২০শে জুন, ২০২০
দেশে করোনার থাবার মধ্যেই কাল ২১ জুন সারা ভারত বছরের প্রথম সূর্য গ্রহণ দেখার জন্য প্রস্তুত। মাসের শুরুতে আংশিক চন্দ্রগ্রহণের পরে কাল রবিবার ভারতের বিভিন্ন জায়গা থেকে দেখা যাবে মতো ‘Ring of Fire’ -এর মতো এক বিরল মহাজাগতিক দৃশ্য।
পৃথিবী ও সূর্যের মাঝে একই সরলরেখায় চাঁদ এসে উপস্থিত হলে চাঁদের ছায়া সূর্যকে ঢেকে দেয়, যাকে আমরা সূর্য গ্রহণ বলে জানি। ২১ শে জুন উত্তর গোলার্ধের সবচেয়ে বড় দিনে এই গ্রহণ হওয়ার ফলে চাঁদ পৃথিবী থেকে সবচেয়ে দূরের কক্ষে অবস্থান করছে। তাই, সে সূর্যকে সম্পূর্ণ রূপে ঢাকতে পারবে না। ফলতঃ, সূর্যের বেড় বরাবর উজ্জ্বল প্রভা দেখা যাবে এবং এক জ্বলন্ত অঙগুরীয়ের নির্মাণ হবে।
সূর্যগ্রহণের সময় টা জানিয়ে রাখি—
আংশিক সূর্যগ্রহণ শুরু হবে– ০৯:১৫:৫৮।
প্রথম পূর্ণগ্রাস সূর্যগ্রহণ শুরু হবে–১০:১৭:৪৫।
গ্রহণের চূড়ান্ত সময়– ১২:১০:০৪।
পূৰ্ণগ্ৰাস সূর্য গ্রহণ শেষ হবে–১৪:০২:১৭।আংশিক সূর্য গ্রহণের শেষ হবে–১৫:০৪:০১।
পুরাকাল থেকেই সূর্য গ্রহণের সাথে জড়িয়ে আছে মানুষের অসীম কৌতূহল ও ভয়।
এই যে দিনের বেলা হঠাৎ করেই সূর্যের আংশিক কিংবা পুরোপুরি অদৃশ্য হয়ে যাওয়া– এই অস্বাভাবিক ঘটনাটাই মানুষের মনে উদ্রেক করেছে ভয়ের এবং ভয় থেকেই সৃষ্টি হয়ে এসেছে গ্রহণ নিয়ে নানান মিথ ও কুসংস্কার। আজকের এই একবিংশ শতাব্দীর কুড়িটা বছর পেরিয়েও মানুষের মধ্যে দিব্য বিদ্যমান এই সব কুসংস্কারের অন্ধকার। এখনও সমাজের বিভিন্ন স্তরের মানুষ গ্রহণের মতো মহাজাগতিক ঘটনাকে ধ্বংস ও মৃত্যুর মতো অশুভ ঘটনার পূর্বাভাস বলে মনে করে থাকেন।
সূর্য গ্রহণের সময়ে শুধু একটা বিষয়ই মাথায় রাখুন। সেটি হলো, খালি চোখে সরাসরি সূর্যের দিকে তাকানো চলবে না। এতে চোখের মধ্যকার রেটিনার ক্ষতি হতে পারে। সরাসরি গ্রহণ দেখতে হলে সোলার ফিল্টার পরে নিন।
অনেকের মনে সূর্য গ্রহণ সম্পর্কে আজও যে কুসংস্কারগুলি ব্যপ্ত, নীচে সেগুলো নিয়ে সংক্ষিপ্ত আলোচনা করছি।
১. “সূর্য গ্রহণের সময় কোনও খাবার রান্না করা বা খাওয়া উচিত না।”
আজও ভারতের বিভিন্ন জায়গায় গ্রহণের সময়ে মানুষ উপবাস রাখেন এই বিশ্বাস থেকে গ্রহণ-কালে সূর্য থেকে নানা রকম ক্ষতিকর রশ্মি এসে পৃথিবীতে পৌঁছোয়। যার ফলে, খাবার বিষাক্ত ও অশুদ্ধ হয়ে যায়। গ্রহণের পূর্বে রান্না করা খাবার থাকলে তাও বর্জন করা হয়।
আমি অনেক শিক্ষিত মানুষকে এও বলতে শুনেছি যে, সূর্যগ্রহণের সময় পৃথিবী যেহেতু অন্ধকার হয়ে আসে, তাই সূর্যের প্রয়োজনীয় রশ্মি পৃথিবীতে প্রবেশ করতে পারে না। সেই কারণে, এইসময় বিভিন্ন ভাইরাস, ব্যাকটেরিয়া আরও সক্রিয় হয়ে ওঠে এবং ব্যপক সংক্রমণ ঘটাতে পারে।
এগুলি কিন্তু একেবারেই ভিত্তিহীন এবং চূড়ান্ত অবৈজ্ঞানিক কথা-বার্তা।
আমার ব্যক্তিগত ভাবে মনে হয়, যেহেতু গ্রহণের সময়ে চারিদিকে একরকম অন্ধকার নেমে আসে, তাই সেই অন্ধকারের মধ্যে কোনো কিছু খেতে অসুবিধে হতে পারে ভেবে হয়তো বা এমন কোনো নিয়ম বানানো হয়েছিল যেটি কালে কালে অপভ্রংশ হয়ে আজকের এই কুসংস্কারে এসে দাঁড়িয়েছে।
সূর্যগ্রহণ একটা অতি স্বাভাবিক প্রাকৃতিক ঘটনা। গ্রহণের সময়ে খাদ্যের কোনো গুণাগুণই নষ্ট হয় না কিংবা সূর্যালোকের তাৎক্ষণিক অভাবে আলাদা করে কোনো ব্যাকটেরিয়া বা ভাইরাস সক্রিয় হয়ে ওঠে না। তাহলে তো রাতের বেলাতেও যেহেতু অন্ধকার থাকে, আমাদের কোনো খাদ্য গ্রহণ করা উচিৎ নয়!
গ্রহণের সময় রান্না করা কিংবা খাওয়া সম্পূর্ণই নিরাপদ। তাছাড়া, আজ রবিবার। সুতরাং, খাওয়া দাওয়া, প্রাত্যহিক কাজকর্ম সবই চলুক জমিয়ে।
২. “গর্ভবতী মহিলা ও বাচ্চাদের সূর্যগ্রহণের সময় বাইরে বেরোনো উচিত নয়”।
এটিও আরেকটি বহুল প্রচলিত কুসংস্কার যে, গ্রহণের সময় বাইরে বেরোলে বা গ্রহণ দেখলে সন্তানসম্ভবা মহিলাদের গর্ভের বাচ্চার ক্ষতি হতে পারে, এমন কী অসুস্থ ও বিকলাঙ্গ বাচ্চার জন্ম হতে পারে। সূর্যগ্রহণ কালে তাই অনেকে গর্ভবতী মহিলা ও ছোট বাচ্চাদের বাড়ির ভেতরে থাকার উপদেশ দিয়ে থাকেন।
অত্যন্ত অবৈজ্ঞানিক ও ভিত্তিহীন ভাবনা এটি।
গ্রহণ দেখার সময় কেবল সূর্যের দিকে সরাসরি তাকানো উচিত নয়, বিশেষ ধরনের সোলার গ্লাস পরে গ্রহণ দেখা উচিত। সেটি নিশ্চিত করতে পারলে সন্তানসম্ভবা মহিলারাও গ্রহণ দেখতে কোনও অসুবিধে থাকার কথা নয়। আর, এই নিয়মটি সব মানুষের জন্যেই প্রযোজ্য।
৩. আজকে সোশ্যাল মিডিয়া দেখলাম এক ফেক নিউজে ছেয়ে গেছে যে, “সূর্য গ্রহণে নানান জোডিয়াক পরিবর্তন হবে; যার ফলে করোনা ভাইরাস পৃথিবী থেকে পালিয়ে যাবে।”
আবার বলছি, সূর্যগ্রহণ নিছক এক প্রাকৃতিক ঘটনা যা প্রতিবছর গড়ে ২-৪ বার ঘটে থাকে। এর সঙ্গে করোনা ভাইরাসের সংক্রমণ বেড়ে যাওয়া বা কমে যাওয়ার কোনো রকম সম্পর্ক নেই।
৪. “সূর্যগ্রহনের সময় রক্তদান করা উচিৎ নয়।”
সূর্যগ্রহনের সময় রক্ত দিলে ইমিউনিটি পাওয়ার কমে যায় না। ইনফ্যাক্ট, কখনোই রক্ত দিলে ইমিউনিটি কমে যায় না। যে পরিমাণ রক্ত নেওয়া হয়, তাতে শরীরে কোনো প্রভাব পড়ে না, শরীর খুব অল্প সময়ের মধ্যেই তা তৈরি করে নেয়। তাছাড়া, রক্তদান শিবিরে রক্ত দেওয়ার আগে যে স্বাস্থ্যপরীক্ষা হয়, তাতে কেউ শারীরিকভাবে অসুস্থ কিংবা দুর্বল বলে চিহ্নিত হলে তাকে রক্তদান থেকে বিরত করা হয়।
৫. ” সূর্য গ্রহণ এক অশুভ সূচক লক্ষণ।”
আজকের ডিজিটাল ইন্ডিয়াতেও অসংখ্য মানুষ বিশ্বাস করেন, সূর্যের তাৎক্ষণিক অন্তর্ধান এক মহা অমঙ্গলের ঘটনা। যেন, এক সাংঘাতিক অনর্থ হয়ে যাবে এতে। ‘রাহু’-র কুপিতদৃষ্টি থেকে মুক্তি পাবার জন্য মানুষ মরীয়া ভাবে জানতে চান, গ্রহণ কালে ঠিক কি করা উচিত আর কি না?
ক) অনেক মানুষ গ্রহণ কালে পূজা-অর্চনা করা বন্ধ করে দেন এই বিশ্বাসে যে, এইসময় মূর্তি-স্পর্শ করলে তা যেন অশুচি হয়ে যাবে। অনেকে তো সূর্য গ্রহণ শেষ হলে গঙ্গাজলে ধুয়ে পবিত্র করে নেন ঠাকুর ঘর।
খ) গ্রহণের অশুভ ফলাফল থেকে বাঁচতে অনেকে স্তোত্র, স্তব, সংকীর্তন শুরু করেন।
গ) কিছু গোঁড়া বিশ্বাসীরা তো আবার এসময় খাওয়া, শোয়া, প্রসাধন, মল-মূত্র বর্জন কিংবা যৌনসংসর্গ করা থেকে বিরত থাকেন।
ঘ) গ্রহণ শেষ হলে অনেক বিশ্বাসী মানুষই আবার স্নান করে ধোয়া কাপড় পড়ে ‘শুদ্ধ’ হয়ে ওঠার চেষ্টা করেন। অনেকেই এসময় গঙ্গাস্নান করে সকল অমঙ্গল তাড়িয়ে ফেলার চেষ্টা করেন।
উপরের সবকটি অভ্যেসই যে নিছক কুসংস্কার, এতে কোনোই সন্দেহ নেই।
হ্যাঁ, পরিবেশের এরকম হঠাৎ পরিবর্তনে কেউ যদি ভগ্নোদ্যম হয়ে পড়েন, বা, স্তব-স্তোত্র-ধ্যান করে মানসিক শান্তিলাভ করতে চান সেটা আলাদা বিষয়। কিন্তু ‘করতেই হবে’ বলে কোনো ভিত্তিহীন কুসংস্কারের খু্ঁটিতে নিজেরাও বাঁধা পড়বেন না কিংবা কাউকে বেঁধে দেবেন না।
বহুবছর ধরে বিজ্ঞান সচেতনতা গড়ে তোলার চেষ্টা চললেও আজও মানুষ সেই অন্ধবিশ্বাসের চশমা এঁটে পথ চলেছে। বিজ্ঞান আমাদের শিখিয়েছে অনেককিছুই।
কিন্তু, ঐ যে!
সমাজ কিংবা ধর্মের শিখিয়ে দেওয়া কুসংস্কার, ভয় আর ভীরুতার সাথে আমাদের যতই হৃদ্যতা হয়েছে, বিজ্ঞান আমাদের থেকে ততটাই দূরে সরে গেছে। বিজ্ঞান আমরা ক্লাসরুমেই পড়েছি, কিন্তু যাপনে বা মননে জুড়তে পারি নি।
অনেক হয়েছে! এবার অন্ততঃ কুসংস্কারমুক্ত হয়ে উঠুন। বলয়গ্রাস সূর্য গ্রহণের মতো বিরল প্রাকৃতিক ঘটনা উপভোগ করুন। এ সুযোগ কিন্তু বারেবারে আসে না।
সব্বাইকে তাই হ্যাপ্পি ‘গ্রহণ’!!
ভুলবশত অন্য একটি লেখা ড মালবিকা ব্যানার্জীর নামে প্রকাশিত হয়েছিল। আমরা দুঃখিত।