মামা নিজে একটা ওষুধের দোকান কেন দেয় না কে জানে! অবশ্য চেম্বারের বাইরে ছোট একটা ঘরে ডিস্পেন্সারি এখনো আছে। তবে সেটা নামেই। পুরনো কিছু শিশি-বোতল, কর্কের ছিপি, সিরাপ আর মিক্সচার ঢালার ফানেল, ডোজ লেবেল করা খাঁজকাটা লম্বা লম্বা সাদা কাগজের টুকরো। কিন্তু সব গুলোতেই প্রচুর ধূলো জমেছে। মান্ধাতার আমলের জিনিস সব। এখন আর ব্যবহার হয় না। মণিমামা বলে, নিয়ম পাল্টে গেছে। এসব আর চলবে না।
‘ফেলে দিলেই তো পারো। চেম্বারটা পরিষ্কার থাকে।’
মামা আঁৎকে ওঠে-‘ফেলিস না।
‘কেন? এগুলো আর কোন কাজে লাগবে?’
‘লাগবে, লাগবে। কোনদিন আবার আইন পাল্টে যায় কে জানে?’
মনিমামার সাথে তর্ক করে লাভ নেই। কিছুতেই মানবে না।
আপাততঃ রোগী নেই। বাঁচা গেছে। মামা খবরের কাগজের কাটিং খাতায় সাঁটতে ব্যস্ত। বাংলা, ইংরেজি মায় হিন্দি পর্যন্ত- যত রাজ্যের খবরের কাগজ ঘেঁটে তার থেকে ভুল বের করে খবরের কাগজের অফিসে চিঠি লিখে সেই ভুল ধরিয়ে দেওয়া- মামার হবি। মামা অবশ্য এটাকে সামাজিক কর্তব্য বলে মনে করে। গণতন্ত্রের চতুর্থ স্তম্ভ রক্ষা করা মণিমামার দায়িত্ব।
রোগী না থাকলেও মামার চেম্বার কখনই নিঃশব্দ থাকে না। পাশের ঘর থেকে কখনো হাম্বা-হাম্বা ডাক, কখনো কিঁচকিঁচ, কখনো ঘেউ ঘেউ শব্দ শোনা যায়। পাশের ঘরে পশু চিকিৎসক বিপুল কাঞ্জিলালের চেম্বার। গ্রামের লোক অনেক সময় একই সঙ্গে মানুষ ও গরুর চিকিৎসা করতে হাওড়া শহরের এই পাড়ায় চলে আসে। এখানে একই বাড়ির পাশাপাশি ঘরে পশু ও মানুষ দুয়েরই চিকিৎসা হয়।
‘বিপুল আমার প্র্যাকটিসের বারোটা বাজিয়ে দিচ্ছে।’
‘কিভাবে? উনি তো ভেটেরেনারি ডাক্তার! উনি কিভাবে তোমার প্র্যাকটিসের ক্ষতি করবেন?’
‘ওসব যদি তুই বুঝতিস, তাহলে তোকে যাদবপুরে রাজমিস্তিরি গিরি পড়তে হত না।’ মামার বদ্ধমূল ধারণা আর্কিটেকচার হল রাজমিস্ত্রি-র কাজ শেখার একটু উন্নততর সংস্করণ।
‘গরুর চিকিৎসাতেই ব্যাটা গেঞ্জিলাল বোকা লোকগুলোর পকেট ফাঁকা করে দেয়। গরুর ওষুধ, গরুর খাবার- যতসব হাবিজাবি জিনিস কিনে পয়সা শেষ। তারপরে আমাকে আর দেখাবে কি করে?’
মাঝে মাঝে মামা নাকি ধার-বাকিতেও রোগী দেখে! মাণিমামা বলে, ‘ধারেও রুগী দেখি।’
কিন্তু সেই ধার কেউ কোনোদিন শোধ করেছে – এরকম কোনো খবর নেই।
কিছুক্ষণ পরে আবার কয়েকজন রুগী এল। চেম্বার চলছে। প্রবল গরমে আমার ঝিমুনি আসছে। ঢং ঢং করে একটা বাজল। চেম্বারের গ্র্যান্ডফাদার ঘড়িটা এখনো চলে! শান্তি মাসীর ফোন আসবে এখুনি।
মণিমামা রুগী দেখতে দেখতে হঠাৎ আমাকে ভেতরে ডেকে পাঠাল। ‘দ্যাখ, দ্যাখ গেঞ্জিলালের কান্ড!’
‘কেন? কি হয়েছে?’
‘আমার প্রেশক্রিপশনের পিছনের পাতায় গরুর ওষুধ লিখে দিয়েছে। দেখাচ্ছি মজা।’
মণিমামা আর কি মজা দেখাবে? মজা দেখালো গেঞ্জিলাল, থুড়ি কাঞ্জিলালের গরু। মামার কথা শেষ হতে না হতে বিকট স্বরে হা-ম্বা ডাক ছেড়ে সাদা-কালো ছোপ ছোপ একটা বিরাট গরু হুড়মুড়িয়ে ঢুকে পড়ল মামার চেম্বারে। দরজা-টরজা ভেঙ্গে একেবারে একাকার। তিড়িংবিড়িং লাফিয়ে রিসেপশনের জিনিসপত্র ভেঙেচুরে একশেষ।
গরুর পিছনে পিছনে ঢুকল ভেটেরেনারি ডাক্তারের কম্পাউন্ডার সনৎ। সে গরুটাকে একটা ইঞ্জেকশন দিতে গেছিল। মোটা সূঁচ সহ সিরিঞ্জটা তখনো গরুর পিছনের উরুতে ফুটে রয়েছে। সনৎ ঝাঁপিয়ে পড়ে সেটা টেনে বের করে দিতেই কয়েক সেকেন্ডের তান্ডবনৃত্য থেমে গিয়ে গরু শান্ত হয়ে গেল। আমি ততক্ষণে পুরোনো প্যাকিং বাক্সে ভর দিয়ে লাফিয়ে রুগী শোয়ানোর কৌচে উঠে পড়েছি। আর মামা দৌড়ে পালাতে গিয়ে ধুতি-টুতি জড়িয়ে একেবারে চিৎপটাং। হাঁটু চেপে ধরে উঃ-আঃ শব্দ করতে করতে বিপুলের গুষ্টি উদ্ধার করতে লেগেছে তখন।
মামাকে ওই অবস্থায় দেখে গরুটার বোধহয় মায়া হল। সুঁচ বের করে নিতে তার ব্যথা তখন কমে গেছে। সে এগিয়ে আরেক ব্যথাতুর দু-পেয়ে জীবের হাঁটুটা চেটে দিতে থাকল। সে এক দৃশ্য বটে!
ঠিক সেই সময় জগু ততক্ষণে আব্দুলকে ধরে মামার গাড়ীটা ঠিক করে চেম্বারে এসে হাজির। চোখ দুটো লাল। বেশ একটু গাঁজা টেনেছে মনে হল। কি আর করা! ওদের দুজনের সাহায্যে মামাকে ধরে ধরে গাড়ীতে তোলা হল। এক পা- দুপা করে হাঁটতে পারছে। বড় কোনো চোট লেগেছে বলে মনে হয় না। এক্সরে করে খারাপ কিছুই পাওয়া গেল না।
ব্যথার মধ্যেও মামার টনটনে খেয়াল। ‘গরুটাকে ধরে খোঁয়াড়ে দে।’
কথাটা সামন্ত-র উদ্দেশ্যে বলা। এইসব কাজের জন্য উপযুক্ত লোক হল ভজুয়া। কিন্তু সে তো আজ ছুটিতে। তাই গাড়ীর মেকানিক আব্দুল সামন্ত-র সাথে গরু নিয়ে চলল খোঁয়াড়ে।
গরু খোঁয়াড়ে গেলে অনেক টাকা গচ্চা দিয়ে তাকে ছাড়াতে হয়। কিন্তু সনৎ অনেক কাকুতি-মিনতি করেও মামাকে টলাতে পারল না।
বসার ঘরে মামার হাঁটুতে বরফ ঘষতে ঘষতে শান্তিমাসী বলল, ‘ওই অপয়া চেম্বার এবার ছাড়ো দেখি!’
কিন্তু মণিমামার চেম্বার নয়, বন্ধ হয়ে গেল বিপুল কাঞ্জিলালের চেম্বার। চিরতরে।
(শেষ)