একইভাবে কার্যকরী হবে সেকথা বলে না – এইধরণের পাইকারি সরকারি বিজ্ঞপ্তি হোমিওপ্যাথি চিকিৎসাদর্শনেরই বিপ্রতীপ – এবং, এই বিজ্ঞপ্তি যদি গরিষ্ঠসংখ্যক নাগরিক অনুসরণ করেন, তাহলে হোমিওপ্যাথি নিয়েই বিভ্রান্তি বাড়বে।
আবার, কোভিড পরিস্থিতি বেশ জাঁকিয়ে বসার মুহূর্তে দেখা গেল, সরকারবাহাদুর কেবলমাত্র আধুনিক চিকিৎসাবিজ্ঞান বাদে বাকি কোনোটিকেই বিন্দুমাত্র গুরুত্ব দিচ্ছেন না। থালা বাজানো বা পুষ্পবৃষ্টি – আয়ুশ চিকিৎসকদের উদ্দেশে কোনোটিই নয়। প্রধানমন্ত্রী যোগের মাধ্যমে রোগ ঠেকানোর বার্তা দিলেও বাকি শাখাগুলি নিয়ে কিছুই বলছেন না। স্বভাবতই, আধুনিক চিকিৎসাপদ্ধতির ডাক্তারবাবুরা বলছেন – তাহলে এত খরচা করে আয়ুশ ডাক্তার তৈরী করা যুক্তি কী?? অনেকে আরেকটু এগিয়ে বলছেন – এই তো, এবারে দুধ আর জল আলাদা হয়ে গেল!!!
হোমিওপ্যাথি পদ্ধতিতে চিকিৎসা করেন যাঁরা, তাঁদের একাংশ রীতিমতো বিরক্ত। তাঁদের বক্তব্য, তথাকথিত আধুনিক চিকিৎসাবিজ্ঞানে যখন এই অসুখের নির্ভরযোগ্য কোনো চিকিৎসা নেই, তাহলে হোমিওপ্যাথিকে একবার সুযোগ দেওয়া হচ্ছে না কেন? সঙ্কটকালে যদি সরকার হোমিওপ্যাথিকে অচ্ছুৎ করে রাখেন, তাহলে সে চিকিৎসার উপর মানুষ ভরসা করবেন কী করে!! এভাবে তো হোমিওপ্যাথি চিকিৎসাকে ইচ্ছাকৃতভাবে পিছন থেকে টেনে ধরে রাখা হচ্ছে!!!
কথাগুলো কোনোভাবেই অযৌক্তিক নয়।
তাহলে, হোমিওপ্যাথি নিয়ে যে প্রশ্নগুলো বারবার উঠে আসে – আসে মূলত আধুনিক চিকিৎসাপদ্ধতির চিকিৎসক-স্বাস্থ্যকর্মীদের দিক থেকে – এবং যুক্তিবাদী মানুষদের দিক থেকেও – সেই প্রশ্নগুলো ফিরে দেখা যাক।
এই লেখায় যে কথাগুলো বলব, সেগুলো মূলত হোমিওপ্যাথি চিকিৎসাদর্শন এবং তার পিছনে থাকা বিজ্ঞান বা বিজ্ঞানের অভাব নিয়ে – অন্তত, আধুনিক চিকিৎসাবিজ্ঞান শরীরবিজ্ঞান আর রসায়নের উন্নতির উপর ভর করে যে পথে এগিয়েছে – সেই দৃষ্টিকোণ থেকে হোমিওপ্যাথির মূলগত দর্শনকে দেখার চেষ্টা করব। উন্নত কোন দেশে হোমিওপ্যাথির রমরমা বাজার বা কোন দেশে হোমিওপ্যাথি নিষিদ্ধ বা রবীন্দ্রনাথ-বিদ্যাসাগর হোমিওপ্যাথির উপর ভরসা রাখতেন কি রাখতেন না – এসব গুরুত্বপূর্ণ বিষয় নিয়ে বিশদ আলোচনা এখানে থাকবে না।
প্রথমেই জানাই, আমি এলোপ্যাথি চিকিৎসক আর অন্য চিকিৎসাপদ্ধতি বিষয়ে খুব একটা বিস্তারে জানি না। আর, সেই না জানার জন্যেই, অন্যান্য চিকিৎসা পদ্ধতি বিষয়ে আমি সচরাচর খুব একটা কথাবার্তা বলতে চাই না। আজকে বলতে বসেছি, আধুনিক চিকিৎসাবিজ্ঞান এবং হোমিওপ্যাথির সঙ্ঘাত প্রসঙ্গে – হোমিওপ্যাথি বিষয়ে কোনো চূড়ান্ত ফয়সালা এই লেখার উদ্দেশ্য নয়।
অতএব, শুরুতেই ডিসক্লেইমার দেওয়া রইল, এ লেখা মূলত কান্ডজ্ঞান প্রসূত। কিন্তু, তা বলে ধরে নেবেন না, চায়ের দোকানে রাজাউজির মারার মতো আলটপকা মন্তব্যের সমষ্টি এই লেখা। শুরুতেই যে কথাটা বললাম – কান্ডজ্ঞান – কিন্তু, সেই কান্ডজ্ঞানের পেছনে বিগত দুই দশকের বেশী সময় ধরে মানুষের চিকিৎসার সাথে জড়িয়ে থাকার অল্পবিস্তর অভিজ্ঞতা এবং ওষুধপত্রের সাথে সাথে চিকিৎসকের কথাবার্তা বা রোগীর রোগপ্রতিরোধ ক্ষমতা ও মনের জোর নিরাময়ের ক্ষেত্রে কতোখানি গুরুত্বপূর্ণ, সেটুকু বোঝার এবং চাক্ষুষ প্রত্যক্ষ করারও সৌভাগ্য রয়েছে।
হোমিওপ্যাথি চিকিৎসাপদ্ধতি বা তার পিছনে যে বিজ্ঞান বা অবিজ্ঞান – সে নিয়ে আমার খুব বিস্তারিত পড়াশোনা নেই – অন্য একটি চিকিৎসাদর্শনের পাঠ আমি নিয়েছি – আমার দৈনন্দিন যাপন ও জীবিকা জড়িয়ে সেই চিকিৎসাপদ্ধতি ধরেই। সেইজন্যে, হোমিওপ্যাথি চিকিৎসাপদ্ধতির মাধ্যমে নিকটজনের অসুস্থতার তদারকি হবে, এইটা আমার কাছে সবসময় গ্রহণীয় নয়।
কিন্তু, সরকার পয়সা খরচ করে এই চিকিৎসাশাস্ত্র পড়ান, এই ব্যবস্থায় শিক্ষিত চিকিৎসকদের সরকারি স্বাস্থ্যব্যবস্থায় নিয়োগও করেন।
কাজেই, এই ব্যবস্থা যদি একেবারেই ভুল হয় বা ভ্রান্ত বিজ্ঞান হয়, তাহলে এর পেছনে অর্থব্যয় জাতীয় সম্পদের অপচয়। তাই না?
অতএব, বিতর্ক জরুরী।
দ্বিতীয়ত, কোনটা বিজ্ঞান, আর কোনটা নয়, সেই নিয়েও আমার স্পষ্ট ধারণা নেই – মানে, ঠিক কোনটি বিজ্ঞান হিসেবে গ্রহণযোগ্য আর কোনটি নয়, সে নিয়ে আমার ধারণা বেশ ভাসা ভাসা। কিন্তু, ওই যে, পপারের বিজ্ঞান-তাই-যাকে-ভুল-প্রমান-করা-সম্ভব অর্থাৎ ফলসিফায়েবিলিটি, সেই কথাটি আমারও মনে ধরে। তর্ক শুরুর আগে, কিছু সাধারণ সূত্র মেনে নেওয়া থাকে। এটিও তেমন। তাই, উদাহরণ দিই, জ্যোতিষশাস্ত্র আমার কাছে অবিজ্ঞান।
হোমিওপ্যাথির বুনিয়াদি ভাবনাগুলোকে ইতিহাস থেকে উৎপাটিত করে শুধু এখনকার প্রেক্ষিতে ফেলে দেখতে চাইলে কথাগুলো কতখনি প্রযোজ্য হবে, বলা মুশকিল – যদিও, ব্যক্তিগতভাবে আমার মতামত যদি জানতে চান, তাহলে বলি, এর অনেকগুলো কথা আজও সমান প্রাসঙ্গিক – হয়ত, এই বাণিজ্যমুখী চিকিৎসাব্যবস্থায় আরো বেশী করে প্রাসঙ্গিক – কিন্তু, আজ থেকে দুশো বছরেরও বেশী আগে, ইউরোপে স্যামুয়েল হ্যানিম্যানসাহেব হোমিওপ্যাথি চিকিৎসার যে গোড়াপত্তন করেছিলেন, সময়ের বিচারে, তা ছিলো, আক্ষরিক অর্থেই বৈপ্লবিক।
পাশাপাশি, এও মাথায় রাখা যাক, আজকের আধুনিক ডাক্তারবাবুরা হোমিওপ্যাথিকে যতখানিই অনুকম্পা বা বিরক্তির দৃষ্টিতে দেখুন না কেন, পরিস্থিতি চিরকাল এমন ছিল না।
আধুনিক চিকিৎসাবিজ্ঞানকে ঠিক আজকের রূপে পৌঁছে দেওয়ার ক্ষেত্রে যে কয়েকজন চিকিৎসকের নাম সর্বাগ্রে আসে – না, গবেষকদের কথা বলা হচ্ছে না – যে গবেষকরা অসুখের পিছনে শরীরবিজ্ঞানের ব্যাখ্যা বা জীবাণু খুঁজে আনেন, তার ওষুধ আবিষ্কার করেন, নিত্যনতুন পরীক্ষানিরীক্ষার পদ্ধতি বা যন্ত্রপাতি আবিষ্কার করেন, আমি তাঁদের কথা বলছি না – বলছি, যে চিকিৎসকরা চিকিৎসা করার মধ্যে দিয়ে এবং সেবিষয়ে অনুপুঙ্খ দৃষ্টিজাত মতামতের মধ্যে দিয়ে বদলে দিয়েছেন চিকিৎসার দর্শন – তাঁদের মধ্যে উইলিয়াম অসলার-এর নাম ভুলে যাওয়া অনুচিত হবে। সেই অসলার-কে উদ্ধৃত করেই আলোচনার সূত্রপাত হোক –
“Ask not what kind of illness the patient has, ask what kind of patient has the illness…..… No one individual has done more good to the medical profession than Hahnemann”
অর্থাৎ, রোগীর কী অসুখ হয়েছে, সেই প্রশ্ন নয় – জিজ্ঞাস্য হোক, ঠিক কী ধরণের রোগীর অসুখ হয়েছে। চিকিৎসাবিজ্ঞানের ক্ষেত্রে হ্যানিম্যানের চেয়ে বেশী উপকার আর কোনো একক ব্যক্তি করেননি।
কিন্তু, হোমিওপ্যাথির জনক হিসেবে স্বীকৃত স্যামুয়েল হ্যানিম্যান ঠিক কী বলেছিলেন? তাঁর মূল কথাগুলো যে বইয়ে ধরা আছে, আসুন, দেখি, হ্যানিম্যানসাহেব তাঁর সেই অর্গ্যানন অফ মেডিসিন বইয়ে কী কথা বলে গিয়েছেন।
সরাসরি ইংরিজিতেই উদ্ধৃত করলাম। নীচে আমার নিজের মতো করে ভাবানুবাদের চেষ্টা রইল।
Aphorism 1 : The physician’s high and only mission is to restore the sick to health, to cure, as it is termed.
চিকিৎসকের একমাত্র উচ্চাভিলাষ বা লক্ষ্য হওয়া উচিত, অসুস্থ মানুষকে সুস্থতায় ফেরানো – অর্থাৎ নিরাময়।
Aphorism 2 : The ideal cure is rapid, gentle, permanent and removes the whole disease in the shortest, least harmful way.
আদর্শ নিরাময় হবে – দ্রুত, এমন যাশরীরের পক্ষে মৃদু ও পীড়াদায়ক নয়, পাকাপাকি – অসুখ সম্পূর্ণ সারানো হবে সবচেয়ে কম সময়ে এবং সবচেয়ে কম ক্ষতিকর পথে।
Aphorism 3 : If the physician understands what is curable in disease, and understands what is curative in medicines, and understands how to apply the medicines to the disease, and knows how to remove conditions which prevent the patient from getting well, he is a true physician.
প্রকৃত চিকিৎসক তিনিই – যিনি জানবেন অসুখের কতটুকু নিরাময়যোগ্য, ওষুধের কতটুকু নিরাময়ের সহায়ক – যিনি জানবেন, এই অসুখে ওষুধ প্রয়োগ করা হবে কী করে এবং যিনি বুঝবেন, অসুস্থ মানুষটি ঠিক কোন কারণে সুস্থ হয়ে উঠতে পারছেন না।
Aphorism 4 : He is likewise a preserver of health if he knows the things that derange health and cause disease, and how to remove them from persons in health.
একইসাথে চিকিৎসক মানুষের সুস্থতা রক্ষার্থে ব্রতী – যদি তিনি জানেন, কী কী কারণে একজন মানুষ সুস্থতা থেকে অসুস্থ হন, কী কী কারণে রোগ হয় – এবং সেই কারণগুলো কীভাবে দূর করা যায়।
Aphorism 5 : Pay attention to the exciting cause AND the fundamental cause including the patient’s character, activities, way of life, habits, etc.
চিকিৎসার জন্যে অসুস্থতার প্রাথমিক কারণ এবং আপাত-কারণ, দুটিই নজরে রাখুন – প্রাথমিক কারণ বলতে রোগীর চরিত্র, দৈনন্দিন জীবনযাপন, ক্রিয়াকলাপ, অভ্যেস ইত্যাদি সবকিছু।
Aphorism 6 : There is no need for metaphysical speculation. Diseases are the totality of the perceptible symptoms.
দার্শনিক তত্ত্ব নিষ্প্রয়োজন – রোগী এবং চিকিৎসক, দুইয়ের সামনে যে উপসর্গগুলি দৃশ্যমান, সেগুলো একত্রেই অসুখ।
Aphorism 7 : To cure, you only need to treat the totality [NOT symptomatic palliation; a single symptom is not the disease].
নিরাময় করতে হলে, সমগ্রের চিকিৎসা হওয়া জরুরী। উপসর্গের উপশম কখনোই নিরাময় নয় – অসুখ বলতে একটিমাত্র উপসর্গ নয়।
(চলবে)
8 Responses
স্যার দারুণ হয়েছে শুরু টা। বাকি কিস্তিগুলোর অপেক্ষায়।
Bivash Saha চলুক
অপেক্ষায়…..
উপকৃৃৃত হলাম ৷ আগামী কিস্তি পড়ার অপেক্ষায় থাকলাম৷
খুবই উপভোগ্য উপস্থাপনা ৷ তিনটে কিস্তিই না পড়ে মন্তব্য করা ঠিক নয় বলে আপনার সঙ্গে সহমত ৷ পরের দুটো কিস্তি খুব দ্রুতই আসুক ৷ অপেক্ষায় রইলাম ৷
উপভোগ্য
এই লেখাটির শুরু করার জন্য ধন্যবাদ।
I like the valuable information you provide in your articles.