খাদ্য বস্ত্র বাসস্থানের জন্য মানুষ যেভাবে আন্দোলন করেন সেভাবে করেন না স্বাস্থ্যের জন্য। আসলে স্বাস্থ্য বা স্বাস্থ্যপরিসেবার প্রয়োজন অনুভূত হয় না অসুস্থ না হলে।
অভয়ার ধর্ষণ হত্যা ও তৎপরবর্তী গণ আন্দোলন দুর্নীতিমুক্ত স্বাস্থ্যপরিসেবার দাবিকে সামনে এনে দিয়েছে। কেননা আমরা আজ জানি যে অভয়া ছিলেন একজন whistle-blower, সম্ভবত নিজের হাসপাতালে ঘটে চলা কোন বড় মাপের দুর্নীতির প্রতিবাদ করতে গিয়ে তিনি শহীদের মৃত্যু বরণ করেন।
কিন্তু স্বাস্থ্য পরিষেবা দুর্নীতিমুক্ত হবে কিভাবে? চিকিৎসক ও স্বাস্থ্যকর্মীরা ভালো হলেই কি স্বাস্থ্য পরিষেবা ভালো হবে? যে সমাজ ব্যবস্থায় প্রশাসক, বিচারক, পুলিশ, রাজনেতা অধিকাংশই দুর্নীতিগ্রস্ত সেখানে সেই সমাজে জন্ম নেওয়া চিকিৎসক স্বাস্থ্যকর্মী দুর্নীতিমুক্ত হবেন কিভাবে আর কেন?
স্বাস্থ্য পরিষেবা পণ্য হওয়ার কথা না। কেননা ১৯৪৮ এর আন্তর্জাতিক মানবাধিকার সনদ অনুযায়ী স্বাস্থ্য একটি মৌলিক অধিকার। যদিও আমাদের সংবিধানে স্বাস্থ্য মৌলিক অধিকার হিসেবে স্বীকৃত নয় তার স্থান নির্দেশক নীতিতে।
আশির দশকের শেষভাগে কনজিউমার প্রোটেকশন অ্যাক্টে স্বাস্থ্যকে পণ্যের দরজা দেওয়া হয়েছে।
স্বাস্থ্য যদি পণ্য হয় তাহলেও অন্যান্য পণ্যের সঙ্গে স্বাস্থ্য পরিষেবার পার্থক্য আছে। স্বাস্থ্য পরিষেবার ক্ষেত্রে ক্রেতা এবং বিক্রেতার মাঝখানে চিকিৎসক থাকেন। ক্রেতা অর্থাৎ রোগী কোন পরীক্ষা করাবেন, কোন ওষুধ খাবেন তা তিনি নিজে ঠিক করেন না, ঠিক করে দেন চিকিৎসক। তাই দুর্নীতির সম্ভাবনা থেকেই যায়।
এই দুর্নীতি রোধ করা যায় যে ব্যবস্থায় তা হল ইউনিভার্সাল হেলথ কেয়ার বা সবার জন্য স্বাস্থ্যের ব্যবস্থা।
অসুস্থ হলে রোগী কোন চিকিৎসকের কাছে যাবেন তা আগে থেকেই নির্দিষ্ট করা। রোগীর কোন উপসর্গ থাকলে কোন কোন পরীক্ষা করানো যাবে, কোন ওষুধ লিখতে হবে, কখন বিশেষজ্ঞের কাছে পাঠাতে হবে, তা নির্দিষ্ট করা। নির্দিষ্ট করা থাকে প্রামাণ্য চিকিৎসা বিধি বা স্ট্যান্ডার্ড ট্রিটমেন্ট গাইডলাইনে। রোগীর পরীক্ষা করাতে কোন খরচ হয় না, কোথায় পরীক্ষা করাবেন তা নির্দিষ্ট থাকে, ডাক্তারের কথা মত পরীক্ষা কেন্দ্র নয়। প্রেসক্রাইব করা ওষুধগুলো পাওয়া যায় নির্দিষ্ট কেন্দ্রে বিনামূল্যে। কোন জেনারেল ফিজিশিয়ান কোন বিষয়ের কোন বিশেষজ্ঞের কাছে রোগীকে পাঠাতে পারবেন তা নির্দিষ্ট থাকে।
এই সমগ্র ব্যবস্থায় রোগী এবং চিকিৎসকের মধ্যে অর্থের আদান-প্রদান থাকে না বলে দুর্নীতির স্কোপ থাকে না।
শুনতে স্বপ্নের কথা মনে হলেও এমন ব্যবস্থা আছে পৃথিবীর অনেক দেশেই। শুরু ১৯১২ সালে নরওয়ে থেকে, ১৯৩৭ এ সোভিয়েত ইউনিয়ন, ১৯৪৮ এ ব্রিটিশ যুক্ত রাজ্য, ১৯৫০ এ গণপ্রজাতন্ত্রী চীন, ১৯৬০ এ কিউবা…। ১৯৭৮ এ বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার আলমা আটা অধিবেশনে ঘোষণা হল ২০০০ খ্রিস্টাব্দের মধ্যে সবার জন্য। সবার জন্য স্বাস্হ্যের ঘোষণাপত্রে ভারতের স্বাক্ষর থাকলেও সবার জন্য স্বাস্থ্য বাস্তবায়িত হয়নি আমাদের দেশে।
বরং ৯০ এর দশক থেকে সরকার স্বাস্থ্য কেন্দ্র থেকে হাত গুটানো বাড়িয়ে ঐ দিয়েছে। শিক্ষার মত স্বাস্থ্য পরিষেবাও পুজিপতিদের মৃগয়াক্ষেত্র।
২০১০ সালে প্ল্যানিং কমিশন সবার জন্য স্বাস্থ্যের লক্ষ্যে এক উচ্চস্তরীয় বিশেষজ্ঞ দল (High Level Expert Group on Universal Health Coverage) তৈরি করে। সেই বিশেষজ্ঞ দল হিসেব করে দেখিয়েছিল ২০১৭- র মধ্যে জিডিপির ২.৫ শতাংশ এবং ২০২২ এর মধ্যে জিডিপির ৩ শতাংশ যদি সরকার স্বাস্থ্য খাতে খরচ করে তাহলে তার দিয়ে সমস্ত দেশবাসীর প্রাথমিক, মধ্যবর্তী এবং অন্তিম স্তরের সমস্ত পরিষেবা সরকার বিনামূল্যে দিতে পারে।
উচ্চস্তরীয় বিশেষজ্ঞ দলের সুপারিশ তৎকালীন ইউপিএ সরকার মানেনি।
২০১৪ এ এনডিএ সরকার এসে স্বাস্থ্য খাতে খরচ ২০ শতাংশ কমিয়ে দিয়েছিল। ২০১৭ র জাতীয় স্বাস্থ্য নীতিতে জিডিপির ২.৫ শতাংশ স্বাস্থ্য খাতে খরচ করার কথা বলা হলেও গড়ে বছরে খরচ করা হয় করা হয় ১ শতাংশের মত, তার বেশিরভাগটা আবার আয়ুষ্মান ভারতের মতো বিমান প্রকল্পের প্রিমিয়াম দিতে।
আমরা যদি দুর্নীতিমুক্ত স্বাস্থ্য ব্যবস্থা চাই তাহলে সরকারকে ইউনিভার্সাল হেলথ কেয়ার দিতে বাধ্য করার কোন বিকল্প নেই।
দেশব্রতী পত্রিকার বিশেষ সংখ্যা, জানুয়ারী ২০২৫-এ প্রকাশিত।
অসাধারণ তথ্য Sir, অনেক কিছু জানলাম। চোখ খুলে দিল । share করছি।