প্রশ্নঃ “স্ট্রেস” বিষয়টি ঠিক কি?
উত্তরঃ খুব সহজভাবে বলতে গেলে যে সমস্ত অভিজ্ঞতা আমাদের মনে উদ্বিগ্নতা ও হতাশার অনুভূতি সৃষ্টি করে সেগুলোই হল “স্ট্রেস”।
স্ট্রেস মূলত তিন রকমের হতে পারে-
১) “গুড স্ট্রেস (ইউ স্ট্রেস)”- জীবনে চলার পথে স্বাভাবিক ভাবেই কিছু কিছু চাপ আসে। অল্প স্বল্প স্ট্রেস কিন্তু আসলে ভালো জিনিস। কোন পরীক্ষা, বাধা অতিক্রম করার মধ্যে যেমন একটা আনন্দ আছে তেমনি একটা গঠনমূলক শিক্ষাও আছে যা পরবর্তী কালে অন্যান্য বাধা অতিক্রম করতে সাহায্য করে।
২) “টলারেবেল স্ট্রেস”- অনেক সময় জীবনে দুর্ঘটনা ঘটে। কিন্তু আত্মীয়- স্বজন, বন্ধু-বান্ধবের সহযোগিতায়, সুস্থ-স্বাভাবিক মস্তিস্ক ওই স্ট্রেস কাটিয়ে উঠতে পারে।
৩) “টক্সিক স্ট্রেস”- যে সমস্ত মানুষের মস্তিষ্ক চাপ নেওয়ার উপযুক্ত নয়, যাঁদের সেরকমের ফ্যামিলি সাপোর্ট নেই, যাঁরা নিজেদের আবেগ নিয়ন্ত্রণে রাখতে পারেন না, সিদ্ধান্তহীনতায় ভোগেন তাঁরা হঠাৎ করে কোন বড় দুর্ঘটনার মুখোমুখি হলে সেই পরিস্থিতি থেকে সহজে বেরিয়ে আসতে পারেন না। তাঁদের মধ্যে নানান শারীরিক ও মানসিক সমস্যা দেখা যায়।
প্রশ্নঃ স্ট্রেস থেকে কিভাবে মানসিক রোগ সৃষ্টি হতে পারে?
উত্তরঃ আমাদের মস্তিষ্কের চাপ নেওয়ার ক্ষমতা এক এক মানুষের এক এক রকম। যাঁদের ছোট বেলা থেকেই নানা প্রতিকূল পরিস্থিতির মধ্য দিয়ে বড় হতে হয়েছে, যাঁদের ফ্যামিলি সাপোর্ট ঠিকমত নয়, যাঁরা দীর্ঘদিন অন্য কোন রোগে আক্রান্ত -তাঁদের ক্ষেত্রে মানসিক সমস্যা তৈরি হবার সম্ভাবনা বেশি। আবার স্ট্রেস যখন “টক্সিক স্ট্রেস” হয়ে ওঠে তখন তা থেকে নানান মানসিক সমস্যা তৈরি হতে পারে। একাকীত্ব, কোন রকম পরিশ্রম না করে অলস ভাবে জীবনযাপন করা, অনিয়ন্ত্রিত জীবনযাত্রা, নেশা, ঠিক মত না ঘুমানো ইত্যাদি বিষয়গুলি মানসিক রোগ সৃষ্টির প্রক্রিয়াটিকে ত্বরান্বিত করে। দীর্ঘদিন স্ট্রেসের মধ্যে থাকলে আমাদের মস্তিষ্কের হিপ্পোক্যাম্পাস ও প্রি ফ্রন্টাল কোর্টেক্স নামক জায়গা দুটি ক্রমশ আয়তনে ছোট হতে থাকে এবং এর ফলে এই অংশগুলির কার্যকারিতা কমতে থাকে।
প্রশ্নঃ স্ট্রেস বা ট্রমা থেকে কি কি মানসিক সমস্যা তৈরি হতে পারে?
উত্তরঃ ট্রমা ও স্ট্রেস থেকে বিভিন্ন মানসিক সমস্যা দেখা যেতে পারে। যেমন-একিউট স্ট্রেস ডিসঅর্ডার, পোস্ট ট্রমাটিক স্ট্রেস ডিসঅর্ডার, এডজাস্টমেন্ট ডিসঅর্ডার, রিএক্টিভ এটাচমেন্ট ডিসঅর্ডার, ডিসইনহিবিটেড সোশ্যাল এনগেজমেন্ট ডিসঅর্ডার ইত্যাদি।
প্রশ্নঃ রিএক্টিভ এটাচমেন্ট ডিসঅর্ডার রোগটিতে কি হয়?
উত্তরঃ কোন বাচ্চা যদি জন্ম থেকে ঠিক মত আদর যত্ন না পায়, বাবা-মায়ের থেকে দূরে থেকে বা হোমে থেকে বড় হয়, বার বার বিভিন্ন মানুষের কাছে থেকে বড় হয় যার ফলে ঠিকমত এটাচমেন্ট তৈরি না হয় তাহলে সেই সব বাচ্চাদের মধ্যে এই জাতীয় সমস্যা দেখা যেতে পারে।এই জাতীয় বাচ্চারা সবসময় দুঃখে থাকে, অকারণে রেগে যায়, অহেতুক বাবা-মা ও আত্মীয়দের ভয় পায়, তাদের সাথে মিশতে পারে না, মনের দুঃখের কথা প্রকাশ করতে পারে না ও তাদের কাছে গিয়ে মন খারাপ কমানোর চেষ্টাও করে না। সাধারণ ভাবে ৫ বছর বয়সের আগেই এই সমস্যা দেখা যায়।
প্রশ্নঃ “পোস্ট ট্রমাটিক স্ট্রেস ডিসঅর্ডার” বিষয়টি কি?
উত্তরঃ কোন ব্যক্তি যদি হঠাৎ করে মৃত্যু, দুর্ঘটনা, মারাত্মক আঘাত, যৌন উৎপীড়ন ইত্যাদির মুখোমুখি হন, এই জাতীয় ঘটনার সাক্ষী হন, নিকট কোন আত্মীয় এই জাতীয় ঘটনার শিকার হন অথবা কেউ যদি কাজের সূত্রে বারংবার এই জাতীয় ঘটনার মুখোমুখি হন (যেমন-পুলিশ, চিকিৎসক, ইত্যাদি) তাহলে তাঁর মধ্যে বেশ কিছু মানসিক সমস্যা দেখা যেতে পারে। এর পরে ওই ব্যক্তির মনে ওই ঘটনাগুলির কথা বার বার ঘুর পাক খেতে থাকে, স্বপ্নের মধ্যেও ওই সব দুঃস্বহ অভিজ্ঞতাগুলি বার বার তাঁকে তাড়া করতে থাকে।ক খনো আবার ফ্ল্যাশব্যাকের মত অভিজ্ঞতা ঘটে।
এর ফলে সেই মানুষটি ওই দুঃসহ স্মৃতিগুলি ভুলে থাকতে চান। যে সব মানুষ, জায়গা, কাজ, পরিস্থিতি ইত্যাদি ওই ঘটনার সাথে যুক্ত বা ওই ঘটনা মনে করিয়ে দেয় -সেগুলিকে তিনি এড়িয়ে চলতে থাকেন।
অনেক সময় সেই দুঃসহ ঘটনাটির স্মৃতি এই ব্যক্তির মন থেকে আংশিক বা পুরোপুরি মুছে যায়।
সেই মানুষটির মনে একটি ভয়, আতঙ্ক, রাগ, ঘৃণা, নিজেকে দোষী মনে করার প্রবণতা, অন্য মানুষকে অবিশ্বাস ইত্যাদি মনোভাব তৈরি হয়। তাঁর মধ্যে আনন্দ, ভালোবাসা ইত্যাদি অনুভব করার ক্ষমতা হারিয়ে যায়। অন্য মানুষজনের সাথে মেশা, সামাজিক কাজকর্মে যুক্ত থাকার ইচ্ছে অনেকাংশে নষ্ট হয়ে যায়।
এর সাথে সাথে অল্পতেই রেগে যাওয়া, মনোযোগের অভাব, ঘুমের সমস্যা,নিজের ক্ষতি করার প্রবণতা, ভাবনা চিন্তা না করে কাজ করা, অকারণে চমকে ওঠা ইত্যাদি লক্ষণ দেখা যেতে পারে।
এই সব সমস্যাগুলি যখন একমাসের পরেও থেকে যাচ্ছে -তখন সেই সমস্যাটিকে “পোস্ট ট্রমাটিক স্ট্রেস ডিসঅর্ডার” বলা হয়।
প্রশ্নঃ তাহলে কেউ যদি এই রকমের ভয়ঙ্কর ঘটনার মুখোমুখি হন তাহলে কি করা দরকার?
উত্তরঃ দুর্ঘটনায় আক্রান্ত ব্যক্তি যদি ঘটনার বিবরণ কারোর সামনে খুলে বলেন তাহলে মন অনেকটা হালকা হয়। তাঁকে এই বিষয়ে উৎসাহিত করতে হবে। অনেক সময় গ্রুপ ডিসকাশন করা যেতে পারে। এই সময় যে বিভিন্ন শারীরিক ও মানসিক সমস্যা হতে পারে এবং সেগুলা যে স্বাভাবিক সেই ব্যাপারটা তাঁকে বোঝাতে হবে। যে সমস্ত বিষয়, জায়গা বা পরিস্থিতি সেই দুর্ঘটনা মনে করিয়ে দিতে পারে সেগুলির মুখোমুখি হতেই বরং তাঁকে উৎসাহিত করতে হবে। ঘুমের সমস্যা হলে স্লিপ হাইজিন মেনে চলতে হবে। আক্রান্ত ব্যক্তি যেন একা না থাকেন, তাঁকে যেন সর্বক্ষণ চোখে চোখে রাখা হয় তা সুনিশ্চিত করতে হবে। সমস্যা যদি বেশি হয় তাহলে সাইকিয়াট্রিস্ট ডাক্তারবাবুর পরামর্শ নেওয়া যেতে পারে।