অধিকাংশ ডাক্তারদের ঘুমের ব্যাপারটা খুব গোলমেলে হয়ে যায়। কেউ উদ্ভট উদ্ভট পরিস্থিতিতে অনায়াসে ঘুমিয়ে নিতে পারে। দুটো অপারেশনের মাঝখানে অনেককে ঘুমিয়ে নিতে দেখেছি। ভীষ্মের ইচ্ছামৃত্যুর মতো অনেকের ইচ্ছাঘুম আছে। ভীষণ ভিড়ে চলন্ত বাসের হ্যান্ডেল ধরেও কেউ কেউ ঘুমিয়ে নিতে পারে। ট্রেনে পাশে বসা লোকটির কাঁধকে বালিশ করে ঘুমনোর দৃশ্য তো হামেশাই দেখা যায়। তবে অধিকাংশ ডাক্তারই ভোগে অনিদ্রায়। রাত জেগে পড়া, নাইট ডিউটি, পেশেন্টদের টেনশনে ঘুমের বায়োলজিকাল ক্লকটা একেবারে ঘেঁটে গোল হয়ে থাকে। রাত যত পাড়ে, এনার্জি তত বাড়ে। সে এক ভয়ানক অস্বস্তিকর অবস্থা। সারা দুনিয়া ঘুমোচ্ছে আর ডাক্তারবাবু সারা বাড়ি জুড়ে দাপিয়ে বেড়াচ্ছে।
আমি এই দ্বিতীয় শ্রেণির ডাক্তার। যত রাত বাড়ে তত স্নায়ুকোষগুলো উত্তেজনায় ফুটতে থাকে। মোহনবাগান-ইস্টবেঙ্গলের ম্যাচের সময় ইস্টবেঙ্গল গ্যালারিতে বসে থাকা মোহনবাগান সমর্থকের মতো মনের অবস্থা। সারা ফ্ল্যাট জুড়ে ঘুরঘুর করছি। মাঝেমধ্যে রাস্তাতেও বেরিয়ে পড়তাম। সেটা কিছুটা বিপজ্জনক হয়ে যাচ্ছিল। রাস্তার কুকুরগুলো আমার বেরনোর উদ্দেশ্য নিয়ে সন্দিহান হয়ে পড়ে ভীষণ চেঁচামেচি জুড়ে দেয়। ফলে সেটাও বেশি দিন চালাতে পারলাম না।
ঘুমের ওষুধ খেতাম না পরের দিন ঘুম ঘুম লাগবার ভয়ে। অপারেশন করতে করতে যদি ঘুম পায়! সাইকিয়াট্রিস্ট এক দাদার কাছ থেকে কিছু ঘুম আনার টিপসও নিলাম। সে একটা সিডি পাঠিয়ে দিলো যার নরম মিউজিকে ঘুম আশেপাশে পোষা বেড়ালের মতো ঘুরঘুর করবে। সেই সিডি চালিয়ে শুলাম। সুরের ওঠাপড়া, সূক্ষ্ম বাঁশির কাজ, জলতরঙ্গর রিনঝিন আওয়াজ সমঝদার শ্রোতার মতন সারারাত ধরে শুনলাম। যেন রাত্রিব্যাপী জলসা। আকাশ রাত্রির কালো চাদরটা আমার চোখের সামনে ধিরেধিরে গুটিয়ে নিলো। সূর্য মুঠো খুলে একটু একটু করে ভোরের ওম ছড়িয়ে দিলো। “রাত্রি এসে যেথায় মেশে দিনের পারাবারে” প্রত্যক্ষ করলাম এক অনির্বচনীয় অনুভূতি নিয়ে।
“ঘুম কই?”
যদিও ডাক্তার হিসেবে জানি চা, কফি ঘুম চটিয়ে দেয়, তবু রাত্রিবেলা মাঝেমাঝে তৈরি করে খেতাম। স্ত্রীকে বলার মতো জরুরি কথাগুলো রাতেই বেশি মনে পড়তো। (তোমার পিসতুতো বোনের বর ফোন করেছিল, তোমার বান্ধবী আজ দেখাতে এসেছিল, তোমার অর্ডার দেওয়া শাড়িটা কেয়ার অফে আমার নাম দেখে চেম্বারে দিয়ে গেছে এবং সেটা ভুল করে আমি সেখানেই ফেলে এসেছি – ইত্যাদি ইত্যাদি)। প্রতিটি তথ্য না জানানো যে “তথ্য গোপন আইন”-এ মারাত্মক অপরাধ তা প্রতিটি স্বামীই জানে। সকালে যদি আবার ভুলি সেই আশঙ্কায় স্ত্রীকে ডেকে তুলতাম। কফির কাপ হাতে ধরিয়ে দিয়ে বলতাম “কফি উইথ অনির্বাণ-এ স্বাগত।”
বেচারি বুঝে ফেলতো যে আবার কিছু গন্ডগোল পাকিয়েছি। সে যাহোক, একদিন ও আমাকে বললো -“এরকম রাতের পর রাত না জেগে লিখতে পারো তো!”
এদিকে আমি ডাক্তার হওয়ার পর থেকে প্রেসক্রিপশন ছাড়া আর কিছু লিখিনা। অসহায় ভাবে জিজ্ঞেস করলাম -“কি লিখবো?”
-“কেন, সারাদিন হাসপাতালে যা করে বেড়াও! ” মিসেসের তড়িঘড়ি জবাব।
ব্যাপারটা মন্দ নয়। লিখেও ফেললাম। মিসেস পড়ে বললো ‘বেশ তো লিখেছো।”
আসলে প্রতিটি মানুষের ভেতরে আরো একটা গভীর গোপন মানুষ থাকে। কেউ ইচ্ছে করলে ভালো ছবি আঁকতে পারে, কেউ দুর্দান্ত আবৃত্তি করতে পারে, কারো গলায় সাত সুর অনায়াসে খেলে বেড়ায়, কেউ আবার অভিনয় করলে বড়োবড়ো পরিচালকরা দেখে বলতে বাধ্য হবেন – “এতোদিন কোথায় ছিলেন?” অন্যান্য অনেক পেশার মানুষরা অবসর যাপনের সময় ভেতরের ভালো লাগা সুকুমার ইচ্ছেটা ধোয়ামোছা করে নিতে পারেন। ডাক্তারি প্রফেশনে যাঁরা আছেন তাদের পেশার মাড়াইকলটা দিনের শেষে একেবারে ছিবড়ে করে দেয়। বেসিক আই-কিউ বেশি থাকা এই মানুষগুলোর প্রতিভার ঝিলিক মাঝেমধ্যে ঝলসে উঠে আবার মিলিয়ে যায়। গার্গী অসাধারণ নাচে, অমরনাথ দুর্দান্ত গান গায়, ইন্দ্র শান্তনুর আঁকা দেখলে মুগ্ধ হয়ে তাকিয়ে থাকতে হয়, জয়ন্ত মাউথ অর্গান বাজালে ব্যাচের রিইউনিয়নে সবাই ওকে ঘিরে ধরি। কেউ খুব গভীরভাবে ভেতরের মানুষটাকে অনুভব করতে চায়না। পেশার চাপে নেশার মৃত্যু ঘটে।
হাসপাতাল থেকে সন্ধ্যাবেলা রাউন্ড দিয়ে ফেরার সময় একদিন একটা ফোন এলো। একটা বহুল প্রচারিত দৈনিকের অফিস থেকে। “আপনার লেখাটা আমাদের পত্রিকার রবিবাসরীয়তে প্রকাশ পাবে। আপনাকে জানানোর জন্য ফোন করছি।”
মিসেস আমার লেখাটা পত্রিকাতে পাঠিয়ে দিয়েছিল। বেশ খুশি হলাম। বাড়ির সবাই আমার থেকে বেশি খুশি। পরপর দেশ, আনন্দমেলা, সানন্দা, বর্তমান, গণশক্তিতে লেখা বেরলো।
কিন্তু এর মধ্যে আমার মধ্যে অদ্ভুত এক পরিবর্তন এসেছে। যে আমি রাতের পর রাত জেগে কাটিয়েছি, সেই আমি ল্যাপটপ নিয়ে বসলেই বিধ্বংসী ঘুম আমার ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ে।
আফ্রিকার সিসি মাছি কামড়ালে অদ্ভুত একটা রোগ হয়। মনে হয় যেখানে সেখানে ঘুমিয়ে পড়ি। কোনো আফ্রিকান মাছি নির্ঘাত আমার শহরে বেড়াতে এসেছিলো। এছাড়া অন্য কোনো ব্যাখ্যা দিতে পারবো না। আমার স্ত্রী আমার রাতজাগার রোগ সেরে যাওয়ায় ভীষণই বিরক্ত। এখন ঘুম তাড়ানোর জন্য প্রতিদিন ডিনারের পরে এককাপ চা আমার জন্য বরাদ্দ হয়েছে।
আমার এখন পরিচিত মহলে আরেকটা পরিচয় তৈরি হয়ে গেছে। যেন বদ্ধ ঘরে একটি জানালা কেউ বসিয়ে দিয়েছে। অনেক ভালো থাকি – অন্তত মনের দিক থেকে।
মনের দিক থেকে ভালো থাকতে হলে একবার নিজের ভেতরের বন্ধ জানালাটা খুলেই দেখুন না। আপনার ভেতরের গভীর মানুষটাকে আমরাও সবাই ছুঁয়ে দেখি।
মনে রাখবেন – ভালো লাগার থেকে বড়ো সংক্রামক রোগ আর নেই। করোনাও না।
Thank you soooooooo much Aunti ???.Aunti আপনার জন্য আমারা পাঠকেরা Sir এর অসাধারণ অসাধারণ গল্প পড়ার সুযোগ পেয়েছি। Sir এর লেখনীতে আমারা যে magic দেখি তার অর্ধেক contribute Anunti এর।???
Lock down এর মধ্যে আমি ও একটু লেখালেখী করছিলাম।আমিও লিখতে পারি এটা তখন ই প্রথম realise করি।আর লেখালেখী করলে সত্যি খুব ভালো থাকা যায়।
ঠিকই রিয়াঙ্কা ???
দারুণ সুন্দর হয়েছে লেখাটি, মুগ্ধ হয়ে পড়লাম।
ধন্যবাদ দাদা ??
আহা কি প্রানবন্ত লেখা দাদা। খুব ভালো লাগলো।
?❤
আহা !
চেষ্টা করে জাগে যদি নিদ্রিত সেই জন ।
তোমার মধ্যে কবিতার মাধ্যমে নিদ্রিত সেই জন জেগে আছে। ❤
Onobodyo
ধন্যবাদ ??
Ki sundor lekhen apni…apner lekha akber noi aki lekha bohuber porte ichha hoi…jei lekhata amader kache ase tokhonthekei chotphot kori kokhon lekhata porbo.
….hoito kokhono 2/3 din poro hoye jai..tobu jokhoni pori tokhoni lekha theke tatka sugondho pai… r mugdho hoi apner lekhonir proti..r…o…likhun, r valo thakun.
ধন্যবাদ ??
????????