তোমরা প্রায়ই তো বক্কাবাজ ঘনাদা’দের, কিম্বা চণ্ডীমণ্ডপের সবজান্তা সেই সিইওকে বলো কথাটা।
“কোথায় খাপ খুলেছ শিবাজি?”
সেই ‘কোথায় খাপ খুলেছ শিবাজি’র গল্পটা জানো তোমরা? শোনো, তবে বলি।
কলেজজীবনে আমার সহপাঠী নাট্যকার বন্ধু ছিল বিবেকব্রত, আমরা বলতাম বিব্রত। সেই তার মুখে শোনা, নাটকের চিটচ্যাট গল্প। আরও নিশ্চয়ই আছে এই রকম অনেক। কিন্তু বিবেক তার নাটক- পাগলামো কমিয়ে পুরো ডাক্তার হয়ে গেল। বাকি গল্পগুলো আর শোনা হল না।
এ’বারে গল্পটা বলি।
এক নাটুকে দলে স্টার আর্টিস্ট একজনই। প্রতি নাটকেই সে নায়কের ভূমিকায়। তো একবার সেই দল তাদের নাট্য উৎসবে নিজেদের নাটক করছে পরপর। ও’বেলার নাটক ছিল ছত্রপতি। এবারের নাটক বাংলার শেষ নবাব। বলাই বাহুল্য, সেই এক তারকাই, আগের নাটকের শিবাজি আর পরের নাটকের সিরাজউদ্দৌলা। স্বপন সাহার সিনেমায় যেমন, পাঁচটা সিনেমার শুটিং একসঙ্গে হত। একই মেক আপ। একই পাত্রপাত্রী। একই সেট। এখানেও তাই।
ভেবে দেখলে শিবাজি আর সিরাজেরও মেক আপ প্রকৃত অর্থে প্রায় একই। ঝলমলে পোষাক, উষ্ণীষ আর তরোয়াল। দাড়িটাও প্রায় একই। শুধু সিরাজের বেলা গোঁফটা বাদ।
এই বার পরের নাটক। সিরাজের সঙ্গে ক্লাইভের তরোয়াল যুদ্ধ তথা মুখে সংলাপ-তরপানি চলছে। ক্লান্ত নায়ক ভুল করে আগের নাটকের শিবাজির সংলাপ আওড়াচ্ছে।
তখন ক্লাইভ যে সেজেছে, সেই নাকি শুধরে দেবার জন্য, এই কথা বলেছিল। তার আবার উচ্চারণে ‘স’এর দোষ ছিল। – “কোথায় খাপ খুলেছ সিবাজি? এ যে পলাসির প্রান্তর! হাঃ হাঃ হাঃ!”
এই নাটুকে দলের আর একটা গল্পও বিবেক বলেছিল। খুব মনে পড়ে কোনও বিসদৃশ কাণ্ড কারখানা দেখলে। যেমন ধরো পুনর্জন্মপ্রাপ্ত হিটলার যদি গ্যাস চেম্বার নিয়ে বিচারবিভাগীয় কমিশন বসায়, সেই রকমের কোনও ঘটনায়।
সেই একই দল। একই চরিত্র। এবারের নাটক, সুলতানা রিজিয়া। নাম চরিত্রে? না কোনও মহিলা শিল্পী নন। সেই একই তারকা নায়ক। যিনি আগের নাটকে শিবাজি সেজেছিলেন। তিনি রিজিয়ার মেক আপ নিয়েছেন। মাথায় লম্বা বেণী। অন্যান্য মহিলাসুলভ মেক আপ। পোষাক মহিলা সুলভ। এ দিকে নাটক শুরুর থার্ড বেল পড়ে গেছে। তড়িঘড়ি তিনি মঞ্চের দখল নিলেন। সুদীর্ঘ ওজস্বিনী সংলাপ। উল্টোদিকে আমলার চরিত্রে এক অভিনেতা। প্রকৃত ডায়ালগে সেই পুরুষ আমলা চরিত্রটি মহিলার শাসন চায় না। রিজিয়ার কথার উত্তরে সে ঢালবে তীব্র জ্বালা ও বিদ্বেষভরা পুরুষতান্ত্রিক সমালোচনা।
কিন্তু সেই অভিনেতা ব্যোমকে গেছে। রিজিয়া, মেক আপ নেওয়া রিজিয়া, হায় বেণী লাগিয়েছে, লিপস্টিক কাজলেও, ভুল নেই কোত্থাও। কিন্তু গালে স্পিরিট লাগিয়েছিল বটে, থার্ড বেলের তাড়াহুড়োয় দাড়িটা টেনে খুলতে ভুলে গেছে।
কাজেই সেই চমকে যাওয়া অভিনেতা তার ডায়ালগ শুরু করল বিকট এক অট্টহাসি দিয়ে। – “হাঃ হাঃ হাঃ! হাসি পায় রিজিয়ার চাপদাড়ি দেখে।”।আমাদেরও আজকাল কমিশন থুড়ি চাপদাড়ি দেখলে বড় হাসি পায়।
এই নাটকের দলের শুরুর দিকের এক ঘটনা বলে শেষ করি।
‘সীতা হরণ’ নাটকে সেই একই নায়ক। দুর্বাদলশ্যাম সুদর্শন, রোগা পাতলা যুবক, ললিত চক্রবর্তী। নায়ক বলে তার মজুরি বেশি। সৌখিন ছেলে। বার্ডসাই খায়।।শেষ দৃশ্যে রাবণের সঙ্গে অন্তিম লড়াই। জোর যুদ্ধ চলছে। দশাসই চেহারার রাবণের মিনিট কয়েক পরেই ভূমিশয্যা নেবার কথা। কিন্তু সে লড়াই করেই চলেছে। পরাজয় মেনে নেবার কোনও লক্ষণই দেখাচ্ছে না। এদিকে রামের তো রকের কথ্য ভাষায় যাকে বলে হালুয়া টাইট অবস্থা। ঘামে জবজবে। মেক আপ গলে গলে পড়ছে।
করুণ গলায় আবেদন করল সে। যুদ্ধ করতে করতে রাবণরূপী হারু কাহারকে ফিসফিস করে বলল, – “কী রে হারু, মর তাড়াতাড়ি!”
হারু, প্রবল বিক্রমে লড়াই করতে করতে দাঁত কিড়মিড়িয়ে উত্তর দিল, – “কেন মরব? হাফ টাইমে যখন সিগ্রেট খাচ্ছিলি, এট্টু চাইলাম শেষটা! দিয়েছিলি?”
বলা বাহুল্য, রাক্ষস সাজা প্রতিনায়ক হারু কাহারের মজুরি রামের চাইতে অনেক কম।
এখনকার ক্ষমতার লড়াইয়ে বেশ লাগসই লাগে গল্পটা।
★
বিবেকব্রতর নাম ব্যবহার করলাম বলে অনুমতি নেবার জন্য ফোন করলাম। বাবু ধরলেন না।