পূর্বপ্রকাশিতের পর
তাহলে মূল ব্যাপারটা কী দাঁড়ালো?
এক কথায় MCI যদি হয় ‘Inspector Raj; NMC হলো সম্পুর্ণরূপে ‘Bureaucratic Raj’ পুরোপুরি আমলা ও কেন্দ্রীয় সরকার নিয়ন্ত্রিত একটি সংস্থা। বুঝলাম না, এরকম একটা অদ্ভুত (আবার নাকি Autonomous) সংস্থা না করে কেন্দ্রীয় সরকার পুরোটাই নিজের হাতে রাখলো না কেন?—তাহলে তো বিষয়টা অনেক সহজ ও বোধগম্য হতো।
বলা হচ্ছে, MCI তে কিছু ডাক্তার নিজেদের মৌরসীপাট্টা স্থাপন করেছিলো নির্বাচনকে manipulate করে এবং এই দুর্নীতির আখড়াকে ভাঙ্গা প্রায় অসম্ভব ছিলো। অভিযোগ যদি আংশিকভাবেও সত্যি হয়, তবে মনে রাখতে হবে দেশের বহু প্রতিষ্ঠানই আজ একই রোগে আক্রান্ত। তার বিরুদ্ধে জনমতগঠন, নির্বাচন সুষ্ঠু স্বাভাবিকভাবে করার ব্যবস্থা নেওয়া, জ্ঞানী ও শ্রদ্ধেয় চিকিৎসকদের সামনে আসতে উৎসাহ দেওয়া—এসবের মাধ্যমে তো এর ব্যাপক সুস্থ পরিবর্তন আনা সম্ভব ছিলো। কিন্তু সরকারের সে রাস্তায় যাওয়া একেবারেই না-পসন্দ। বলা হচ্ছে, Search Committee-র মাধ্যমে সবচেয়ে দক্ষ ব্যক্তিদের বেছে নেওয়া সম্ভব। কিন্তু যারা বাছবে তারা তো সবাই হয় আমলা বা তাদের মনোনীত। দেশের আমলাতন্ত্র ও তাদের কার্য্যকলাপ সম্পর্কে মানুষের অভিজ্ঞতা কী বলে?—স্বাধীনতার পর থেকে কেন্দ্র-রাজ্যে যতগুলি বড় মাপের দুর্নীতি হয়েছে, সর্বক্ষেত্রে আমলাদের কিছু না কিছু অংশ যুক্ত ছিলো। বস্তুতঃ, আমলাতন্ত্রের প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষ মদত ছাড়া অনেকদিন ধরে সংগঠিত কোনও দুর্নীতি সরকারী – বেসরকারী কোনও ক্ষেত্রেই আদৌ সম্ভব নয়।
তাই, সত্যিই অবাক কান্ড যে, তথাকথিত দুর্নীতিগ্রস্ত MCI-কে সরিয়ে সম্পুর্ণ আমলাতন্ত্র নিয়ন্ত্রিত NMC-কে নিয়ে আসা হলো যা নাকি দেশের চাহিদা মতো সৎ, শিক্ষিত, দক্ষ চিকিৎসক তৈরী করতে আগামী দিনে দেশকে সাহায্য করবে। কী মনে হয় – সম্ভব?
তাহলে লাভবান কারা হলো? মেদিকেল ছাত্র? জনগণ?
সবচেয়ে অনিশ্চিত অবস্থার মধ্যে আছে মেডিকেল ছাত্ররা। NEXT ও তৎজনিত সমসস্যাগুলি যে ঠিক কী রূপ ধারণ করতে পারে সেটাই তো পরিষ্কার নয়, তার সঙ্গে লাগাতার বেসরকারীকরণের ঝোঁক পরবর্তীকালে সরকারী ক্ষেত্রে চাকরীর সুযোগও সঙ্কুচিত হবার প্রবল সম্ভাবনা—
এরই মধ্যে NDTV –র একটি প্রতিবেদনে পকাশ যে, উত্তরাখন্ড সরকার প্রাইভেট মেডিকেল কলেজের ফী নিয়ন্ত্রণে রাজ্যের ভূমিকা সরিয়ে নিয়েছে। একাধিক প্রাইভেট মেডিকেল কলেজে বার্ষিক ফী ৬ লক্ষ টাকা থেকে ২২-২৩ লক্ষ টাকায় বর্দ্ধিত করেছে। শুধু তাই নয়। দ্বিতীয় বর্ষের ছাত্রছাত্রীদের প্রথম বর্ষের বকেয়া টাকা মিটিয়ে দিতে হবে (ফী বাড়ানো হয়েছে retrospective effect-এ)। এতো লুঠতরাজ।। মেধাবী গরীব ছাত্রছাত্রীদের এখনও ভরসা সরকারী কলেজগুলি। সরকার কী সেগুলিকেও বিলগ্নিকরণের রাস্তায় হাঁটবে?
বস্তুতঃ, শুধু ছাত্র নয় সমস্ত মানুষের স্বার্থে জড়িয়ে আছে এই প্রশ্নে। ভারতবর্ষে বর্তমানে ৫২৯ টি মেডিকেল কলেজের মধ্যে ২৬৯ টি সরকারী। মোট ৭০,৯৭৮ টি আসনের মধ্যে সরকারী ঠিক অর্দ্ধেক ৩৫৬৮৮ (তিনশোর বেশী ডেন্টাল কলেজে আবার সরকারী মাত্র ৫০টি) মোট আসন প্রায় ২৭ হাজার)। অন্যান্য সর্বভারতীয় পরীক্ষাগুলির মতো NEET অবশ্যম্ভাবীভাবে ভীষণই বৃহৎ ও কর্পোরেট পরিচালিত কোচিং নির্ভর। মেডিকেল শিক্ষা ক্রমশঃ অথচ দৃঢ়ভাবে অর্থনীতি নির্ভর হয়ে উঠেছে। NEET-এর পরীক্ষায় আর একটা মজা আছে। এখানে কোনভাবে র্যাঙ্কিং-এ নাম তুলতে পারলেই এবং অভিভাবকের মাণিব্যাগ গভীর ও দীর্ঘ হলেই বেসরকারী কলেজে স্থান পাকা—সংরক্ষণ, অসংরক্ষণের কোনও তোয়াক্কা না করেই। NEET –এর র্যাঙ্কিং নিয়ন্ত্রিত হয় Percentile পদ্ধতিতে (অসংরক্ষিত ক্ষেত্রে 50th Percentile এবং সংরক্ষিত ক্ষেত্রে 40th percentile পর্যন্ত Cut off marks)। সসুতরাং, সব সময়েই যতজন পরীক্ষা দেয় তাদের অর্দ্ধেকীও বেশ কিছু ছাত্রছাত্রী র্যাঙ্ক পাবে। গতবার, অসংরক্ষিত ক্ষেত্রে ৭২০ নম্বরের মধ্যে ১৩৩ নম্বর পেয়েও র্যাঙ্ক পাওয়া সম্ভব হয়েছে। Physics- এ কোনও নম্বর না পাওয়া সত্ত্বেও অন্ততঃ ৫০০ জনের র্যাঙ্ক পাওয়া আটকায়নি।
এখনই, বেসরকারী মেডিকেল কলেজগুলিতে বিভিন্ন নিয়ন্ত্রণ থাকা সত্ত্বেও মোট পড়ার খরচ মোটামুটি গড়ে ৬০ লক্ষের উপরে (Telegraph ১২ই আগষ্ট,১৯)। NMC তো শতকরা ৫০ ভাগের উপর থেকে নিয়ন্ত্রণ তুলেই নিচ্ছে। তাহলে, শুধু MBBS পড়ার খরচ বেসরকারী ক্ষেত্রে কত দাঁড়াবে? কোটিতে হবে তো?
খুব স্বাভাবিকভাবে সাধারণ মানুষের সামনে যা অতি বিপজ্জনক সমস্যা হিসাবে হাজির হচ্ছে, তা হলো—
১) শুধু দরিদ্র নয়, মধ্যবিত্ত এমনকি মোটামুটি উচ্চবিত্ত অভিভাবকদের কাছে তাদের সন্তানদের জন্য দেশের অর্ধেক আসন (মেডিকেলে) নিশ্চিতভাবে রুদ্ধ। এবং আশঙ্কা, রুদ্ধ-র দিকেই পাল্লা ক্রমশঃ ভারী হবে।
২) MBBS পড়তে কোটি, পোস্ট গ্র্যাজুয়েট পড়তে আরও অনেক কোটি—এই সমস্ত চিকিৎসকেরা আদৌ কোনও দিন সাধারণ মানুষের কাজে লাগবে তো? তাদের তো আগে এত কোটি টাকা তুলতে হবে তারপর তো জনপরিষেবা।
৩) ক্রমশঃ মেধাবী ছাত্ররা মেডিকেল শিক্ষা থেকে সরে গেলে (এমনিতেই ডাক্তারদের উপর ক্রমবর্ধমান হামলা, সাধারণ ছাত্রদের ভীতিগ্রস্ত করে তুলেছে) শুধু চিকিৎসা জগতের ক্ষতি তা নয়—সবচেয়ে বেশি ক্ষতি সাধারণ মানুষের।
তাহলে লাভটা মূলতঃ কার?
অবশ্যই সর্বতোভাবে বেসরকারী ক্ষেত্রের—
১) ‘Inspector Raj’ খতম হলে নতুন প্রাইভেট মেডিকেল কলেজে খোলা ও পরিচালনা অনেক সহজ হয়ে যাবে।
২) ফী বিনিয়ন্ত্রণের ফলে আর্থিক উন্নতি তো ব্যাপক হবে। এই মূগুর্তে দেশে বিভিন্ন ক্ষেত্রে বিনিয়োগের খরা চলছে। আশা করা যায় প্রাইভেট মেডিকেল শিক্ষায় কর্পোরেট সেক্টর উৎসাহের সঙ্গে এগিয়ে আসবে, কারণ ভালো return নিশ্চিত.
3) NEXT –এর ফলে সমস্ত উত্তীর্ণ ছাত্রছাত্রীই বস্তুতঃ একই মাপকাঠিতে বিবেচ্য হবে। অতি পেছিয়ে পড়া প্রাইভেট মেডিকেল কলেজ থেকে শিক্ষাপ্রাপ্ত ও সামনের সারিতে থাকা সরকারী কলেজ থেকে বেরোনো নবীনদের মধ্যে আর কোনও বিশেষ প্রভেদ থাকবে না—আকবর বাদশা ও হরিপদ কেরাণী সমসারিতেই থাকতে পারবে।
উপসংহার—
এক বাক্যে NMC-কে অভিহিত করতে হলে বলতে হবে ‘By the Selected, of the Selected and very definitely for the Selected’—তাই ভাববেন না NMC হঠাৎ করে মাথায় চলে এসেছে। অনেক বুদ্ধি করে অনেক পরিকল্পনা করে MCI-কে হঠিয়ে NMC-কে আনা হয়েছে। MCI-কে রেখে সেখানে নিজেদের লোক ঢুকিয়ে দিলে অসুবিধা কী ছিলো? নিশ্চয়ই ছিল—আর, সেজন্যই সমগ্র মেডিকেল শিক্ষাই নয়, সমগ্র চিকিৎসা ব্যবস্থাকেই নিশ্ছিদ্র বেসরকারীকরণের দিকে নিয়ে যাবার জন্য NMC এক সদম্ভ দৃঢ় পদক্ষেপ। আমাদের রাজ্যে চিকিৎসা জগৎকে উচ্ছন্নে পাঠানোর প্রয়াস তো অনেক আগেই শুরু হয়েছে। এখন কেন্দ্রীয় প্রচেষ্টায় তা আর শুধু রাজ্যে নয় সারা দেশেই অতি বিপজ্জনক অবস্থার সৃষ্টি করেছে—আর সব থেকে বেশী বিপদ হলো মানুষের, সাধারণ খেটে খাওয়া মানুষের।
ইংরাজীতে একটা প্রবাদ আছে—‘treatment worse than malady’—MCI-র বদলে NMC তার থেকেও অনেক ভয়ঙ্কর।
শেষ