চেম্বারে যখনই কোনো প্রেগন্যান্ট মহিলা আসেন তখন অনেকগুলো পরীক্ষার করতে বলা হয়, তার মধ্যে একটা হলো ডাউনস্ সিনড্রোম আছে কিনা জানা। যদি আমরা নিশ্চিত হয় বাচ্চার ডাউনস্ আছে তখন বাবা মাকে এর সম্মন্ধে বলা হয়, প্রায় ১০০ পার্সেন্ট বাবা মাই প্রেগনেন্সিটা এগিয়ে নিয়ে যেতে চায় না। হয়তো পেটের মধ্যে কোনো বাচ্চা বলছে – আমি বাঁচতে চাই, take my hand,not my life। কিন্তু আমরা শুনতে পাই না, আমরা শুনতে চাই না।
আজ এর অন্যদিকের এক গল্প শুনি। মহুয়া আমার স্কুলের বন্ধু। এটা মহুয়ার কথা, কিন্তু এটা আরো অনেক পরিবারের কথা। এই গল্পের নায়ক নায়িকারা আমাদের চোখে পরে, কিন্তু ওদের চেনার চোখ আমাদের অনেকেরই নেই।
“যার ভালবাসা, আদর, আবদার আমাদের জীবনকে ভরিয়ে তুলেছে, যার টান আমাদের পরিবারে সকলকে একসাথে জুড়ে রেখেছে, সে আমাদের সবার প্রিয় বোন। বোনকে তো সবাই ভালোবাসে, তাহলে আমার বোন কেন স্পেশাল?
দুর্গা পূজার ঠিক আগে, যখন প্যান্ডেলের বাঁশ পড়ছে, পুজোর বাজার জোর কদমে চলছে, ভোর রাত্রে চাদরটা গায়ে টেনে নিতে হচ্ছে, তখনই আমাদের বাড়িতে এলো এক নতুন অতিথি।আনন্দ-উত্তেজনা থিতু হওয়ার আগেই জানা গেল ওর ডাউন সিনড্রোম আছে। এটা একধরনের ক্রোমোসোমাল ডিসঅর্ডার। ২১ নম্বর ক্রোমোসোম দুটোর বদলে তিনটে। আমার তখন এক। তাই আমার তেমন কোনও স্মৃতি নেই, সবই মায়ের থেকে শোনা। এই কঠোর সত্যি জানার পর বড়োরা বোনের শরীর আর ভবিষ্যতের জন্য ভীষণ উদ্বিগ্ন হয়ে পড়লো। তৈরি হলো এক লড়াইয়ের জন্য। তবে আমার কাছে বোন ছিল আমার অন্যান্য ভাইবোনদের মতোই। আমার খেলার সাথী। যেহেতু বোনের নিজস্ব জগৎ গড়ে ওঠা মুশকিল, তাই ছোটবেলা থেকেই, মা-বাবা শিখিয়েছিল আমরা যেন সবসময় ওর পাশে থাকি।বলেছিল, আমাদেরই হতে হবে ওর বন্ধু- ওর খেলার সাথী-ওর সবকিছু। বড়ো হওয়ার সাথে সাথে ও নিজের সরলতা-ভালোবাসা দিয়ে সবার মনে এক বিশেষ জায়গা করে নেয়। ও পথ ভুলে পৃথিবীতে চলে আসা এক দেবদূত। বোন কখনোই কিছুতে খারাপ দেখে না। আমরা যদি কখনো কিছু নিয়ে বিরক্ত হই বা বা রেগে যাই, তখন ও ওর নিষ্পাপ মন দিয়ে সবকিছুর থেকে ঠিক ভালোটুকু সামনে নিয়ে আসে আর আমাদের ঠিক হাসিয়ে দেয়।
একবার রাতে,মা যখন অজ্ঞান হয়ে গেছিল, হার্ট অ্যাটাক হয়েছিল তখন বোন’ই অন্য ঘর থেকে বাবাকে জাগিয়ে, মা’কে সে যাত্রা রক্ষা করে।
যদি কখনো কেউ মায়ের সাথে দেখা করতে যায়, কেউ কিছু বলার আগেই বোন নিজের হাতে এক কাপ চা বা কফি বানিয়ে এনে তাকে দেয়। সাথে বিস্কুট আর ওর মিষ্টি হাসি।
এতো কিছু বলার পরেও স্বীকার করতে বাধা নেই, সবকিছু সবসময় খুব একটা মনোরম হয় না।যাদের বাড়িতে বোনের মতো কেউ বড়ো হচ্ছে তারাই শুধু আসল সত্যিটা জানে। পরিবারের সকলকে অনেক ত্যাগ স্বীকার করতে হয়। কাছের মানুষদেরই তাদের দৈনন্দিন খুঁটিনাটি প্রয়োজনের যত্ন নিতে হয়। নিজেকে দেখা, চিকিৎসকের কাছে যাওয়া, সবকিছুর জন্যই এদের সাথে কাউকে দরকার। লেখাপড়া শেখানোর জন্যও প্রচুর ধৈর্য-মনোযোগ ও সময় প্রয়োজন। তার ওপর শরীর-স্বাস্থ্যের জটিল হাল, সবসময়ই একটা উদ্বেগ থেকে যায়। তারা আর্থিকভাবে ও অন্যভাবে সবরকম ভাবে কী করে সাবলম্বী হবে তাই নিয়ে কাছের লোকদের চিন্তার শেষ থাকে না।
এর ওপর রয়েছে সামাজিক চাপ। বোন বাইরে গেলে কেউ কেউ এসে জিজ্ঞাসাবাদ করেন-সহানুভূতির চোখে তাকিয়েও থাকেন। তখন ওর চোখে এক অসহনীয় বেদনা দেখি। চোখের এই ভাষা পড়তে পড়ার মতো লোক কোথায়? ছোট থেকেই এটা নিয়ে ও হয়তো বাঁচতে শিখেই গেছে।আর ও এও জানে ও আমাদের সকলের চোখের মণি। তাই মন খারাপ হলেই এসে জড়িয়ে ধরে। খুব কাছের লোকেরাই ওকে নিয়ে মজা করে, ওর সরলতার সুযোগ নিয়ে আমাদের ঘরের কথা বের করার চেষ্টা করে, আবার কখনো কখনো সম্পূর্ণ পাশ কাটিয়ে চলে যায়, যেন ওর কোনো অস্তিত্বই নেই।
বোনের জন্য আমরা মাঝে মাঝে টের পাই মানুষ কেমন মুখোশ পড়ে থাকে। একবার আমার দিদির বিয়ে ভেঙে গেছিল যখন পাত্রপক্ষ বোনের কথা জানতে পারে। যদি দিদির জন্য তাদের বংশে এমন কোনো বাচ্চা আসে। দিদিকে সে যাত্রায় বোনই বাঁচিয়ে দিল। পরে একদিন এটা জানতে পেরে ও এমন তাকালো যে আমরা লজ্জায় পরে গেলাম। ওর চোখ যেন প্রশ্ন করছে, অসুস্থ কে? বুঝলাম ওই এক্সট্রা ক্রোমোসোম ওকে এক্সট্রাঅর্ডিনারি করে দিয়েছে।
ওর জীবনে ডাউন বলে কিছু নেই, শুধু আপ, আপ আর আপ।”
এটা মহুয়ার মুখে মধুমিতার গল্প।
২১ মার্চ, ডাউনস্ সিনড্রোম এওয়ারেনেস ডে। আমরা যদি পৃথিবীটা সত্যিই সুন্দর করতে চাই, আমাদের মানুষকে জানতে হবে, মানতে হবে, নিজেদেরকে মানাতে হবে।