একটি পছন্দের পানীয় নিয়ে কিছু কথা লিখতে চাই। এক কিস্তিতে হবে না। ধারাবাহিক বলতেও সাহস হচ্ছে না। সে বড় ভারিক্কি ব্যাপার! যাইহোক যা খুশি লিখে যাই। আপনারা একটু আধটু পড়লেই আমি খুশি।
যব গেঁজিয়ে প্রাপ্ত পানীয় নয়। জলের পর পৃথিবীর সর্বাধিক জনপ্রিয় পানীয়ের কথা বলছি। বৈজ্ঞানিক নাম Camellia sinensis, যাকে নিয়ে অনেক কথা লেখা যেতে পারে কারণ এর ইতিহাস প্রায় সাড়ে চার হাজার বছরের পুরানো।
আজ প্রথম পর্ব, চায়ের আবিষ্কার তথা আদিকথা নিয়ে। তারপর আসব ভারতে চায়ের আমদানি, ভালো চায়ের প্রস্তুত তথা আস্বাদন পদ্ধতি, চায়ের সাথে আফিম ব্যবসায়ের যোগ এবং সেখান থেকে লেগে যাওয়া যুদ্ধ ইত্যাদি নানা প্রসঙ্গে। এছাড়াও থাকবে টী ব্যাগস্। এমনকী দেশীয় কায়দায় মাটির ভাঁড়ের চা নিয়েও কথা বলার ইচ্ছা আছে।
সঙ্গে থাকবেন।
_______________
চায়ের আমি চায়ের তুমি
চা দিয়ে যায় “চিনা”
খ্রিষ্টপূর্ব ষষ্ট শতাব্দী। জেন বৌদ্ধধর্মের (Zen Buddhism) প্রবক্তা ভারতীয় সন্ন্যাসী বোধিধর্ম গেলেন চিন দেশে। উদ্দেশ্য মূর্তি পূজা বা মন্ত্রোচ্চারণের পরিবর্তে গভীর মনোযোগে ধ্যানের মাহাত্ম্য প্রচার। সংস্কৃতে ধ্যান, ইংরাজিতে meditation, চিনে ভাষায় chan আর জাপানিতে zen সবই প্রায় এক। যাইহোক স্থানীয় মহারাজা উডি (Wudi)-র অনুমতিক্রমে বোধিধর্ম ধ্যানে বসলেন এক গুহার সামনে। এক-দু’দিন বা এক-দু’বছর নয়। নির্জন গুহার দিকে তাকিয়ে তাকিয়ে কাটিয়ে দিলেন একটানা ন’বছর। একটা সময় ক্লান্তিতে চোখের পাতা দুটি একত্রিত হয়ে এল। ক্রোধে, হতাশায় বোধিধর্ম সেগুলিকে তৎক্ষণাৎ কেটে ফেললেন। ছুঁড়ে দিলেন দূরে। সন্ন্যাসীর প্রোথিত আঁখিপল্লব পল্লবিত হল চিরহরিৎ চা গাছে।
নোবেল বা অস্কার ঘোষণার পর আমরা অনেকে তন্ন তন্ন করে ভারতীয় বা বঙ্গযোগ খুঁজে বেড়াই। কিন্তু বোধিধর্মের গল্পটা শুনে চা আবিষ্কারের কৃতিত্বে নিজেদের পাতে ঝোল টানলে ভুল হবে। কারণ চা আবিস্কার হয়ে গেছে তার চেয়েও দু’হাজার বছর আগে। তবে এশিয়ান হিসেবে অবশ্যই গর্বিত হওয়া যায়।
এবার নিয়ে যাই খ্রিষ্টপূর্ব সাতাশ শতাব্দীতে (2737 BC)। তৎকালীন চিনের এক মহারাজা Shen Nung বা Shennong বসেছিলেন বাগানে একটি গাছের তলায়। ভেষজ ওষধিতে শান্নং-এর অগাধ বিশ্বাস। আজ্ঞাবশত ভৃত্য রেখে গেলেন এক পাত্র গরম জল। গাছ থেকে উড়ে এসে পড়ল কয়েকটি সবুজ পাতা। পালটে গেল জলের রং। রাজা অম্লান বদনে খেয়ে ফেললেন সেই রঙিন জল। খুশি হলেন। শরীর আরও চাঙ্গা হল। আবিষ্কার হল চায়ের।
পুরাতত্ত্ব অনুযায়ী চা গাছ পৃথিবীতে আছে প্রায় পঞ্চাশ মিলিয়ন বছর ধরে। তার আবিষ্কার নিয়ে অনেক গল্পগাথা থাকাটাই স্বাভাবিক। তবে প্রায় সবগুলোই সেই একই দেশ ঘিরে। আর সেজন্যই আজকের শিরোনামে কিংবদন্তি পালটে চিনবদন্তি!
Camellia sinensis প্রথম দিন থেকেই চা নামে পরিচিত ছিল এমনটা নয়। Tu, Te ইত্যাদি নানা নামের মধ্যে দিয়ে শেষে এসে আমরা দাঁড়িয়েছি Tea তে। আর Mandarin ভাষায় Cha. ভারতের চায়ে (Chai) অবশ্য একটু আলাদা কনসেপ্ট। তার নিজস্বতা নিয়ে অন্য এক দিন কথা বলবো।
পৃথিবী জুড়ে প্রায় 7000 বিভিন্ন ভাষা প্রচলিত। তবু মূলত tea/cha এই দুটি নামেই বিশেষ পরিচিত। এর পিছনেও কারণ আছে। পঞ্চদশ শতাব্দী পর্যন্ত চিনের যে অংশ থেকে থেকে সিল্ক রুট দিয়ে চা রপ্তানি হত সেখানে প্রচলিত নাম ছিল Cha. আর ষোড়শ শতাব্দী থেকে ইউরোপিয়ানরা সমুদ্র পথে চিনের যে অংশের সাথে বাণিজ্য স্থাপন করলো সেখানকার লোকেরা বলত Tea. অর্থাৎ একই পাতা সড়ক পথে গেছে চা নামে। আর জলপথে গেছে Tea নামে।
কথায় আছে একজন চায়নাম্যানকে যদি মরুভূমিতে থাকতে বাধ্য করা হয় তাহলে সে সাতটি জিনিস নেবে। জ্বালানি-কাঠ, চাল, তেল, নুন, সয়া-সস, ভিনিগার এবং চা। শেষের বস্তুটি ওদের জীবনে এতখানিই গুরুত্বপূর্ণ। তবে শান্নং আবিষ্কৃত পানীয়টি সেদেশেই একটি গেরস্থালি নামে পরিচিতি হতে সময় লেগেছে অনেক। বিভিন্ন রাজা মহারাজাদের পৃষ্ঠপোষকতা ছাড়াও রয়েছে Lu Yu (লু ইয়ু) নামের এক চা-ঋষির (Tea Sage) কৃতিত্ব। 760-762 খ্রিস্টাব্দ নাগাদ তিনি লিখেছিলেন Cha Jing (চা সূত্র) বা The Classic Of Tea নামের একটি যুগান্তকারী বই। আমাদের গীতার জনপ্রিয়তার সাথে টেক্কা দিতে পারে এই বই। চা কিভাবে বানাতে হবে, কোন পাত্রে, কোন জলে সব কিছু নাকি লেখা আছে এই বইয়ে। তবে লু ইয়ু-এর সব কথা যে সবাই মেনেছে তাও নয়। যেমন, উনি ঠাণ্ডা চা খেতে বারণ করেছিলেন। তাতে নাকি বদহজম হয়। কিন্তু আমেরিকায় পঁচাশি শতাংশ চা-ই খাওয়া হয় বরফ মিশিয়ে। গীতার কথা যেহেতু তুললাম তাই বলে রাখি, চায়ের যদি কিছু ধর্মযোগ থাকতে হয় তা হল বৌদ্ধ। ধর্মপ্রচারের পাশাপাশি নিজের এই সুঅভ্যাসও সন্ন্যাসীরা ছড়িয়ে দিয়েছেন নানা দেশে।
এমনিতে চা গাছ বলতে যে দু’তিন ফুটের বনসাইয়ের ছবি ভেসে ওঠে সেটা খানিকটা কৃত্রিম। বাড়তে দিলে ওরা বিশ ত্রিশ ফুট লম্বা হয়ে যেতে পারে কিন্তু বেশি পাতা গজানো আর সেই পাতা সহজে তোলার জন্যে ওদের ছোট করে রাখা হয়। চাইনিজ মালের লাস্টিং নিয়ে আমার নিজেরও প্রচুর প্রশ্ন আছে। তবে চা গাছের বয়স নিয়ে প্রশ্ন তুলতে গেলে একটু ভাবতে হবে। দার্জিলিংয়ের বাগানগুলো না হয় চার পাঁচশো বছরের পুরানো কিন্তু ইউহানের সেই 1700 বছরের পুরানো বাগানটার কথা ভাবুন। এছাড়াও নাকি চিনে এমন সাতখানা গাছ আছে যাদের বয়স চার হাজার বছর!
সীমান্ত সমস্যা নিয়ে দেশে যখন চিনে আমদানি নিষিদ্ধ করা হয় আমি একটু মুচকি হাসি আর এক কাপ ভালো দার্জিলিং চা খেয়ে ফেলি। নাহ্, এর মধ্যে আর পলিটিক্স ঢুকিয়ে লাভ নেই। আজ বরং থামি। পরের দিন ভালো চা বানানো নিয়ে লিখবো। বলবো গরম জলে চা পাতা দেবেন না কি শুকনো পাতার ওপর গরম জল ঢালবেন। থাকবে আরও অনেক চা-কথা।
ক্রমশঃ…