“পশ্যামি দেবাংস্তব দেব দেহে/ সর্বাংস্তথা ভূতবিশেষসংঘান্ / ব্রহ্মাণমীশং কমলাসনস্থম্/ ঋষীংস্চ সর্বানুরগাংস্চ দিব্যান্।”
অর্জুনকে শ্রীকৃষ্ণ সবে তাঁর বিশ্বরূপ দেখিয়েছেন। নতজানু পার্থ স্বীকার করে নিচ্ছেন যে তাঁর সারথির দেহে দেবতা ও ভূতের (যে অর্থেই হোকনা কেন) সহাবস্থান রয়েছে। সৃষ্টিকর্তা ব্রহ্মা এবং তাণ্ডবনৃত্যের শিব একই শরীরে বর্তমান।
আজ সারথিদের নিয়ে বলবো। ছোটবেলা থেকে আমার দেখা সারথিদের সম্পর্কেও নিঃসন্দেহে মহাভারতের এই শ্লোকটা খেটে যায়। নাইট ডিউটি দিয়ে চেম্বারে যাওয়ার সময় রাস্তার একটা ঘন্টা আমি পেছনের সীটে জড়সড় হয়ে ঘুমিয়ে যেতাম। নাইট ডিউটির ব্যাগটায় আমার চাদর রাখা থাকতো। আমার এক ড্রাইভার পরম মমতায় আমাকে চাদরে মুড়ে দিত। গন্তব্যে পৌঁছে দেখতাম আমি চাদরে মোড়া।
খানাখন্দ বাঁচিয়ে সুশীল আমার ঘুমের ব্যাঘাত না ঘটিয়ে ঠিক সময়ে চেম্বারে পৌঁছে দিয়েছে। আবার অন্য এক সারথির জন্য থানা থেকে ফোন পেয়েছি। “স্যার, অমুক আপনার ড্রাইভার?”
আমি শশব্যস্ত হয়ে বলি- “হ্যাঁ, কেন, কি হয়েছে?”
কিছু নয় বলে চেনা পুলিশ অফিসার ফোন রেখে দিয়েছেন। পরে জানতে পারি যে জুয়ার আসরে বাবু ধরা পড়ে আমার নাম নিয়েছিলেন। এবং আমাকে ‘শো’ করে বাজি জিতে বেরিয়েও এসেছেন।
আমি নিজে ড্রাইভিং জানি। রীতিমত লাইসেন্স আছে। কিন্তু একজন আইসক্রিম বিক্রেতার গাড়ি ভাঙার পর গাড়ি চালানো ছেড়ে দিয়েছি। সে অন্য গল্প, পরে বলা যাবে।
আমার ছোটবেলায় প্রথম সারথি হিসেবে পেয়েছিলাম এক বয়স্ক মানুষকে। মায়ের আব্দার রাখতে বাবা একটা অ্যাম্বাসেডর কিনেছিল। সেকেন্ডহ্যান্ড বললে শ্রদ্ধেয় গাড়িটিকে অসম্মান করা হবে। ফিফথ কি সিক্সথহ্যান্ড গাড়িটি চলার থেকে থামতো বেশি। থেমে গেলেই গাড়ির সমবয়সী ড্রাইভার আমাদের ঠেলতে বলত। আমরা হইহই করে নেমে গিয়ে ঠেলতে লাগতাম। গাড়ি হঠাৎ করে একটা ঝটকা মেরে চলতে শুরু করতো। সেই চলন্ত গাড়িতে আমরা বনগাঁ লোকালে ওঠার মতো করে উঠে পড়তাম। শেষের দিকে ড্রাইভারদাদু আর মুখে ঠেলার কথা বলত না। গাড়ি থেমে গেলে আমাদের দিকে আড়চোখে তাকাতো। সমঝদারো কে লিয়ে ইশারাই কাফি হ্যায়। আমরাও ঝট করে নেমে গাড়ি ঠেলতে লাগতাম। ছোটবেলাকার টুকরো কিছু কথা মনে রয়ে যায়। কোথাও একটা যাবার কথায় মাকে বাবা বলেছিল – “তোমরা গাড়িতে চলে যাও, আমার তাড়া আছে – আমি রিকশায় চলে যাবো।”
খুব স্বাভাবিক কারণেই সেই ভিন্টেজ গাড়ি বেশিদিন আমাদের বাড়িতে থাকেনি।
চাকরি সূত্রে প্রথম ড্রাইভার হিসেবে পেয়েছিলাম অসীমদা এবং তামাংদাজুকে। ইলেক্ট্রিসিটি বোর্ডের হাসপাতালের ড্রাইভার। রাম্মামে পোস্টিং। সিকিম বর্ডারের কাছে জায়গাটা। রাম্মামে দুটো মেডিক্যাল ইউনিট। দুজন ডাক্তার। ভয়ংকর সুন্দর জায়গা। পাহাড়ের একদিক খাড়া ওপরে উঠে গেছে। অসংখ্য সুন্দর সুন্দর রঙবেরঙের নামনাজানা ফুল সবুজ গুল্মলতার গায়ে জড়িয়ে রয়েছে। কোন অদৃশ্য লোক থেকে সরু সরু ঝোরা বা ঝর্ণা স্কুল ছুটি হওয়া বালিকাদের মতো কলকল করতে করতে পাহাড়ি রাস্তা মাড়িয়ে তলায় নেমে যাচ্ছে। পাহাড়ের উল্টোদিকেই বিশাল খাদ। খুব মনখারাপের সময় খাদগুলো আমায় ডাকতো। দুই বৈপরীত্যের মাঝখানে পড়ে থাকা রাস্তায় অসীমদা আর তামাংদাজু আমাকে ড্রাইভিং শিখিয়েছিল। উপরমহল জানতে পারলে তাদের চাকরি নিয়ে টানাটানি হতো। কিন্তু এই অল্পবয়সী বস-এর আব্দার তারা ফেলতে পারেনি। অসীমদাকে পাশে নিয়ে রাম্মাম থেকে পাঁচ ঘন্টা ড্রাইভিং করে নিউ জলপাইগুড়ি স্টেশনে পৌছানোর পর অসীমদা বলেছিল “আপনি পাস করে গেলেন।” খুব আনন্দ পেয়েছিলাম। এমএস পাস করেও বোধহয় এতো খুশি হইনি।
রাম্মাম থেকে ট্রান্সফার হয়ে এলাম জলঢাকায়। ট্রানজিট লীভে বাড়ি গিয়েছিলাম। ভোরবেলায় এনজিপি স্টেশনে নামতে পাবলিক অ্যাড্রেস সিস্টেম জানালো যে জলঢাকা থেকে এত নম্বর গাড়ি আমার জন্য বাইরে অপেক্ষা করছে। গাড়ির কাছে গিয়ে জিজ্ঞেস করলাম যে এই গাড়িটাই জলঢাকা যাবে কিনা। দুব্যাগ ভর্তি বই হাতে একটা বাচ্চা ছেলে যে স্বয়ং ডাক্তারবাবু এটা ভাবতে পারেনি ড্রাইভার সাহেব। সে জানালো যে একজন ডাক্তারকে সে নিতে এসেছে। ডাক্তারের পাত্তা নেই।
বউয়ের ভাই, পশুপাখির সন্তান ইত্যাদি লেখার অযোগ্য কিছু বিশেষণে ডাক্তারকে ভূষিত করে বললো সে না এলে আমাকে গন্তব্যে পৌঁছে দেবে ড্রাইভার সাহেব। অবশ্যই দক্ষিণার বিনিময়ে। আমরা বেশ কিছুক্ষণ অপেক্ষা করে জলঢাকার উদ্দেশ্যে রওনা দিলাম। কিছুক্ষণের মধ্যে আমাদের ছোট্ট গাড়ি ভিড়ে ঠাসা তেহট্ট গামী লোকাল বাস। প্রায় ডেকে ডেকে প্যাসেঞ্জার তোলা হচ্ছে। ঘটনাবহুল সেই যাত্রার একেবারে শেষের দিকে বাধ্য হয়ে নিজের পরিচয় দিই। তখন আরেক কেলেংকারী। ড্রাইভার কিছুতেই আর জলঢাকা ঢুকবে না। কাউকে বলবো না কথা দিয়ে সন্ধ্যা নেমে আসার পর জলঢাকায় ঢুকে ছিলাম। ভাড়া অফার করতে লজ্জায় প্রায় মাটিতে মিশে গিয়েছিল মোক্তান।
পরে জলঢাকা থাকাকালীন আমার বিয়ে হয়। আমার স্ত্রীকে মোক্তান আমাদের প্রথম সাক্ষাৎ-এর গল্প বলে। তার আগে পর্যন্ত সত্যিই আমি এই গল্পটা কাউকে শোনাইনি।
আমার বর্তমান সারথির কথা একটু শুনিয়ে রাখি। গত তিনবছর ধরে সে আমাদের সাথে আছে। বেশ কুঁড়ে এবং সৎ প্রকৃতির। “কৃষ্ণকান্ত অতি প্রশান্ত”র ড্রাইভার সংস্করণ। আমার আশেপাশের লোকজনের সন্দেহ যে ও ভালমানুষের মুখোশ পরে থাকে। আগের ড্রাইভারের ভয়ংকর সব কীর্তিকলাপের পর বাড়ির সবাই ড্রাইভার এবং ভালোমানুষ পরস্পরের বিপরীতার্থক শব্দ বলে জানে। আজ সকালেই সেই মারাত্মক ঘটনাটা ঘটে গেল। আমাকে চেম্বারে নামিয়ে ড্রাইভার গাড়ি শুদ্ধ হাওয়া। ফোন রিং হয়ে যেতে যেতে একসময় সুইচড অফ হয়ে গেল। মেয়ের স্কুল আছে। আমাকে একবার চেম্বার থেকে অফিস যেতে হবে।
আশেপাশের কোনো জায়গায় গাড়ি নেই। আমার চেম্বারের কাছেই থানা। নিরুপায় হয়ে থানায় গেলাম। থানার ভেতরে গাছের ছায়ায় দাঁড়ানো একটা গাড়িকে বেশ চেনা চেনা লাগছিল। কাছে গিয়ে দেখি মক্কেল গাড়ির ভেতর ঘুমিয়ে আছে। প্রায় ধাক্কা মেরে কুম্ভকর্ণের ঘুম ভাঙাতে হল।
গরমে রাতে ঘুম হয়নি। সেই জন্য একটু ঘুমিয়ে পড়েছিল। সেই গভীর ঘুমে মোবাইলের আওয়াজও শুনতে পায়নি। সেটি বাজতে বাজতে নিজের ব্যাটারি শেষ করেছে।
আমি দীর্ঘশ্বাস ফেলে বললাম যে গাড়ির সাথে ড্রাইভার শুদ্ধ চুরি গেলেও আশ্চর্য হবনা।
কি বুঝলে কে জানে- খুব চালাক চালাক গলায় বললো – “সেই জন্যই তো থানার ভেতর ছায়া দেখে গাড়িটা রেখেছিলাম।”
হাসতে হাসতে পেট ব্যাথা হয়ে গেলো। এত ধৈর্য্য থাকলে তবেই বোধহয় এত বড় মাপের ডাক্তার হওয়া যায়।