বাপুরাম সাপুড়েকে জানার আগেই আমরা গ্রামে সাপুড়ে দেখেছি। সাপুড়েরা গোল গোল ঝাঁপিতে ভরে সাপ নিয়ে আসত, গ্রামের বাড়ি বাড়ি ঘুরে সাপের খেলা দেখিয়ে চাল -পয়সা সংগ্রহ করত। যদিও এরাও এক রকম ভিখারীই ছিল, এদের আমরা ভিখারীদের থেকে একটু আলাদা ভাবতাম। এই সাপুড়ে বা বাঁদর নাচ দেখানো লোকগুলি ভিখারীর মতন বাড়ী বাড়ী ঘুরত ঠিকই, তবুও এদের , বিশেষ করে সাপুড়েদের আলাদা একটা মর্যাদা ছিল। অবশ্য আমাদের গ্রামের ওদিকে যে সব সাপুড়ে আসত তাদের আমরা কখনো ওঝাগিরী করতে শুনিনি। ওদের আমরা গুনিনও বলতাম। একটা ধারণা ছিল যে ওদের কিছু মন্ত্র বা তুকতাক জানা আছে, যা দিয়ে ওরা সাপকে বশ মানায়।
আমাদের পাশের গ্রামে বছরে একদিন ঝাঁপান মেলা বসত। নির্দিষ্ট তিথি কিছু একটা ছিল নিশ্চয়ই, আজ আর মনে নেই। একবার কি দুবার ঐ মেলায় সাপুড়েদের সাপ খেলা দেখতে গিয়েছি। কুড়ি তিরিশ জন সাপুড়ে এসে হাজির হত। তাদের মধ্যে পাশের গ্রামের যুগলদাকেও খেলা দেখাতে দেখেছি। ওদের সাপের খেলা আমাদের কাছে নতুন কিছু ছিল না। কিন্তু যুগলদা কিছু কিছু ছড়া কেটে মন্ত্র জাতীয় কিছু বলছিল, আজও তা মনে আছে। “কোন গুরুর নাম জানি, কোন গুরুর নাম নাহি জানি, সকল গুরু তুলে নিলাম মাথে; কাল সাপ দিলেন গুরু হাতে”।
বহু বছর পর ক্যানিং যুক্তিবাদী সমিতির অনুষ্ঠানে গিয়ে , হারানবাবুর কাছে এরকম লম্বা লম্বা ছড়া শুনেছি। সাপের বিষ নামানোর মন্ত্র বলে ঐ সব ছড়া বলা হত। কিন্তু ওতে যে কোন কাজ হয় না, চল্লিশ বছর ওঝাগিরি করে হারানবাবু সেটা বুঝেছেন।
এই যুগলদা কিন্তু কোনদিন সাপের ঝাঁপি নিয়ে খেলা দেখাতে আসেনি। লোকের বাড়িতে ক্ষেত মজুরের কাজ করতে দেখেছি যুগলদাকে। আমি গ্রাম ছেড়ে চলে আসার অনেক পরে যুগলদা সাপের কামড় খেয়েই মারা গেছেন।
আমাদের ঐ ছোট বেলায় ধারণা ছিল, সাপুড়েরা মন্ত্র বলে সাপেদের বশ করে। নিদেন পক্ষে ওদের কাছে কোন জড়িবুটি, শেকড় বাকর থাকে, যায় জন্য সাপ ওদের কামড়ায় না। এসব যে একেবারেই বাজে কথা তার প্রমাণ আমরা বহুবার পেয়েছি।
সিনেমায় সাপুড়েদের বীণ বাজিয়ে সাপ খেলাতে দেখা যায়; কিন্তু আমি কোনদিন কোন সাপুড়েকে বীণ বা বাঁশী বাজাতে দেখনি। অনেকের ধারণা, সাপ ঐ বীণের শব্দে আকৃষ্ট হয়। এটাও একেবারেই ভুল ধারণা। সাপের কানই নেই, ওরা শব্দ শুনতে পায় না। সাপ বা সাপুড়ে নিয়ে বহু ভ্রান্ত ধারণার এটাও একটা।
বছর তিনেক আগে আমার সিনিয়ার এক ডাক্তারবাবু আমাকে ফোন করে বললেন, আমাদের একটা দোকানে সাপ ঢুকতে দেখা গেছে, কোন সাপুড়ের সন্ধান দিতে পারেন? বীণ বাজিয়ে সাপকে বের করে আনবে! সাপ ধরাটা যে একেবারেই একটা হাতের কৌশল আর সাহসের ব্যাপার, এটা শুধু আজকাল আমরা বলছি তা নয়; বিখ্যাত সাহিত্যিক শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় তাঁর বিখ্যাত উপন্যাস শ্রীকান্ত+তে সে কথা লিখে গেছেন, প্রায় একশ বছর আগে। তবুও মানুষের মধ্যে এই ধারণা আজও বদ্ধমূল।
সাপ ধরা আর সাপের খেলা দেখানো এক দল লোকের জীবিকা ছিল। দেশের আইনে এসব কাজ কঠোর ভাবে নিষিদ্ধ করার জন্য এদের পেশা পাল্টাতে হয়েছে। তবুও এখনও অনেক জায়গায়ই সাপুড়েদের দেখা যায়। এরা রোজগারের পথ বা কায়দা পাল্টেছে। আগেও এরা ওদের এই সাপ ধরার হাতের কায়দাকে কিছুটা অলৌকিক ক্ষমতা বলে দেখিয়ে তাবিজ- কবচ , জড়ি -বুটি বিক্রী করত। এসব জিনিসে বিশ্বাস করার লোকের অভাব এখনও নেই। হাবড়া রেল ষ্টেশনের প্লাটফর্মে এরকম সাপুড়েদের দুটি গুমটি দোকান আছে। ওরা প্রথমে সাপের খেলা দেখিয়ে লোক জমা করে; তারপর ঐ সব জড়ি- বুটি বিক্রী করে। এঁদের একজনকে একবার কেউটে সাপে কামড় দেয়, সাপ ধরতে গিয়ে। আমি তখন হাবড়া পাতালের ইমারজেন্সিতে ডিউটি করছিলাম। লোকটি ঝিমিয়ে পড়েছে দেখে সাথে সাথেই ভর্তি করে অ্যান্টি ভেনম চালাই। ওর সাথে যে বয়স্ক লোকটি এসেছিল, সে আমাকে বলছিল, এরা কিন্তু সাপুড়ে নয়, বিজ্ঞান কর্মী। এই যে সাপে কামড়ালে হাসপাতালেই চিকিৎসা করতে হবে, এই ব্যাপারটা যে ওরা বুঝেছে, এটাই বিজ্ঞান মানসিকতা।
এই সাপুড়েদের খুব ভালোভাবে কাজে লাগিয়ে তামিনাড়ুতে মহাবলীপুরম ইরুলা কোপারেটিভ সোসাইটি তৈরী করা হয়েছে চল্লিশ বছরের বেশী হল। এখন সরকারী ভাবে এই একটি জায়গায়ই সাপের বিষ সংগ্রহ করা হয়। এই সাপের বিষ থেকেই দেশের সবকটি ল্যাবরেটরিতে সাপের বিষের অ্যান্টি ভেনম তৈরি হয়। এই ইরুলা বা সাপুড়েরাই আজ গোটা দেশের মানুষের জন্য সাপের বিষ সংগ্রহের কাজটি করে যাচ্ছেন। আমাদের দেশে এদের মত বংশ পরম্পরায় সাপুড়ে এখনও অনেক আছে। এদের ঠিক মত কাজ দেওয়া হয় না, এরা অন্য কাজও তেমন পারে না। বাধ্য হয়েই বেআইনি কাজ করছে।
বিজ্ঞানীরা অনেকদিন থেকেই বলছেন, ভারতে চার প্রান্তে চারটি বিষ সংগ্রহ কেন্দ্র থাকা উচিত। বর্ধমান জেলার পাল্লা রোডে সাপুড়েদের একটি বড় পাড়া আছে। এই মাল পাড়ার সাপুড়েদের কাজে লাগিয়ে এরাজ্যেও ইরুলা সোসাইটির মত বিষ সংগ্রহ কেন্দ্র করা যায়। এতে এ রাজ্যের সাপে কাটা রুগীদের জন্য উন্নত অ্যান্টি ভেনম তৈরি করা যাবে।
সাপুড়েদের সম্পর্কে আমার নিজের ধারণা একেবারে পাল্টে দিয়েছেন ক্যানিং যুক্তিবাদীর তিন সৈনিক। হারান প্রামাণিক, দ্বিজপদ হাজারী আর কাবিল জমাদার। এরা তিনজনই এক সময় পেশাগত ভাবেই সাপুড়ে ছিলেন। হারানবাবু চল্লিশ বছর সাপুড়ে আর ওঝাগিরি করার পর, যুক্তিবাদী সমিতির সদস্য হয়ে যান। এখন ওনারা সমিতির বিভিন্ন অনুষ্ঠানে ঘুরে ঘুরে মানুষকে বোঝান যে, মন্ত্র তন্ত্র বা জরিবুটিতে কোন কাজ হয় না। সাপে কাটার একমাত্র ওষুধ অ্যান্টি ভেনম। কাবিল জমাদার ভাই গত কয়েক বছর ধরেই সাপে কাটা রুগীদের নিজের মোটর বাইকে চাপিয়ে হাসপাতাল পৌঁছে দিচ্ছেন।
সাপুড়েদের বিশেষ ক্ষমতাকে এরকম নানান কাজে লাগানো যায়। আমরা এসব নিয়ে ভাবছি কি?