লেখার সময় পাওয়াই মুশকিল। করোনা কমলেও কোনও একটা ভাইরাল জ্বরের প্রকোপ চলছে। দলে দলে রোগী আসছেন। তবে ভালো ব্যাপার হলো দু- তিন দিনেই জ্বর কমে যাচ্ছে। যে কারণে জ্বরের রোগীরা একবার দেখিয়ে যাওয়ার পর আর ফেরত আসছেন না। আগে যেমন রাত সাড়ে নটা থেকে এগারোটা পর্যন্ত একটানা ফোনে কথা বলতে হতো, সেই ফোন আসা অনেক কমেছে।
ফোনের প্রসঙ্গই যখন এলো, তখন একটা ফোনের কথা লিখে রাখি। একজন পরিচিত ভদ্রলোক গতকাল রাতে ফোন করেছিলেন। হাত ও পায়ের নখ গুলো ভেঙে ভেঙে যাচ্ছে, অল্প অল্প ব্যথাও হচ্ছে, কী করবেন? সাধারণত আমি ফোনে ওষুধপত্র বলতে চাইনা। চেনাজানা হওয়ায় বললাম, ‘ফ্লুকোনাজল ২০০ সপ্তাহে একবার করে খান। না কমলে তখন চামড়ার ডাক্তারকে দেখাবেন।’
আজ সেই ভদ্রলোক বাড়ির খুপরিতে হাজির। এসেই সঞ্জয়দার সাথে ঝগড়া শুরু করেছেন। সঞ্জয়দা নাম ছাড়া ঢুকতে দেবে না, আর তিনি ঢুকবেনই। বলছেন, ‘আমার একটাই জিজ্ঞাস্য আছে। জিজ্ঞেস করেই চলে যাব।’
সঞ্জয়দা ঘর পোড়া গরু। বলল, ‘সবাই ঐ বলেই ঢোকেন। তারপর শুরু করেন, ডাক্তারবাবু, প্রেশারটা একবার মেপে দিন, বুকটা একবার শুনে দিন। আমার মেয়ের নাক দিয়ে জল পড়ছে, কী করব?’
রোগী দেখার জন্য মনসংযোগ করা দরকার। বাইরে সারাক্ষণ ঝগড়া চললে মনসংযোগ করা যায়? সামনের বুড়িমা কী বলছেন কিছুই মাথায় ঢুকছে না।
অগত্যা মাথা বাড়ালাম, ‘এতো চ্যাঁচামেচি কীসের?’
আমাকে দেখে সেই ভদ্রলোক বললেন, ‘আমিই কালকে ফোন করেছিলাম নখের সমস্যার জন্য।’
ভদ্রলোককে দেখেই চিনেছি। বললাম, ‘হ্যাঁ, মনে আছে। আমি তো ওষুধ বলেই দিয়েছি। না কমলে চামড়ার ডাক্তারের কাছে যেতে বলেছি। আপনি আবার এসেছেন কেন?’
‘ইয়ে ডাক্তারবাবু… ফুটোনো জল খেলে কী নখ ঠিক হয়ে যাবে?’
‘এই অদ্ভুত কথা জিজ্ঞেস করার জন্য আপনি এতো ঝামেলা করছেন? আমাকে কী একটু শান্তিতে রোগীও দেখতে দেবেন না? ফুটোনো জল খেলে নখ কখনও ভালো হয়? বুদ্ধি শুদ্ধি কী একেবারেই লোপ পেয়ে গেছে?’
ভদ্রলোক সরাসরি আমাকে আক্রমণ করলেন, ‘তাহলে আপনি বললেন কেন সপ্তাহে একবার ২০০ এম এল ফুটোনো জল খেতে? বুদ্ধি শুদ্ধি আছে বলেই তো জানতে চলে এসেছি।’
বুঝলাম ফোনে আর ওষুধের নাম বলা যাবে না। ফোনে ফ্লুকোনাজল ফুটোনো জল হয়ে যায়। সফটোভ্যাক শক্তভাত হয়ে যায়।
ঝামেলা মিটিয়ে ঘরে ঢুকে দেখি বুড়িমা পায়ের বুড়ো আঙুলের একটা ব্যান্ডেজে হাত বোলাচ্ছেন। বললাম, ‘ওটা কী হয়েছে? ব্যান্ডেজ কেন? অনেক কিছুই তো বললেন, ওটার কথা তো বলেন নি?’
বুড়িমা বললেন, ‘ওটা নিয়ে তোমাকে মাথা ঘামাতে হবে না বাপু। তুমি প্রেশার সুগারটা একটু স্বাভাবিক করে দাও। এই ঘা আমার বহুদিনের সঙ্গী। ওটা থাক।’
বললাম, ‘থাকবে কেন? আপনি খুলে দেখান। এন্টিবায়োটিক দি, মলম দি। দরকার হলে সার্জেন দেখাবেন। ডায়াবেটিস রোগী আপনি। শুধু মুধু একটা ফুট আলসার পুষে রাখবেন কেন?’
বুড়িমা বললেন, ‘আমি রোজ সকালে পঁয়তাল্লিশ মিনিট ধরে গরম জলে লবণ দিয়ে ঘাটা পরিষ্কার করি। তারপর মলম লাগাই। বারান্দায় রৌদ্রে পা তুলে ঘা’টাকে আধ ঘণ্টা রোদ খাওয়াই। তারপর ব্যান্ডেজ করি। স্নানের পর আবার মলম লাগিয়ে ব্যান্ডেজ করি। রাতে আবার গরম জল দিয়ে পরিষ্কার করি। আবার ব্যান্ডেজ করি। এটার পেছনে অনেক সময় কেটে যায়। এই ঘা সেরে গেলে সময় কাটবে কী করে? বাড়িতে আমার কোনও কাজ কর্ম নেই। তুমি যাবে আমার সাথে গল্প করতে?’
এসব আজব রোগীই আমার বরাতে জোটে। বুড়িমার পরে একটি বাইশ-তেইশ বছরের ছেলে ঢুকল। ঢুকেই দরজা বন্ধ করে বলল, ‘বাবাকে দেখাব। তার আগে কয়েকটা কথা বলে নি। ওনার সামনে বলা যাবে না। আমার বোন পনেরদিন হলো সুইসাইড করেছে। তাই বাবার মাথার ঠিক নেই। আপনাকে যদি খারাপ কিছু বলে প্লিজ কিছু মনে করবেন না।’
সন্তান হারা পিতার কথায় কিছু মনে করব এমন পাষণ্ড আমি নই। বললাম, ‘আহারে, বাবার এখন কী অবস্থা? ওনার কথায় কিছু মনে করার প্রশ্নই নেই।’
‘লকডাউনে স্কুল বন্ধ। বোন ক্লাস এইটে পড়ত। বড্ড বেশি মোবাইলে এডিক্টেড হয়ে গেছিল। সারাক্ষণ মোবাইল নিয়ে পরে থাকত। কারুর কথায় কান দিত না। দিন পনেরো আগে বাবা হঠাৎই রেগে গিয়ে ওকে মারধোর করে। বাবা বোনকে ভীষণ ভালোবাসত। কোনোদিনও ওর গায়ে হাত তোলেনি। সেদিন রাতেই বোন গলায় দড়ি দেয়। তারপর থেকেই বাবা কেমন হয়ে গেছে। সারাক্ষণ একটা ঘোরের মধ্যে আছে। বাবার ধারণা হয়েছে, লকডাউন করে আর স্কুল বন্ধ করে আসলে স্কুল পড়ুয়াদের স্বাভাবিক জীবনযাত্রা ধ্বংস করে দেওয়ার চক্রান্ত চলছে। এবং সেই চক্রান্তের পুরোভাগে রয়েছেন চিকিৎসক এবং বৈজ্ঞানিকরা। তাঁরা ছোটো ছোটো বাচ্চাদের নিয়ে কোনও একটা বীভৎস এক্সপেরিমেন্ট করছেন। বাবা এখানেও কিছুতেই আসতে চাইছিল না। জোর করে এনেছি। দাঁড়ান, এবার ওকে নিয়ে আসি।’
ছেলেটি বাইরে গেল। আমি বড়সড় একটা দীর্ঘশ্বাস ফেললাম। এদেশে খারাপ কিছু ঘটলেই সবাই প্রথমে চিকিৎসককে দোষ দেয়। ব্যাপারটা এখন অনেকটাই যেকোনো রচনাকেই টেনে গরুর রচনায় আনার মতো।
কিন্তু ছেলেটির বদলে এক মহিলা ঢুকলেন। আমি অবাক হয়ে সঞ্জয়দাকে ডাকলাম, ‘সঞ্জয়দা, এর আগে যে ছেলেটি এল, সে কোথায়।’
সঞ্জয়দা বলল, ‘ওই ছেলেটির সাথে যে ভদ্রলোক এসেছিলেন তিনি পাড়ার মোড়ের দিকে হাঁটা লাগিয়েছেন। ছেলেটি তাঁর পেছন পেছন দৌড়েছে।’
আমি আমার আরেক সহকারী গৌড়কে পাঠালাম ওদের খবর নেওয়ার জন্য। গৌড় ঘুরে এসে জানাল পাড়ার মোড় শুনশান। কেউ নেই।