অর্থনীতির অভিমুখঃ শিল্প বিপ্লবের ফসল এবং অ্যাডাম স্মিথ, ডেভিড রিকারডো প্রমুখের মুক্ত বাণিজ্য তত্ত্বের উপর ভর করে যে ব্রিটিশ লগ্নি পুঁজির (Finance Capital) তার ফরাসি, দিনেমার, বেলজিয়ান, পর্তুগিজ, স্প্যানিশ ইউরোপীয় ভাই বেরাদারদের নিয়ে সারা বিশ্ব দখল, ঔপনিবেশিক শাসন ও উপনিবেশগুলিতে মুৎসুদ্দি পুঁজির (Comprador Capital) জন্ম, তারই উত্তরসূরি হিসাবে প্রথম বিশ্বযুদ্ধের পর থেকে মার্কিন পুঁজিবাদ ও সাম্রাজ্যবাদের (US Capitalism and Imperialism) প্রবল উত্থান। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর থেকে তার একচ্ছত্রতা। একদিকে তার পৃষ্ঠপোষকতায় বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির অসাধ্যসাধন, অন্যদিকে আগ্রাসী সামরিক ও বাণিজ্য নীতির মাধ্যমে তার বিস্তার। এরই সঙ্গেসঙ্গে সে জন মেনারড কেইন্স থেকে মিল্টন ফ্রিডম্যান, পল স্যামুয়েলসন, কেনেথ অ্যারো, রবার্ট সোলো প্রমুখ সমাজকল্যাণকর থেকে নবউদারতাবাদী অর্থনৈতিক ধারায় পরিপুষ্ট।
মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের অধীনস্ত আধুনিক বিশ্ব পুঁজিবাদ (Modern Global Capitalism) বারবার নিজেই নিজের সংকট মোচন। একমাত্র রুশ সোভিয়েত সমাজতান্ত্রিক মডেল বিংশ শতাব্দীতে তাকে কিছুটা প্রতিযোগিতায় ফেলেছিল। এখনকার একবিংশ শতাব্দীর উত্তর – আধুনিক নিও – লিবেরাল বিশ্বে তার একমাত্র প্রতিযোগী হান জাত্যাভিমান ও সম্প্রসারণবাদপুষ্ট চিনা সমাজতান্ত্রিক রাষ্ট্রীয় পুঁজিবাদ (Chinese Socialist State Capitalism)।
সরাসরি ব্রিটিশ ঔপনিবেশিক শাসন থেকে মুক্ত হবার পর ভারত নেহরু থেকে ইন্দিরা হয়ে রাজীব গান্ধী অবধি সমাজতন্ত্র ও পুঁজিবাদের মিশেল এক মিশ্র অর্থনৈতিক (Mixed Economic) নীতি গ্রহণ করে আসছিল। ১৯৯১ তে আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রে যেমন সোভিয়েত সমাজতন্ত্রের অবসান, ভারতের ক্ষেত্রেও অর্থনীতির উদারীকরণের মাধ্যমে মার্কিন পরিচালিত পুঁজিবাদের রাস্তায় পথ চলা শুরু। আর বর্তমান মোদিনোমিক্স এর নামে তাতে সম্পূর্ণ সঁপে দেওয়া।
এবারের পূর্ণাঙ্গ বাজেটঃ ১৯৪৭ থেকে বার্ষিক কেন্দ্রীয় বাজেট ও রেল বাজেটের সূচনা যা মোদির আমলে ২০১৭ থেকে একীকৃত হয়ে কখনও পূর্ণাঙ্গ, কখনও খণ্ডিত বাজেট হিসাবে পেশ। যোজনা কমিশন লুপ্ত হয়ে যেমন নীতি আয়োগ এর সৃষ্টি, তেমনই লুটিয়েন নয়া দিল্লির নর্থ ব্লকের কেন্দ্রীয় অর্থ দপ্তরের বাজেটে কাগজভর্তি ট্রাঙ্ক এর পরিবর্তে ব্রিফ কেসের আমদানি এবং গাজরের হালুয়া বিদায়।
সেই পথ ধরে তামিল বংশোদ্ভূত দিল্লির জেএনইউ থেকে অর্থনীতিতে স্নাতকোত্তর, বিজেপির প্রবীণ নেত্রী এবং প্রাক্তন শিল্প ও বাণিজ্য মন্ত্রী (২০১৪ – ’১৭), প্রাক্তন প্রতিরক্ষা মন্ত্রী (২০১৭ – ’১৯) ও বর্তমান অর্থ ও কর্পোরেট সংক্রান্ত মন্ত্রী (২০১৯ – ) নির্মলা সীতারামনের বাজেট পেশ। প্রতিবার ইঙ্গিতবাহী সজ্জার মত এবারও পদ্মশ্রী শিল্পী দুলারি দেবীর আঁকা বিহারের বিখ্যাত মধুবনী আর্ট শোভিত ঘিয়ে রঙের দক্ষিণী সিল্কের শাড়ি পরিহিত নির্মলা দেবীর অষ্টম বাজেট পেশ। ছয়টি পূর্ণাঙ্গ এবং দুটি অন্তর্বর্তী, গত এক বছরের মধ্যে তিনবার বাজেট পেশ। যে বাজেটটিকে সাংবাদিকমহল ও বিশেষজ্ঞদের একাংশ মধ্যবিত্তকেন্দ্রিক ও বিহারময় নামে অভিহিত করেছেন। বাজেট পেশের আগেই প্রথাগত রাষ্ট্রপতির ভাষণে এবং প্রধানমন্ত্রীর বক্তব্যে সেরকম ইঙ্গিত ছিল। আর বাজেট পেশের সঙ্গেসঙ্গে বিজেপি নিয়ন্ত্রিত শক্তিশালী প্রচারযন্ত্র এই বাজেটকে জনমোহিনী ও মধ্যবিত্তঅন্তপ্রাণ আখ্যা দিয়ে মোদিনোমিক্স এর ভূয়সী প্রশস্থি শুরু করে। এবার আশা যাক এই বাজেটের বিষয়ে।
কোন খাতে কত বরাদ্দ (কোটি টাকায়) এবং গতবারের তুলনায় হ্রাস – বৃদ্ধিঃ
১) ঋণ শোধঃ ১২,৭৬,৩৩৮ (মোট বাজেট বরাদ্দের ২৫.০৮%) (+ ০.৭৫% বৃদ্ধি)
২) পরিবহন (রেল সহ): ৫,৪৮,৬৪৯ (মোট বাজেট বরাদ্দের ১০.৭৮%) (- ০.৭৯% হ্রাস)
৩) প্রতিরক্ষাঃ ৪,৯১,৭৩২ (- ০.১০%)
৪) পেনশনঃ ২,৭৬,৬১৮ (- ০.৪৫%)
৫) গ্রামীণ উন্নয়নঃ ২,৬৬,৮১৭ (+ ১.১৭%)
৬) স্বরাষ্ট্রঃ ২,৩৩,২১১ (- ০.১৩%)
৭) খাদ্য ভর্তুকিঃ ২,০৩,৪২০ (- ০.২২%)
৮) প্রশাসনঃ ১,৮৬,৬২৩ (- ০.৭৮%)
৯) কৃষি ও সংশ্লিষ্টঃ ১,৭১,৪৩৭ (+ ০.৩৬)
১০) সারের ভর্তুকিঃ ১,৬৭,৮৮৭ (- ০.৩৬%)
১১) শিক্ষাঃ ১,২৮,৬৫০ (+ ০.০৯%)
১২) স্বাস্থ্যঃ ৯৮,৩১১ (+ ০.০৫%)
১৩) নগর উন্নয়নঃ ৯৬,৩১১ (+ ০.৫৪%)
১৪) তথ্য প্রযুক্তি ও টেলেকমঃ ৯৫,২৯৮ (- ০.৬৫%)
১৫) শক্তিঃ ৮১,১৭৪ (+০.২৪%)
১৬) শিল্প ও বাণিজ্যঃ ৬৫,৫৫৩ (+ ০.০৮%)
১৭) অর্থ দপ্তরঃ ৬২,৯২৪ (- ০.১২%)
১৮) সমাজ কল্যাণঃ ৬০,০৫২ (+ ০.১৯%)
১৯) বিজ্ঞান ও প্রযুক্তিঃ ৫৫,৬৭৯ (+ ০.৪৬%)
২০) বিদেশ মন্ত্রকঃ ২০,৫১৭ (- ০.১৪%)
২১) খনিজ তেলে ভর্তুকিঃ ১২,১০০ ( – ০.০৮%)
২২) উত্তর পূর্ব ভারতের উন্নয়নঃ ৫,৯১৫ (+ ০.০৩%)
২৩) অন্যান্যঃ ৪,৮২,৬৩৫ (- ০.১৪ %)
মোট বরাদ্দ (Total Budgetary Layout): ৫০,৮৮,৩৪৪ কোটি টাকা
ঋণ শোধ, মূলধনী ব্যয় (Capital Expenditure or Carpex), পরিকাঠামো গঠন ইত্যাদি: ২০২৪ – ’২৫ এর চাইতে ২০২৫ – ’২৬ আর্থিক বর্ষে রাজস্ব ঘাটতি (Fiscal Deficit) ৪.৮% থেকে ৪.৪% কমানোর (০.৪%) লক্ষ্যমাত্রা নেওয়া হয়েছে। পরিকাঠামো খাতে ১.৮% কম বরাদ্দ এবং সামাজিক সুরক্ষার খাতে ১.৬% বরাদ্দ বৃদ্ধি করা হয়েছে। জিডিপি ঘাটতির ৪.৪% ধার করে সেখান থেকে ৪.৩% পরিকাঠামো গঠন করে অর্থনীতিকে সচল করার পরিকল্পনা। আবার কর ছাড়ের কারণে মানুষ হয় খরচ নয় সঞ্চয় করবে এবং তার ফলে অর্থনীতি চাঙ্গা হবে প্রত্যাশা। দেখা যাচ্ছে ব্যক্তিরা (Individuals) কর্পোরেট সংস্থা গুলির চাইতে বেশি কর দেন। কর্পোরেটের মাধ্যমে কর্মসংস্থানের কোন সুরাহা হয়নি। অথচ এযাবতকাল কর্পোরেট সহায়ক বাজেট পেশ করে আসা হয়েছে। এখনও প্রত্যাশা কর্পোরেট কর্মসংস্থান সহ অর্থনীতির দুর্বলতা গুলি কাটিয়ে উঠতে সহায়ক হবে।
কর্মসংস্থান প্রসঙ্গেঃ নির্দিষ্ট কোন রূপরেখা নেই। বিগত বাজেটের প্রতিশ্রুতিমত ‘পিএম – ইন্টার্নশিপ প্রকল্পে’ ১.২৫ কোটি বেকার যুবকের চাকরি নিয়ে বাজেট নিশ্চুপ। নিশ্চুপ ‘স্কিল ইন্ডিয়া ভিশন’, ‘পিএম – কৌশল বিকাশ যোজনা’, ‘ন্যাশনাল স্কিল ডেভেলপমেন্ট কর্পোরেশন’ নিয়ে। এবার উঠে এল নতুন শ্লোগান ‘মেক ফর ইন্ডিয়া, মেক ফর দ্য ওয়ার্ল্ড’।
সমাজকল্যাণ, গ্রামমোন্নয়ন, কৃষি, শিল্প ইত্যাদিঃ সমাজ কল্যাণে কাটছাঁট। গ্রামমোন্নয়নে ‘পিএম – আবাস যোজনা’ প্রভৃতি খাতে কিছুটা বরাদ্দ বৃদ্ধি হলেও কৃষিতে অবহেলা। এমজিএনআরইজিএস এ গতবারের একই বরাদ্দ রয়েছে। শিল্প উৎপাদনে উদ্দীপনাহীনতা। সংখ্যার কারিকুরি। ‘বিকশিত ভারত’, ‘জিরো পভার্টি’ ইত্যাদি আপ্তবাক্যের কোন প্রতিফলন ঘটেনি।
গণপরিবহনঃ রেল খাতে ২,৬৫ লক্ষ কোটি টাকার মধ্যে ২,৫২ লক্ষ কোটি টাকাই খরচ হবে বেতন, রক্ষণাবেক্ষণ, পরিচালনা প্রভৃতি খাতে। বাদবাকি অর্থে জোর ‘বন্দে ভারত’, ‘নমো ভারত’ প্রভৃতি ব্যায়বহুল ট্রেন নির্মাণ ইত্যাদিতে। যাত্রী নিরাপত্তা ও স্বাচ্ছন্দের জন্য থাকবে কেবল ১২,১১৮.৩৯ কোটি টাকা।
বাংলা, বিহার ও দিল্লিঃ বর্তমান মোদি সরকারের প্রধান দুই সমর্থন স্তম্ভের একটি বিহারের মুখ্যমন্ত্রী নীতিশ কুমারের জনতা দল (ইউনাইটেড) এর সমর্থন। তাদের খুশি রাখতে এবং আসন্ন বিহার বিধানসভা নির্বাচনের কথা মাথায় রেখে ১১,৫০০ কোটি টাকার ‘ওয়েস্টার্ন কোশী ক্যানাল এক্সটেনশন, রেনভেশন অ্যান্ড মডারনাইজেশন’ সহ ঢালাও বাজেট বরাদ্দ করা হয়েছে বিহারের জন্য। দিল্লিকে নির্বাচনের আগে ১০০ কোটি টাকা বাজেট বৃদ্ধি করা হয়েছে (১,৩৪৮ কোটি টাকা)। পশ্চিমবঙ্গের বর্তমান প্রকল্পগুলিতে সামান্য কম – বেশি বরাদ্দ করা হয়েছে। এর বাইরে কিছু নেই।
স্বাস্থ্য, শিক্ষা, শক্তি, বিজ্ঞান, গবেষণাঃ সামান্য বরাদ্দ বৃদ্ধি করা হয়েছে। স্বাস্থ্যে ৩৬ টি জীবনদায়ী ক্যানসারের চিকিৎসার ওষুধের উপর থেকে বহিঃশুল্ক (Custom Duty) মকুব করা হয়েছে। গিগ অর্থনীতিতে যুক্ত ডেলিভারি বয় প্রমুখ অসংগঠিত শ্রমিকদের ‘ই – শ্রম পোর্টাল’ এর মাধ্যমে ‘প্রধানমন্ত্রী – জনআরোগ্য যোজনা’ প্রকল্পে অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে। কৃত্রিম মেধা নিয়ে গবেষণায় ৫০০ কোটি টাকা বরাদ্দ করা হয়েছে যদিও ইতিমধ্যে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, চিন প্রভৃতি দেশ এই নিয়ে গবেষণায় অনেক এগিয়ে গেছে। পারমাণবিক গবেষণা ইত্যাদি খাতে ২৪,০৪৯ কোটি টাকা বরাদ্দ হয়েছে যা দিয়ে শক্তি উৎপাদনের জন্য ২০৩৩ এর মধ্যে পাঁচটি পারমাণবিক চুল্লি গড়ে তোলার লক্ষ্যমাত্রা নেওয়া হয়েছে।
ট্রাম্পেটিং এর প্রতিক্রিয়ায়ঃ উগ্র মার্কিন ও শ্বেতাঙ্গ জাত্যাভিমান জাগিয়ে ডনাল্ড ট্রাম্পকে সামনে রেখে ইলন মাস্ক প্রমুখ অতি ধনী ব্যাবসায়ীরা মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ক্ষমতা দখল করেছেন। তারা চাইছেন দুনিয়া জুড়ে তাদের শর্তে মুক্ত বাণিজ্য করে আরও মুনাফা। ট্রাম্প হুমকি দিয়ে রেখেছেন যারা মার্কিন পণ্যের উপর উচ্চ শুল্ক রাখবে তাদের প্রতি কঠোর ব্যাবস্থা নেওয়া হবে। তিনি ভারতকে চিনের সঙ্গে জুড়ে সাংঘাতিক শুল্ক (Tariff) হারের দেশ হিসাবে অভিহিত করেছেন। বিশ্ব জুড়ে অসম প্রতিযোগিতায় ভারতীয় পণ্যকে রক্ষা করতে বিদেশি কিছু পণ্যের উপর চড়া বহিঃশুল্ক লাগু ছিল। কিন্তু ট্রাম্পের হুমকির পর ভারত তাড়াতাড়ি এই বাজেটে ২৮ টি আমদানি হওয়া মার্কিন পণ্যের ২০ টির উপর থেকে শুল্ক হ্রাস করে দিয়েছে। গতবছর অন্য আটটির শুল্ক লাঘব করা হয়েছিল।
বীমা ক্ষেত্রে বিদেশি বিনিয়োগের ঊর্ধ্বসীমা ৭৪% থেকে ১০০% করে রাষ্ট্রয়াত্ব বীমার পরিসরকে গুরুত্বহীন করে বেসরকারি ও বিদেশি বীমা কোম্পানির অবাধ ব্যাবসা ও মুনাফার সুযোগ করে দেওয়া হল। এলআইসি থেকে আগেই এসবিআই এর মত বিপুল মূলধন সরানো হয়েছে। ইতিমধ্যে দেশি বেসরকারি বীমা সংস্থাগুলির সঙ্গে গাঁটছড়া বেধে বিদেশি বীমা সংস্থাগুলি বাজার ভরিয়ে দিয়েছে। স্বাস্থ্য বীমা তাদের একটি প্রধান লক্ষ্য। ফলে গ্রাহকদের একদিকে যেমন বীমার কিস্তি বহুগুণ বেড়ে গেছে, অন্যদিকে বেসরকারি হাসপাতাল – নার্সিং হোম, কর্পোরেট হাসপাতাল এবং সরকারি হাসপাতালেও (আয়ুষ্মান ভারত, পিএম – জেএওয়াই, স্বাস্থ্য সাথীর বীমা কোম্পানি গুলির গ্রাসে পড়া) চিকিৎসা খরচ বহুগুণ বেড়ে চলেছে।
ধর্মের কল বাতাসে নড়েঃ এবার আমরা আসছি যা নিয়ে এত ঢক্কানিনাদ সেই মধ্যবিত্তের আয়কর ছাড় নিয়ে আলোচনায়। রাজস্ব খাতের ৩৩.৭% প্রায় এক লক্ষ কোটি টাকা আয়কর ছাড়। কিন্তু এই অর্থ আসলে আসছে মুলধনী ব্যয় ১১.১১ লক্ষ কোটি টাকা থেকে কমিয়ে ১০.১১ লক্ষ কোটি টাকা করে। এর লক্ষ্য সরকারি – বেসরকারি চাকরিজীবী, স্বাধীন পেশাজীবী প্রমুখ ভারতীয় অর্থনীতির মধ্য শ্রেণীটির (Middle Income Group), যাদের সংখ্যা সবমিলিয়ে জনসংখ্যার এক তৃতীয়াংশ (৩৩%), সবচাইতে সরব ও প্রভাবশালী অংশটির (জনসংখ্যার মাত্র ৩%) দীর্ঘদিনের ক্ষোভ ও সমস্যাকে কিছুটা প্রশমিত করা কিছুটা আয়কর ছাড়ের ব্যাবস্থা করে। বার্ষিক আয়ে সাত লক্ষ টাকা অবধি যে আয়কর ছাড়টি ছিল সেটি বাড়িয়ে ১২ লক্ষ টাকা করা হয়েছে। তার সঙ্গে স্ট্যান্ডার্ড ডিডাকশনের ৭৫ হাজার টাকা যুক্ত হবে। কর স্তরের (Slabs) ধাপ বেড়ে ছয়টি হয়েছে। ২৪ লক্ষ টাকার বেশি বার্ষিক আয়ে ৩০% কর। গৃহঋণের, প্রবীণদের এবং বিদেশে অর্থ পাঠানোর উৎস করে (Deduction at source) ছাড় বেড়ে হয়েছে যথাক্রমে ছয় লক্ষ, এক লক্ষ ও ১০ লক্ষ টাকা।
এর রাজনৈতিক দিকগুলির প্রধান দুটি বিষয় হলঃ (১) ধর্মের কল দেখিয়ে, ধারাবাহিক উচ্চকিত আত্মপ্রচার করে এবং চোখ ধাঁধানো প্রচার চালিয়েও ২০২৪ লোকসভা নির্বাচনে নরেন্দ্র মোদি ২০১৪ ও ২০১৯ এর মত একক সংখ্যাগরিষ্ঠতা পেলেন না। আরএসএস অনেকদিন থেকে বলছিল। অন্যতম কারণ ছিল অত্যধিক মুদ্রাস্ফীতি, দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধি, কর্মসংস্থানের অভাব। যার প্রভাব গুরুতরভাবে পড়েছিল দরিদ্র ও মধ্যবিত্তদের উপর। যেগুলি বিশ্বজুড়ে আর্থিক মন্দা, নোট বন্দীর ক্ষত, কোভিড অতিমারির আক্রমণ, ইউক্রেন ও মধ্যপ্রাচ্যের যুদ্ধ এবং মোদি সরকারের একের পর এক প্রো – কর্পোরেট আর্থিক নীতি ও বাজেটের ফলে বেড়েই চলছিল। (২) রাজধানী দিল্লির রাজ্য সরকারটি ১৯৯৮ এর পর থেকে নানাভাবে চেষ্টা করেও বিজেপি দখল করতে পারেনি। ২০১৩ অবধি সেটি ছিল মুখ্যমন্ত্রী শীলা দীক্ষিতের নেতৃত্বে ১৫ বছর কংগ্রেসের অধীনে এবং তারপর মুখ্যমন্ত্রী অরবিন্দ কেজরিয়ালের নেতৃত্বে ১৩ বছর আম আদমি পার্টির দখলে। দিল্লিতে চাকরিজীবী ও মধ্যবিত্তদের একটি বড় অংশ বাস করে। নির্বাচনের আগে তাদের সন্তুষ্ট করার চেষ্টা হল।
এই কর ছাড়ের অর্থনৈতিক দিকগুলির প্রধান বিষয়গুলি থাকছেঃ (১) অনেক ঢাকঢোল পিটিয়ে মোদির সময়ের অর্থনীতির উন্নতির যে ঢালাও প্রচার করা হয় সেগুলি বিশ্ব ক্ষুধা সূচক, বিশ্ব মানব উন্নয়ন সূচক সহ আন্তর্জাতিকভাবে স্বীকৃত ও মান্যতপ্রাপ্ত সূচক ও রিপোর্টে ভয়ঙ্কর পরিস্থিতি প্রকাশ করে। মোদি জমানার অর্থনীতি ও মানবতার করুণ চিত্র ঢাকতে এরপর আম্বানি – আদানি কয়েকটি পারিবারিক ফাটকা পুঁজির (Crony Lumpen Capital) বিপুল বিত্তকে দেখিয়ে ভারতকে বিশ্বের তৃতীয় বৃহত্তম অর্থনীতি হতে চলা পঞ্চম বৃহত্তম অর্থনীতি বলে প্রবল প্রচার চালানো হয় তাও মুখ থুবড়ে পরে দেশের আর্থিক বৃদ্ধি (Growth Rate) বিস্তর গোঁজামিল সত্ত্বেও ছয় শতাংশের সামান্য বেশিতে পৌঁছনোয়। যা দিয়ে কোন ঘোষিত লক্ষ্যই অর্জন করা সম্ভব নয়। অথচ তাঁর নিরুচ্চার দশ বছরের প্রধানমন্ত্রীত্বে পরস্পর বিরোধী দলগুলির জোট সরকার চালিয়ে বিশ্ব অর্থনীতির ধ্বসের মধ্যেও কংগ্রেসী মনমোহন সিংহ দেশের আর্থিক বৃদ্ধি হারের গড় ধরে রেখেছিলেন ৭.৭%। সেই সময়েও BIG CAPITAL বা বৃহৎ পুঁজির (বৃহৎ পারিবারিক ফাটকা পুঁজি, বৃহৎ কর্পোরেট পুঁজি, বৃহৎ বিদেশি ও বহুজাতিক পুঁজি) দাপট ছিল, কিন্তু মোদি শাসনে এদের সার্বিক লুঠ ও আত্মসাতের কারণে সহযোগী একটি ছোট অংশ ধনী হলেও ব্যাপক সাধারণ মানুষ অর্থশূন্য হয়ে পড়েন। ভারতীয় অর্থনীতি স্থবির হয়ে পড়ে। এদের হাতে কিছু অর্থ দিয়ে ভারতীয় অর্থনীতিকে জাগিয়ে তোলার মরিয়া চেষ্টা। (২) দেশের উৎপাদন শিল্পকে পঙ্গু করে বিদেশি ও কতিপয় সংস্থার প্রয়োজনীয় ও নিত্য প্রয়োজনীয় সামগ্রী ও সরঞ্জাম, ভোগ্য পণ্য বিভিন্ন মল, বাজার, দোকান ও অন লাইন শপিং এ ভরিয়ে দেওয়া হলেও ক্রেতার অভাবে ব্যাবসা মার খায়। সাধারণের হাতে কিছু টাকা দিয়ে এই সংস্থা ও বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠানগুলিকেও জাগিয়ে তোলার চেষ্টা।
নানা মুনির নানা মতঃ কোন কোন বিশেষজ্ঞ এই বাজেটের প্রশংসা করেছেন। কেউ কেউ আবার সমালোচনা করেছেন। তবে বেশিরভাগের মত হল এই বাজেট স্বল্প মেয়াদি চাহিদা বাড়াবে। কিন্তু উপযুক্ত পরিকাঠামো ও স্থায়ী সম্পদ গঠনের ব্যাবস্থা না থাকায় অর্থনীতির গতি রুদ্ধ হবে। কৃষি সংকটে, শিল্পে উৎপাদন বৃদ্ধির লক্ষণ নেই, বিদেশি বাণিজ্যের উন্নতির সম্ভবনা কম। এই বাজেটে দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধি ও মুদ্রাস্ফীতি রোধের কোন প্রচেষ্টা নেই। ডলারের দাম ৮৭ টাকা ছাড়িয়ে গেছে, পেট্রো পণ্যের দাম বেশিই থাকছে আর সোনার দাম নাগালের বাইরে। এই বাজেটে দেশের অন্যতম সমস্যা কর্মসংস্থানের কোন দিশা নেই। নেই মাত্র ৩% আয়করদাতার বাইরে বিপুল পরিমাণ জনসংখ্যার ক্রয় ক্ষমতা বাড়ানোর কোন উদ্যোগ। শেয়ার বাজারও মুষড়ে পড়েছে।
০৩.০২.২০২৫