দেশের সব প্রাপ্তবয়স্কদের অবিলম্বে কোভিডের টীকা দেবার একটা দাবী উঠেছে কোন কোন মহল থেকে। এরাজ্যের সরকার বলছে তারা সব নাগরিকের জন্য টীকা কিনে নিতে চাইছে, কিন্তু কেন্দ্র দিচ্ছে না।
আপনি জাতীয়তাবাদী হতে পারেন, জাতীয় স্বার্থ আপনার অগ্রাধিকার হতে পারে। আপনি আঞ্চলিকতাবাদী বা প্রাদেশিকতাবাদী হতে পারেন। কিন্তু করোনা ভাইরাস তুমুলভাবে আন্তর্জাতিকতাবাদী। বিশ্বের দূরতম প্রান্তের একটা ছোট্ট দেশেও যদি সংক্রমণ রয়ে যায়, আপনার দেশ বা আপনার রাজ্য নিরাপদ নয়। টীকা ও কোভিড অতিমারী মোকাবিলার সমস্ত সরঞ্জামের সুষম (equitable) বন্টন যতক্ষণ না নিশ্চিত করা গেছে, ততক্ষণ আপনি আমি কেউ নিরাপদ নই।
ধনতন্ত্রের নগ্ন চেহারাটাই ফুটে উঠছে বিশ্বজুড়ে টীকাকরণের চিত্রে। টীকাকরণ এখনো সমস্ত দেশে শুরুই করা যায়নি। বলা বাহুল্য, সবচেয়ে গরীব দেশগুলোই এখনো না-পাওয়ার দলে রয়েছে। আফ্রিকা মহাদেশের ছোট মাঝারি গরীব দেশগুলো অন্ততঃপক্ষে তাদের স্বস্থ্যকর্মীদের সুরক্ষা দেবার মত টীকা ধনী দেশগুলোর কাছ থেকে ভিক্ষা চেয়েও পাচ্ছে না। অথচ, ধনী দেশগুলো তাদের দেশের যুবাবয়সীদেরকেও টীকা দিতে ব্যস্ত। ধনী দেশ ও গরীব দেশগুলোর মধ্যে টীকাকরণের কভারেজের ব্যবধান রোজ বাড়ছে। জানুয়ারীর তুলনায় মার্চে এই ব্যবধান দৃষ্টিকটু ভাবে বেশী।
ইজরায়েলের জনসংখ্যার একশো শতাংশ, সংযুক্ত আরব আমীরশাহীর আশি শতাংশ, ব্রিটেন এবং মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের প্রায় পঞ্চাশ শতাংশ জনগণ টীকা পেয়েছে আজ অব্দি, সেখানে বাংলাদেশ, ইন্দোনেশিয়া, মেক্সিকোর মত দেশের জনসংখ্যার পাঁচ শতাংশও এখনো টীকা পাননি। আফগানিস্তানে কভারেজ শূন্য দশমিক চার শতাংশ, কেনিয়াতে শূন্য দশমিক শূন্য চার শতাংশ। সমগ্র আফ্রিকা মহাদেশে শূন্য দশমিক ছয় শতাংশ, ভারতসহ এশিয়ায় চার শতাংশের কম।
টীকা উৎপাদনকারী সংস্থাগুলোকে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা বারবার আবেদন করার পর একমাত্র অ্যাস্ট্রাজেনেকা রাজি হয়েছে নো-প্রফিট-নো-লস্ নীতিতে টীকা উৎপাদন ও সরবরাহ করতে।
গরীব দেশগুলো নিজেদের দেশে টীকা প্রস্তুত করবার্যজন্য তৈরী, তারা শুধু প্রযুক্তিগত সহায়তা চায় উন্নত দেশগুলো থেকে, কিন্তু মুনাফা কমে যাবার আশঙ্কায় বাধ সাধছে প্রস্তুতকারী সংস্থাগুলো। ডাঙ্কেল আঙ্কেলের গ্যাট (GATT) চুক্তি মনে আছে নিশ্চয়ই। ট্রেড-রিলেটেড অ্যাস্পেক্টস অব ইন্টেলেকচুয়াল প্রপার্টি রাইটস্ (TRIPS)-এর ধারার দিকে ইঙ্গিত করছে বৃহৎ ফার্মা হাউসগুলো।
ধনতন্ত্রের এই সংকীর্ণ মুনাফামুখী নীতি, ধনী দেশগুলোর জাতীয় স্বার্থবাহী নীতি বিজ্ঞানকেও অস্বীকার করছে। জনস্বাস্থ্য বিজ্ঞান অনুযায়ী এভাবে অতিমারি ঠেকানো বা নিয়ন্ত্রণ করা অসম্ভব। কোন কোভিড টীকাই একশো শতাংশ সুরক্ষা দেয় না, টীকা নেবার পরেও যে কেউ সংক্রমিত হতে পারেন। তবে সেক্ষেত্রে রোগের তীব্রতা কম থাকবে, হাসপাতালে ভর্তির প্রয়োজন কমে আসবে, মৃত্যু প্রতিরোধ করা সম্ভব হবে। কিন্তু সমগ্র পৃথিবী থেকে একসাথে সংক্রমণকে উপড়ে ফেলতে না পারলে কোন জাতিই নিরাপদ নয়। স্প্যানিশ ফ্লু অতিমারির সময় বিজ্ঞান এত উন্নত ছিল না, টীকা আবিষ্কার করা যায়নি, পাবলিক হেলথ্ ইন্টারভেনশনের টুলস্ হাতে ছিল না। তাই কয়েকবছর ধরে সংক্রমণের দ্বিতীয়, তৃতীয়, চতুর্থ তরঙ্গ এসে মানব সভ্যতাকে ছারখার করার পর অতিমারির স্বাভাবিক মৃত্যু হয়েছিল।
কোভিড অতিমারির প্রথম তরঙ্গের প্রকোপ শেষ হতে না হতেই বিজ্ঞানীরা টীকা আবিষ্কার করে ফেললেন, বিজ্ঞানের এ এক অভাবনীয় সাফল্য। কিন্তু পূঁজিবাদী ব্যবস্থায় বিজ্ঞানকে, বৈজ্ঞানিক আবিষ্কারকে কব্জা করে রেখেছে ধান্দার ধনতন্ত্র। টীকা উৎপাদনের প্রযুক্তিকে বিশ্বের দরবারে উন্মুক্ত করে দিতে পারলে, দুনিয়ার সব কোণে টীকার সুষম বন্টন সুনিশ্চিত করতে পারলে, একসাথে সবদেশের জনগণের ভালনারেবল্ অংশকে আগে, অন্যান্য অংশকে পরে টীকা দিতে পারলে সংক্রমণের দ্বিতীয়, তৃতীয় তরঙ্গগুলোকে প্রতিহত করে দেওয়া যেত, অতিমারির স্বাভাবিক মৃত্যু অব্দি অপেক্ষা করতে হত না। পাবলিক হেলথ্ ইন্টারভেনশনের টুলস্ হাতে থাকা সত্বেও সেভাবে ইন্টারভিন করা যাচ্ছে না একমাত্র পুঁজিবাদী ব্যবস্থার জন্য।
গরীব দেশের ষাটোর্ধ্ব মানুষকে, স্বাস্থ্যকর্মীসহ ফ্রন্টলাইনারদের, কোমর্বিডিটি-সম্পন্ন চল্লিশোর্ধ্ব মানুষকে বঞ্চিত করে ধনী দেশগুলোর নিজেদের জনসংখ্যার প্রত্যেককে আগে টীকা দিয়ে দেবার এই যে অসুস্থ, অবৈজ্ঞানিক প্রবণতা, তার মধ্যেও অন্যরকম দৃষ্টান্ত রেখেছে দক্ষিণ কোরিয়া। যথেষ্ট ধনী দেশ, চাইলেই তার শোয়া পাঁচ কোটি জনসংখ্যার প্রত্যেকের জন্য চড়া দামে টীকা কিনে নিতে পারত তারা। কিন্তু তা না করে শান্তভাবে বসে ছিলেন প্রেসিডেন্ট মুন জেই-ইন, যতক্ষণ না বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার কো-ভ্যাক্স চেইন তাদের জন্য বরাদ্দ টীকা পাঠায়। এবং তারা আপাততঃ শুধুমাত্র বয়স্ক ও ফ্রন্টলাইনারদের জন্য যতটুকু দরকার, ততটুকুই নিয়েছে।
সুতরাং, এদেশে সমস্ত প্রাপ্তবয়স্কদের অবিলম্বে টীকা দেবার যে দাবী উঠেছে কোন কোন মহল থেকে, তা শুধুমাত্র আন্তর্জাতিক ভ্রাতৃত্বের পরিপন্থীই নয়, অমানবিক ও অনৈতিকও বটে। সর্বোপরি অবৈজ্ঞানিক।
এ রাজ্যের সরকার সব নাগরিকের জন্য টীকা কেনার যে ইচ্ছে প্রকাশ করেছে, তার কোন বাস্তব ভিত্তি ছাড়াই, বোঝাই যাচ্ছে তা একটি প্রাক-নির্বাচনী রাজনৈতিক উচ্চারণ বৈ কিছু নয়। রাজ্য সরকার অতিমারির শুরুতে ঘোষণা করেছিল সমস্ত স্বাস্থ্যকর্মী ও অন্যান্য ফ্রন্টলাইন কর্মীদের জন্য এক লক্ষ টাকা করে বীমার কথা। প্রথম দু-এক মাসে দু-চার জন কোভিড আক্রান্ত হবার পর টাকা পেলেও বহু সহস্র আক্রান্ত সরকারী কর্মী আজও টাকা পাননি।
সাধারণ মানুষ কোভিড আক্রান্ত হয়ে সুস্থ হবার পর কোভিড-যোদ্ধা হিসেবে তাদের ইচ্ছুক অংশকে কোভিড মোকাবিলার কাজে নিয়োগ করা হয়েছিল মাসিক পনেরো হাজার টাকা পারিশ্রমিকে। তাঁরা ডিসেম্বরের পর থেকে আর টাকা পাচ্ছেন না, অথচ নির্বাচনের আগে তাঁদের ছেঁটেও ফেলতে পারছে না সরকার। কোভিড মোকাবিলায় সরকার যে আর এক পয়সাও খরচ করতে চাইছে না, তা এই দুটো দৃষ্টান্তেই পরিষ্কার। ফলে সবার জন্য টীকা কেনা অসম্ভব জেনেই সরকার এধরণের অবান্তর প্রস্তাবনা রেখেছে, তাও দিনের আলোর মতই স্পষ্ট।
ভালো লেখা।