বন্ধুগণ
আর জি কর মেডিকেল কলেজে কর্তব্যরত মহিলা ডাক্তারকে পৈশাচিকভাবে খুন ও ধর্ষণের পর ৬ মাস অতিক্রান্ত। পশ্চিমবঙ্গ, সারা দেশ এমন কি বিশ্বের লক্ষ লক্ষ মানুষ এই নির্মম ঘটনা এবং পরবর্তীতে প্রশাসন, পুলিশ, গোয়েন্দা সংস্থা এবং বিচার ব্যবস্থার ভূমিকার তীব্র নিন্দা করেছেন। গত ৬ মাস ধরে লক্ষ লক্ষ মানুষ এই ঘটনার সঙ্গে প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে জড়িত সকলকে বিচারের আওতায় এনে কঠোর শাস্তির দাবি তুলেছেন। সমগ্র স্বাস্থ্য ব্যবস্থার দুর্নীতির অবসান চেয়েছেন, জনস্বাস্থ্য ব্যবস্থাকে স্বচ্ছ ও জনস্বার্থে করার দাবি তুলেছেন। নারী নির্যাতনকারী এই ব্যবস্থার অবসান চেয়েছেন। থ্রেট কালচারের অবসান করে গণতান্ত্রিক ব্যবস্থার দাবি তুলেছেন।
এই দাবিগুলি কি গণতান্ত্রিক, ন্যায়সঙ্গত ও ন্যায্য দাবি নয়?
অভয়াকাণ্ডে ঘটনার পরম্পরা কি এটাকে প্রশাসনিক হত্যাকান্ড প্রমাণ করে না? তর্কের খাতিরে যদি ধরে নেওয়া হয় যে একমাত্র অভিযুক্ত একাই অপরাধী তবে প্রশ্ন ওঠে কে সে? সে গভীর রাতে পুলিশ আউটপোস্ট পার করে হাসপাতালের এক কর্মীর ডাকে সেখানে ঢুকেছিল। ঘটনার পর বিনা বাধায় পুলিশের বাইকে চেপে হাসপাতাল ছেড়ে পুলিশ ব্যারাকেই নিশ্চিন্তে আশ্রয় নিয়েছিল, অথচ সামান্য এক সিভিক ভলেন্টিয়ারকে একমাত্র অপরাধী প্রমাণ করতে প্রমাণ লোপাট করতে ঝাঁপিয়ে পড়ল কেন?
অথচ, অভয়া ছিলেন সরকারের দ্বারা নিয়জিত এক স্বাস্থ্যকর্মী। কর্তব্যরত অবস্থায় তার উপর এই নারকীয় কান্ড ঘটেছে। এরপর যদি প্রশাসনের উদ্যোগে প্রমাণ লোপাট না হোত, সন্দীপ ঘোষের প্রাইজ পোস্টিং না হোত, সরকার দায় স্বীকার করে স্বচ্ছ তদন্তের পরিসর তৈরী করত তবে নিশ্চিত একে কেউ প্রশাসনিক হত্যাকান্ড বলত না। কিন্তু প্রশাসনের বিপরীত আচরণ ঘটনাকে প্রশাসনিক হত্যাকান্ড বলতে বাধ্য করেছে। তাই জনতার দাবি অভয়ার ন্যায় বিচার প্রশাসনকেই সুনিশ্চিত করতে হবে।
সিবিআই আদালতে স্বীকার করেছে গভীর ষড়যন্ত্র হয়েছে, ক্রাইম সিনের অদল বদল অসম্ভব নয়। কিন্তু এই ষড়যন্ত্র উন্মোচন করতে সে চেষ্টা করেনি। কেন্দ্রীয় ফরেন্সিক ল্যাবরেটরির রিপোর্ট এই তথ্যকে সমর্থন করেছে এবং একমাত্র অভিযুক্ত ছাড়াও একজন মহিলাসহ একাধিক ব্যক্তির ডিএনএ অভয়ার মৃতদেহ থেকে নেওয়া স্যাম্পেলে পেয়েছে। অভয়ার মৃত্যু শ্বাসরোধ করে হয়েছে বললেও একমাত্র অভিযুক্তসহ কারুর ফিঙ্গারপ্রিন্ট পাওয়া যায় নি । নিম্ন আদালতের রায়ে স্পষ্ট হয়েছে তদন্তে চূড়ান্ত গাফিলতি হয়েছে। তাই যুক্তি বিবেকসম্পন্ন মানুষ এই রায় মেনে নিতে পারেন কি? ন্যায় বিচার মেনেনি । তাই সংগ্রাম আদালত ও রাজপথে চলবে যতক্ষণ পর্যন্ত তা না মেলে।
দীর্ঘ ৬ মাসে প্রশাসন ন্যায়ালয় এবং কেন্দ্র-রাজ্য নির্বিশেষে বিভিন্ন এজেন্সিগুলির ন্যায়বিচার বিরোধী অবস্থান কি দিনের আলোর মতো স্পষ্ট নয়? জনতা তাই এই ‘সেটিং’ কে ধরে ফেলে আওয়াজ তুলেছেন ‘অভয়ার ভয় নাই – রাজপথ ছাড়ি নাই’।
অভয়ার ঘটনা চোখে আঙ্গুল দিয়ে দেখিয়েছে যে সরকারি স্বাস্থ্য ব্যবস্থা কেমন দুর্নীতির আখড়া। স্বাস্থ্যক্ষেত্রকে প্রাইভেট সংস্থার মুনাফার ক্ষেত্র করে, হাসপাতালগুলিকে এক নৈরাজ্যের পরিবেশ তৈরী করে, জনস্বাস্থ্যের দাবিকে জলাঞ্জলি দিয়ে স্বাস্থ্যসাথী, আয়ুষ্মান ভারত প্রভৃতির নামে বীমা কোম্পানিগুলির রমরমা করা হচ্ছে।
দেশে প্রতি ১৭ মিনিটে একজন নারী ঘরে-বাইরে ধর্ষিতা-নির্যাতিতা হন । নারী নির্যাতনের অপরাধে অভিযুক্ত অপরাধীরা বিত্তশালী বা প্রভাবশালী হলে হয় ছাড়া পান নয়তো মামুলি সাজ হয় আর নিরপরাধ বিত্তহীনরা অপরাধী সাব্যস্ত হয়ে ফাঁসীতে লটকান। মানুষ এই ব্যবস্থার অবসান চান।
আজ সমাজ মাধ্যমে, ইন্টারনেট ও নানা পণ্যের বিজ্ঞাপনে নারীর সম্মান ভূলুন্ঠিত হচ্ছে। যে ভোগবাদী পুরুষতান্ত্রিকতা নারীকে পণ্য করে তুলছে তার শিকড় প্রোথিত আছে সমাজ ব্যবস্থার গভীরে। এর শিকড় উপড়ে ফেলার জন্য প্রস্তুত হোন।
প্রশাসন জনতার আন্দোলনকে ভয় পেয়েছে। তাই জুনিয়র ডাক্তার, সিনিয়র ডাক্তারদের অন্যায়ভাবে হেনস্থা, মামলা এবং লাগাতার হুমকী দেওয়া হচ্ছে। নির্যাতিতার মা-বাবাকেও একদিকে হুমকী এবং অন্যদিকে টাকার লোভ দেখানো হচ্ছে। আন্দোলনকারী সাধারণ জনতাও ছাড় পাচ্ছেন না। তবে হুমকী দিয়ে হামলা করে ন্যায় বিচারের আন্দোলনকে যারা দমন করার স্বপ্ন দেখছেন তাঁরা মুর্খের স্বর্গে বসবাস করেন।
আন্দোলনকারী জনতা এবং এবং সকল গণতান্ত্রিক মানুষ কারুর ভরসায় বসে নেই। তার কিন্তু প্রকৃত অপরাধীদের ও তার মদতদাতাদের সনাক্ত করে ফেলেছেন। জনতার চার্জশিট ইতিমধ্যেই পেশ করা হয়ে গেছে। এখন এই বিচারকে ছিনিয়ে আনার বৃহত্তর লড়াইকে আসুন আরও বৃহত্তর পরিসরে ছড়িয়ে দিই।
বিজ্ঞান মনস্ক