লকডাউনের মধ্যেও সাবিনার কাজকর্মের বিরাম নেই। কিছুটা স্বভাব, কিছুটা নেশা। মায়ের থেকেই এই উত্তরাধিকার প্রাপ্তি। রকমারি রান্না। শুধু তাইই নয়, সেগুলোকে শৈল্পিকভাবে পরিবেশন।
ন্যাশনাল মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালের কাছেই সাবিনা ইয়াসমিনের বাড়ি। হাসপাতালে নাকি করোনা আক্রান্ত রোগী পাওয়া গেছে- গুজবের জেরে রাস্তা সিল করেছে পুলিশ। হাঁটাহাঁটি বন্ধ। পার্ক সার্কাস ময়দানের খোলা হাওয়ায় ঘোরাঘুরি নিষিদ্ধ। সবাই হাঁপিয়ে উঠলেও সাবিনার মুক্তি তার ছাদে । একটুকরো মরূদ্যান। লাউশাকের লকলকে ডগা, কচি কচি উচ্ছে, ছোট ছোট বেগুন, নধর কুমড়ো। কাঁচালঙ্কা, ধনেপাতা, পার্সলে, পুদিনা।
একপদে হলেও দু’বেলাই তরিবত করে রান্না করে সাবিনা। তারপর গা ধুয়ে, চুল বেঁধে, খোঁপায় একটা গন্ধরাজ । বেল, জুঁই, চাঁপার ঘ্রাণে ম’ ম’ করা ছাদে টেবিল পাতে সাবিনা। গোটা পরিবার ডিনার করে। কলাপাতা গোল করে কেটে ডিশের মধ্যে পেতে সুন্দর করে সাজায়। ফুলদানিতে লিলি। খাওয়া একটা শিল্পকলা। লক্ষ্মী আর সরস্বতীর মিলন। সবাই পারে না।
পার্ক সার্কাসের অলিগলি, তিলজলা বস্তির কিছু মানুষ ভিনরাজ্যের। এঁরা বাড়ি ফিরতে পারেননি লকডাউনের জেরে। সাবিনাদের পাড়ার উদ্যোগ- যে যা পারবে রান্না করে পাঠিয়ে দেওয়ার। সাবিনা খেয়াল করেছে, গত দুদিন ধরে কিছু মানুষ এসেছেন খাবার নিতে। চেহারায় কুন্ঠিত ভাব। এঁরা তো ভিখিরি নন। ঘাম ঝরিয়ে ভাত উপার্জন করেন। এভাবে হাত পেতে নিতে কার ভাল লাগে? পাশের বাড়ির তহমিনা বিভিন্ন পদ রেঁধে নিয়ে গেছিল। লোকজন একবার নিয়েই চলে গেছেন। আত্মাভিমান বোধহয় করোনা ভাইরাসের থেকেও সংক্রামক। সাবিনা ঠিক করল একটাই পদ রাঁধা শ্রেয়। খিচুড়ি।
উৎসবে, বিপদে খিচুড়ি মান রক্ষা করে। পেট ভরে, মনও। রান্নার ঝামেলাও নেই। ঘরের সবজিতেই হবে। ফুলকপি, ডুমো ডুমো করে কাটা খোসাসমেত আলু, বরবটি, টমেটো।
কিন্তু আন্দাজটা কী হবে ? ‘বিসমিল্লাহ’ বলে আড়াই কেজি ভাতের চাল, দেড় কেজি মুগ ডাল আর এক কেজি মসুর ডাল নিয়ে নিল সাবিনা। মুগডাল শুকনো কড়াইতে ভেজে নিল।
পাঁচকেজি বিরিয়ানির হাঁড়িতে রান্নাটা করেছে সাবিনা। ওরা হাঁড়িশুদ্ধ খিচুড়ি নিয়ে চলে গেছে। পরে হাঁড়ি ফেরৎ পেলে সেটা জীবাণুনাশ করে তুলে দেওয়ার কাজটা রান্নার করার মতো অতো আনন্দের কাজ হবে না সেটা বোঝে। তবে সে কাজ করে দেওয়ার জন্য লোকের অভাব নেই সাবিনার।
কেন থাকবে ? খিচুড়ির হাঁড়ি পাঠিয়েই স্বস্তিতে থাকেনি সাবিনা।
সাবিনার ভাষায় : “দ্যাখো, খাবার একটু শৈল্পিকভাবে পরিবেশনের ক্ষেত্রে দামী রান্না, সস্তার রান্না এসব কথা মাথায় আসে না। খেয়ে তৃপ্ত হওয়ার আগে মনও তৃপ্ত হওয়ার দাবি রাখে। দেখে আগে ভালো লাগতে হবে। ওই ভালো লাগার মূল্য তো আছেই! নইলে বড়ো বড়ো রেস্টুরেন্টগুলোতে দামী এবং সুদৃশ্য প্লেটে খাবার পরিবেশন করেই ক্ষান্ত থাকতো । প্লেটের কোণায় অথবা মাঝখানে আড়াআড়িভাবে টমেটোর গোলাপ, লঙ্কাজবা ফুল শোভা পেত না। যেকোনো খাবারের পাশে একগুছি ধনেপাতা, বা নানারঙের শৈল্পিক আঁচড় তারও তো যথেষ্ট মূল্য ধরে নেওয়া হয়। খাবার পরিবেশনের শিল্পসম্মত উপায়গুলো যথেষ্ট পরিমাণে টাকাপয়সা খরচ করেই প্রতিষ্ঠান থেকে শিখতে হয়। কিন্তু কেউ কেউ আবার জন্ম থেকেই একটুআধটু এইরকম গুণ নিয়ে জন্মায়। এই গুণের অধিকারীরা গরীব হলেও এবং মাটির বাড়িতে বাস করলেও এদের বারান্দা সর্বদাই লেপাপোঁছা থাকে। এদের ছোট উঠোনখানিও সযত্নে নিকানো থাকে। তাই আমি প্রতিটি শালপাতার থালার একপাশে সাজিয়ে দিয়েছি কাঁচালঙ্কা, পেঁয়াজ, একটুকরো গন্ধলেবু, টমেটো আর পুদিনাপাতা দিয়ে।”
খিচুড়ি পাতে পাতে বেড়ে দিয়েছিলেন পুলিশকর্মীরা । সাবিনা ইয়াসমিন চর্মচক্ষে দেখতে পায়নি -সেদিনের প্রতিটি খিচুড়ির গ্রাসে তৃপ্তির সৌরভ মিশে ছিল পরিযায়ী অভুক্ত শ্রমিকদের। বার বার চেয়ে খেয়েছেন ওঁরা। সাবিনা ঈশ্বরী পাটনিদের দেখেনি কিন্তু খাইয়েছিল সযত্নে।
বাহ, আটপৌরে ঘরকন্নার খুঁটিনাটি গল্পও কত তৃপ্তি দেয়।