জীবনে প্রথম একা একা বিদেশে পাড়ি দেবার আগে অনু কতটা নার্ভাস ছিল বুঝেছিল কলকাতা–দিল্লি ফ্লাইটে উঠেই। মামার জন্য যে সাতটা বই নিয়ে যাবার কথা, তার দুটো রেখেছিল ক্যাবিন ব্যাগেজে – প্লেনে পড়ার জন্য। এখন দুটোই ওর পড়ার টেবিলের শোভাবর্ধন করছে। বেরোবার আগে ব্যাগে ঢোকাতে ভুলে গেছে। ছোটোমামাকে সামলাতে হবে টরোন্টো পৌঁছে, কিন্তু তার আগে সারা রাস্তা করবে কী? ইন–ফ্লাইট এন্টারটেনমেন্টের সিনেমা ছাড়া গতি নেই। অনু সিনেমার পোকা না, বই পড়তে পছন্দ করে – কিন্তু উপায়ান্তর নেই… দিল্লি এয়ারপোর্টের বইয়ের দোকান বন্ধ, এখন ফ্র্যাঙ্কফুর্ট অবধি আট ঘণ্টা আর ফ্র্যাঙ্কফুর্ট থেকে টরোন্টো প্রায় সাড়ে নয়–দশ ঘণ্টা ওর কিচ্ছু করার নেই।
একজন কাউকে যদি পেত, যার সঙ্গে গল্প করা যেতে পারে… তবে এয়ারপোর্টে সবাই খুব গম্ভীর থাকে। অচেনা লোকের সঙ্গে যেচে কথা বলে না কেউ। বসে বসে, বা লাইনে অপেক্ষা করতে করতে সবাই নিজের মনের জগতে হারিয়ে থাকে – বিশেষত যারা একা যাচ্ছে, তারা। অনু তাদের লক্ষ করে। সাধারণত একটা বইয়ের আড়ালে লুকিয়ে, কিন্তু আজ ফোনের দিকে তাকিয়ে।
মহিলাকে প্রথম দেখতে পেয়েছিল সিকিউরিটির লাইনে। দৃষ্টি আকর্ষণ করার মতোই ব্যক্তিত্ব। প্রথমত, এয়ারপোর্টের মতো জায়গায় বেশ জোরে কথা বলেন। তার ওপর ইংরেজিতে অ্যামেরিকান টান। দেশে বসে বিদেশী অ্যাকসেন্ট নকল করা নয়। বিদেশে বসবাস করার ফলে সহজাত অ্যামেরিকান ইংরেজি। কিন্তু সবচেয়ে বেশি চোখে পড়ে হাবভাব। একেবারে আকাট–আনাড়ি। বার বার পাসপোর্ট, টিকিট, বোর্ডিং পাস হারিয়ে ফেলছিলেন, ব্যাগ পড়ে যাচ্ছিল, খোলা ব্যাগ থেকে জিনিস পড়ে যাচ্ছিল, আর তার মধ্যেই ডাইনে–বাঁয়ে, আগে পিছে সবার সঙ্গে ঘাড় ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে বকবক করছিলেন – সব মিলিয়ে প্রায় মিনিট পনেরো–কুড়ি পেছনের লোকেদের দেরি করিয়েছিলেন। বেশ কয়েকবার পেছন থেকে উচ্চৈঃস্বরের তাগাদা শুনতে হয়েছে। অনুর মনে হচ্ছিল, এ যদি যাত্রাসঙ্গী হয়, তাহলে অন্তত কথার অভাব হবে না!
ফলে, প্লেনে উঠে, নিজেরই সারিতে, দু সিট দূরে সেই মহিলাকেই দেখে অনু বেশ খুশিই হলো। কোভিড যুগের যাত্রা – ফলে প্লেনে দুটো করে সিট বাদ দিয়ে দিয়ে যাত্রীদের বসানো হয়েছে, একটা সারি বাদে আর একটা সারিতে বসতে দেওয়া হয়েছে, বার বার করে বলে দেওয়া হয়েছে, যাত্রীরা যেন নিজেদের নামাঙ্কিত আসনেই বসেন – অন্য সিটে না বসেন। বসতে না বসতেই মহিলা কথা শুরু করলেন। নাম মৃদুলা। ভদ্রতাজ্ঞান পশ্চিমীদের মতো। অনুর নাম জিজ্ঞেস করার আগে নিজের নাম বললেন। বললেন, অনু তো ডাকনাম নিশ্চয়ই? বা অপভ্রংশ? অনুভা, অনুশ্রী… অনু কিছু বলল না। ওর ভালো নাম তমা। সেটা ও পছন্দ করে না বলে ব্যবহার করে না – কেবল খাতায় কলমে থাকে। কথা ঘোরানোর জন্য মন্তব্য করল, “মৃদুলা তো বাঙালিদের মধ্যে খুব প্রচলিত নাম না!” এবং জানতে পারল মৃদুলার মা বাঙালি ছিলেন না। অনু টরোন্টো যাচ্ছে শুনে বললেন, উনিও টরোন্টোতেই থাকেন। পঁয়ত্রিশ বছর হয়ে গেল। তার আগে, বিয়ের পর থেকেই দিল্লিতে ছিলেন, ফলে কার্যত সম্পূর্ণ প্রবাসী। কলকাতার সঙ্গে পাট চুকেছে মা বাবার মৃত্যুর পর – সে–ও তো বাইশ বছরের ওপর।
অনু যাচ্ছে ছোটোমামার কাছে। ছোটোমামাও বহু বছরের প্রবাসী। অনুর জন্মের আগে থেকেই। বার বার ডাকেন, আয়, ঘুরে যা। এবারে বললেন, গ্র্যাজুয়েশন করে বসে আছিস – পোস্ট গ্র্যাজুয়েট ক্লাস কবে শুরু হবে তার নেই ঠিক। এখানে এখন করোনা বেশি নেই – সেকেন্ড ওয়েভ শেষ হয়ে গেছে। আমরাও খুব সাবধানে আছি।
আর একটা আকর্ষণও আছে। মামার একটা ছুটি কাটানোর বাড়ি আছে। এই লেক হাউসটার গল্প খুব শুনেছে অনু। লেকের পাড়ে একেবারে জঙ্গলের মধ্যে একটা বাড়ি, তার অর্ধেক ডাঙায়, অর্ধেক জলে। একদিকে ভোরে আর সন্ধেবেলা দলে দলে হরিণ আসে মামার বাগানে গাছপালা খেতে, আর অন্যদিকে ঝাঁক বেঁধে মাছ লেকের ধারে জলে ঘুরে বেড়ায়। মামা ঠিক করেছে বাড়িটা বিক্রি করে দেবে। এখন না আসলে আর দেখতে পাবে না। এই শেষ সুযোগ জেনে বাবা বলল, চলে যা। সত্যিই ওয়ানস ইন আ লাইফটাইম অভিজ্ঞতা হবে। বিশেষ করে এই ফল্–এর সিজনে গাছপালা একেবারে দেখবার মতো…
মৃদুলার মুখে একটা কিসের ছায়া পড়ল? অনু ভালো করে বুঝতে পারছে না। এর মধ্যে রাতের খাবারের পাট চুকে গেছে। মৃদুলা কিছু খাননি – এই বয়সে এই সময়ে ডিনার খেলে আর হজম হয় না – তাই একটা সফট ড্রিঙ্কের ক্যান চেয়ে নিয়েছিলেন মাত্র – অনুর খাওয়া শেষ হবার পরে ওকে সেটাও দিয়ে দিলেন। অনু খেয়েছিল, তাই ক্যানটা সিট পকেটে ঢুকিয়ে গল্প করছিল।
কোথায় মামা–র লেক হাউস? জানো?
মৃদুলার প্রশ্নের উত্তরে অনু বলল, যতদূর শুনেছে, বাড়ি থেকে ঘণ্টা দু–তিন দূরে, মাস্কোকা লেকের পাড়ে। মৃদুলা চেনেন লেকটা। বললেন, দূরে না। লোকে অনেক দূরে দূরে যায় এরকম বাড়িতে থাকতে। মালিকরা ভাড়া দেন। ওঁরাও ভাড়া নিয়ে প্রায়ই যেতেন। তবে আজকাল আর যান না।
কেন যান না? জিজ্ঞেস করতে গিয়ে অনু থমকে গেল। থাক, কোনও ব্যক্তিগত ব্যাপার থাকতে পারে। বলার হলে নিজেই বলবেন।
কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে মৃদুলা বললেন, “বছর পনেরো আগে একটা ঘটনা ঘটেছিল… তার পর থেকে…”
এবারে অনু জিজ্ঞেস করল, “কী হয়েছিল?”
মৃদুলা সময় দেখে বললেন, “অনেকটা কাহিনি। ঘুম পাচ্ছে না?”
পাচ্ছে না। সঙ্গে সময় কাটানোর আর রসদও নেই অনুর। তাই উৎসাহভরে বলল, “না না, আমি ঘুমোব না। বলুন, বলুন।”
মৃদুলা বললেন, “ক্যানাডার জঙ্গুলে কটেজের ব্যাপারে তুমি কি জানো? শহর থেকে অনেক দূরে দূরে অজস্র কটেজ–ক্যাবিন আছে। ইউরোপে, অ্যামেরিকাতেও আছে। মালিকরা সেগুলো হয় নিজেদের ছুটি কাটানোর জন্য ব্যবহার করে, বা ভাড়া দেয়।”
অনু জানে। শুনেছে মামাও ভাড়া দেয়। দেশ থেকে কেউ গেলে ক’দিন সবাই মিলে ঘুরতে যায়। দারুণ অভিজ্ঞতা। জঙ্গল, লেক, হরিণ, মাছ – সব মিলিয়ে এক অনন্য অনুভূতি।
মৃদুলা বললেন, “ঠিক বলেছ। আমরা কটেজ কিনিনি। আমার হাজবেন্ড বলত, একটা কটেজ কেনা মানে নিজেকে বেঁধে ফেলা। ওখানেই ছুটি কাটাতে যেতে হবে। না কিনলে যেখানে খুশি যেতে পারব। সত্যিই প্রতি বছর বিভিন্ন জায়গায় যেতাম। কখনও নিউফাউন্ডল্যান্ড, কখনও ওন্টারিওতেই, কখনও অ্যালবার্টা। আমার প্রিয় ছিল অ্যালবার্টার দু–তিনটে জায়গা। ওখানে বার বার গেছি। প্রতি ফল্–এ ছুটি নিয়ে ফল–কালার্স দেখতে যেত প্রায় সারা জীবন। খুব ভালোবাসত ফল কালার্স। অভিদীপ্ত বলত – গাছেদের হোলিখেলা।”
“বছর পনেরো আগেকার কথা। একটা নতুন কটেজের খোঁজ পেয়েছিল অভিদীপ্ত। বেশ লম্বা–ই ছুটি ছিল। বোধহয় পাঁচ দিন। আমরা চারজন। আমি, অভিদীপ্ত, অভীষ্ট আর অভীশা। ও, ভালো কথা, অভিদীপ্ত আমার হাজবেন্ডের নাম। অভীষ্ট আর অভীশা – ছেলে আর মেয়ে। তখন ওরা ১৩ আর ৮ বছরের।”
অন্ধকারের মধ্যে প্রায়ান্ধকার একটা প্লেন উড়ে চলেছে, ডানার ঝলসানো আলোগুলো প্লেনের ভেতরটাকে আলোকিত করে তুলছে ঝলকে ঝলকে।
“কোথায় যাচ্ছি তখনও জানি না। সব ব্যবস্থা অভিদীপ্ত–ই করত… সারপ্রাইজ দিতে ভালোবাসত। সারা বছর ধরে প্ল্যান করত। আমরা প্রথম জানতে পারতাম যখন প্লেন ধরতে যাচ্ছি – অ্যালবার্টার প্লেন… স্যাস্কাচ্বেন–এর প্লেন…, বা হয়ত দেখতাম গাড়ি বাড়ি থেকে বেরিয়ে এয়ারপোর্টের দিকে যাচ্ছে না – তখন বুঝতাম এবারে কাছাকাছি কোথাও…
“সেবারে অ্যালবার্টা। সাড়ে চারঘণ্টার ফ্লাইট ক্যালগারি। একসঙ্গে সিট পাইনি, ফলে কথা বলার লোক ছিল না। বই পড়তে ভালো লাগছিল না। অনেকক্ষণ কেটে যাবার পরে শেষে হাল ছেড়ে প্রায় বোর হয়েই কানে ইয়ারফোন লাগিয়ে টিভি চালিয়ে চ্যানেলগুলো ঘোরাচ্ছিলাম। হঠাৎ, একটা সিনেমা শুরু হলো – তার নামটা বেশ লাগল – ওয়ান্স ইন ইওর লাইফটাইম। দেখতে শুরু করলাম…”
মৃদুলা একটু চুপ করে থেকে বললেন, “কী কুক্ষণেই যে…” কিছুক্ষণ জানলা দিয়ে বাইরের নিকষ কালো আঁধারের দিকে তাকিয়ে থেকে আবার ফিরলেন।
“অদ্ভুত, সিনেমাটা অনেকটা আমাদের মতো একটা পরিস্থিতি নিয়ে। চারজন মিলে কোথাও একটা কটেজে যাচ্ছে ছুটি কাটাতে। তবে মাইক আর রন্ডা বিবাহিত নয় – বাগদত্তা, প্রি–ম্যারাইটাল হানিমুনে যাচ্ছে। রন্ডার আপন ভাই জেফ, আর কাজিন লিন্ডা ওরফে লিনি সঙ্গে যাচ্ছে। কাজিনটির বছর আঠেরো বয়স, আর ভাইটিও টিন–এজার, সবার চেয়ে ছোটো।
“কোথায় যাচ্ছে বলা কঠিন – তবে ক্যানাডার মতোই বরফ, লেক, পাহাড় আর জঙ্গলের দেশ। মাইক আর রন্ডা – আশানুরূপভাবে খুব উত্তেজিত, যদিও মাঝে মাঝে ইয়ার্কি মেরেই জেফ আর লিনি–কে বলছে, তোরা আমাদের মধ্যে কাবাব–মে–হাড্ডি হয়ে যাচ্ছিস, ওখানে গিয়ে জ্বালাবি না মোটেই… বলে দিলাম… এই সব।”
অনুর হঠাৎ মনে হলো মৃদুলা একেবারে ছোটোমামার মতো সিনেমার গল্প বলেন। প্রথমে দেখাচ্ছে, এই… তারপরে দেখাল, ওই… ছোটোবেলায় একবার ভাইফোঁটার দিন কাচ্চাবাচ্চাদের নিয়ে বসে ‘গানস অফ নাভারোন’–এর গল্প বলেছিল। সবে নেটফ্লিক্স না কোথায় দেখেছিল। প্রথমে দেখাচ্ছে, একটা গ্রিক দ্বীপে একটা বিরাট বাড়ির ধ্বংসাবশেষ… আর মাঝে মাঝে সমুদ্র। আকাশ থেকে প্লেনে ক্যামেরা বসিয়ে। আর বলছে…
“রাস্তায় একটা জায়গায় ওদের গাড়িটা আটকে গেল। ইঞ্জিনের হুড খুলে মাইক টর্চ চাওয়ায় আবিষ্কার হলো, কোনও কারণে জেফ গুছিয়ে রাখা বড়ো টর্চটা নিয়েছিল আগের দিন, আবার ভরতে ভুলে গেছে। ওদের কাছে কেবল তিনটে ছোটো টর্চ – তাতে সামান্যই আলো হয়। এর পরেও দুটো ছোটো শহরের ভেতর দিয়ে ওদের যেতে হলো, বড়ো টর্চ কোনোও দোকানেই পাওয়া গেল না। মাইকের বেশ অস্বস্তি হচ্ছিল – বার বার বলছিল, একটা বড়ো টর্চ থাকা উচিত ছিল…
“জঙ্গলের পথে অনেকটা যেতে হলো। রোদ পড়ে গিয়েছে, আর আকাশে মেঘ বলে বেশ অন্ধকার হয়ে গিয়েছে। চারিদিক ম্যারম্যারে। এরকম একটা আবহে গাড়ি থেকে নেমেই রন্ডার প্রথম অনুভূতি হয়েছে অস্বস্তির আর ভয়ের। কার্ডিগানটা গায়ে জড়িয়ে নিয়ে বলেছে, আমার কেমন যেন লাগছে – এটা কোথায় এলাম। মাইক অবশ্য বেশ উৎসাহিত – বলেছে, আরে, কাল সকালে রোদ উঠলেই দেখবে সব ঝকঝক করছে, তখন আর এরকম লাগবে না।
“বাকি সবাই বেশ দমেই আছে। বাড়ি থেকে বেরোন’র সময় যে উৎসাহ ছিল, আর বাকি নেই। মাইকের কাছে চাবি। ও তালা খুলে বাড়িতে ঢুকল। বাড়ির ভেতরটা আরও বেশি ম্যারম্যেরে। বাইরের দরজা খুলে একটা এন্ট্রানস হল জাতীয় ছোটো ঘর – আমরা এরকম ঘরকে প্যাসেজ বলি। প্যাসেজের পরে দুদিকে দুটো করিডোর – আর সোজা গেলে বসার ঘর। একদিকের করিডোর দিয়ে গেলে দুটো শোবার ঘর, আর অন্য দিকের করিডোর দিয়ে গেলে খাবার ঘর আর রান্নাঘর। ওরা ভেতরে ঢুকে ইতস্তত করছে। মাইক একমাত্র একটু হইচই করার চেষ্টা করছে। বার বার বলছে, চলো চলো সাজিয়ে গুছিয়ে বসি… সব আলো জ্বালি – হাতের কাছে সব সুইচ জ্বেলে দিল মাইক। বেশ উজ্জ্বল আলো, কিন্তু সারা বাড়িতে, সব দেওয়ালে সারি সারি অয়েল পেন্টিং – তার কোনওটারই রং খুব উজ্জ্বল না। সবই কালো, গাঢ় বেগুনি, গাঢ় নীল, কালচে লাল, বাদামী ধরণের রঙের। মাইক বলল, ওর যে বন্ধুর বাড়ি, তার বাবা আর্টিস্ট ছিলেন। ওনারই নাকি ছবি সব। তবে সারা বাড়িতে, করিডোরে উঁচু উঁচু চারপেয়ে ছোটো ছোটো টেবিলের ওপরে নানা স্কাল্পচার আর পটারি – কাপ, ডিশ, ফ্লাওয়ার ভেস – সেগুলো কোথা থেকে এসেছে, তা মাইক বলতে পারল না।”
বহুদিন মৃদুলা অ্যামেরিকা মহাদেশে আছে। ফ্লাওয়ার ভাস–কে ভেস বলে। অনু মাস্কের আড়ালে হাসল, মৃদুলা ধরতে পারলেন না।
অনুর মনে একটা প্রশ্ন এসেছিল। জিজ্ঞেস করল, “আচ্ছা, এই সব কটেজে কেউ থাকে না? দেখাশোনা করে কে? আমাদের দেশে বাগানবাড়ি মালিকরা কেয়ারটেকার, দারোয়ান, বাড়ির কাজের লোক রাখে। বাড়ি পরিষ্কার করে, পাহারা দেয় – কখনও একই লোক সব কাজ করে – রান্নাও করে দেয়।”
মৃদুলা হেসে বললেন, “ওখানে সব নিজে করতে হয়। বেশিরভাগ ক্ষেত্রে মালিকই করে। ভাড়াটে বা গেস্ট আসার আগে–পরে বাড়ি সাফা করা, ছোটোখাট রিপেয়ার… সব। যারা পারে না, তারা প্রপার্টি ম্যানেজার রাখে। সাধারণত আসেপাশের গ্রামের মহিলারা এসে বাড়িঘরদোর পরিষ্কার করে দেয়, আর তাদের বাড়ির পুরুষরা – স্বামী বা অ্যাডাল্ট ছেলে – রিপেয়ার করে, বাগানের দেখাশোনা করে, ঘাস কাটে – এসব আর কী। তবে আমাদের দেশের কাজের লোকের মতো অল্প টাকার কাজ নয়, অনেক খরচ করতে হয় ম্যানেজারের পেছনে। বুঝলে?”
ঘাড় নাড়ল অনু। কাজের লোক আছে, কিন্তু বেশি টাকা দিয়ে কাজ পেতে হয় বলে তাদের কাজের লোক বলা যায় না।
“ঘরদোর গোছাতে হলো। নোংরা নয়, কিন্তু সব আসবাবে ভারি ডাস্ট কভার দেওয়া। সাধারণত বাড়ি ভাড়া দিলে মালিক এসে এগুলো সব সরিয়ে দেয়, আবার ভাড়াটে চলে গেলে লাগিয়ে দেয়, কিন্তু বন্ধুবান্ধবকে বলতেই পারে – ডাস্ট কভার খুলে নিস – বা ভাড়া সস্তা হলে সেগুলো ভাড়াটেরই দায়িত্ব থাকে। ওরা ডাস্ট কভার সরিয়ে ভাঁজ করে জায়গামতো গুছিয়ে রেখে গাড়ি থেকে ওদের খাবার দাবার নিয়ে এসে রান্নাঘরে লার্ডারে, ফ্রিজে ভরে রাখল। তারপরে বাকি মালপত্র বেডরুমে নিয়ে যাওয়া – দুটো শোবার ঘরের একটা বেশ বড়ো, অন্যটা অত বড়ো না। রন্ডা বলল, ও আর মাইক বড়ো বেডরুমে শোবে, জেফ আর লিনি ছোটো ঘরটা নিক।
“জেফ ফট করে আপত্তি করল। বলল, লিনি সারা রাত বয়ফ্রেন্ডের সঙ্গে গল্প করবে। আমি ওর সঙ্গে এক ঘরে থাকতে পারব না।
“সবাই থতমত খেয়ে গেছে – তাহলে জেফ শোবে কোথায়? লিনি রাগ করেছে, বলেছে, ঠিক আছে, শুতে না চাইলে ও গিয়ে বসার ঘরে শুতে পারে – ওখানে যথেষ্ট জায়গা আছে – কাউচ, মাটিতে রাগ্…
“জেফ সবাইকে অবাক করে বলেছে, কেন? আর একটা বেডরুম আছে – সেটাতে শুতে পারি – মাইক, তোমার কাছে চাবির গোছা আছে। দেখো – ওই ঘরের চাবিটা আছে নিশ্চয়ই।
“এবারে মাইক আমতা আমতা করতে লেগেছে। জানা গেল, সত্যিই আর একটা শোবার ঘর আছে, কিন্তু সেটা বাড়ির মালিক দেয়নি। বলেছে, ওদের দুটো শোবার ঘর, বসার ঘর, খাবার ঘর আর রান্নাঘরের চাবি দেওয়া হবে, কিন্তু আর একটা শোবার ঘর ব্যবহারের অনুমতি নেই। মাইক যত বলে, জেফ তত জেদ করে। মেয়েরাও বলতে শুরু করেছে, আরে, ওরা তো এখানে নেই। চুপচাপ ঘরটা ব্যবহার করে আবার গুছিয়ে রেখে দিলে কিছু হবে না। মাইক বলল, সব চাবিই আছে, বলে একটা একটা করে ট্যাগ লাগান চাবি দেখাল – কেবল ও ঘরের চাবিটা নেই। তা–ও সবার চাপাচাপিতে সেই চাবিগুলোই এক এক করে দরজায় লাগিয়ে দেখা গেল – ওগুলোর একটা দিয়েও দরজাটা খোলে না।
“সবাই নানা প্ল্যান করছে, বন্ধ দরজা কী করে খোলা যায়, মাইক তখন প্রায় বাধ্য হয়ে ওদের জানাল, যে মালিক বলেছে, ঘরটা ভালো না। ওটা খুললে সমস্যা আছে, তাই। দরজা খুললে বিপদও হতে পারে।”
মৃদুলা থেমে জল খেলেন। তারপরে বললেন, উনি কিন্তু বুঝতে পারছেন চাবি কোথায়। সিনেমায় ওই ঘরের দরজাটা এমন ভাবে দেখান হচ্ছে, যে প্রতি শটেই দরজার পাশের একটা উঁচু টেবিলে একটা গাঢ় নীল আর সোনালী রঙের ফুলদানি দেখা যাচ্ছে। বোঝা–ই যাচ্ছে, ওই ফুলদানির ভেতরে কিংবা নিচে রাখা রয়েছে ঘরে ঢোকার চাবিটা – মৃদুলা সিনেমা দেখছেন, আর ভাবছেন, ঘরে যদি বিপদ কিছু থাকেই, তাহলে চাবিটা কেন ওখানে রাখা, আর এ–ও চাইছেন যে ওরা যেন বুঝতে না পারে চাবিটা কোথায় আছে।
বিপদের কথা শুনে সবাই একমুহূর্তের জন্য থমকে গেলেও, পরমুহূর্তেই জেফ দ্বিগুণ উৎসাহে বলতে শুরু করল, তাহলে ও ঘরে কী আছে দেখতেই হবে। কিন্তু মেয়েরা আর সাহস পায় না। লিনি বলতে শুরু করল, তাহলে বরং জেফ দ্বিতীয় ঘরে ঘুমোবে, লিনি না–হয় বসার ঘরে শোবে। বলল, ওর অভ্যেস আছে রাতে কাউচে ঘুমোনো। অনেক দিনই বাড়িতে এ–ভাবে ঘুমোয়। কিন্তু রন্ডা অনেকটাই ভয় পেয়েছে। বলতে শুরু করেছে, না, কাউকে আলাদা শুতে হবে না। লিনি আর জেফ যদি একই ঘরে ঘুমোতে না চায়, তাহলে জেফ আর মাইক এক ঘরে শুক, আর লিনি আর রন্ডা অন্য ঘরটা নেবে। শুনে মাইক খুব বিরক্ত। হানিমুন বুঝি মাটি হয়। এই সব আলোচনার মধ্যে জেফ হঠাৎ হাত নাড়াতে গিয়ে না কী করতে গিয়ে ধাক্কা দিয়েছে দরজার পাশের টেবিলটাতে, নড়ে গিয়ে ফুলদানিটা প্রায় পড়ে যায় যায়… লিনি খপ করে ধরে তুলে নিয়েছে আর তখন দেখা গেছে, মৃদুলা যা ভেবেছে, তা–ই – ওর নিচেই রয়েছে একটা চাবি।
চট করে চাবিটা নিয়ে নিয়েছে জেফ। দরজা ও খুলবেই। মেয়েরা তখন প্রাণপণে বাধা দিচ্ছে, মাইক বলছে, দেখাই যাক না খুলে – ব্যবহার না করলেই হলো তো… এসবের মধ্যে জেফ চাবি ঘুরিয়ে দরজার হাতল চেপে সবে দরজাটা খুলতে যাবে, এমন সময়ে মৃদুলার যাত্রা শেষ হতে চলেছে বলে প্লেনের ইন–ফ্লাইট এন্টারটেনমেন্ট বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে!
অনু এমন হতাশ হলো, যে প্রায় চেঁচিয়ে বলে উঠেছিল, “আরে, এটা একটা গল্প হলো! তারপরে কী হলো জানতে পারলেন না?”
মৃদুলা মাথা নাড়লেন। বললেন, “আমি তো তোমাকে সিনেমার গল্প বলতে বসিনি। এটা তো বলতে পারো ভূমিকা।
মৃদুলারা দুপুর হবার ঠিক আগে ক্যালগারি পৌছলেন। অভিদীপ্ত গাড়ি বুক করে রেখেছিল, হুন্ডাই টাক্সন, অটোমেটিক ট্র্যানসমিশন, সব বুঝে নিয়ে রওয়ানা দিতে দিতে দুপুর পেরিয়ে গেল।
সিনেমাটা অর্ধেক দেখে থেকে মৃদুলা একটা অস্বস্তিতে ছিলেন – একটা সিনেমা অর্ধেক দেখলে একটা অস্বস্তি হয়ই, কিন্তু এটা তার চেয়েও বেশি। খালি মনে হচ্ছিল, কী মিস করলেন? সুযোগ পেলেই একবার ফোনে গুগ্ল্ খুলে সিনেমাটা সার্চ করছিলেন – পাচ্ছিলেন না। একবার তো অভীষ্ট বলেই ফেলল, “মা ফোনে সারাক্ষণ কী দেখছ? জিজ্ঞেস করছি, শুনতেই পাচ্ছ না!” আর একবার অভিদীপ্ত জানতে চাইল, “তোমার কী হয়েছে বলো তো, প্লেন থেকে নেমে পর্যন্ত একটা কথা বলছ না?” তখন বাধ্য হয়ে ফোনটা ব্যাগে রেখেছিলেন। তা–ও, খাওয়া শেষ করে গাড়িতে ওঠার আগে, রেস্টুরেন্ট সংলগ্ন কনভিনিয়েন্স স্টোরে গিয়ে একটা ব্যাটারি চালিত বড়ো টর্চও কিনে নিলেন। সবাই অবাক। দরকার নেই। যেখানে যাচ্ছেন সেখানে ইলেক্ট্রিক্ বাতি আছে, আর প্রতি বারের মতই অভিদীপ্ত যথেষ্ট টর্চ, সোলার ল্যাম্প ইত্যাদি নিয়েছিল। তবু মানলেন না মৃদুলা। একটা টর্চ, আর তার দু–সেট ব্যাটারি কিনে আবার গাড়িতে উঠলেন।
ঘণ্টা চারেকের রাস্তা। অ্যালবার্টার এই অঞ্চলে ওরা আগে আসেনি। যদিও অভিদীপ্ত খুব ভালো ড্রাইভার, তবু কিছুটা পাহাড়ি রাস্তা পেরিয়ে ওদের প্রায় সাড়ে চার ঘণ্টা লাগল। তখনও সূর্যাস্ত হয়নি। শীতের আগে অবধি ওখানে দিন অনেক বড়ো থাকে। হাইওয়ে ছেড়ে জঙ্গলের রাস্তা পার করে, ওরা এসে পৌঁছল ওদের গন্তব্যে। জঙ্গলের শেষে, একটা খোলা জায়গায় একটা কটেজ, চারপাশের ঘাসজমিতে বাগানের চিহ্ন নেই, বাড়ির ওপারে লেক। চারপাশের জমি পাহাড়ি।
গাড়ি থামার পরে চারিদিক নিস্তব্ধ। জঙ্গুলে শব্দ, নিঃশব্দ থমথমে, কিন্তু তাতে ভয়ের কিছু নেই – বরং উজ্জ্বল শান্ত ভাব। তবু পৌঁছন–মাত্র মৃদুলাকে আবার একটা অস্বস্তি গ্রাস করল। কোনও মিল নেই, আবার আছে। জঙ্গল, লেক আর বাড়ির দৃশ্য আলাদা, তবু তো জঙ্গল, লেক আর বাড়ি! তবু তো একটা গাড়ি থেকে চারটে মানুষ নামল – হোক না তাদের মধ্যের সম্পর্ক আলাদা! হোক না, ঝকঝকে হলদে–কমলা দেওয়াল, আর লালচে ছাদ, তবু তো সেই জলের পাশে কটেজ! তবে সবচেয়ে বেশি মৃদুলাকে যেটা ধাক্কা দিল, তা হলো বাড়ি দুটোর আদল প্রায় এক। জলের ধারে লম্বা কটেজ, এক সারিতে সবকটা ঘর, মাঝখানে ঢোকার রাস্তা। এখানে বাড়ির বাইরে দিয়ে টানা বারান্দা ধরে এক ঘর থেকে আর এক ঘরে যেতে হয়, সিনেমায় খোলা বারান্দা ছিল না, ছিল বাড়ির ভেতরে করিডোর।
হাউসকিপাররা ওদের জন্য অপেক্ষা করছিল – এ বাড়ির সার্ভিসে সেটা লেখাই ছিল – ইডিথ আর বব স্বামী–স্ত্রী, থাকেন কাছেই গ্রামে। ওখানকার একাধিক হলিডে কটেজে কিপারের কাজ করেন। ঘর–দোর তৈরি, ওদের মালপত্র গুছিয়ে দিয়ে, খাবার–দাবার সাজিয়ে দিয়ে ওরা বিদায় নিলেন। বলে গেলেন, কোনও অসুবিধে হলে যোগাযোগ করতে, গ্রামে যাবার রাস্তা ওইদিকে।
ওরা চলে যাবার পরে মৃদুলার অস্বস্তিভাবটা আবার ফিরে এল। জোর করে সেটাকে দমন করে গেলেন সূর্যাস্ত দেখতে। লেকের ওপারে জঙ্গুলে পাহাড়ের ওদিকে সূর্য ডুবে গেল দেখতে দেখতে। ছায়া ছায়া অন্ধকার নেমে এল চারিদিকে। কটেজটার দু দিকেই টানা বারান্দা – মৃদুলা আর অভিদীপ্ত লেকের দিকের বারান্দায় ইজি চেয়ারে বসে ছিলেন। অভিদীপ্ত জানতে চাইলেন, “কটেজটা তোমার চেনা লাগছে?”
মৃদুলা এত চমক জীবনে কমই পেয়েছেন। কোনও রকমে দুরন্ত হৃদস্পন্দন উপেক্ষা করে বললেন, “কেন বলো তো? তোমার চেনা?”
অভিদীপ্ত হেসে বললেন, “তোমার মনে পড়ছে না? আমরা যখন প্রথম ক্যানাডা এলাম – প্রথম ফল্ কালার্স দেখতে গেছিলাম যেখানে সেই কটেজটা একদম এরকম ছিল।”
মৃদুলা ভুরু কুঁচকে চেয়ে রইলেন। প্রথম ক্যানাডা আসা অনেক বছর আগে। তখন গুড্ডু আর কুট্টিকে আনতে পারেননি। স্কুল চলছিল বলে ওরা ঠাকুর্দা–ঠাকুমার কাছেই ছিল দিল্লিতে। ওরা এসেছিল কয়েক মাস পরে। তখন এরকম কটেজে এসেছিলেন ওরা? না আসার কারণ নেই। ফল্ কালার্স দেখা অভিদীপ্তর একটা অবসেশনের মতো। কিন্তু, না। মৃদুলার মনে নেই সেই ছুটির কথা।
অভিদীপ্ত একটু হতাশ হলো। মৃদুলার স্মৃতিশক্তি চাগাড় দেবার জন্য বলল, “মনে নেই? আমরা বলেছিলাম এটাই আমাদের আসল হানিমুন। বিয়ের পর দু–পক্ষের মা–বাবাকে সঙ্গে নিয়ে পুরী–ভ্রমণ মোটেই হানিমুন ছিল না!”
তারপরে যেটা বলল অভিদীপ্ত, সেটা শুনে মৃদুলার মেরুদণ্ড দিয়ে একটা ঠাণ্ডা স্রোত বয়ে গেল।
অভিদীপ্ত বলল, “আমার এসে থেকে মনে হচ্ছে – দিস কুড বি আওয়ার সেকেন্ড হানিমুন!”
যথানিয়মে সন্ধে কাটল। যতক্ষণ বাইরের আলো থাকে ততক্ষণ বাইরে থাকা, তারপরে ঘরে ঢুকে মা–বাবা ছেলে–মেয়ে আড্ডা, গল্প, হাসি, তামাশা – তবে অভীষ্ট এখন বড়ো হচ্ছে, ওর বন্ধুবান্ধবদের সঙ্গেও যোগাযোগ রাখার চেষ্টা বজায় রাখছে, তাই ও অনেকটা সময়–ই ওদের সঙ্গে ছিল না, এদিকে ওদিকে চলে যাচ্ছিল।
খাওয়া–দাওয়া সেরে শুতে যাবার সময় পরের ঘটনাটা ঘটল। মৃদুলা সবে জিজ্ঞেস করেছেন, “তোমাদের বিছানা তোমরা করে নিতে পারবে, না কি আমাকে করে দিতে হবে?” তখন অভীশা বলল, “দাদা গাড়িতে সারা রাস্তা, এখানে এসে থেকে সারা সন্ধে কেবল গার্লফ্রেন্ডের সঙ্গে গল্প করেছে, রাতেও নিশ্চয়ই রাত জেগে দুজনে গ্যাঁজাবে, সেলফোনের আলোতে আমার ঘুম আসে না, আমি দাদার সঙ্গে এক ঘরে ঘুমোব না।”
কথাটা অভীশা যখন বলেছে, তখন মৃদুলা কী করছিলেন, তা মনে নেই, কিন্তু এখনও, এত বছর পরেও পরিষ্কার মনে আছে, কথাটা শুনে থমকে গেছিলেন, দরজার থেকে মেঝের ওপর কাঠের দাগের দিকে চেয়ে ছিলেন – সে দাগের ডিজাইনটা চাইলেই এখনও দেখতে পান মনের চোখে।
মৃদুলা কিছুই বলতে পারেননি। অভিদীপ্ত বলল, “কোথায় ঘুমোবি তবে? বুড়ো বয়সে মা–বাবার সঙ্গে এক ঘরে ঘুমোতে পারবি?”
অভিশা বলল, “না, তা কেন? দাদাকে বলো, ও বসার ঘরে ঘুমোক।”
মৃদুলা ততক্ষণে ধরেই নিয়েছেন, যে ওদের জীবনের গতিও সিনেমাটার মতোই চলছে। সামান্য রদবদলগুলো কিছু না, আসলে সিনেমায় চারজনের যা হয়েছিল, ওদেরও তা–ই হবে এবং সিনেমার শেষে কী হয়েছিল সেটা জানা খুব দরকার। তাই, বাকিরা যতক্ষণ আলোচনা করছে – মৃদুলা চট করে সেলফোন খুলে নেট সার্চ করছেন – পাচ্ছেন না সিনেমা–টা। এর মধ্যে ছেলেমেয়ের ঝগড়া তুঙ্গে উঠেছে, মৃদুলা সেল ফোন থেকে মুখ তুলে দেখেন ওরা প্রায় হাতাহাতি করার মুখে, অভিদীপ্ত অসহায়ের মতো ওঁর দিকে তাকিয়ে – ওদের থামান’র জন্য ছেলেকে বললেন, “আচ্ছা, দুজনে না–হয় একই ঘরে শুলে না, কিন্তু বসার ঘরে শুতে তোমার আপত্তি কী? কাউচ–টা তো বেশ বড়ো…”
প্লেনের অল্প আলোয় মৃদুলা অস্পষ্ট, কিন্তু কোথা থেকে একটা আলো পড়ছে ওর মুখে। চোখ দুটো বিকট রকম জ্বলজ্বল করছে। অনু অস্বস্তিতে এদিক ওদিক তাকিয়ে দেখে, ওরই সিটের ওপরের রিডিং ল্যাম্পটা জ্বলে রয়েছে। হাত বাড়িয়ে নেভাতে যাবে, মৃদুলা থামালেন। বললেন, “থাক। ওটা আছে বলে তোমার মুখ দেখতে পাচ্ছি। নইলে তুমি একেবারেই অন্ধকারে।”
“ছেলে কী বলল?” জানতে চাইল অনু।
মৃদুলা বললেন, “ছেলে যা বলল, তাতে আবার আমার শরীরে হিমশীতল স্রোত বয়ে গেল। বলল, কেন, একটা স্পেয়ার বেডরুম আছে – সেখানে শুলেই তো হয়?”
মৃদুলা এতটাই হতভম্ব হয়ে গিয়েছিলেন, যে কিছুক্ষণ কিছুই বলতে পারেননি। তারপরে হঠাৎ কথা ফিরে এল যেন। অভিদীপ্ত কী বলছিল, ওর কথা কেটে চেঁচিয়ে বললেন, “না, কক্ষনও না, কিছুতেই না – এই দুটো ঘরের মধ্যেই থাকতে হবে।”
অভিদীপ্ত এসে মৃদুলাকে দু’কাঁধে ধরে বলল, “মৃদু, কী হলো তোমার? চুপ করো, চেঁচিও না। এ বাড়িতে দুটোই বেডরুম। সুতরাং…”
অভীষ্ট আবার বলল, “না। আর একটা বেডরুম আছে। এই তো, এখানেই…”
মৃদুলা আবার অনুকে জিজ্ঞেস করলেন, “ঠিক সিনেমার মতো – বুঝতে পারছ?”
অনুর এতক্ষণ মনে হচ্ছিল, সিনেমার সঙ্গে মিলটা আপাতদৃষ্টিতে থাকলেও মহিলা জোর করে মিল খোঁজার চেষ্টা করছেন, এমন কিছু মিল নেই। বিশেষত হানিমুনের ব্যাপারে মিল টেনে আনায় ওর বেশ হাসিই পেয়েছিল। কিন্তু এখন ঘাড় নাড়ল। মিল আছে বইকি। বলল, তারপর?
অভীষ্ট বলল, “বসার ঘরের ওপাশের ঘরটাই বেডরুম।”
অভিদীপ্ত পকেট থেকে ফোন বের করে কটেজের মালিকের ইমেইলটা বের করে বলল, “পরিষ্কার লেখা আছে – দুটো বেডরুম, ডাইনিং, ড্রইং আর কিচেন – কটেজের দু’দিকে টানা বারান্দা – দু–দিকেই দরজা আছে, ইচ্ছেমতো এদিক বা ওদিক দিয়ে ঢোকা–বেরোনো যায়। তিনটে বেডরুমের কথা নেই।”
অভীষ্ট – উফফ্, বলে খাবার ঘর থেকে বেরিয়ে বারান্দা ধরে হাঁটা দিল। খাবার ঘর আর বসার ঘরের দরজার মাঝখানে আর একটা দরজা। বন্ধ। সব ঘরে, বারান্দায়, সর্বত্র আলো জ্বলছে, কিন্তু ওই ঘরটা অন্ধকার। দরজার সামনে দাঁড়িয়ে বলল, “এটা কী? ঘর না?”
ভুরু কুঁচকে অভিদীপ্ত বলল, “হতে পারে, কিন্তু এটা তো বন্ধ।”
অভীষ্ট বলল, “হাউসকিপারদের ফোন করে জিজ্ঞেস করা যায় না, আমরা এই ঘরটা খুলতে পারি কি না? ওদের কাছে চাবি আছে নিশ্চয়ই?”
অভিদীপ্ত কিন্তু কিন্তু করে বলল, “তা হতে পারে, কিন্তু যদি তিনটে ঘর আমাদের ওরা ভাড়া দিতেই চাইত, তাহলে সেটা বলল না কেন? ওদের বিজ্ঞাপনেও কিন্তু দু–বেডরুম বলা আছে, তৃতীয় বেডরুমের কথা লেখাই নেই – এই যে, বলে ফোন থেকে ওয়েবসাইটের বিজ্ঞাপনটা দেখিয়ে বলল, স্লিপিং স্পেস ফর ফোর পার্সন্স।”
মৃদুলা ততক্ষণে প্রাণপণে সেল ফোনে সিনেমাটা খুঁজছেন। কোথাও পাচ্ছেন না। এমন সময় ওঁর চোখ পড়ল এই ঘরের দরজার পাশে একটা স্টুলের ওপরে একটা ফুলদানী রাখা রয়েছে। পোর্সেলিনের তৈরি – উজ্জ্বল নেভি ব্লু আর সোনালীর ডিজাইন। সিনেমাতেও ঠিক এমনই কালার কম্বিনেশন ছিল ফুলদানীটার। যদিও ডিজাইনটা অন্যরকম ছিল। এই বাড়িতে অত ছবি আর আর্টওয়ার্ক নেই। গোটা বারান্দায় এই একটাই স্টুল, আর একটাই ফুলদানী – আর সেটাই এই দরজার পাশে। মৃদুলা জানেন, ওটা সরালেই তার নিচে কী পাওয়া যাবে।”
অনু খেয়াল করল ওর নিঃশ্বাস বন্ধ হয়ে গেছে। মৃদুলা লক্ষ করলেন ওর মুখের – না, চোখের ভাষা। বললেন, “আমিও খুব ভয় পেয়েছি। আমি কিছু বলতে পারছি না, আমি একদৃষ্টে চেয়ে আছি ফ্লাওয়ার ভেসটার দিকে, আর মনে মনে বলছি, না, না, কেউ যেন খেয়াল না করে ওটা যে রয়েছে…
অভীষ্ট বলছে, কেয়ারটেকারকে ফোন করে জিজ্ঞেস করাই যায়, ঘরটা ব্যবহার্য হলে আমরা এখনও গিয়ে চাবি নিয়ে আসতে পারি, অভিদীপ্ত বলছে সেটা উচিত হবে না, পরে কথায় কথায় জানা যেতে পারে, এমন সময় অভীশা বলল, আমি জানি চাবি কোথায় আছে। ওই ফ্লাওয়ার ভেস–এর নিচে।
মৃদুলা চিল চিৎকার করে বলেছেন, “না, ওখানে হাত দিও না…” কিন্তু কোনও শব্দ বেরিয়েছল কি না মনে নেই… কেউ শুনল না, অভিদীপ্ত ফুলদানীটা সরিয়ে দেখল, সত্যিই ওটার নিচে একটা দরজার চাবি। বলল, “খুলে দেখতে তো ক্ষতি নেই – আবার বন্ধ করে রেখে দিলেই হবে, তবে হ্যাঁ, মালিক বা কেয়ারটেকারের অনুমতি ছাড়া ঘর আমি ব্যবহার করতে দেব না। সেরকম হলে ওদের সঙ্গে তিনটে বেডরুমের কনট্র্যাক্ট করতে হবে…”
মৃদুলা ততক্ষণে কেমন উদ্ভ্রান্তের মতো হয়ে গেছেন। বলছেন, “না, না। ওই ঘর খুলবে না। খুলবে না। আমি আগে দেখি… দেখি…” আর খুঁজে চলেছেন… ওরা জিজ্ঞেস করছে, “কী দেখবে? কী হলো…” কিন্তু – কোথাও ফিল্মটা নেই – ওই ওয়ান্স ইন ইওর লাইফটাইম… কোনও ওয়েবসাইটে নেই, কোনও রেফারেনস নেই – আইএমডিবি, রটেন টমাটোজ, ইয়াহু মুভিজ, মুভি–ডট–কম… উইকিপিডিয়া… মৃদুলার খালি মনে হচ্ছে, দরজাটা খোলা যাবে না… উচিত হবে না… সাংঘাতিক একটা কিছু ঘটে যাবে… আর খালি মোবাইলে স্ক্রিন থেকে স্ক্রিনে যাচ্ছেন – কোথাও যদি জানতে পারেন সিনেমায় ওই তৃতীয় ঘরের দরজা খোলার পরে কী হয়েছিল… আর একই সঙ্গে মনে হচ্ছে ওই ছবি তো আর দেখতে পাবেন না – ওটার নামই তো ওয়ান্স ইন ইওর লাইফটাইম – একবারই দেখতে পাওয়া যাবে…”
ঠিক এই সময়ে ফট্ ফট্ করে আলো জ্বলে উঠল প্লেনের ভেতরে, পাবলিক অ্যাড্রেস সিস্টেমে শোনা গেল প্লেন প্রায় পৌঁছে গেছে – আর কিছুক্ষণের মধ্যেই ল্যান্ড করবে।
এর মধ্যেই আট ঘণ্টা কেটে গেছে? অনুর খেয়াল হলো ওদের দিকের জানলার বাইরে অন্ধকার থাকলেও অন্যদিকের আকাশে হালকা আলোর ছোঁয়া। সূর্য উঠছে। ফ্র্যাঙ্কফুর্ট পৌঁছন’র কথা সকাল সাতটা দশ মিনিটে – ওখানে সূর্য উঠবে সাড়ে সাতটার পরে।
দুজনে ওয়াশ রুম গেলেন। ফিরে এসে মৃদুলা কিন্তু আর বলতে চাইলেন না। বললেন অনেক বাকি আছে। শর্টে বলা যাবে না, আর তা ছাড়া চারপাশের লোকজনের কথাবার্তা, চলাফেরায় অসুবিধে হবে। সেটা অনুও বুঝছিল কিন্তু বাকিটা না জেনে তো যাওয়া যাবে না।
মৃদুলা বললেন ওঁর ফ্র্যাঙ্কফুর্টে একটু কাজ আছে, তাই এয়ারপোর্টেও একসঙ্গে থাকতে পারবেন না। দুজনে টিকিট বের করে মেলালেন – দুজনেরই ফ্র্যাঙ্কফুর্ট–টরোন্টো যাত্রাও একই প্লেনে। মৃদুলা বললেন, “তাহলে ট্রানসফার ডেস্কে দেখা হবে। ধরো ফ্লাইটের ঘণ্টা দুয়েক আগে – একসঙ্গে গিয়ে পাশাপাশি সিট চাইব, কেমন?”
দেখতে দেখতে প্লেন নামল ফ্র্যাঙ্কফুর্টে, আর ডিসেম্বার্কেশনের অনুমতি পাওয়ামাত্র, মৃদুলা, “দেখি, রে, আমি একটু চটপট বেরিয়ে যাই…” বলে অনুকে, অন্যান্য প্যাসেন্জারদেরও একটু ঠেলেঠুলেই বেরিয়ে গেলেন, কিছুদূর গিয়ে একবার ঘুরে হাত নেড়ে গেলেন, টা টা মার্কা।
ফ্র্যাঙ্কফুর্টে নেমে অনু কিছু করার খুঁজে পেল না। অতবড়ো এয়ারপোর্ট সকাল সাতটায় প্রায় ঘুমন্ত, প্রায় কোনও দোকানই খোলেনি – অবশ্য ওদেরই বা দোষ কী? সূর্যই তো ওঠেনি এখনও। খুঁজে–পেতে একটা ব্রেকফাস্ট খাওয়ার জায়গা পেল – বাবা বলে দিয়েছিল ফ্র্যাঙ্কফুর্টে গিয়ে অবশ্যই ফ্র্যাঙ্কফুর্টার খাবি। আর বিয়ার। অত সকালে বিয়ার খেতে ইচ্ছে করছিল না, তাই ফ্র্যাঙ্কফুর্টার সহযোগে এক মগ কফি অর্ডার দিল। গল্পটা মাথা থেকে বেরোচ্ছে না। হঠাৎ মনে হলো, মৃদুলা দুটো গল্পেই টর্চের কথা বলেছিলেন ফলাও করে। টর্চের একটা ভূমিকা ছিল নিশ্চয়ই? নইলে বার বার বলতেন না। সিনেমাটা যতদূর দেখেছিলেন তাতে টর্চ আসেনি। কিন্তু মৃদুলা যে টর্চ কিনেছিলেন, সেটা কী কাজে লাগল? সেটা জানতে হবে পরের যাত্রায়। গল্প বলতে জানেন বটে মহিলা। ভাষার দখলও সাংঘাতিক। ফল কালারকে ওর বর বলত – গাছেদের হোলিখেলা। থমকে গেল। অভিদীপ্ত বলত – গাছেদের হোলিখেলা। মৃদুলা কি ওর ফ্যামিলির কথা বলতে বার বার অতীতকালই শুধু ব্যবহার করছিলেন? আর কী বলেছিলেন? অভিদীপ্ত ফল্ কালার্স দেখতে যেত সারা জীবন, অভিদীপ্ত ভালো গাড়ি চালাত, ছুটি অর্গানাইজ করত, গাড়ি ভাড়া করত – সবই কেমন অতীতকাল মার্কা। কেন?
তারপরেই কয়েকটা অদ্ভুত গরমিলের কথা খেয়াল হলো। কতদিনকার আগের ঘটনা বলছিলেন মহিলা? পনেরো না? পনেরো বছর আগে… চট করে ফোনে সার্চ করল। এই ক’দিন আগে ওর মামাতো দাদা বলেছিল বস নতুন গাড়ি কিনেছে… হুন্ডাই টাক্সন, তাতে অটোমেটিক ট্রানসমিশন আছে।
উইকিপিডিয়া বলছে, গাড়িটা ২০১১তে প্রথম ইউ–এস–এ–তে আসে। পনেরো বছর আগে এ গাড়ি নিয়ে ক্যানাডা বেড়ানোর সম্ভাবনা কতটা?
অনুর ভীষণ ঘুম পাচ্ছে বসে বসে। সারা এয়ারপোর্টটাই কেমন ঝিমন্ত। কিছুক্ষণ এদিক ওদিক হাঁটল। বসলেই ঢুলছে। সারা রাত জাগার ফল – কী নাম ছিল সিনেমাটার? ওয়ান্স ইন আ লাইফটাইম? না ওয়ান্স ইন ইওর লাইফটাইম? ট্রানসফার ডেস্কের কাছে এসে একটা চেয়ারে বসে ওরকম যতগুলো নাম হতে পারে, সবকটা দিয়েই সার্চ করল। একটা দুটো – যেমন ওয়ান্স ইন আ লাইফটাইম – নামে সিনেমা আছে, কিন্তু সে অন্য সিনেমা, কোনও ভাবেই মৃদুলার দেখা ছবির সঙ্গে তাদের মিল নেই। হঠাৎ আর একটা জিনিস খেয়াল হলো। অনু যে ভাবে ফোনের স্ক্রিনের ওপর আঙুল দিয়ে টাচ্–স্ক্রিন ফোনে সার্চ করছে, মৃদুলাও ঠিক সেরকমভাবেই হাতে ফোন ধরে আঙুল দিয়ে ঘষে ঘষে দেখাচ্ছিলেন উনিও সিনেমাটা সার্চ করছিলেন। কিন্তু পনেরো বছর আগে…
আবার গুগ্লের শরণাপন্ন। অ্যাপেল প্রথম টাচ স্ক্রিন ফোন আনে বাজারে – তার আগে–পরে স্যামসাং, বা এলজি – কিন্তু সে সবই দু–হাজারের দশকের শেষের দিকে। আজ থেকে পনেরো বছর আগে এরকম ফোন ছিল না। তাহলে? শুধুই কি অভ্যেসবশত সিনেমা সার্চ করার কথা বলার সময়ে মৃদুলা টাচ–স্ক্রিনে আঙুল বোলাচ্ছিলেন?
অনু ট্রান্স্ফার ডেস্কের সামনে হাঁটল কিছুক্ষণ। আরও একটা অসঙ্গতির কথা খেয়াল হলো… মহিলার বয়স কত? পঁয়ত্রিশ বছর ক্যানাডায়, তার আগে বারো বছর দিল্লিতে – বিয়ের পর থেকে। সাতচল্লিশ বছর আগের বিয়ের সময় যদি কুড়ি একুশ বছরও বয়স হয়ে থাকে – তাহলে আজ অন্তত সাতষট্টি। এত বয়স্ক লাগছিল না, পঞ্চাশ থেকে ষাটের মধ্যে মনে হচ্ছিল। তবে অনেকে বয়স ধরে রাখতে পারে।
কিন্তু সাতচল্লিশ বছর আগে যার বিয়ে – তার বড়ো ছেলের বয়স পনেরো বছর আগে তেরো? বিয়ের উনিশ বছর পরে ছেলে হয়েছে? এটা অসম্ভব না হলেও বিশ্বাস করা একটু কঠিন। যদিও নিজের ছেলে–মেয়ে না–ও হতে পারে, হয়ত ছেলেপিলে হয়নি বলে দত্তক নিয়েছেন…
ধ্যাৎ, বলে নিজেকে ধমকে অনু আবার গিয়ে বসল। ও গোয়েন্দা না – এত মাথা না ঘামালেও চলবে। কিন্তু মন থেকে বের করতে পারছিল না। আবার উঠল একা একা ওই বিশাল এয়ারপোর্টের এদিক ওদিক হাঁটতে হাঁটতে, বন্ধ দোকানের আলো–জ্বলা শো–কেসের উজ্জ্বল বিপনী দেখতে দেখতে এদিক ওদিক খুঁজল – যদি মৃদুলাকে দেখতে পায়, এখানেই ধরে বলবে, বাকিটা বলুন। এখনই।
সময় এসে গেল। মৃদুলার হদিস নেই। বলেছিল ফ্লাইটের দু’ঘণ্টা আগে আসতে। ক্রমে পাঁচ মিনিট গেল, দশ মিনিট… অনু ট্রানসফার ডেস্কে গিয়ে জানতে চাইল মৃদুলা কি এর মধ্যে ট্রানসফার করিয়ে চলে গেছেন?
অন্য যাত্রীর সম্বন্ধে কোনও ইনফরমেশন দেওয়া বারণ। আরও পাঁচ মিনিট অপেক্ষা করে অনু গেট–এর দিকে রওয়ানা দিল।
ওখানেও মৃদুলা নেই। ঘণ্টাখানেক পর ফ্র্যাঙ্কফুর্ট–টোরোন্টো ফ্লাইট এল। তখনও না। অনুর সিট আবার প্যাসেজের ধারেই। দেখতে পাচ্ছিল, ওর পরে কে উঠছে। কিন্তু এই বিরাট প্লেনগুলোতে একাধিক দরজা, ফলে অন্য দরজা দিয়ে কেউ ঢুকে অন্য দিকে চলে গেলে বোঝা যায় না।
এত বড়ো প্লেনে ঘুরে ঘুরে খুঁজে পাওয়া যাবে না। জিজ্ঞেস করতে হবে। কিন্তু চালাকি করে – নইলে এক যাত্রীর খবর আর এক যাত্রীকে বলবে না ওরা। এয়ার হোস্টেসকে ডেকে বলল, “আমার এক আন্ট এই ফ্লাইটে আছেন, কিন্তু ফোনে পাচ্ছিলাম না বলে যোগাযোগ করতে পারিনি। নাম মৃদুলা। কোথায় বসেছেন দেখতে পারবেন কি? বলবেন, আমি – অনু – এই সিটে আছি?”
“আমি দেখছি,” বলে চলে গেলেন মহিলা। একটু পরে একজন স্টুয়ার্ড এসে বললেন, “এক্সকিউজ মি, আপনি কী নাম বলছিলেন?”
নাম জেনে, লিস্ট মিলিয়ে বললেন, “স্যরি, এই ফ্লাইটে ওই নামে কারও বুকিং–ই নেই।”
অত্যন্ত আশ্চর্য হল অনু – টিকিটটা ও–ও দেখেছে, ফ্লাইট নম্বর, সময় – ইত্যাদি সব মিলেছিল। কিন্তু মৃদুলা প্লেনে না উঠলেও তো নামটা দেখা যাবার কথা। ওর অবাক ভাব দেখে, এবং বয়সের জন্য, এবং মেয়ে বলেও বোধহয়, স্টুয়ার্ড একটা অ্যানাউনসমেন্টও করলেন – মৃদুলা নামে যদি কেউ এই ফ্লাইটে থাকেন, তাহলে ফ্লাইট–ক্রুর দৃষ্টি আকর্ষণ করবেন দয়া করে, আপনার আত্মীয় অনু এই ফ্লাইটে আছেন।”
কেউ সাড়া দিল না।
ব্যাপারটা বুঝল না অনু।
ফ্র্যাঙ্কফুর্টার খেয়ে পেট ভরা তাই সামান্য ব্রেকফাস্ট খেয়ে, একটা কাপ কফিতে আধচুমুক দিয়ে ফেলে দিয়ে অনু কখন ঘুমিয়ে পড়েছে, জানে না।
ঘুম ভাঙল – বাইরে দিনের আকাশ। তবে পাশে বসা সহযাত্রী জানলা বন্ধ করে ঘুমোচ্ছেন বলে অনুর চোখে এতক্ষণ আলো লাগেনি। ঘণ্টা তিনেক কেটেছে ঘুমিয়ে। এখনও প্রায় ঘণ্টা ছয়েক যাত্রা। অনু ভাবল, খাতা খুলে গল্পটা লিখে রাখবে। সিনেমার নামটাও লিখে রাখতে হবে। কোনও দিন যদি দেখার সুযোগ হয় – দুটো গল্পই অন্তত অর্ধেক হয়ে থাকবে না।
খাতা বের করে লিখতে বসল। আপাতত পয়েন্টগুলো লিখে রেখে পরে ডিটেল লেখা যাবে। তবে খটকার জায়গাগুলো বিশদে লিখল, যদি ভুলে যায়!
অনেকটা সময় লাগল লিখতে – মাঝে খেতেও দিয়ে গেল। খাওয়া শেষ করে আবার ঘুমিয়ে পড়ল। সারা রাত না ঘুমোনোর ফল।
এবার ঘুম ভেঙে দেখল যাত্রার আর বিশেষ বাকি নেই। ঘণ্টা খানেকের মধ্যেই টরোন্টো পৌঁছবে। কিছু করার নেই, সিটের হাতল থেকে রিমোটটা খুলে বোতাম টিপল অনু। টিভিটা চালু হতেই একটা সিনেমা শুরু হলো। অন্ধকার নীলচে ব্যাকগ্রাউন্ডে একটা জঙ্গুলে জায়গা, তাতে একটা কটেজ – বরফের দেশে যেমন হয় – উল্টোনো ‘ভি’ আকৃতির ছাদ, তার রং সবজেটে – আর পেছনে একটা লেক। দেখতে দেখতে পর্দায় ফুটে উঠল ছবির নাম – ওয়ান্স ইন ইওর লাইফটাইম! অনু হতবাক হয়ে চেয়ে রইল। কানে ইয়ারফোন নেই, কিছু শুনতে পাচ্ছে না – কিন্তু দেখতে পাচ্ছে চেনা গল্প। চারজন ছেলে মেয়ে – গাড়িতে মালপত্র তুলছে, বোঝা–ই যাচ্ছে তারা বেড়াতে যাচ্ছে। কিন্তু অনু শুধু দেখছে দুটি মেয়ের মধ্যে যে বড়ো, তাকে। তার বডি–ল্যাঙ্গুয়েজ থেকে পরিষ্কার, সে তার প্রেমিক, বা স্বামীর সঙ্গে কোথাও যাচ্ছে, আর অন্য দুটি ছেলেমেয়ে তাদের থেকে খুব ছোটো না। কিন্তু – এ যদি রন্ডা হয়, তাহলে একে অনু রন্ডা বলে চেনে না। দিল্লি থেকে ফ্র্যাঙ্কফুর্ট এই চোখ দুটোই সারা রাত চেয়ে ছিল ওর দিকে। এ–ই ওকে গল্প বলেছিল সারা রাত।
এই ছবিটা ওর দেখা উচিত না, শেষ হবার মতো সময় আর বাকি নেই ফ্লাইটে, ওর উচিত টিভিটা বন্ধ করে দেওয়া… কিন্তু ও এ সব কিছুই করল না। নিথর বসে দেখতে থাকল মৃদুলা… না, রন্ডা আর মাইক, আর জেফ আর লিনি গাড়ি করে রওয়ানা দিল নিরুদ্দেশের দিকে…