১৮ জানুয়ারি শনিবার আর ২০ জানুয়ারি সোমবার শিয়ালদহ কোর্ট চত্বর এক উত্তাল সময়ের সাক্ষী হয়ে রইল। আর জি কর হাসপাতালে কর্তব্যরত চিকিৎসকের ধর্ষণ ও খুনের মামলার রায়দান ছিল ১৮ জানুয়ারি। ঘটনার ১৬২ দিন এবং বিচার শুরুর ৬৮ দিন পর শিয়ালদহ অতিরিক্ত দায়রা বিচারকের আদালতে রায় ঘোষিত হয়- সঞ্জয় রাই ই একমাত্র দোষী। ২০ জানুয়ারি সাজা ঘোষণা করলেন বিচারক অনির্বাণ দাস – যাবজ্জীবন কারাদণ্ড এবং ৫০০০০ টাকার জরিমানা।
শুধু রাজ্য নয়, সারা দেশ তাকিয়ে ছিল এই মামলার রায়ের দিকে। হাসপাতালের নিরাপত্তা রক্ষী, কর্মরত নার্স ডাক্তার দের কাজের জায়গা পেরিয়ে একা সিভিক ভলানটিয়ার সঞ্জয় রাই এর পক্ষে এ নৃশংস ঘটনা ঘটানো সম্ভব নয় এ কথা সকলেরই জানা । চারপাশে অসংখ্য প্রমাণ ও প্রমাণ লোপাট করার প্রমাণ থাকা সত্তেও সঞ্জয় কেই একমাত্র দোষী হিসাবে ঘোষণা করা হল। এমন রায়ই যে বেরোতে পারে এই আশঙ্কা ছিলই। তবু হাজার হাজার মানুষ এক দুর্মর আশা নিয়ে হাজির হয়েছিলেন কোর্টে – ‘বৃথা আশা মরিতে মরিতে ও মরেনা’ …
জয়েন্ট প্ল্যাটফর্ম অফ ডক্টরস, অভয়া মঞ্চ আর সহযোগী সংগঠন গুলির উদ্যোগে শনি ও সোমবার প্রতিবাদ সভা ছিল কোর্ট চত্বরে। এই মঞ্চ এই মুহূর্তে বিচারের ক্ষেত্রে লোয়ার কোর্টের কাছে কোন আশার আলো দেখার প্রত্যাশী ছিল না। এর প্রধান উদ্দেশ্য ছিল মানুষের কাছে এই বার্তা পৌঁছানো যে প্রশাসন প্রকৃত দোষীদের আড়াল করতে চাইছে। উদ্দেশ্য ছিল এই আড়াল করার কারণ গুলি চিহ্নিত করা। এই দিক থেকে সফল কর্মসূচি গ্রহণ করতে পেরেছে অভয়া মঞ্চ ।
নিশ্ছিদ্র নিরাপত্তার ঘেরাটোপে মোড়া ছিল শিয়ালদহ কোর্ট এবং স্টেশন সংলগ্ন এলাকা। অস্থায়ী সিভিক ভলানটিয়ার কে বাঁচাতে যেমন হত্যাকে প্রথমে আত্মহত্যা বলে চালানোর চেষ্টার পর ৯ অগাস্ট ভোরে সেমিনার রুমে মেলা বসে যায় ডাক্তার উকিল সরকারি আধিকারিকদের , তেমনই শিয়ালদহ এলাকায় সতর্কতা আর নিয়মের নাগপাশে সঞ্জয় কে অধরা রাখতে সচেষ্ট ছিল প্রশাসন, পাছে আবার বিস্ফোরক কিছু বলে ফেলে! জমায়েতের পুলিশি অনুমতি ছিল না।
কিন্তু কে না জানে বজ্র আঁটুনি ফস্কা গেরো! ১৮ এবং ২০ দু দিনই সব নিয়মের নিগড়কে অগ্রাহ্য করে দূর দূরান্তের বহু সাধারণ মানুষ এসে যোগ দেন। প্রতিবাদী গান, কবিতা, স্লোগানে মুখরিত হয়ে ওঠে শিয়ালদহ এলাকা। ১৮ তারিখ রায় ঘোষণার দিন জুনিয়র চিকিৎসক আন্দোলনের নেতারা অভয়া মঞ্চের কর্মসূচিতে যোগ দেন। জুনিয়র চিকিৎসকরা WBJDF এর পক্ষ থেকে একটি গুরুত্বপূর্ণ লিফলেট বিতরণ করে যেখানে তদন্ত প্রক্রিয়ার ২০ টি গভীর অসঙ্গতিকে তুলে ধরা হয়েছে। WBJDF এর পক্ষে ডঃ অনিকেত মাহাতো, ডঃ দেবাশিস হালদার, ডঃ আস্ফাকুল্লা নাইয়া এবং অভয়া মঞ্চের তরফে ডঃ পুণ্যব্রত গুণ, ডঃ উৎপল বন্দ্যোপাধ্যায়, ডঃ পবিত্র গোস্বামী, আইনজীবী দিবাকর ভট্টাচার্য, ধৃতিমান সেনগুপ্ত প্রমুখ বক্তব্য রাখেন। রায় ঘোষণার দিন অভয়ার মা বাবা এবং ওনাদের আইনজীবীরাও এই জমায়েতে যোগ দেন এবং বক্তব্য রাখেন। সমস্ত বক্তাই একটি বিষয়ে দৃঢ়মত যে সঞ্জয় রাই অপরাধের সঙ্গে যুক্ত হলেও আসল অপরাধীরা এখনো অধরা। প্রশাসনিক মদত এবং পরিকল্পনা ছাড়া এই অপরাধ সংঘটিত করা সম্ভব নয়। ডঃ পুণ্যব্রত গুণ বলেন আদালত না মানলেও এ কথা অস্বীকার করার জায়গা নেই যে এই হত্যাকাণ্ড একটি বিরলতম অপরাধের দৃষ্টান্ত। বিভিন্ন বক্তব্যে মেদিনীপুর মেডিকেল কলেজে জাল স্যালাইনে প্রসুতি মৃত্যু আর দুর্নীতি ঢাকতে চিকিৎসক দের অন্যায় সাসপেনসন এবং আস্ফাকুল্লা নাইয়ার বাড়ি পুলিশি অভিযানের প্রসঙ্গও উঠে আসে।
এই দু দিনের শেষ কর্মসূচি ছিল শিয়ালদহ থেকে মৌলালি পর্যন্ত মিছিল এবং মানব বন্ধন। ২০ তারিখ মৌলালি তে মুখ্যমন্ত্রীর কুশ পুত্তলিকা দাহ করা হয়।
ওয়েস্ট বেঙ্গল জুনিয়র ডক্টরস ফ্রন্ট, জয়েন্ট প্ল্যাটফর্ম অফ ডক্টরস এবং অভয়া মঞ্চের অঙ্গীকার আন্দোলনের মধ্যে দিয়ে ন্যায় বিচার ছিনিয়ে আনা, ভয়ের রাজনীতির অবসান ঘটানো। শিয়ালদহে ১৮ আর ২০ জানুয়ারির জনজোয়ারে আশার প্রদীপ আবার উজ্জ্বল হয়ে উঠেছে। জনতার আদালতই বাধ্য করবে তদন্ত আর বিচার কে সঠিক পথের দিশা দেখাতে, ছিন্ন করবে শত ষড়যন্ত্রের জাল।
✊✊✊✊