২৯শে দেপ্টেম্বর ২০২৫
ইস্পাত উপন্যাসের রচয়িতা নিকোলাই অস্ত্রোভস্কির উদ্দেশ্যে শ্রদ্ধা জানিয়ে রোম্যাঁ রঁলা’ বলেছিলেন, “যন্ত্রণাবিদ্ধ অস্থির পৃথিবীকে বিদীর্ণ করে দিয়ে যে নবজীবনের বিস্ফোরণ ঘটে, তারই মধ্যে দিয়ে একটা উদাত্ত সংগীতের মতো কতগুলি অগ্নিময় প্রাণকে নতুন বিশ্বাসের ঘোষণায় আকাশ-বাতাস মুখরিত করে তুলে উৎসারিত হতে দেখি। সেই মানুষগুলো এই পৃথিবীর বুক থেকে বিদায় নেওয়ার পরেও, বহুদিন পর্যন্ত তাঁদের সেই বিশ্বাসের বাণী দিকে দিকে প্রতিধ্বনিত হয়ে ফেরে।”
ইস্পাত উপন্যাসকে পড়ার আগে বোধ করি তার রচয়িতা সম্পর্কে আমাদের কিছু জানা দরকার। রাশিয়ার সমাজতান্ত্রিক বিপ্লবের সময় এই লেখকের বয়েস ছিল মায় তেরো। তবু কঠোর শ্রম আর দারিদ্রের অর্থটা তাঁর জানা ছিল তার আগেই। একটা রেল স্টেশনের রেস্তোরাঁয়, তাঁকে কাজ করতে হতো দিনে বারো চোদ্দ ঘণ্টা, সরু আঁকাবাঁকা সিঁড়ি দিয়ে ভারী ভারী সামোভার তুলতে নামাতে হতো, চুল্লিতে জ্বালানির যোগানের কাজ করতে হতো। পনেরো বছর বয়সে তিনি গৃহ যুদ্ধে লড়তে নেমেছিলেন। পরে কিয়েভ রেলওয়ে মেরামতির কারখানা আর রেল পথ নির্মাণের কাজে তিনি অংশগ্রহণ করেছিলেন। অস্ত্রোভস্কি ইউক্রেনে একজন উৎসাহী কমসমল সংগঠক ছিলেন। যে কোনো কাজে তিনি হাত দিতেন তাতে তিনি ঢেলে দিতেন নিজের অন্তর মন।
১৯২৪ সালের শেষের দিকে তিনি গুরুতরভাবে অসুস্থ হয়ে পড়লেন। দেখা গেল সেটা মেরুদণ্ডের ক্ষয় রোগ। বাল্যে অপুষ্টি আর মাত্রাতিরিক্ত শ্রম, গৃহযুদ্ধের ফ্রন্টে জখম, দেশের বিধ্বস্ত অর্থনীতির পুনঃ সংস্থাপনের কাজে তাঁর অমানুষিক পরিশ্রম – এই সবেরই ফল হল ঐ রোগ। এই সাহসী যোদ্ধা সহসা দেখতে পেলেন তিনি অচল – সারা সোভিয়েত দেশ তখন পুনরুজ্জীবনের সৃজনী আগুনে উদ্দীপ্ত। নওজোয়ানরা তখন সামনের সারিগুলিতে – দেশের নতুন নতুন সম্পদ আর নতুন জীবন গড়ার কাজে তারা ব্যাপৃত। সোভিয়েত ইউনিয়নের সেরা সেরা ক্লিনিকের সেরা সেরা ডাক্তাররা অস্ত্রোভস্কির চিকিৎসা করেছিলেন কিন্তু রোগের অবস্থা ছিল চিকিৎসার অসাধ্য। এই তরুণের অঙ্গ প্রত্যঙ্গ অকেজো হয়ে গেল, তারপরে গেল দৃষ্টিশক্তিও। রোগই জিতে গেল, – রোগ তাকে যোদ্ধা শ্রেণী থেকে সরিয়ে তাঁর ‘শয্যা সমাধি’ অবধারিত করে দিল। কী করবেন তিনি তখন? কী ভাবে বেঁচে থাকবেন? ওই ভাবে কি বেঁচে থাকা যায়?
তাঁর উপন্যাসের নায়ক পাভেল করচাগিনের সামনে এলো এই সব মর্মান্তিক প্রশ্ন। এইসব প্রশ্নের উত্তর বের করবার জন্য চললো অস্ত্রোভস্কির অতি কষ্টকর প্রচেষ্টা। উদ্ধার পাওয়ার একটা চিন্তা এলো: আত্মহনন। কিন্তু শেষ মুহূর্তে তিনি দৃঢ ভাবে সেই উপায়কে বাতিল করলেন, “েজীবন যখন অসহনীয় হয়ে ওঠে তখন কি করে বাঁচতে হয় সেটা শেখো, জীবনটাকে কাজে লাগাও।”
১৯৩০ সালের সেপ্টেম্বর মাসে অতি নিদারুণ শেষ আঘাত হয়ে এলো সম্পূর্ণ অন্ধত্ব – তখন অস্ত্রোভস্কি তাঁর বন্ধু পিওতর নভিকভ এর কাছে চিঠিতে লিখেছিলেন, “নিজের জীবনটাকে অর্থপূর্ণ করে তোলার একটা পরিকল্পনা আমার আছে। ….. শয্যাশায়ী হলেও আমি অসুস্থ নই। ওসব ভুল। একগাদা বাজে কথা। আমি একদম সুস্থ। আমার পা চলে না, দেখতে পাইনা ছাই কিছুই – সবই একটা নিদারুণ ভুল।”
তিনি উঠে দাঁড়াতে পারবেন না, ভোরের আলোয় তাঁর চোখ মেলবে না আর কখনও। তাহলে কী উপায় ? তিনি উঠে দাঁড়াবেন, দাঁড়িয়ে হেঁটে এসে যাবেন সোজা জীবনের মাঝখানে – নিজের বইয়ের পৃষ্ঠাগুলি থেকে। পরবর্তী প্রজন্মের কাছে অস্ত্রোভস্কি কি বলতে চান সেটা তাঁর জানা ছিল। বিপ্লবের এক যোদ্ধা, তাঁকে কখনও জোর করে পিছু হটানো যায় না, তাঁরই জবানবন্দি হবে সেটা। বইখানি লেখা শেষ হলে অস্ত্রোভস্কি বলেছিলেন, “এবার বেরিয়ে পড়েছি লৌহ কঠোর বেষ্টনীর ভেতর থেকে …… এখন আমি আবার এসে দাঁড়িয়েছি যোদ্ধাদের সারিতে।”
“জীবন মানুষের সবচেয়ে প্রিয় সম্পদ। এই জীবন সে পায় মাত্র একটি বার। তাই, এমনভাবে বাঁচতে হবে যাতে বছরের পর বছর লক্ষ্যহীন জীবন যাপন করার যন্ত্রণা ভরা অনুশোচনায় ভুগতে না হয়, যাতে মৃত্যুর মুহূর্তে মানুষ বলতে পারে আমার সমগ্র জীবন, সমগ্র শক্তি আমি ব্যয় করেছি এই দুনিয়ার সবচেয়ে বড় আদর্শের জন্য— মানুষের মুক্তির জন্য সংগ্রামে।”
সংঘর্ষ ও নির্মাণের কাজে ব্যাপৃত প্রতিটি মানুষের জীবনের অনুপ্রেরণা সমাজতান্ত্রিক নতুন মানুষ পাভেল করচাগিন-এর স্রষ্টা নিকোলাই অস্ত্রোভস্কির জন্মদিনে তাঁকে শ্রদ্ধা।