কথারম্ভ
করোনা ভাইরাসের ভ্যাক্সিন কিংবা ওষুধ আবিষ্কার প্রায় হয়েই গেল বলে নিত্যনতুন খবরের বিরাম নেই। সমস্যা হল, করোনা ভাইরাসের সঙ্গে লড়াই করার উপযোগী রসদ, অর্থাৎ নির্দিষ্টভাবে ভাইরাসকে মারার উপযুক্ত অ্যান্টিবডি ও এই নির্দিষ্ট ভাইরাস মারার জন্যই প্রস্তুত রক্তকণিকা আমাদের দেহে তৈরি হয়ে নেই। কারো দেহে একবার ভাইরাস আক্রমণ হলে তবেই সেরকম সুনির্দিষ্ট অস্ত্রশস্ত্র দেহে তৈরি হবে। অন্য উপায় হল করোনা-র কার্যকর ভ্যাক্সিন বা টিকা। কিন্তু ভ্যাক্সিন পাবার পরে, বা একবার করোনা বীজাণুর আক্রমণ হবার পরে, দেহে যে বীজাণু-মারা অস্ত্রশস্ত্র তৈরি হবে, তা কোভিড-১৯ ভাইরাসকে মারতে পুরো সক্ষম হবে তো? যেমন আরেকটি ভাইরাসঘটিত রোগ গুটিবসন্ত একবার হলে সারাজীবনের জন্য আর গুটিবসন্ত হয় না, আর তার ভ্যাক্সিন একবার শরীরে গেলেও তা প্রায় একই রকম সুরক্ষা দেয়। কিন্তু কোভিড–১৯ রোগের ক্ষেত্রে কি সেরকম হবে? মনে রাখতে হবে, একবার জলবসন্ত হলে জীবনে আর জলবসন্ত হয় না, কিন্তু অন্যান্য অধিকাংশ ভাইরাসঘটিত রোগ একবার হলে সারাজীবন তার থেকে সুরক্ষা পাওয়া যায় না। যেমন ভাইরাল ফ্লু বারবার হতে পারে। আবার টিকা দিয়ে সুরক্ষা অনেকসময়েই আংশিক, যেমন ফ্লু ভ্যাক্সিন নিয়ে এত বছর এত গবেষণার পরেও তা মোটামুটি ৫০% মতো সুরক্ষা দেয়, জলবসন্ত ভ্যাক্সিন দেবার পরেও ২৫%-৩০% ক্ষেত্রে জলবসন্তের কমজোরি আক্রমণ হওয়া সম্ভব।
এইসব মনে রেখে আমরা জেনার-এর গুটিবসন্ত ভ্যাক্সিন আবিষ্কার করার ইতিহাস আরেকটু খুঁটিয়ে দেখব, তা থেকে বুঝতে চেষ্টা করব কোভিড-১৯ ভ্যাক্সিনের কাছ থেকে কতখানি আশা করা বাস্তবসম্মত, আর কতোটা স্রেফ লাক বা চান্স! অবশ্য আগেকার দিন আর নেই, আমরা বিজ্ঞানে অনেক এগিয়েছি। তবে মানবদেহে ভ্যাক্সিন পরীক্ষা করা এখন অনেক বেশি আইনকানুনের নিগড়ে বাঁধা, অন্যদিকে ভ্যাক্সিন তৈরি করতে পারলে সম্ভাব্য লাভের অঙ্কটা বিশাল। ফলে ইতিহাস থেকে শিক্ষা নিয়ে কোভিড ভ্যাক্সিনের সম্ভাব্য ভবিষ্যৎ আঁচ করা বেশ সমস্যার ব্যাপার।
এবার আমরা পর্ব ৪ এর মূল অংশে আসি।
সাধারণাব্দ (CE) ১৮০০ সাল নাগাদ এডোয়ার্ড জেনার-এর টিকা আবিষ্কার হবার ১৭০ বছর পরে বিশ্ব থেকে গুটিবসন্ত নির্মূল করা গেল। তবে প্রাচীনকালে ভারত ও চীনে গুটিবসন্তের রস সুস্থ মানুষের দেহে ঢুকিয়ে, কম মারাত্মক রোগ তৈরি করে ভয়াবহ রোগ আটকানোর প্রথা ছিল। স্বয়ং জেনার এই প্রাচীন টিকা নিয়েছিলেন বাল্যকালে। জেনার-এর আবিষ্কারের ছোট একটি বিবরণ দিয়েছি তৃতীয় পর্বে। আজ চতুর্থ পর্বে দেখতে চাইব কেমন করে জেনার এমন টিকা আবিষ্কার করলেন যা মানবসভ্যতার সবথেকে বড় মারণব্যাধিকে হার মানাল। আর দেখব ডাক্তাররা কেমনভাবে নিলেন জেনার-এর এই আবিষ্কারকে, কেমন করে টিকার ব্যাপক ব্যবহারের ছাড়পত্র মিলল।
ইংল্যান্ডের রয়্যাল সোসাইটি ভ্যাক্সিনেশন মানল না!
১৭৯৭ সালে জেনার নিজের হাতে জেমস ফিপস নামে বালকের দেহে প্রথমে গো-বসন্ত রোগের বীজাণু প্রবেশ করালেন। তার মাস-দুয়েক পরে সেই একই বালকের দেহে গুটিবসন্তের বীজাণু প্রবেশ করালেন। গো-বসন্তের বীজাণু শরীরে ঐভাবে চামড়া কেটে প্রবেশ করানোর কাজটা এতাবৎ ইতিহাসে প্রথম হলেও, গুটিবসন্তের বীজাণু প্রবেশ করানোর ব্যপারটা বহুপ্রচলিত ছিল।
আমরা এর আগে দেখেছি, ভয়াবহ গুটিবসন্ত রোগ আটকানোর উপায় হিসেবে এই পদ্ধতি ভারত ও চীনে চলত। এর নাম ছিল ভ্যারিওলেশন, আর জেনার-এর পদ্ধতির নাম হবে ভ্যাক্সিনেশন। এই শব্দদুটো আমাদের মনে রাখতে হবে।
জেনার যেভাবে গো-বসন্ত আর গুটিবসন্ত বীজাণু মানুষের দেহে ইচ্ছেমত প্রবেশ করিয়ে পরীক্ষা করেছিলেন, আজকের দিনে এইভাবে সরাসরি মানুষের ওপর পরীক্ষা করার চিন্তাও বাতুলতা মাত্র। কিন্তু সেসময় এরকম পরীক্ষা চলত । আর তখন চিকিৎসাশাস্ত্র এতোই অনুমাননির্ভর ছিল, মানুষের ওপর করা পরীক্ষার এতোই অভাব ছিল যে এক-দুজন মানুষের রোগ ঠেকানো গেলে সেটাকেই একটা বেশ বড়সড় প্রমাণ বলে ভাবা হত। তাই জেনার-এর টিকার এমন হাতেগরম ফল সাধারণভাবে অগ্রাহ্য হবার কারণ ছিল না। কিন্তু ইংল্যান্ডের ডাক্তার সমাজ এই টিকা আবিষ্কারকে চট করে মেনে নিতে পারলেন না, বরং তাদের একটা বড় অংশ একে উড়িয়ে দিতে চাইলেন।
তখন ইংল্যান্ডে বিজ্ঞানের আবিষ্কারকে মান্যতা দেবার মতো একটাই সংস্থা ছিল—রয়াল সোসাইটি। রয়্যাল সোসাইটিতে জেনার তাঁর গবেষণাপত্র পাঠালেন, কিন্তু সোসাইটি তা ছাপল না, ফিরিয়ে দিল। অবশ্য এর পেছনে অনেক কারণ আছে, আর তা পুরোটা জেনারের এই পরীক্ষা নিয়ে অবিশ্বাসের ফল নয় (পাদটিকা ১)। তখন অনন্যোপায় জেনার তাঁর অভিজ্ঞতার ভাঁড়ার ঝেড়ে ২৩টি কেস রিপোর্ট একত্র করে একটি ছোট বই ছাপালেন—An Inquiry into the Causes and Effects of the Variolae Vaccinae।
জেনারের এই বইতে ছিল ২৩-টি কেস রিপোর্ট। তখনকার বিচারে সংখ্যাটি কম বলা যেত না। তবে সবকটি কেস একরকম ছিল না।
- রিপোর্টে উল্লিখিত ২৩ জনের মধ্যে প্রথম ১২ জনের আগে গোরুর ছোঁয়াচ থেকে স্বাভাবিকভাবে গো-বসন্ত হয়েছিল, এবং জেনার বারবার ভ্যারিওলেশন করেও তাদের দেহে গুটিবসন্তের লক্ষণ বিন্দুমাত্র আনতে পারেন নি। এই ১২ জনের অনেকে বাড়ির অন্য গুটিবসন্ত রোগীর সেবা করেছে, কিন্তু গুটিবসন্ত হয়নি। এ থেকে জেনারের সিদ্ধান্ত ছিল, গো-বসন্ত হল গুটিবসন্ত থেকে অনেক কম মারাত্মক ছোঁয়াচে একটি রোগ, এবং একবার গো-বসন্ত হয়ে গেলে তার গুটি-বসন্ত হবে না।
- জেনারের কেস নম্বর ১৩, ১৪ ও ১৫ ছিল ঘোড়ার বসন্ত বা হর্সপক্স নিয়ে। তাঁর বইয়ের প্রথম অংশে জেনার দেখাতে চেয়েছিলেন, গো-বসন্ত আসলে এসেছে ঘোড়া থেকে—সেটা তাঁর পরীক্ষাতে প্রমাণ হয়নি, এবং পরেও একথা ভিত্তিহীন বলেই ভাবা হয়েছে। এদের ঘোড়ার বসন্ত থেকে টিকা দিয়ে তা কাজে লাগেনি। জেনার বললেন, হর্সপক্স গো-বসন্তের মতো অতটা সুরক্ষা দেয় না।
- এরপরের কেস ১৬ এবং কেস ১৭ সবথেকে বিখ্যাত, আমাদের পূর্বপরিচিত সারা নেমস ও জেমস ফিপস। সারা নেমস-এর হাতে গো-বসন্তের গুটি হয়েছিল, আর সেই গুটি থেকে রস নিয়ে জেমস ফিপস-কে দেওয়া হয়েছিল। মাসদুয়েক পর জেমস ফিপস-এর চামড়ায় গুটিবসন্তের বীজাণু প্রবেশ করিয়ে দেওয়া হলেও তার ভ্যারিওলেশন-এর কোনো লক্ষণ দেখা দেয় নি, গুটিবসন্তও হয়নি। ভ্যারিওলেশন-এর জন্য ব্যবহৃত গুটিবসন্তের বীজাণুটি নষ্ট হয়ে গেছে কিনা দেখতে চাইলেন জেনার। যে বীজাণুর ‘স্যাম্পল’ ফিপস-এর শরীরে ঢুকিয়েছিলেন, সেই একই স্যাম্পল থেকে রস নিয়ে জেনার ফিপস-এর বাড়ির লোকেদের কয়েকজনের চামড়ায় প্রবেশ করালেন—তাদের কিন্তু ভ্যারিওলেশন-এর স্বাভাবিক লক্ষণগুলি প্রকাশ পেল।
- গো-বসন্তের রস টিকা দিলে, একজন মানুষের শরীরে ঐ টিকার স্থানে যে ফুস্কুড়ি হয়, তা থেকে রস নিয়ে আরেকজন মানুষের চামড়ায় টিকা দিলে কী হয়? এই প্রশ্নের জবাব কেন জরুরি ছিল তা আমরা যথাস্থানে দেখব। শেষ ৫-টি কেস (নম্বর ১৯ থেকে ২৩) দিয়ে জেনার এটা দেখতে চাইলেন। ১৯ নম্বর কেস এক বালক। তার চামড়ায় জেনার সরাসরি গোরুর দেহ থেকে পাওয়া গো-বসন্তের রস টিকা দিলেন, সেই বালকের ইঞ্জেকশনের জায়গায় ফুস্কুড়ি হল। সেই ফুস্কুড়ির রস নিয়ে ২০ নম্বর বালকের চামড়ায় টিকা দিলেন, আবার তার ফুস্কুড়ি থেকে রস নিয়ে ২১ নম্বর, তার থেকে রস নিয়ে ২২ নম্বর, ও ২২ নম্বর বালকের রস ২৩ নম্বর বালকের চামড়ায় টিকা দিলেন। তারপর ২১ নম্বর, ২২ নম্বর ও ২৩ নম্বর বালকের দেহে তিনি ভ্যারিওলেশন পদ্ধতিতে গুটিবসন্তের বীজাণু দিলেন। তাতে তাদের গুটিবসন্ত রোগ হল না, ও ভ্যারিওলেশনের পরে যে প্রতিক্রিয়া স্বাভাবিক তাও হল না—ঠিক যেমন জেমস ফিপস-এর হয়নি।
এ থেকে জেনার-এর সিদ্ধান্ত হল, গো–বসন্তের ভ্যাক্সিন ‘শৃঙ্খল’ (chain) মানুষের দেহে বজায় রাখা যায়। সহজ কথায়, গো-বসন্তের টিকা মানুষর দেহে দিয়ে যে ফুস্কুড়ি হয়, তা থেকে রস নিয়ে দ্বিতীয় একজন মানুষের দেহে দিয়ে সেখানে আবার ফুস্কুড়ি তৈরি করা যায়, এবং সেই ফুস্কুড়ির রস থেকে তৃতীয় মানুষের শরীরে ফুস্কুড়ি করা—এই পদ্ধতি পরপর অসংখ্যবার চালানো যায়। এবং এইভাবে ফুস্কুড়ি তৈরি হওয়া সমস্ত মানুষই গুটিবসন্ত থেকে সুরক্ষা পায়।
তথ্যসূত্রঃ
১) (Edward Jenner and the history of smallpox and vaccination, Stefan Riedel, Baylor University Medical Center Proceedings, 2005, Volume 18 (1), Page 21-25. .https://www.ncbi.nlm.nih.gov/pmc/articles/PMC1200696/ accessed on 7 May, 2020. )
২) In celebration of the 200th anniversary of Edward Jenner’s Inquiry into the causes and effects of the variolae vaccine, Robert C Brunham and Kevin M Coombs, The Canadian Journal of Infectious Diseases, 1998 Sep-Oct; 9(5): Page 310–313. (https://www.ncbi.nlm.nih.gov/pmc/articles/PMC3250919/, accessed on 8 May, 2020)
পাদটিকা ১— এর বছর দশেক আগে জেনার রয়াল সোসাইটিতে তাঁর অন্য গবেষণাপত্র পাঠিয়েছিলেন, এবং সেটি প্রকাশিত হয়েছিল। সেই গবেষণাপত্র ছিল সদ্যোজাত কোকিলছানার আচরণ বিষয়ক। এতে অবাক হবার কিছু নেই, সে সময় জেনার-এর মতো যেসব ভদ্রলোক বিজ্ঞানী (Gentleman Naturalist) ছিলেন তাঁদের আগ্রহ বহুমুখী হত, চিকিৎসক কেবল ডাক্তারি নিয়েই ভাববেন, এমন স্পেশালাইজেশনের যুগ তখনও আসেনি। কিন্তু সে কথা থাক। কোকিলছানা নিয়ে জেনার-এর গবেষণাপত্র প্রকাশিত হলে কী হবে, ঐ গবেষণার মূল বক্তব্য নিয়ে অধিকাংশ ভদ্রলোক বিজ্ঞানী জেনারের মত সমর্থন তো করেনইনি, উপরন্তু তাঁকে উৎকেন্দ্রিক ভেবেছিলেন। তবে সেটা ছোট ব্যাপার।
অন্য, এবং বেশি গুরুত্বপূর্ণ, কারণটি হল, ভদ্রলোক বিজ্ঞানীরা জানতেন গোয়ালাদের মধ্যে একটা প্রচলিত কথা আছে যে গো-বসন্ত হলে সেই মানুষের পরে আর গুটিবসন্ত হয় না। যে কোনো পণ্ডিতগোষ্ঠীর মতো তাঁদেরও এইসব ‘অ-ভদ্রলোকের’ মধ্যে চালু প্রথা নিয়ে যথেষ্ট অবজ্ঞা ছিল। ফলে সেটাই যখন জেনার রয়্যাল সোসাইটির মতো উচ্চমার্গের পণ্ডিতসভায় চালাতে চাইলেন, তাঁদের এতদিনকার উচ্চবর্ণের অহঙ্কার ঘা খেল। তাঁরা বললেন, যতসব ছোটলোকের প্রথা—এনিয়ে মাথা ঘামাবার কোনো দরকার নেই। পরে অবশ্য জেনার-এর ভ্যাক্সিন সুপ্রতিষ্ঠিত হয়ে গেলে, “মন্ত্রী কহে, আমারো ছিল মনে / কেমনে বেটা পেরেছে সেটা জানতে” বলে এসেছিলেন এঁদের অনেকেই।
চিত্র পরিচিতি (কেবলমাত্র অব্যবসায়িক উদ্দেশ্যে ব্যবহারযোগ্য)
১) এডোয়ার্ড জেনারের সেই বিখ্যাত পুস্তিকা- An Inquiry into the Causes and Effects of the Variolae Vaccinae
২) ফিচারড ইমেজঃ শেষ গুটিবসন্ত রোগী—বাংলাদেশের তিনবছর বয়সী রহিমা বানু