পহেলগাঁওয়ের প্রেক্ষিতে ভারতের প্রতিক্রিয়ার কথা বলতে গিয়ে কিছু সংবাদ চ্যানেল “কড়া ওষুধ” এবং “বদলা” কথাদুটো পরপর ব্যবহার করছে। এতে চিকিৎসক হিসেবে আমার কিঞ্চিৎ অস্বস্তি হচ্ছে। “কড়া ওষুধ”-এর বিষয়ে আমি মোটামুটি একমত, কিন্তু তার সঙ্গে “বদলা” শব্দটা ব্যবহার করা হচ্ছে কেন? ওষুধ তো বদলা নেবার জন্য প্রয়োগ করা হয় না। আমরা যখন অ্যান্টিবায়োটিক প্রয়োগ করি, তখন “ব্যাকটেরিয়া সিং, আ রাহা হুঁ ম্যায়… এক এক কো চুন চুন কে মারুঙ্গা” বলে জীবাণুদের দিকে প্রতিশোধস্পৃহা নিয়ে তেড়ে যাই না। রোগীকে বাঁচানোই একমাত্র উদ্দেশ্য হিসেবে থাকে মনে এবং মস্তিষ্কে, জীবাণু নাশ তার একটা পদ্ধতি মাত্র। স্পৃহা বা মানসিকতা খুব গুরুত্বপূর্ণ মনে হয়। চিকিৎসা (এমনকি অ্যান্টিবায়োটিক প্রয়োগ) একটা মানবিক প্রয়াস, কারণ হত্যা নয়, জীবন বাঁচানোই চিকিৎসকের উদ্দেশ্য এবং ‘স্পৃহা’। চিকিৎসকের অনুভূতি বা প্রবৃত্তি ‘জিঘাংসা’ নয় ‘জিজীবিষা’ এবং ‘শুশ্রূষা’। এই মানসিক দিকটাই ঠিক করে দেয় আমাদের কর্ম ধর্ম না অধর্ম।
এক্ষেত্রেও কড়া ওষুধ প্রয়োগ করার উদ্দেশ্য, আমি যতটুকু বুঝি, দেশকে বাঁচানো এবং বিপন্মুক্ত করা। নিষ্ঠুর হত্যাকাণ্ডের অপরাধীদের এবং তাদের নিয়োগকারী / মদতদাতাদের শাস্তি দেওয়া হল ‘জাস্টিস’। একইসঙ্গে সেই ধরনের সন্ত্রাসীদের উৎপাদনকেন্দ্র এবং সাপ্লাই চেন ধ্বংস করা হল ভবিষ্যতের সুরক্ষার বন্দোবস্ত করা। মদতদাতাদের “কড়া জবাব” দেওয়া হল ডেটারেন্স, যেটাও ভবিষ্যতের সুরক্ষার জন্যই। এগুলো সদর্থক ভাবনা প্রসূত এবং কড়া ওষুধের ব্যবহার এই উদ্দেশ্যেই। এটাকে ‘বদলা’ নাম দিয়ে কি দেশকে এবং দেশের মানসিকতাকে অপমান করা হচ্ছে না? সাংবাদিক এবং সঞ্চালকেরা শব্দ ব্যবহার করার ক্ষেত্রে আরেকটু সচেতন থাকলে ভালো হয়। ক্রমাগত ভুল শব্দ ব্যবহার করে দেশের সাধারণ নাগরিকদের মানসিকতাকে খারাপ দিকে ঠেলে দেওয়া দীর্ঘ মেয়াদে দেশের পক্ষে ক্ষতিকর। পাকিস্তান রাষ্ট্রের যেসব কাজ বা বৈশিষ্ট্যকে ঘৃণা করি, নিজের দেশে সেগুলোর সম্প্রসারণ চাই না, কারণ শেষ অব্দি আমার প্রিয় দেশ ‘ভারত’, যাকে ‘ভারত’ থাকতে হবে, আরেকটা বড় সাইজের পাকিস্তান হয়ে যাবার মধ্যে তার কোনো গৌরব নেই।
মহাভারতে যে ধর্মযুদ্ধের কথা বলা হয়েছে, তা ‘ক্রুসেড’ নয়। কুরুক্ষেত্র কোনো ‘রিলিজিয়ন’ বাঁচানোর যুদ্ধের গল্প নয়, খৃষ্টান বনাম মুসলমান বা হিন্দু বনাম মুসলমান গোছের কিছু নয়৷ কুরুক্ষেত্রে ‘ধর্ম যুদ্ধ’ শব্দটির অর্থ হল নীতি মেনে যুদ্ধ। সংগ্রাম, সংঘাত মানবজীবনে থাকেই। তা ধর্মযুদ্ধ কিনা, তা নির্ভর করে উদ্দেশ্য, নীতি এবং নৈতিকতার ওপর। আমার বিশ্বাস, আমার দেশ এখনও রামায়ণ মহাভারত ভোলেনি৷ আমার দেশকে যেটুকু চিনি, তাতে আমার বিশ্বাস ভারত সঠিক সময়ে সঠিক মাত্রায় সঠিক ‘কড়া’ ওষুধ প্রয়োগ করবে সুচিকিৎসার উদ্দেশ্যেই, কোনো ক্ষতিকর উদ্দেশ্যে নয়। সেই ওষুধ এবং চিকিৎসা ভারতে, দক্ষিণ এশিয়ায় এবং পৃথিবীতে সুস্থতার সহায়ক হবে, কোনো অকারণ ‘সাইটোকাইন স্টর্ম’ জনিত ধ্বংসলীলা ডেকে আনবে না। শুভের জয় হোক… শুভশক্তির, শুভ পদ্ধতির, শুভ ভাবনার জয় হোক।
বেশ ভালো বিশ্লেষণ। তবে রামায়ণ মহাভারত এর কাহিনী তে নীতি নৈতিকতা নিয়ে অনেক প্রশ্ন আছে। জতুগৃহে পাঁচ পুত্র সহ নিষাদ মাতা কে ও সেই পর্বে তাদের দেখভাল করার দায়িত্বে নিয়োজিত পুরোচন কে যেভাবে কুন্তী ও পঞ্চপান্ডব পুড়িয়ে মেরেছিল সেখানে কোন্ নৈতিকতা ছিল? জরাসন্ধ, শিশুপাল হত্যায় ছিল চরম অনৈতিকতা। দ্রোণাচার্য কে বধ করার জন্য যে কপটতা,কর্ণ কে নিরস্ত্র অবস্থায় মস্তক ছেদনে সেই একি নীতিহীনতা। এমন অনেক অন্যায় কে আমাদের চোখের আড়াল করে রাখা হয়েছে অথবা বিভ্রান্ত করা হয়েছে। বিশ্লেষণী দৃষ্টিভঙ্গিতে সুন্দর এই লেখাটির সাথে মহাভারত, রামায়ণের নৈতিকতার উল্লেখ না করলেই ভালো হতো। অবশ্যই এটা আমার একান্ত ব্যক্তিগত মত। অন্যদের মত জানতে অপেক্ষা করব।