১৯৯৪ সালে রাঁচির হাসপাতালে, একটি বছর ২৭-২৮-এর ছেলে ভর্তি হল। তার বাবার বক্তব্য অনুযায়ী ছেলেটি বদ্ধ উন্মাদ বলতে যা বোঝায়, তাই। চার পাঁচ বছর হল খায় দায় না ঠিক করে, লোকের গায়ে আর বাড়িতে ঢিল মারে, গালাগালি করে, রাত্তিরে ঘুমোয় না, ভিনগাঁয়ের শত্রু আসবে বলে জেগে থাকে পাহারা দেবার নাম করে আর মাঝে মাঝে চিৎকার করে গাঁ-শুদ্ধ লোকের ঘুম ভাঙায়।
জুনিয়র একটি ছেলে অসুখের ইতিহাস লিখে নিয়ে এল। আমি সব শুনে বললাম, “সবই তো বুঝলাম, কিন্তু এত দিনের এই ভয়াবহ অসুখের মধ্যেও ছেলেটির এত সুন্দর সাফ সুতরো চেহারা, ফিট্ফাট্ পরিচ্ছন্ন পোশাক, চকচকে কামানো গাল… হিসেব যেন মিলছে না।” বহুদিন ধরে মানসিক রোগে যে ভুগছে, আমার কিছু বন্ধুর আপত্তি সত্ত্বেও তার চেহারায় রোগের ছাপ থাকে।
ছেলেটা বলল, “স্যর, ডা. মহান (হাসপাতালের এক বড় ডাক্তার) নাকি বলেছেন ওনার গ্রামের লোক, ভর্তি করতেই হবে।” শুনেই হাড়পিত্তি জ্বলে গেল। মহানের এই এক গুণ। কোথাও কিছু নেই, গাঁয়ের লোক এলে তাকে ভর্তি করতেই হবে। আমরা অবাক হয়ে বলতাম, নিজের ওয়ার্ডে ভর্তি করে না, অন্যের ওয়ার্ডে করে… কেন রে?
নিয়ে গেলাম ডা. সুদর্শনের কাছে। উনি আমাদের টিম লিডার। বললেন, “আমারও সন্দেহ হচ্ছে। কিন্তু উপায় নেই, ডা. মহান বলেছেন ওনার গাঁয়ের লোক এরা। আমি যেন দয়া করে ভর্তি করে নিই। ভর্তি করো, তারপর অব্জার্ভ্ করো।”
সব হাসপাতালের… সব সংস্থার… আভ্যন্তরীণ রাজনীতির নিয়মে ডা.সুদর্শন (তিনিও বড় ডাক্তার) আর ডা. মহানের সম্পর্ক ছিল আদায় কাঁচকলায়।
ভর্তি হল রোগি। কিন্তু কোনও অসুখের লক্ষণ দেখা যায় না! কয়েক দিন পরে দিলাম সব ওষুধ বন্ধ করে। আরও ক’দিন গেল। সে থাকে, খায়, ঘুমোয়, হাসপাতালের চৌহদ্দিতে ঘুরে বেড়ায়। কোন বেচাল নেই, একটা ভুল কথা মুখ থেকে বেরোয় না।
শুধু দেখি মাঝে মাঝে, বার বার নাম ধরে ডাকলেও সাড়া দেয় না। একদিন বললাম, “তুমি কি কানে কম শোন? ডাকলে সাড়া দাও না কেন?”
লোকটা হঠাৎ ভীষণ রেগে বলল, “ভুলভাল নামে ডাকলে সাড়া দেব কেন?”
বললাম, “তোমার নাম প্রদীপ ওঝা নয়?”
বলল, “হরগিজ নেহি!”
জানতে চাইলাম, “তোমার নাম তাহলে কী?”
বলল, “মেরা নাম অযোধ্যা প্রসাদ।”
ফাইলের প্রথম পাতা দেখে বললাম, “বাবার নাম বল… ঠিকানা বল… অ্যাকাডেমিক কোয়ালিফিকেশন কী?…”
তার পরে গলাটাকে কঠিন করে বললাম, “তুমি নিজের নাম, বাবার নাম, কোয়ালিফিকেশন, বাড়ির ঠিকানা যা যা বলছ, কোনওটাই তোমার বাবার বলা ডিটেলের সঙ্গে মিলছে না কেন?”
ঘাড় গোঁজ করে বলল, “মুঝে ক্যা মালুম?”
ওর দেওয়া সব ডিটেল লিখে নিয়ে গেলাম ডা. সুদর্শনের কাছে। বললাম, “দিন দশেক হল সব ওষুধ বন্ধ করে দিয়েছি, কিন্তু কোন সিম্টম্ নেই। তার ওপর দেখুন কী সব বলছে…”
সুদর্শন বললেন, “বুঝলাম, কিন্তু দেখ, এ দিকে বলছে অ্যাকাডেমিক কোয়ালিফিকেশন বি.এ., অন্য দিকে ও নাকি রাঁচির ভেট হসপিটালে সায়েনটিফিক অ্যাসিস্ট্যান্ট!
খেয়াল করিনি। উচিত ছিল।
দু’জনে গিয়ে ধরলাম চেপে ছেলেটাকে। ও নিজের বক্তব্য থেকে এক চুলও নড়ল না, কিন্তু বি.এ. পাশ করে কী করে সায়েন্টিফিক অফিসারের চাকরী করছে, তাও বলতে পারল না, বা বলল না।
সুদর্শন বললেন, “ডা. মহানকে জানিয়ে দাও। উনি ‘গ্রামের লোক, গ্রামের লোক,’ বলে ভর্তি করেছেন, এখন ওনার জানা উচিত কী গণ্ডগোলের ব্যাপার হচ্ছে।”
বস্ হবার মজাই এই। আমাকেই যেতে হল সেই দুর্মুখ, বদমেজাজি, রগচটা ডাক্তারের কাছে। অর্ধেক শুনেই বললেন, “আমাকে বলতে এসেছ কেন? তোমাদের মাস্টারমশাই কী জানেন না, এমন সিচুয়েশনে কী করতে হয়? বাড়ির লোককে চিঠি দিয়ে ডেকে পাঠাও। তারা এসে এক্স্প্লেন করুক…”
তাই হল। হাসপাতাল থেকে অন ইন্ডিয়ান গভ্মেন্ট সার্ভিস লেখা খামে চিঠি গেল। ছেলেটার বাবা এলেন দিন দশেক পরে। মেজাজ বেশ গরম। তিন মাসের জন্য ভর্তি করে তিন সপ্তাহে কেন তাঁকে ডেকে পাঠান হয়েছে?
আমি খানিকক্ষণ তর্কাতর্কি করে দেখলাম আমার দ্বারা হবার নয়। ডা. সুদর্শনকে খবর দিলাম। তিনি এসে রোগির বাবার হাবভাব দেখে রেগে বললেন, “আপনার লজ্জা করে না? ভুলভাল নাম ধাম দিয়ে ছেলেকে ভর্তি করে গিয়েছেন?”
রোগির বাবা আরও রেগে বললেন, “বেশ করেছি। আসল নাম দিলে তার বিয়ে হবে পরে? আপনি তো তার রোগের চিকিৎসা করবেন, তার নামের, বা আমার নামের তো না! নাম দিয়ে আপনার কাম কী?”
বিহারে এরকম অদ্ভুত কিন্তু জবাবহীন লজিক প্রায়ই সামলাতে হত। একবার মেঘমন্দ্র গাড়ি চালিয়ে হাসপাতাল আসছে, সামনে একটা বাস রাস্তার বাঁ দিকে দাঁড়িয়ে আছে। মেঘমন্দ্র যেমনি তাকে ডান দিক দিয়ে পাশ কাটিয়ে পার হতে যাবে, ড্রাইভার হঠাৎ বাস চালু করে দিয়েছে পিছনে না দেখে। বাধ্য হয়ে মেঘমন্দ্র মাঝরাস্তায় গাড়ি থামিয়েছে, কিন্তু উল্টো দিক থেকে আর একটা বাস আসছিল, সে সময়মত থামতে পারেনি,ফলে গাড়িটা বিশ্রীভাবে ঘষে গিয়েছে। যে বাসের ড্রাইভার পিছনে না তাকিয়ে হঠাৎ চালিয়েছিল, তারই দোষ – মেঘমন্দ্র খুব জোরে গাড়ি চালিয়ে গিয়ে ধরেছে কাঁকে থানারই সামনে। ড্রাইভারকে নিয়ে গিয়েছে থানায়। থানার অফিসার সব শুনে বললেন, “লেকিন ইসকা গাড়িসে তো অ্যাকসিডেন্ট নেহি হুয়া?”
মেঘমন্দ্র বলেছিল, “লেকিন উস্ বাস ড্রাইভারকা কোই দোষ নেহি হ্যয়। এই আদমিটাই পেছনে না দেখ্কে গাড়ি চালা দিয়া…” বা অমন কিছু।
স্মিত হেসে পুলিশ অফিসার বলেছিলেন, “ডাক’সা’ব, যার সঙ্গে ধাক্কা লেগেছে, তাকেই লাগবে। সমঝিয়ে, ধরুন আপনি গাড়ি চালিয়ে যাচ্ছেন, সামনে হঠাৎ একটা কুকুর এসে পড়ল। আপনি কাটালেন, একটা বাচ্চা চাপা পড়ল। দোষ কুকুরের, কোন সন্দেহ নেই… কিন্তু উস সময় ম্যয় আপকো অ্যারেস্ট করুঁ, ইয়া কুত্তা ঢুণ্ডনে নিক্লু? (অর্থাৎ, ওই সময় আমি আপনাকে অ্যারেস্ট করব, না কুকুর খুঁজতে বেরোব?)”
এই ধরণের অকাট্য যুক্তির মুখোমুখি হলে সমান প্রশ্নের অবতারণা করতে হয়। সৈয়দ মুজতবা আলি একে “মাছ দিয়ে মাছ ঢাকা” নাম দিয়েছিলেন। বলেছিলেন, “এক খুনের বদলে আর এক খুন”। বলেছিলেন পাঠানমুল্লুক সম্বন্ধে, কিন্তু খুনোখুনির ব্যাপারে বিহারীরা পাঠানদের চেয়ে কিছু কম নয় বলেই আমার ধারণা। বিহারী ডাক্তার সুদর্শনও সেই পন্থাই অবলম্বন করলেন। কঠিন গলায় বললেন, “আপনার ছেলে বি.এ. পাশ। কিন্তু সরকারী সংস্থায় পোস্ট সায়েনটিফিক অফিসারের চাকরী কী করে হল?”
ভীষণ খলনায়কোচিত হাসি হেসে বাবা বললেন, “আমরা থাকি চিফ মিনিস্টারের গ্রামে। আমার ছেলে কিছু পাস না করলেও ভিট্নারী (ভেটেরিনারী) ডিপাট্-এর বড় সাহেব হতে পারে।” (তার কিছুদিন পরেই সারা দুনিয়া পশুখাদ্য ঘোটালার কথা জানতে পারে)।
ব্যস, আর যায় কোথায়! লম্ফ দিয়ে প্রায় ‘হা-রে-রে-রে-রে-রে-রে’ চেঁচিয়ে স্যর বললেন, “অনিরুদ্ধ, পুলিশে খবর দাও। এই বলছে চিফ মিনিস্টারের গ্রাম, আর আগে বলেছিল ডা. মহানের গাঁয়ের লোক। পুলিশ আসুক, তারাই খোঁজ করুক কী কী মিথ্যে বলছে। শেষে হয়তো দেখা যাবে কোথাও ডাকাতি করে লুকিয়ে আছে এসে!”
জোঁকের মুখে নুন পড়ার মত রোগির বাবার বারফাট্টাই নিভে গেল। হাতে পায়ে ধরে, “মাফ্ কর দিজিয়ে, মাফ্ কর দিজিয়ে…” কিন্তু ততোক্ষণে পরিস্থিতি ঘোরালো হয়ে গিয়েছে, ডা. মহানও জানতে পেরেছেন রোগি আদৌ তাঁর গ্রামের নয়, তিনিও এসে যাচ্ছেতাই বলে গেলেন। শেষে আমার ওপর আদেশ হল, ডিসচার্জ করিয়ে ছেলেকে সঙ্গে নিয়ে তবেই বাবা হাসপাতাল থেকে বেরোবেন, নইলে নয়।
বড় ডাক্তাররা যাবার পরে রোগির বাবা আমাকে প্রায় মিনমিন করে জিজ্ঞেস করলেন, “কিন্তু আমি তো ওকে এখানে এনেছিলাম রোগ সারাতে… কই, তার তো কিছু হল না?”
আমি বললাম, “আমরা ওকে প্রায় তিন সপ্তাহ রেখেছি। প্রথম ক’ দিন আপনার বর্ণনা অনুযায়ী চিকিৎসা করেছি, তার পরে প্রায় দিন দশেক বিনা চিকিৎসায় রেখে তবে আপনাকে চিঠি দিয়েছি, আপনি তারও প্রায় দশ দিন পরে এসেছেন। আমরা কোন রোগ লক্ষণ দেখিনি।”
বাবা বললেন, “ও যে গাঁজা খায়, দিন রাত গাঁজা খেয়ে পড়ে থাকে।”
আমরা অবাক! গাঁজা খায় বলে নিয়ে এসে সম্পূর্ণ অন্য এক অসুখের বর্ণনা দিয়ে ভর্তি করে গিয়েছে – কেন?
তখন জানা গেল যে এই বাবা যখন হাসপাতালে এসে প্রথম কাউকে বলেন ছেলের সমস্যা হল সে গাঁজা খায়, তখন নাকি সেই কর্মচারী বলেন যে এই কথা বললে ছেলে ভর্তি হবে না। সেই কর্মচারীই বাবাকে শিখিয়ে দেন কী বলতে হবে, অর্থাৎ কী বললে ডাক্তাররা ভর্তির কথা ভেবে দেখবে। সেই সঙ্গে সেই কর্মচারীই আবার রোগির বাবাকে বলেন আমি এক ডাক্তারের সঙ্গে আপনার পরিচয় করিয়ে দেব, তাঁকে আপনি বলবেন যে আপনি ওমুক গ্রাম থেকে এসেছেন। ডাক্তারবাবু গ্রামে যাননি বিশ বচ্ছরের ওপর হয়ে গেল,সেখানকার কাউকে চেনেনও না, কিন্তু নিজের গ্রাম থেকে এসেছে শুনলে বিমুখ করেন না – এ কথা বলে তিনি ডা. মহানের কাছে রোগির বাবাকে নিয়ে গিয়ে বলেন, “স্যর, এ আপনার গ্রাম থেকে এসেছে, ছেলেকে ভর্তি করতে।” ডা. মহানও স্বভাবসিদ্ধ ভাবে বলে দেন, “ঠিক হ্যয়, ভর্তি হয়ে যাও!”
এই পরোপকারের জন্য সে নাকি তাদের কাছ থেকে মাত্র পাঁচশো টাকা নিয়েছিল! এই টাকা দিতে হয়েছিল এমন এক জমানায়, যখন সরকারী হাসপাতালে সারা মাসের চিকিৎসা-খর্চাই ছিল মাত্র তিনশো টাকা।
ছেলে বি.এ. পাশ, মুখ্যমন্ত্রীর কল্যাণে সরকারী চাকরী করছে সায়েন্টিস্টের পোস্টে – সেকথা জানাজানি হলে ছেলের চাকরী যাবে এই ভয়ে বাবা মিথ্যে নাম-ধাম দিয়ে ছেলেকে ভর্তি করে দিয়ে যান। গ্রামের নাম তো ডা. মহানের গ্রাম হয়ে গিয়েছিল আগেই, বাকিগুলো বদলাতে আর কতোক্ষণ!
এও বোঝা গেল, কেন ডা. মহানের গ্রামের লোক কখনোই ওনার নিজের ওয়ার্ডে ভর্তি না হয়ে সবসময় অন্য ডাক্তারের দিনেই আসে!
নানা কারণে লোকে মিথ্যে বলে পাগলা গারদে রোগি ভর্তি করত। তার মধ্যে সবচেয়ে বেশি দেখা যেত ফেলে দিয়ে চলে যাবার উদ্দেশ্যে মিথ্যে বলা।
রামভরোসাকে আমরা সব্বাই চিনতাম। আমি তখন প্রায় চার বছর
সি.আই.পিতে কাজ করছি – ও ছিল ক্রনিক পেশেন্ট – সেই যুগে ভর্তি যখন রোগিরা অ্যাসাইলাম-এ আসত বাকি জীবন কাটাতে, অসুখ সারিয়ে বাড়ি ফিরতে নয়।
রামভরোসা ভর্তি হয়েছিল প্রায় বিশ বচ্ছর আগে। ডা. সুদর্শন যখন জুনিয়র ডাক্তার তখন রামভরোসা ভর্তি হয়। সে গল্প শুনে শুনে আমাদের মুখস্থ হয়ে গিয়েছিল।
“আমিই তো ওকে প্রথম দেখি,” সুদর্শন বলতেন। “ওর কাকা নিয়ে এসেছিল। তখন ওর কী দুরবস্থা! নিজেকে কুকুর মনে করত। কথা বলত না, ঘেউ ঘেউ করত। থালাশুদ্ধ খাবার নর্দমায় ঢেলে চার হাত পায়ে হামা দিয়ে মুখ দিয়ে নর্দমা থেকে খেত।”
এই সিমটমটার জন্যই আমি বোধহয় রামভরোসাকে সারা জীবন মনে রাখব। সে যাই হোক, আমরা কিন্তু রামভরোসাকে বেশ নরম্যাল দেখতাম। তার চলা বলা, আচার আচরণ, কোনটাতেই কোন বিচ্যুতি ছিল না। চিকিৎসায় ওর অসুখ সম্পূর্ণ কনট্রোল হয়েছিল, ফলে ওকে দিয়ে ওয়ার্ডের অজস্র কাজ করাতেন নার্স আর ওয়ার্ড-বয় সকলেই। এটা আনো, ওটা দিয়ে এসো, রোগি সামলাও, এ সব কাজই রামভরোসা করত হাসিমুখে – অনেক ক্ষেত্রে নিজে থেকেই এগিয়ে এসে।
সেরে যাবার পরে ওর বাড়িতে নাকি অজস্র চিঠি পাঠান হয়েছে, কোনওটারই কোনও জবাব আসেনি। শেষে সোশ্যাল ওয়ার্কার গিয়ে দেখেছে সে গ্রামে রামভরোসার পরিবারবর্গ কোনদিন থেকে থাকলেও তারা আর নেই, গ্রামের কেউ কিছু বলতেও পারেনি।
ফাইনাল পরীক্ষার আগে পরীক্ষার্থীদের কাজ দেওয়া হত সেই সব ওয়ার্ডে যেখানে কাজের চাপ থাকত কম। আমাকে দেওয়া হয়েছিল রামভরোসার ওয়ার্ডে। রোজই দেখতাম রামভরোসার কাজের চাপ মাইনে করা কর্মচারীদের চেয়ে বেশি বই কম নয়। সেই সঙ্গে লক্ষ্য করতাম রামভরোসাকে অনেক সময়ই একবার ডেকে সাড়া পাওয়া যায় না। অনেক বার ডাকতে হয়, কখনও কাছে গিয়ে ডাকলে তবেই চমকে তাকায়।
এক দিন নার্সকে জিজ্ঞেস করলাম, “কানে কম শোনে বলে তো মনে হয় না। ডাকলে কেন সাড়া দেয় না, জানেন?”
নার্সের দেখলাম বিশেষ হেল দোল নেই। বলল, “মেনটাল পেশেন্ট হ্যয়, না জানে ক্যয়া ক্যয়া সোচতে রহ্তা হ্যয়।”
কী মনে হল, জিজ্ঞেস করলাম, “রামভরোসা, তোমার কানে শোনার কোন ঘাটতি আছে বলে তো মনে হয় না, কিন্তু অনেক সময় তুমি ডাকলে সাড়া দাও না, কেন?”
রামভরোসা আমার দিকে খানিকক্ষণ চেয়ে থেকে বলল, “স্যর, বলব?”
যেন জানতে চাইছে, নির্ভয়ে বলব?
বললাম, “বইকি! জানতে চাইছি তো।”
রামভরোসা বলল, “হাসপাতালে আমাকে সবাই রামভরোসা বলে, কিন্তু আমার নাম তো আসলে রামভরোসা নয়, তাই। আমার সত্যি বলতে কী এখনও অভ্যেস হয়নি।”
আমি অবাক! “তোমার নাম রামভরোসা নয়? তবে কী নাম তোমার?”
রামভরোসা বলল, “আমার নাম স্যর বিক্রম মিশ্র।”
ওয়ার্ডের অফিসে নিয়ে গিয়ে ওর ফাইল খুললাম, বললাম, “এখানে লেখা আছে রামভরোসা মাহাতো।”
“মাহাতো?” প্রায় আর্তনাদের মত শোনাল। “আমি মাহাতো নই স্যর, আমি ব্রাহ্মণ!”
আমি বোকার মত নার্সের দিকে তাকালাম। নার্স বলল, “স্যর, বাজে কথা বলছে। আমি বিশ বচ্ছর ধরে জানি ওর নাম রামভরোসা…”
বললাম, “ওর প্রথম ফাইলটা দিন দেখি…”
পুরোন পেশেন্টদের আদি ফাইল থাকত, অনেক দিন ভর্তি থাকলে কাগজে কাগজে ভরে গিয়ে ফাইলের সংখ্যা বেড়ে যেত। কারও কারও পাঁচ-ছটা ফাইলও দেখেছি।
রামভরোসার বেরোল তিনটে।
নাম রামভরোসা মাহাতো, বাবার নাম নওলকিশোর মাহাতো, গ্রামের নাম… সব পড়ে শোনালাম রামভরোসাকে – ও অবাক হয়ে বলল, “ডাক’সা’ব, সব ভুল। আমার নাম বিক্রম, বিক্রমজিৎ। পদবী মিশ্র। বাবার নাম যুগলকিশোর। গ্রামের নাম…
কাগজে সব লিখে নিয়ে গেলাম আবার ডা. সুদর্শনের কাছে। সুদর্শন অবাক! আরও অবাক কারণ উনিই এই রোগির ডাক্তার ছিলেন প্রথম দিন থেকে। “ভুল বকছে না তো?” বলে আমায় বললেন, “ডেকে আনো তো।”
রামভরোসা এল। বড় সাহেবের সামনে সে তো মাটিতে মিশে যাচ্ছে, কিন্তু কথাবার্তা ঠিক ঠিক, নাম ধাম বাবার নাম… সব শুনে তো সুদর্শন একেবারে হাঁ! আমাকে বললেন, “এই বার বোঝা গেল কেন ওর গ্রাম থেকে কেউ আসেনি আর কেন পনেরো বছর আগে সোশ্যাল ওয়ার্কার কাউকে না পেয়ে ফিরে এসেছিল!”
“ওর বলা ঠিকানায় একটা চিঠি পাঠাই?” জানতে চাইলাম।
“অবশ্যই,” উত্তেজিত হয়ে বললেন সুদর্শন। “এক্ষুনি পাঠাও।”
পাঠালাম। দিন কাটে, আমার পরীক্ষা এগিয়ে আসে, পড়াশোনার ফাঁকে সময় পাই কম। রাম… ইয়ে, বিক্রমজিতের চিঠির কথা ভুলেও যাই।
পরীক্ষার পর নতুন চাকরী পাই ওখানেই, সুদর্শনের টিমে জুনিয়র টিচার। এক দিন সুদর্শন ছাত্রদের ক্লাস নিচ্ছেন রোগি দেখতে দেখতে, আর আমি নিষ্কর্মা বসে ভাবছি কতক্ষণে ছাড়বে রে বাবা, ক্যান্টিন গিয়ে কফি খাব, এমন সময় পাশের ওয়ার্ড থেকে ঊর্ধ্বশ্বাসে ছুটে এলেন নার্স।
“স্যর স্যর! গজব হো গিয়া! গাঁও সে রামভরোসাকা ভাই আয়া হ্যয়!”
চিঠি পাঠান’র প্রায় আড়াই তিন মাস পরে!
সুদর্শন বললেন, “গো কুইকলি, লোকটা যাবার আগেই রামভরোসার ছুটি করতে হবে।”
আমি দৌড়লাম। গিয়ে দেখি রামভরোসা… ইয়ে, বিক্রমের ভাই-ই বটে! দুই ভাইয়ের দেখা হয়েছে প্রায় বিশ পঁচিশ বছর পরে, বিক্রমের বয়স আজ চল্লিশের ওপর, ভাই পঁয়ত্রিশ থেকে চল্লিশের মধ্যে। অর্থাৎ বিক্রম যখন বাড়ি ছেড়েছে, তখন ভাইয়ের বয়েস দশ কি পনের! কিন্তু দুই ভাই পরস্পরকে দেখেই চিনেছে। চিনেছে যারা দেখেছে সব্বাই। মুখ প্রায় দুজনের জেরক্স কপি! একে অপরকে জড়িয়ে ধরে হাউ হাউ করে কাঁদছে। বিক্রম বলছে, “তোর সঙ্গে কোন দিন আবার দেখা হবে তা তো ভাবতেই পারিনি।”দেখতে দেখতে হাসপাতালের সব ডাক্তার, রোগি, নার্স, ক্লাস ফোর স্টাফ সব্বাই ভীড় করে দুই ভাইকে দেখতে এল।
ভাইয়ের কাছ থেকে শোনা গেল এক অত্যাশ্চর্য কাহিনী: রামভরোসা অসুস্থ হবার পরে ওদের কাকা ওর বাবাকে বলে রাঁচিতে চিকিৎসা করালে ভাল হয়ে যাবে। কাকা ভাইপো দু’জনে রওয়ানা দেয়। সাত দশ দিন পরে কাকা ফিরে আসেন, বিধ্বস্ত! বলেন রাত্তিরে ট্রেনে দু’জনে শুয়েছিলেন, সকালে উঠে দেখেন ভাইপো নেই। ট্রেন থেকে নেমে তিনি এত দিন গ্রামে গ্রামে খোঁজ করেছেন ট্রেন লাইন ধরে, কিন্তু কোত্থাও হদিশ পাননি। পাঠক হয়ত মনে করতে পারছেন নব্বইয়ের দশকে এক বিখ্যাত বিহারী গণিতজ্ঞ প্রায় তিন বছর নিরুদ্দেশ থাকার পর হঠাৎ ফিরে আসেন। ওনার হারিয়ে যাবার গল্পটাও কতকটা এরকমই ছিল।
যা হোক, খবর শুনে ভাই বেরোল দাদার খোঁজে, এখানে ওখানে যায়, কিছু দিন খোঁজাখুঁজি করে ফিরে আসে, আবার বেরোয়। কিন্তু বাবা খবর শুনে শয্যা নিলেন, আর উঠলেন না। বছর কয়েক পরে মারা গেলেন। যখন বাবা মারা যান, ভাই তখন বাইরে। ফিরে দেখে বাবাকে দাহ করা হয়ে গিয়েছে, কাকা তার মাকে বের করে দিয়ে জমি জমা সব নিয়ে নিয়েছে। গ্রামের মোটামুটি স্বচ্ছল পরিবারের বড় ভাইয়ের বউ ছেলের একেবারে পথে বসা অবস্থা। এখন সংসার চলে কাকারই জমিতে মজদুরি করে।
আমরা ভাইকে বললাম, “অর্থাৎ, এখানে এসে বিক্রমকে বেনামে ভর্তি করে দিয়েছিল, যাতে সম্পত্তি গ্রাস করতে পারে।”
ভাই বলল, “আমি এক বার এখানেও এসেছিলাম। ভিতরে তো ঢুকতে পারিনি। অফিসে জিজ্ঞেস করেছিলাম বিক্রম মিশ্র বলে কোন রোগি কি গত মাস দুয়েকে ভর্তি হয়েছে? তারা বলেছিল, না। তাই শুনে আমি ফিরে গেছি।”
বটেই তো। বিক্রম মিশ্র নামে তো কেউ কোন দিন ভর্তি হয়নি।
“কিন্তু আমার চিঠি গিয়েছে সে কবে, এত দেরী হল কেন?”
“পয়সা ছিল না ডাক’সা’ব,” বলল বিক্রমের ভাই। “শেষে আমার বউ বলল, ‘দাদা বড়ো, না আমাদের সংসার?” তাই ঘটি থালা এ সব বন্ধক দিয়ে ট্রেনের টিকিট কেটে এসেছি।”
কী কাণ্ড!
বিক্রমকে জিজ্ঞেস করলাম, “বাড়ি যাবে?”
বলল, “বিলক্ষণ! কাকাকে সায়েস্তা করতে হবে না!”
বললাম, “দেখ, কাকার এখন অনেক ক্ষমতা – তোমাকেই না মেরে টেরে দেয়!”
ভাই বলল, “সে ভয় নেই। গ্রামের কেউ কাকাকে পছন্দ করে না। তার ওপর দাদা যদি গিয়ে সত্যি ঘটনা বলে, কাকা বিপদে পড়বে।”
বেশ কথা। লিখে দিলাম ছুটি, প্রায় শোভাযাত্রা করে স্টাফ, পেশেন্ট আর বিক্রমের ভাই গেল হাসপাতালের অফিসে। আমি আমার বন্ধুদের সঙ্গে গেলাম ক্যান্টিনে, সকলেই চমৎকৃত!
দেরী হল না। হাউ মাউ করতে করতে ফিরে এল ওয়ার্ড বয়। স্যর! সত্যনাশ হুয়া! বিশ বচ্ছর আগে ওর কাকা তো একশ কুড়ি টাকা জমা করে দিয়েছিল চিকিৎসার খরচ হিসেবে। তার পরে কোন টাকা দেয়নি কেউ। সেই বকেয়া আজ সুদে আসলে বেড়ে দাঁড়িয়েছে তিরানব্বই হাজার টাকার বেশি!
তিরানব্বই হাজার!
আমার বন্ধুরা বলল, “দৌড়ে যা, ডিরেকটরের কাছে, আগে ডা. সুদর্শনের কাছে যা, ওনাকে দিয়ে সই করিয়ে নে।”
এক ছুট্টে সুদর্শনের ঘরে গিয়ে ব্যাপারটা বলতেই সুদর্শন বুঝে নিয়ে খস্ করে সই করে দিয়ে বললেন, “তাড়াতাড়ি যাও ডিরেকটরের কাছে। পাঁচটা প্রায় বাজে, বেরিয়ে গেলে বিপদ হবে।”
ডিরেকটরের অফিস হাসপাতাল অফিসের পাশে। হাসপাতাল থেকে বেরিয়ে দেখি অফিসের সামনে ক্লার্ক বিক্রমের ভাইকে খুব বকছে এত দিন ভাইকে না নিতে আসার জন্য, টাকা বাকি রাখার জন্য, এখন টাকা নিয়ে না আসার জন্য… ইত্যাদি। আমি ছুটে গিয়ে বললাম, “ওকে কিছু বলবেন না। আমি ডিরেকটরের অনুমতি নিয়ে আসছি, পয়সা দিতে হবে না।”
ডিরেকটরকে পুরো গল্পটা বলতে হল। শুনে উনিও থ’! ওঁরও এত বছরের অভিজ্ঞতায় এমন হয়নি। বললেন, “এক্ষুনি ফাইল পাঠাও। বেচারা অনেক দিন বাড়ি যায়নি।”
ফাইল সঙ্গেই ছিল। বের করে ধরে দিলাম, ডিরেকটর খস্খস্ করে লিখে দিলেন, সমস্ত ‘ডিউজ’ মকুব হইল, বা সেরকম কিছু।
ছুটে বাইরে গিয়ে দেখি অফিসের সামনে ভোঁ-ভাঁ। রামভরো… ইয়ে, বিক্রমের ভাইও নেই, আমাদের ক্লার্কও নেই।
অফিসে ক্লার্ক মন দিয়ে কাজ করছে। জিজ্ঞেস করলাম, বলল, “আরে হম ক্যয়া জানতা, দেখিয়ে গিয়া হোগা অন্দর।”
ওয়ার্ডে গিয়ে দেখি কেউ নেই, উদ্বিগ্ন মুখে বিক্রম দাঁড়িয়ে, ওর জাগতিক সব সম্পত্তি একটা গাঁটরিতে বেঁধে।
ওয়ার্ডে নেই, ক্যানটিনে নেই, আউটডোরে নেই। গেটের দারোয়ান বলল, ভাই আর ফিরে আসেনি। রাস্তার মোড়ের পান বিড়ির দোকান, ঝুপড়ি চায়ের দোকান… নেই, নেই, নেই! মোপেড নিয়ে ছুটলাম কাঁকে চক, কোত্থাও নেই বিক্রমের ভাই। ফিরতে ফিরতে অন্ধকার হয়ে গিয়েছে, অফিস টফিস সব বন্ধ, আমার বন্ধুরা সবাই ফিরে গিয়েছে হস্টেল, বাড়ি… ওয়ার্ডে গিয়ে শুকনো মুখে বিক্রমকে বললাম, “পেলাম না।”
আধো অন্ধকারে ফিরছি, পিছন ফিরে দেখলাম ওয়ার্ডের বাইরে হিমের মধ্যে একলা বিক্রম বসে আছে, নার্স ওকে বোঝাচ্ছে, “আব অন্দর চলো, ইঁহা বৈঠকে ক্যা ফায়দা? ও জরুর আয়েগা, কাল সুবহ আয়েগা…”
আমার বহুদিনের সাইকিয়াট্রি ডাক্তারি প্র্যাকটিসে কয়েকটা অসম্ভব কষ্টের ছবি মনের মধ্যে ছাপ ফেলে রেখেছে, এই দৃশ্যটা তাদের মধ্যে অন্যতম।
পরের কয়েক দিন বেচারা বিক্রমের সামনাসামনি হতে পারছিলাম না। এর মধ্যে নার্স খবর এনেছে কী হয়েছিল। আমি যখন ডিরেকটরের কাছে, তখন ক্লার্ক বিক্রমের ভাইকে বলেছে, “নব্বই হাজার দিতে হবে না, আমাকে পঞ্চাশ হাজার দাও, আমি ভাইকে ছেড়ে দিচ্ছি। কিন্তু ডাক্তারবাবু গিয়েছেন পুলিশ ডাকতে। উনি ফিরতে না ফিরতেই তোমাকে জেল যেতে হবে।”
বলা বাহুল্য, এই কথা শুনে সে ভাই আর এক মুহূর্তও অপেক্ষা করেনি সি.আই.পি-র চৌহদ্দিতে।
এই গল্পের বাকিটা খুব খারাপ না। ডা. সুদর্শন এর পর ডিরেকটরকে ধরে সোশ্যাল ওয়ার্ক ডিপার্টমেন্ট থেকে লোক দিয়ে বিক্রমকে বাড়ি পাঠান। সোশ্যাল ওয়ার্কার ফিরে জানান যে বাড়ির লোক প্রথমে লাখ টাকার ভয় পেলেও পরে বিক্রমকে সাদর অভ্যর্থনা করে বাড়িতে নিয়ে গিয়েছে। আর কাকা? না, তার কোন খবরের জন্য সোশ্যাল ওয়ার্কার অপেক্ষা করেনি।
রামভরোসার কথা এর আগে কেউ জানতে পারেনি কেন? আমি রামভরোসাকে জিজ্ঞেস করেছিলাম। বলেছিল, “আমি ভেবেছিলাম শুরুর দিকে কখনও কেন লোকে আমাকে এ নামে ডাকে, কিন্তু তার পরে ভেবেছিলাম বোধহয় এখানে এটাই দস্তুর।”
কে জানে অসুস্থ মস্তিষ্কে কী বুঝেছিল বেচারা! আর একটা অদ্ভুত ব্যাপার হল, যে আমার আগে কেউ রাম… ইয়ে, বিক্রমকে জিজ্ঞেস করার কথা ভাবেইনি, কেন কেউ ডাকলে ও সঙ্গে সঙ্গে সাড়া দেয় না!
৩/৬/২০১৭