ভারতবর্ষের মত তৃতীয় বিশ্বের দেশগুলোতে চিকিৎসা নিয়ে সাধারণ মানুষের নানা রকম ক্ষোভ। বিশেষতঃ আধুনিক চিকিৎসক ও চিকিৎসা ব্যবস্থার প্রতি সেই ক্ষোভ মাঝে মাঝেই এমন আকার ধারণ করে, যে ডাক্তারকে শারীরিক মানসিক আঘাত করতেও কেউ দ্বিধা করে না।
আমরা মাঝে মাঝেই দেখতে পাই, নানা রকম অপ্রীতিকর ঘটনা ঘটেছে, অথচ সেই ঘটনা ঘটার মতো সত্যি কোন কারণ নেই!! কোন একটি মাত্র ফ্যাক্টরকে দায়ী করা এক্ষেত্রে কঠিন।
সামাজিক রাজনৈতিক অর্থনৈতিক – বিভিন্ন কারণের পাশাপাশি একটি বড় সমস্যা হলো – আধুনিক চিকিৎসক ও চিকিৎসা ব্যবস্থা নিয়ে মানুষের সীমাহীন অজ্ঞতা। এর একটি বড় কারণ হলো – নানা অদরকারি বিষয়ের সঙ্গে প্রাথমিক শিক্ষা ব্যবস্থায় স্বাস্থ্য সচেতনতা বা সাধারণ অসুখ বিসুখ নিয়ে সচেতনতা তৈরির প্রচেষ্টা এখনো অব্দি চোখে পড়েনি! অতএব, ডাক্তার বাদে বাকি যাঁরা নানা বিষয়ে খুব ভালো পড়াশোনাও করেন, স্বাস্থ্য সম্পর্কিত সমস্যা নিয়ে তাঁদের মিনিমাম নলেজও তৈরি হয় না!
ফলস্বরূপ, আমরা যাঁরা আধুনিক চিকিৎসা ব্যবস্থার সঙ্গে জড়িত, তাঁরাও দ্বিধাগ্রস্ত। কোন দিকটা সমাধান করলে এই সমস্যার সমাধান সম্ভব?
আর এই কারণেই, সামাজিক রাজনৈতিক অর্থনৈতিক সমস্যাগুলোকে হাতিয়ার করে কিছু লোক ঝামেলা পাকিয়ে ফেলেন, আর আমরাও ভাবছি, সেই পথেই ঝামেলাগুলো দূর করবো!
অথচ, বেশিরভাগ ঝামেলা ভালো করে খুঁটিয়ে দেখলে দেখা যাবে – সামগ্রিক ভাবে আধুনিক চিকিৎসাব্যবস্থার সম্পর্কে মানুষ মারাত্মক ভাবে ভুল ধারণা পোষণ করেন। শুধু না বোঝার ফলে তৈরি হওয়া ঝামেলার জায়গাগুলো নয়, যাঁরা আধুনিক চিকিৎসাব্যবস্থায় বিশ্বাস করেন, যাঁরা তথাকথিত সামাজিক রাজনৈতিক অর্থনৈতিক সমস্যায় ভোগেন না, যাঁরা আধুনিক চিকিৎসকের পরামর্শ মেনে চলেন, এই ব্যবস্থা সম্পর্কে তাঁদেরও অজ্ঞতা সীমাহীন!!
আরো নানারকম তথাকথিত চিকিৎসাপদ্ধতিতে যেমন কোন কিছু প্রমাণ করার, রাখার দায় নেই, কোন বিজ্ঞানসম্মত উপায়ে রোগীর সমস্যা খোঁজার দায় নেই, কোন আইন কানুনের তোয়াক্কা করা নেই, প্রেসক্রিপশন নেই, পরীক্ষা-নিরীক্ষা নেই, চিকিৎসার ফলাফল নেই, ফলাফলের বিশ্লেষণ নেই, ভুল শোধরানোর উপায় নেই – বেশিরভাগ সময় অন্ধকারে ঢিল ছুঁড়ে দিয়ে যা খুশি সমাধান বলে দেয়া যায়, সেটা যে আধুনিক চিকিৎসাব্যবস্থায় অচল, এই সাধারণ জ্ঞানটুকু বেশিরভাগ মানুষের নেই!!!
ফলতঃ কোন না কোন সময়, এই ব্যবস্থায় বিশ্বাস রাখা মানুষ গুলোও অবিশ্বাসী হয়ে পড়েন! কঠিন ভাবেন মডার্ন মেডিসিনকে! নানারকম ঝামেলা তৈরি করেন। আপাতদৃষ্টিতে সেই সব ঝামেলাগুলোকে শুনলে মনে হতে পারে – সত্যি ই কিছু গোলমাল আছে!!
সত্যিই কি তাই??
এটা বুঝতে হলে প্রথমে বুঝতে হবে – এতোক্ষণ এই যে আধুনিক চিকিৎসা ব্যবস্থার প্রতি বিশ্বাসের কথা বললাম, সেই বিশ্বাস অবশ্যই জরুরি, কিন্ত এটাও বোঝা দরকার – সেই বিশ্বাসের জোর কতটা? কোন ভিতের ওপর দাঁড়িয়ে আছে সেই বিশ্বাস?
কিন্ত ভালো করে ভেবে দেখলে বোঝা যায় – আমাদের মত দেশে চিকিৎসা ও চিকিৎসকের প্রতি বিশ্বাস ব্যাপারটা তৈরি হয় কতগুলো বিদঘুটে কারণে।
সেই কারণগুলোর মধ্যে একটি আজ বলা যাক –
প্রথমতঃ একজন মানুষ যখন অসুস্থ হন, প্রথম যে সমস্যায় তিনি পড়েন সেটা হলো – কার কাছে যাবেন? কারণ, আশেপাশের অ-ডাক্তার সবাইই তাঁর মতো!!
আধুনিক চিকিৎসা ব্যবস্থায় এক একজন ডাক্তার এক একটি বিষয় নিয়ে পড়াশোনা করেন, প্রাকটিস করেন। জেনারেল ফিজিশিয়ান ব্যাপারটা কি, আদৌ বেশিরভাগ মানুষ জানেন না!
এর পাশাপাশি আছে নানারকম স্বঘোষিত বিশেষজ্ঞদের মোহময়ী বিজ্ঞাপন। সংখ্যায় তাঁরা কিন্ত যথেষ্ট পরিমাণে আছেন আমাদের আশেপাশে!আর এই বিজ্ঞাপনী ফাঁদে পড়েছেন আধুনিক চিকিৎসকরাও! অনেকেই এক একটি বিষয়ে নিজেকে বিশেষজ্ঞ প্রমাণ করার জন্য উঠে পড়ে লেগেছেন! এমবিবিএস-এর মত কোর্স করে আসার পরও, তার গুরুত্ব কমে আসছে বহু ডাক্তারদের কাছেই!!
এবং এটি কঠিন সত্য যে, আধুনিক চিকিৎসাব্যবস্থায় কারো পক্ষেই সবজান্তা হওয়া সম্ভব নয়!!
তো এই জাঁতাকলে পড়ে মানুষ কি করেন?
এক, তাঁরা বিজ্ঞানসম্মত নয় এমন চিকিৎসাব্যবস্থার স্বঘোষিত সবজান্তা তথাকথিত ডাক্তারের (?) শরণাপন্ন হন! সেখানেই নষ্ট করে ফেলেন গুরুত্বপূর্ণ সময় ও সুযোগ।
দুই, তাঁরা আধুনিক চিকিৎসক বেছে নেন। হ্যাঁ, জাস্ট আলু পেঁয়াজ বেছে নেয়ার মত বেছে নেন!
কোন পদ্ধতিতে বেছে নেন?
নিচের পদ্ধতিগুলো থেকে বেছে নিন আপনার পদ্ধতি:
- বেশিরভাগ মানুষ চা এর দোকানের আড্ডা থেকে ‘ভালো ডাক্তার’ এর নাম শোনেন!
- কোন ডাক্তার কম ফি নেন সেটা শুনে নেন!
- চেনা জানা কেউ হয়তো পাইলসের ব্যথা থেকে মুক্তি পেয়েছেন জেনারেল সার্জেনের কাছে গিয়ে, অতএব শ্বাসকষ্টের রোগীও ছুটবে তাঁর কাছেই!
- কোন ডাক্তার বেশি ফি নেন, অথচ সময় দেন না!
- কোন ডাক্তার বেশি ফি নেন, কিন্ত মিষ্টি করে কথা বলতে পারেন না!
- কোন ডাক্তার কারণে বা অকারণে পরীক্ষা করান!
- কোন ডাক্তার পরীক্ষা করান না!
- কোন ডাক্তার রোগীকে ফ্রি স্যাম্পল দেন, কে দেন না!
- কোন ডাক্তার অসংখ্য রোগী দেখেন!
- কোন ডাক্তার ঠিক করে রাখা সংখ্যার বেশি রোগী দেখেন না !
- কোন ডাক্তারের চিকিৎসা পেয়ে অন্য কেউ ভালো হয়েছেন!
- কোন ডাক্তারের কাছে চিকিৎসা করিয়ে রোগীর রোগ সারেনি!
- কোন ডাক্তার হাসপাতালে প্রাকটিস করেন!
- কোন ডাক্তারের নামের পেছনে এটা ওটা ডিগ্রীর মতন লেখা আছে!
- কোন ডাক্তারের নামের পাশে শুধু এমবিবিএস, এমডি লেখা (তিনি বেশি পড়াশোনা করেননি!)
- কোন ডাক্তারের নামের পাশে লেখা ডিগ্রীটি অপরিচিত!
- কোন ডাক্তারের বিদেশী ডিগ্রী আছে!
- কোন ডাক্তার ফটাফট ইংরেজিতে কথা বলেন!
- কোন ডাক্তার গম্ভীর ভাবে রোগী দেখেন!
- কোন ডাক্তার অন্য ডাক্তারকে নিয়ে তুচ্ছতাচ্ছিল্য করতে পারেন!
- কোন ডাক্তারের নামে অলৌকিক ঘটনা আছে!!
- কোন ডাক্তারের নামে রোগীর খারাপ হওয়া বা রোগীর মৃত্যুর বদনাম আছে!
- কোন ডাক্তারের ওষুধের দোকানে চেলা চামুণ্ডা আছে!
- কোন ডাক্তারের কাছে পাশের বাড়ির জ্ঞানী মানুষটি চিকিৎসা করান!
- পাড়ার মুরব্বি নেতা কোন ডাক্তারকে প্রেফার করেন!
- কোন সেন্টারে গেলেই ডাক্তার পাওয়া যায়!
- কোন সেন্টারে গেলেই ডাক্তার পরীক্ষা করে দেন!
- কোন সেন্টারের বিজ্ঞাপন আছে পথে ঘাটে বা মিডিয়ায়!
- কোন সেন্টারে দক্ষিণ ভারতের ডাক্তার আসেন!
এরকম আরো অসংখ্য ব্যাপার ভেবেচিন্তে ডাক্তার বেছে নেয়ার পদ্ধতি রমরমিয়ে চলে আমাদের দেশে!
কতরকম কারণ যে শুনি, তার কোন ঠিক ঠিকানা নেই!
এবার উপরের কারণগুলো একটু ভেবে দেখুন এক এক করে!
বেশিরভাগ রোগী এর কোন না কোন উপায় অবলম্বন করেন। এবং বলা যায় প্রায় পঁচানব্বই শতাংশ বা তার চেয়ে বেশি মানুষ এই পদ্ধতিতে আধুনিক চিকিৎসক বেছে নেয়ার পর, কোনক্রমে তাঁর কাছেই চিকিৎসা করান বা এই কারণগুলোর কোন একটা সেই রোগীর চিন্তা ভাবনার বিপক্ষে গেলে অন্য উপায়ে অন্য ডাক্তার বেছে নেন!
কেমন যেন ‘দেবতা’ বাছাই প্রক্রিয়া লাগছে না?? ?
এর সঙ্গে বিজ্ঞানসম্মত ভাবে চিকিৎসক বাছাই করার কোন সম্পর্ক নেই, বরং এই করতে গিয়ে বেশিরভাগ সময় এ ডাক্তার ও ডাক্তার করে নষ্ট হয়ে যায় অমূল্য সময়!
তারপর, সত্যিকারের সমস্যা যখন গভীরে চলে যায়, যখন বাকি বিশেষজ্ঞরা হাত তুলে দেন অনায়াসে, কোন দায় নেই বলে রোগী সেই বিশেষজ্ঞকে কিছু বলতেও পারেন না, তখন আধুনিক চিকিৎসককে শুরু করতে হয় প্রথম থেকে!
সেই পদ্ধতি খানিকটা হলেও যে সময় ও খরচ সাপেক্ষ, সেটা মানুষ বোঝেন না, বা বোঝার ধৈর্য হারিয়ে ফেলেন!
আর শুরু করেন ঝামেলি!!
একটু সময় নিয়ে ভেবে দেখলেই বোঝা যায় – চিকিৎসার জন্য ডাক্তার বেছে নেয়ার এই পদ্ধতিতে যতক্ষণ না মানুষ বিজ্ঞানসম্মত উপায় গ্রহণ করছেন, ততক্ষণে এই সমস্যা যাবার নয়!
বলবেন – সাধারণ মানুষ কি করে ডাক্তার বেছে নেবেন তাহলে?
কারো শিক্ষার ব্যাপারটা যেহেতু আমাদের হাতে নেই, প্রাথমিক কর্তব্য হিসেবে বলতে পারি – এ বিষয়েও আপনাকে খোলাখুলি একজন আধুনিক চিকিৎসকের দ্বারস্থ হতে হবে। না – অন্য কেউ হলে আধুনিক চিকিৎসা নিয়ে আপনাকে কোন না কোন ফাঁদে ফেলবেই!!!
সরকারি হাসপাতাল হোক বা প্রাইভেট চিকিৎসক হোক, একজন জেনারেল ফিজিশিয়ানের মতামত প্রথমেই নিয়ে রাখা সবচেয়ে দরকারি। খোলাখুলি তাঁর কাছ থেকে জানা উচিত – কি করা যায়?
তারপর সেই অনুযায়ী দরকার হলে আপনি বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকের পরামর্শ নিতে পারেন বা জেনারেল ফিজিশিয়ানের চিকিৎসা নিতে পারেন।
এতে একদিকে যেমন চিকিৎসাপদ্ধতি বিজ্ঞানসম্মত হয়, বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকের কাছেও অযথা ভিড় কমে!
ভেবে দেখুন, ঝামেলি পাকিয়ে আর যাই হোক, চিকিৎসা হয় না! বরং একটা নিয়ম মেনে চললে, অনেক সহজ হয়ে যায় পুরো পদ্ধতি।
অতএব, আলু পটল বাছাই করার মতো নয়, সঠিক চিকিৎসার প্রথম শর্ত হলো সঠিক ডাক্তার বাছাই করা!
আর সেটা যদি বিজ্ঞানসম্মত ভাবে না হয়, তাহলে পুরো চিকিৎসাটাই একটা ঝামেলি হয়ে দাঁড়ায়। আর সেই ঝামেলির জন্য, বহু রোগীরই শেষ অব্দি সঠিক চিকিৎসকের কাছে পৌঁছানো হয় না।
মাঝখান থেকে চিকিৎসার নামে ক্ষীর খেয়ে নেয় যারা, তাদের আপনারা কোনদিনই চিনতে পারেন না!!