চৈত্রের দুপুরে হাসপাতালে ডিউটি। রোগীর ভিড়ে উপচে পড়ছে ছোট্ট হাসপাতাল চত্ত্বর। পিলের জ্বর আর পান্ডুরোগের ভিড়ে প্রসব যন্ত্রণা আর দুর্ঘটনার উপর্যুপরি আর্তনাদ। আর একা কুম্ভ আমি। সত্যি বলছি, কথায় কথায় চিকিৎসক নিগ্রহকারী ব্যক্তিরা চিকিৎসকের জায়গায় ঘন্টা দুয়েক নিজেকে কল্পনা করলে বিবেক জাগ্রত হয়ে সম্ভ্রম জাগতে বাধ্য।
এমন সময় এক যুবককে চার কাঁধে তুলে হাসপাতালে একটা ভিড় জড়ো হল। বাড়ির ছাদে কাজ করা-কালীন পা পিছলে নিচে পড়েছে। তার পর থেকেই হাত,পা সব অবশ। অসাড়ে প্রস্রাব হয়ে যাচ্ছে। কথাটুকু বলতে পারছে শুধু।
চিৎ করে শুইয়ে পায়ের পাতায় প্লান্টার রিফ্লেক্স দেখে বুঝলাম আপার মোটর নিউরোন ছিঁড়েছে। হাতের রিফ্লেক্স দেখে নিশ্চিত হলাম ঘাড়ের কাছে থাকা স্পাইনাল কর্ডের অংশ ছিঁড়েছে। একটা নরম সারভাইকাল কলার পরিয়ে মাথা থেকে ঘাড় নট নড়ন চড়ন অবস্থায় রেখে স্যালাইন, অক্সিজেন, ইউরিনারী ক্যাথিটার পরিয়ে নিউরোসারজিক্যাল ইউনিটে রেফার করতে উদ্যত হলাম।
রোগীর বড় দাদা জিজ্ঞাসু চোখে আমার রেফার কাগজে প্রায় ঝুঁকে পড়ে প্রশ্ন করলেন “দিব্যি তো কথা বলছে। এখানে কি কিছুই করা যাবে না?”
বুঝিয়ে বলার প্রয়োজন আছে বুঝে বললাম, “ধরুন কোলাঘাট তাপবিদ্যুৎ কেন্দ্রে বিদ্যুৎ তৈরি হয়। সেখান থেকে তারের মাধ্যমে রূপনারায়ণ পেরিয়ে হাওড়া হয়ে গঙ্গা পেরিয়ে কলকাতায় বিদ্যুৎ পৌঁছালে তবে গিয়ে আপনার ফ্ল্যাটে আলো জ্বলে। এবার ধরুন গঙ্গার উপরে থাকা বিদ্যুৎবাহী তার ছিঁড়ে গেলে কলকাতা অন্ধকার হবে ঠিকই কিন্তু হাওড়ার কোনও সমস্যা হবে না। এক্ষেত্রে আমাদের ব্রেন যদি কোলাঘাট তাপবিদ্যুৎ কেন্দ্র হয় তাহলে সেখান থেকে সারা শরীরে বিদ্যুৎ পৌঁছায় শিরদাঁড়ার ভেতরে থাকা স্পাইনাল কর্ড দিয়ে। স্পাইনাল কর্ডের যে অংশ আঘাতপ্রাপ্ত হবে তার পরের অংশ অকেজো হয়ে পড়বে।”
ভদ্রলোক গোলগোল চোখ করে জিজ্ঞেস করলেন, “আমার ভাইয়ের তাহলে কি হয়েছে স্যার?”
ভারী গলায় উত্তর দিলাম “রূপনারায়ণের ওপরই স্পাইনাল কর্ড ক্ষতিগ্রস্ত। অর্থাৎ কিনা ব্রেনের পরেই ঘাড়ের কাছে আঘাত হয়েছে। তাই কথা বলতে পারছে ঠিকই কিন্তু তার পরের অংশে বিদ্যুৎ না থাকায় হাত, পা সবই অকেজো।
প্রাথমিক ভাবে কি করণীয়?
স্পাইনাল কর্ডকে নট নড়ন চড়ন অবস্থায় রেখে যত দ্রুত সম্ভব নিউরোসার্জারী ইউনিটে ভরতি করে অপারেশানের ব্যবস্থা করা। এর মাঝে স্যালাইন,ইউরিনারী ক্যাথিটার,আর অক্সিজেনের প্রয়োগ জরুরী। রোগীর শ্বাসপ্রশ্বাস ও রক্তসঞ্চালন স্বাভাবিক রেখে তবেই রেফার করা উচিত।
ভদ্রলোক কি বুঝলেন জানি না।
রোগীকে নিয়ে বেরিয়ে গেলেন বটে কিন্তু কলকাতার হাসপাতালে নিয়ে যেতে ভরসা পান না বলে দক্ষিণের হাসপাতালে নিয়ে যেতে চাইলেন। চলে যাবার পথে বলেছিলাম, তাতে অনেক দেরি হয়ে যেতে পারে।
এরপর কেটে গেলো সপ্তাহ খানেক। ডিউটি ঢোকার পথে সেই ভদ্রলোক পথ আটকে বললেন, ডাক্তারবাবু, ভাইটা কাল রাত্রে মরে গেলো। আপনি তো দেখেছিলেন। ইন্সুরেন্স করা আছে। যদি একটা ডেথ সার্টিফিকেট করে দেন।
বাড়িতে মারা গেলে হাসপাতাল থেকে ডেথ সার্টিফিকেট পাওয়া নিয়মবিরুদ্ধ জেনে ভদ্রলোক অনুনয়ের মাত্রা বাড়িয়ে আমার সামনে হাত জড়ো করলেন। বিব্রতবোধ করলাম। দ্বিতীয়বারও আমার অপারগতার কথা জানিয়ে পেছন ফিরলাম।
তারপর হঠাৎ কি মনে হতে ভদ্রলোকের দিকে তাকিয়ে জিজ্ঞেস করলাম “অবশেষে কোন হাসপাতালে নিয়ে গেছিলেন”?
কোনও হাসপাতালে নয়। বাড়িতেই পাড়ার ডাক্তারকে দিয়ে স্যালাইন আর গ্যাসের ইঞ্জেকশন দিয়েছিলাম।
মাথায় আকাশ ভেঙে পড়লো আমার। কোন পোড়া দেশে চিকিৎসক হয়েছি আমি? যেখানে এত্ত এত্ত পড়াশুনা করেও যখন জ্ঞান সমুদ্রে খাবি খাচ্ছি মনে হয় তখন কোন ভরসায় এঁরা জীবনকে সঁপে দেন ভুঁইফোড় স্বঘোষিতদের হাতে?
ভারাক্রান্ত হৃদয়ে ডিউটিতে ঢুকলাম। পেছন থেকে অস্পষ্ট স্বরে ভেসে এলো “স্যার, আপনি চাইলে ডেথ সার্টিফিকেট টা দিতেই পারতেন। ইচ্ছে করে দিলেন না”
আর পেছনমুখো হইনি। সারাদিনের লড়াই তখন শুরুর সময়। এই সময় কি রাগলে চলে?