আজ সকালে এক বিজ্ঞানকর্মিকে ফেসবুকের তুলনার কথা বলতে গিয়ে, একটি গানের কথা মনে পড়েছিল। “যতীনের চা দোকনে“! প্রায় বছর পনের –ষোল আগে শোনা গান, যতীনের চা দোকানে। সে সময় ঐ গানে, বয়স্ক শিক্ষা বা সাক্ষরতা নিয়ে বলা হয়েছিল।
সাক্ষরতার সংজ্ঞা ইতিমধ্যে পাল্টে গেছে। বছর দশেক আগেই শুনেছি, সাক্ষরতা বলতে বোঝাবে, কম্পিউটারের প্রাথমিক কিছু কাজ জানা। এর একটা বেশ গালভরা নামও বলেছিলেন, পৃথিবীবিখ্যাত ঐ বাঙালি পন্ডিত, “কম্পিউটার লিটারেসি”।
এখন অবশ্য কম্পিউটারের কাজ না জানলেও , এন্ড্রয়েড ফোনেই প্রায় সব করা যাচ্ছে। এই এন্ড্রয়েড ফোনে সস্তার জিও যোগ হয়ে, একটি সামাজিক বিপ্লব হয়েছে। ভালোমন্দ বিচারের ক্ষমতা আমার নেই। তার সময়ও হয়নি। যুগে যুগে যখনই কোন নতুন কিছু এসেছে, তার পক্ষে বিপক্ষে হাজারটা যুক্তি বলেছে লোকে। এই যে দুটি এটম বোমা, লক্ষ লক্ষ মানুষের প্রাণ নিল, তার পক্ষে বলার লোকও নেহাত কম নেই।
যতীনের চা দোকানে বসে, সদ্যসাক্ষর বয়স্ক মানুষের, খুঁটিয়ে খবরের কাগজ পড়া দেখে, কোন গীতিকার গান লিখেছিলেন। এখন এই এন্ড্রয়েড ফোন নিয়ে, আবালবৃদ্ধবনিতার সোশ্যাল মিডিয়া বিচরণ, ঐ খুঁটিয়ে কাগজ পড়ার মত। এখানে আদার ব্যাপারীও নির্বিকার ভাবে, জাহাজ তৈরির জন্য, বাঘা বাঘা মেরিন ইঞ্জিনিয়ারদের পরামর্শ দিতে পারে। এই সেদিন দেখলেন না, চাঁদের বুকে “বিক্রম গাড়িটা” নামানো নিয়ে এই, সোস্যাল মিডিয়ার বিশেষজ্ঞদের লাখ লাখ পরামর্শ। আমিও লিখেছিলাম–“সোশ্যাল মিডিয়া গত দু’দিনে প্রমাণ করেছে, ভারতের আর কিছু থাক বা না থাক, এ দেশে কোটি কোটি বিশেষজ্ঞ আছে। Space scientist তো লাখ লাখ। লাখ লাখ লোক বাড়িতে বসে, টিভির রিমোট টিপে, বিক্রম গাড়িটা চাঁদের বুকে নামানোর চেষ্টা করেছিল। কারণটাতো জানেনই, টিভিতে তো দেখতেই পেয়েছেন। যার গাড়ি আগে নামবে, তাকেই বুকে জড়িয়ে আদর! বিক্রম বেচারা এত রিমোটের ধাক্কা সামাল দিতে পারেনিকো!”
১লা সেপ্টেম্বর যখন এই লেখাটা শুরু করেছিলাম, তখনও অবশ্য এই “বিক্রম”, “প্রজ্ঞান”, “শিভম স্যার” এদের নামটাও শুনিনি। আমার এই যতীনের চা দোকান, সোস্যাল মিডিয়ার কল্যাণে, আমিও , অন্তত ওসব নামটামগুলিতো জেনেছি।
কথা হচ্ছে, আজকের এই সোশ্যাল মিডিয়া কিভাবে একটা সামাজিক “বিপ্লব” করে যাচ্ছে? আমরা চন্ডীমন্ডপ দেখিনি, সাহিত্য বা সিনেমার পর্দায় যেটুকু দেখা। তার পরে এলো শহরের রোয়াক। তাও, আমরা যারা 75-80 সালের পর, হদ্দ গ্রামের থেকে কলকাতায় এসেছি, তারা ওই টেনিদা, ঘনাদার গল্প পড়েই যেটুকু জেনেছি। আমাদের দেখা বাঙালির নির্ভেজাল আড্ডার জায়গা হল, পাড়ার চায়ের দোকান।
এবার একটু চা খেয়ে জিরিয়ে নিয়ে, জমিয়েই আড্ডাটা দেওয়া যাক। এই যেমন আমি বাজারে বেরিয়ে, আমার এক নাতি কুটুম্বর সাথে গল্প করতে করতে চা দোকানে ঢুকলাম। আমি জানতাম না দোকানদারের নাম নিতাই।
ওর কোন বন্ধুস্থানীয় একজন রাস্তা দিয়ে যেতে যেতে একটা হালকা ডাক দিয়ে গেল, “কিরে নিতাই, আজ চায়ে ঠিকঠাক চিনি দিছিসত(অ)!” এই যে একেবারে অকিঞ্চিতকর একটা হালকা রসিকতা, এর থেকেই জল অনেকদূর গড়াতে পারে। নিতাই সোজা সোজা মানুষ হলে, মৃদু হেসেই বন্ধুর রসিকতাটি হজম করতে পারে। যে বন্ধুটি বলে গেল, সেও হয়তো একেবারে রসিকতা করেই বলল। এবার সোশ্যাল মিডিয়ায় এই সামান্য কথাই কতদূর গড়াতে পারে দেখুন।
এই যে দুটি নতুন লোক চা খাওয়ার জন্য বসে আছে, এরা ভাবতেই পারে, এই নিতাই লোকটা একটু ভুলো মনের মানুষ, গতকাল হয়তো চায়ে চিনি দিতে ভুলে গেছল। চিনি কম দিলে তো পরে মিশিয়ে নেওয়া যেতেই পারে, কিন্তু বেশি দিলেই মুশকিল। আমার আবার প্রায় চিনি খাওয়াই বারণ। আমার ডায়াবেটিস নেই, কিন্তু ওদিকে বেঞ্চে বসা প্রৌঢ় মানুষটি ব্লাডসুগারের রুগী, তিনি একেবারে হৈ হৈ করে উঠলেন, “এই নিতাই, এসব কি? তাইতো বলি, ভেলোরের ডাক্তারের ওষুধেও সুগার কমে না কেন?” নিতাই বেচারা একেবারে কানটান ধরে একসা। “না কাকাবাবু, না, আপনি আমার এতোদিনের খদ্দের, কত বছর চিনি ছাড়া চা করে দিচ্ছি আপনাকে, ও ভুল কখনো হয়!”
এই “ভেলোরের ডাক্তার” শব্দবন্ধের উপর বাঙালীর প্রবল দুর্বলতা। ঐ যে চায়ের দোকানের কাকাবাবু ঐ যাদু শব্দ দুটি বলে ফেললেন, সাথেসাথেই আড্ডার অভিমুখ ঘুরে গেল। ওনারা তিন প্রৌঢ় একেবারে, হিন্দুদর্শন আলোচনার মত, মেতে গেলেন, ভেলোরের ডাক্তার কত ভাল আর কোলকাতার ডাক্তার কত খারাপ, সেই আলোচনায়।
আমাদের ঐ সুগারের রুগী কাকাবাবুটির ভেলোর যাওয়ার ইতিহাসটিও বেশ রোমাঞ্চকর। উনি অবশ্য ওনার সমবয়সী মানুষগুলির সাথেই গল্পটা “শেয়ার” করছিলেন। নাতি সহ আমি, আর বাকী জনা তিনেক চায়ের উপলক্ষে বসে থাকা লোকও, প্রবল আগ্রহ নিয়ে শুনে নিলাম। (চুপিচুপি জানিয়ে রাখি; কে বলতে পারে, কবে আমাকেও যেতে হতে পারে, ভে–লো–র!) শ্রোতা পেয়ে, কাকাবাবু, এটা সম্ভবত ৩৭ নম্বর বার, তাঁর ভেলোর ভ্রমণের গল্প বলতে লাগলেন। “আরে বুঝলে না, সুগারের জন্যে তো ভেলোরে যাওয়া নয়। বিডনস্ট্রিটের ডাক্তার বসুই তো বরাবর দেখেন আমাকে, সুগারের জন্য। একরাতে নাকি আমি তিনবার জোরে জোরে বাতকর্ম করেছি। আমাদের বৌমা কিন্তু খুব শিক্ষিত মেয়ে, তার উপর ডাক্তারের বাড়ির মেয়েতো, ওর জ্যাঠামশাই ক্যাম্বেলের ডেপুটি সুপার ছিলেন। আমাকে অবশ্য কিছু বলেনি। তো, সকালেই ছেলে অফিসে বেরনোর আগে বলল, বাবা, তুমি একবার ভেলোরে চেকআপ করিয়ে এস। কেন, ভেলোরে কেন? গত মাসেও তো সুগার 176.5 ছিল!” পাশের ভদ্রলোক বললেন, “ওটা পিপি না ফাস্টিং?” “পিপি”। “তাহলে তো উইদিন কন্ট্রোল।” “আরে ভাই, বলে না, উঠলো বাই তো কটক যাই! ছেলে ওইদিনই অফিসের কম্পিউটার থেকে, ডাক্তারের ডেট নিয়ে, যসবন্তপুর এক্সপ্রেসের টিকিট কেটে ফেলল। বলল বাবা, চলো, একবার সবাই মিলে ভেলোরে চেক করিয়েই আসি। বুঝলে না, ছেলে তো অফিস থেকেই সব পেয়ে যাবে।” পাশের বন্ধু মানুষটির মুখটা একটু বিমর্ষ দেখাল। উনি বলেই ফেললেন , “আরে দাদা, আমরা তো আর ছেলের কোম্পানির পয়সায় ডাক্তার দেখাতে পারিনা, আমি তো নীলরতনেই দেখাই। ডাক্তার চৌধুরীর নাম আছে; শুনেছি বাইরে ১২০০ টাকা ফি নেন।“ এবার আমাদের কাকাবাবু বুক ফুলিয়ে, ভেলোরের ডাক্তারের গুণকীর্তন আর কোলকাতার ডাক্তারের বদমায়েসির ফিরিস্তি শুরু করলেন। এই একটি প্রসঙ্গে, চায়ের দোকান থেকে লোকাল ট্রেন, মন্দির থেকে শ্মশান ঘাটে, বাঙালী বিশেষজ্ঞের অভাব নেই। কারোর মামাশ্বশুরের বাড়ীওলার ভাইপো, হয়তো সাড়ে সাত বছর আগে ভেলোরে গেছল; সেই সুবাদে তিনিও “ভেলোর বিশেষজ্ঞ”।
যেখানে বাঘের ভয়, সেখানে সন্ধ্যা হয়। এর মধ্যে নাতিকে চিমটি কেটে চুপ করিয়েছি। এ পাড়ায় যে আমার এক পুরানো ছাত্র থাকে জানতামই না। বর্তমানে আর জি করে এম ডি পাঠরত ছেলেটি, চায়ের দোকানে আমাকে দেখে, স্যার , বলে এগিয়ে এসেছে। ভাগ্যিস এরা কলকাতার ডাক্তারদের শ্রাদ্ধকার্যে ব্যস্ত ছিল, নয়তো ছাত্রর সামনেই আমার জামা প্যান্ট খুলে নিত।
ওকেও পাশে বসতে বলে, চুপচাপ শুনতে বললাম। নীলরতন হাসপাতালে দেখানো দাদু একটু বোঝানোর চেষ্টা করলেন যে, উনি কলকাতার ডাক্তার দেখিয়েই ভালো আছেন। কিন্তু চা দোকানের “খাপ পঞ্চায়েত” ওনাকে বুঝিয়ে দিল যে, উনি আদৌ বেঁচেই নেই। যেখানে ভেলোরের ডাক্তার পনের মিনিট দেখে, সাড়ে তেইশ হাজার টাকার টেষ্ট করে, ওষুধ দিয়েছে; সেখানে কলকাতার সরকারী হাসপাতালে, চারশ জনের পিছনে লাইন দিয়ে, মাসে মাসে বিনাপয়সায় একটি দুটি টেষ্ট করেই চিকিৎসা! অসম্ভব!
আমার এই ডাক্তার ছাত্ৰ, এখনও পেশায় প্রবেশ করেনি। এদের একেবারে বোবা–কালা ভাবার কোন যুক্তি নেই। আজকের সমাজ কেমন চিকিৎসা চায়, ওরাও সবই দেখছে। বিশেষ করে মধ্যবিত্ত বাঙালি, কিসে খুশি হয়, এদের আর আমাদের মতো প্রাচীনপন্থী শিক্ষকদের কাছে শিখতে হয়না, সমাজই শেখাচ্ছে।
ভাবছেন এমন একটি খাপ পঞ্চায়েতে তিনটি নতুন লোক এতো সময় বসে থাকল, অন্তত দোকানদার নিতাই কিছু বলল না? এই ব্যাটা দরকচা মার্কা কলকাতার ডাক্তারের এই একটি বাতিক। বিনা পয়সায় সিনেমা পেলেই বসে যাই।
নিতাইকে ভুলিয়ে রাখতে নিজে দুবার চা খেলাম, আর নাতি একবার একটা বিস্কুট খেল, আর একটা বাপুজি কেক। কেকটা অবশ্য ও পুরোটা খায়নি। নিতাইয়ের দোকানের লেজ নাড়া ভক্ত কুকুরকে অর্ধেক খাইয়েছে।
এই কুকুর নিয়েই বা কম কি হল ফেসবুকে। আরে আরে, কখন নিতাইয়ের দোকানে, আর কখন ফেসবুকে বসে আছি, গুলিয়ে যাচ্ছে। নীলরতনে কুকুরের বাচ্চা মারা নিয়ে কি কান্ডই না হল। পুলিশ, কুকুর হত্যাকাণ্ডের অপরাধী ধরার আগেই, ফেসবুকের খাপ পঞ্চায়েত, নীলরতন হাসপাতালটিই উঠিয়ে দিল। নিতাইয়ের দোকানেও ওই কুকুর নিয়ে আর এক কান্ড হয়ে গেল। একজন গুগুল-ঘাঁটা পন্ডিত, ঐ বাপুজি কেকের জন্য আসা কুকুর নিয়ে একটা জ্ঞানগর্ভ বক্তৃতা দিয়ে, নিতাইকে উপদেশ দিল, কুকুরটাকে ভ্যাকসিন দিতে। রাস্তার কুকুরকে ভ্যাকসিন দেওয়ার দায় তার নয় বলায়, লেগে গেল খটামটি। ভেলোরের সব আলো এবার পড়ল ঐ লেড়ি কুকুরের উপরে। আপাতত কুকুরের কল্যাণে, কলকাতার ডাক্তাররা বেঁচে গেল।
চায়ের দোকানের আড্ডা বলে কথা। মিনিটের মধ্যে রং বদলায়। চিনি থেকে ভেলোরে, সেখান থেকে কুকুরে। তারপরই নাটক জমে গেল। চায়ের দোকান থেকে হাত চারেক দূরে, ড্রেনে এক বেচারা ঢোড়া সাপ দেখে, সে কি হৈ হৈ কান্ড। একজন লাফিয়ে এসে নিতাইয়ের ঝাঁপ আটকানোর বাঁশটা নিয়েই সাপ মারতে গেল। ভেলোর নিয়ে চুপ থাকতে বলেছি, সাপ নিয়ে তো আর বারণ করিনি। আমার ছাত্ৰ, জুনিয়র ডাক্তারটি বলে বসল, “আরে ওটা ঢোড়া সাপ, বিষ নেই, কেন মারছেন?” ব্যাস, শুরু হয়ে গেল ফেসবুকীয় পান্ডিত্য প্রকাশ। ছাত্রটি একবার বলার চেষ্টা করেছিল, স্যার কিছু বলুন। স্যার যে ঘরপোড়া গরু সেটা ওর জানার কথা নয়।
স্যারের আবার ঘর কবে পুড়ল? সেই আবার ফেসবুক! যতোই ভাবি চায়ের দোকানের গল্প শোনাবো, সেই ঘুরে ফিরে ফেসবুক। বলতে যখন হবেই, ভ্যান্ত্যারা না করে বলেই ফেলি। একবার বিশ্বজিৎ দাস নামের এক ভদ্রলোক একটি খুব কাজের ভিডিও পোষ্ট করেছিলেন; তাতে আবার আমাকে ট্যাগ করা। বেশ । শাঁখামুটি সাপ যে খুব উপকারী সাপ, সেটা বোঝাতে ঐ ভিডিওটি বেশ কাজে লেগেছিল। এই অধম সাপপাগল, ঐ ভিডিওটা বিশেষ ভাবে প্রচারের জন্য ফেসবুকে দিয়েছিল। আন্তর্জাতিক খ্যাতিসম্পন্ন সর্পবিদ বিশাল সাঁতরা, ঐ বিশ্বজিৎবাবুকে সুন্দর ভিডিওটির জন্য ধন্যবাদও দিয়েছিলেন। মাঝখান থেকে এক চ্যাংড়া মন্তব্য করে বসল, “ওটা আদৌ শাঁখামুটি? ভুল হচ্ছে না তো”। মাথাটা গরম হয়ে গেল। লিখলাম, “আপনার তাহলে ওটাকে ঠিক কী মনে হচ্ছে? আদৌ সাপ মনে হচ্ছে কি?” উত্তরে চ্যাংড়া লিখল,“you are over smart”! সেই থেকে চায়ের দোকানের আড্ডায় আমি নির্বাক শ্রোতা।
নির্বাক থাকাও বিপদ। কদিন আগে, বাঁকুড়ার এক ভদ্রলোক, আমাকে ট্যাগ করে কি যেন একটা ফেসবুকে “লেপে” দিলেন। এই লেপে দেওয়া কথাটা আবার এমনি এক পাক্কা আড্ডাবাজ, গোস্বামীবাবুর কাছেই শিখেছি। তো, একেবারেই আমার আগ্রহের বাইরের কি যেন বিষয় ছিল। চুপ করে থাকলাম। বাঁকুড়ার ভদ্রলোক দু’দিন পরে আমাকে “কমিউনিষ্ট” বলে গালাগাল দিলেন। জানিনা, চুপকরে থাকার “বদগুণটা” আবার কবে থেকে ঐ বিশেষ মতাদর্শী লোকগুলির একচেটিয়া হল।
এই “ট্যাগের” বিপদ নিয়ে দু একটা কথা না বললেই নয়। এই ট্যাগ হল, চায়ের দোকানের আড্ডায় আপনাকে জোর করে আটকে রাখা। ধরে নিতে পারেন; নিতাইয়ের দোকানের সামনে দিয়ে আপনি বাজারে যাচ্ছেন; আপনার পরিচিত কেউ ডেকে বসাল। নিম্নচাপের বৃষ্টি পড়েই যাচ্ছে। আপনার ছাতাটি নিয়ে, আপনার বন্ধুটি কোন জরুরী কাজে বেরিয়ে গেল। আপনি বসে বসে, ওখানে, আপনার অপছন্দের যা কিছুর মধ্যে জড়াচ্ছেন। নিতাই হয়তো আঁচে কয়লা দিয়েছে; আপনি ধোঁয়ার মধ্যে বসে রইলেন। আর, অন্তত যে সব রাজা-উজির মারা আলোচনা চলছে, আপনাকে বসে বসে শুনতে হবে। মায় ভেলোর ফেরৎ কাকাবাবুর বাতকর্মের শব্দ-গন্ধ সবই সয়ে যেতে হবে। এখানে জনান্তিকে বলে রাখি, ভেলোরের ডাক্তার কিন্তু ওনার ঐ বাতকর্মের সংখ্যাও কমাতে পারেননি, শব্দও কমাতে পারেন নি। ওটার জন্য যে, ভেলোরের ডাক্তারদের কোন সুপারস্পেশালিটি করা নেই, এই সার কথাটা বাঙালীকে কে বোঝাবে? বাস্তবে, আমার ভেলোরের বন্ধু প্রোফেসার হ্যাসডক, আমাকে প্রায় ঐ রকমই অনুযোগ করেছিল। “তোমাদের ওখানকার লোক, তুচ্ছাতিতুচ্ছ কারণে ভেলোরে দৌড়ে আসে কেন?” উত্তরটা সবারই জানা; মধ্যবিত্তের বাতিক রোগ।
ঐ ভেলোর ফেরৎ কাকুর অফিসার ছেলের নামটা জানলে, ফেসবুকে খুঁজে বের করা কঠিন কিছু নয়। সেখানে দেখবেন, সচিত্র তিরুপতি ভ্রমণের বর্ণনা। মায়, বাবার ডাক্তার দেখানো উপলক্ষে ভেলোর গিয়ে, বাকী সবার “ হোলবডি চেকাপ”-এর সগর্ব ঘোষণা।
এই দেখুন, ফেসবুকের মহিমা। কোথায় হচ্ছিল, ঢোড়া সাপের বিষের কথা, কোথায় চললাম, ভেলোরের ডাক্তারের মহিমা কীর্তনে। আমার ওই ছাত্র তো একবারই বলেছিল, “ঢোড়া সাপের বিষ নেই”। অমনি আমাদের নিতাই হয়ে গেল, চায়ের দোকানী থেকে সর্পবিশারদ। নিতাই আমার ঐ ডাক্তার ছাত্রকে পরিষ্কার জানিয়ে দিল, তোমরা আজকালকার ছেলে, যা জানোনা, তাই নিয়ে কথা বলবে না। “জয় মা মনসা” বলে, মাথার উপরে হাত তুলে একটা বড় নমস্কার জানাল। ওসব দেখে আমার বাংলায় স্নাতকোত্তর পাঠরত নাতি কুটুম্বর মুখে একটা মৃদু হাসি দেখে, ওই সোজা সিধা মানুষ নিতাইয়ের কি রাগ। বলে দিল, “জানো, মনসা মঙ্গল এ বলেছে, শনি মঙ্গলবার সব সাপের বিষ থাকে।” এবার প্রায় টানতে টানতে নাতিকে ওখান থেকে সরিয়ে আনলাম। বেচারা মঙ্গল কাব্যের উপর গবেষণা করছে; ওকেই কিনা, জ্ঞান দিয়ে দিল, পাড়ার চায়ের দোকানদার!
এদিকে হয়েছে আর এক কান্ড, নাতিটি ওই আড্ডার মাঝে আমাকে নিয়ে একটা সেলফি তুলে, ফেসবুকে লেপে দিয়েছে জানতাম না। এর মধ্যে মেদিনীপুর থেকে ওর আর আমার চেনা একজন মন্তব্য করেছে, “এটা তোর ডাক্তার দাদু? অনেক দিন পর দেখলাম।“ নাতি খুশি হয়ে ওর মোবাইলটা আমার হাতে দিয়ে বলল, “এই দেখ, হরেনদাদা কি লিখেছে?” আমার ছোটবেলার বন্ধু হরেন, আমিও ওকে, বহু বছর পর, এই ফেসবুক–এর কল্যাণে দেখলাম। ওর টাকটা এই ক’বছরে আরও কত বেড়েছে ……।। বলতে বলতেই, আর একটা মন্তব্য। এ লিখেছে, “তোর পাশের লোকটা কেরে? একেবারে হুনমানের মত দেখতে।” সঙ্গে একটা চোখ মারা ইমোজি। কি আর করা! এই হল সোশ্যাল মিডিয়া। পরের মন্তব্যটা দেখিই নি, এমন ভাব করে, ওর মোবাইল ওকে ফেরৎ দিলাম।
আমাকে হনুমান বললেও, ওর ঐ সেলফির কল্যাণে একটা খবরও পেয়ে গেলাম। ছবিতে দেখলাম, আমার হনুমান মার্কা ছবির মাথার পিছনে লেখা ছোট্ট পোস্টার, “এখানে ফ্লাট ও বাড়ী ভাড়ার সন্ধান দেওয়া হয়।“ গতকালই আমাদের এক বন্ধু জানতে চেয়েছিল, আমাদের পাড়ায়, ফ্লাট ভাড়ার খবর জানি কি না।
আমারা ওর দোকানে বসে থাকতে থাকতেই, একজন নিতাই কে জিজ্ঞেস করে গেল, পাড়ার যে কাকু নবান্নে চাকরি করে, সে সন্ধ্যায় কখন ওর দোকানে আসে।
মনে পড়ল, আমার এক ভায়রা, মেয়ের বিয়ের আগে, হবু জামাইয়ের পাড়ার চায়ের দোকানে আধঘণ্টা বসে, জেনে এসেছিল, হবু জামাই ছেলে কেমন।
কাজের কাজ যে একেবারেই হয়না তা তো নয়। তবে ওই যে দু’একটা বললাম। এখানে বিশাল সাঁতরাকেও নিতাই চাওলা, সাপ নিয়ে জ্ঞান দিয়ে যায়। বেশিরভাগ মন্তব্যই ওই, “চিনি ঠিকঠাক দিছিসত” গোছের; অগ্র–পশ্চাৎ ভেবে বলে না লোকে। তবে হ্যাঁ, নিতাইয়ের চা দোকান পাড়ার একটা দর্পণ। আমার মত মশলাসন্ধানীদের জন্য বেশ একটা, “শুনুকপাহাড়ীর হাট“। কিন্তু বেশিরভাগ সময়ই লঘু–গুরু জ্ঞান থাকে না। শুনুকপাহাড়ীর হাটে বহু লোক হাঁড়িয়া খায় জানতাম; কিন্তু এখানে তো দেখি প্রায় সবাই মাতাল । ( ১৬.৯.২০১৯)
সুখপাঠ্য।। সরল বর্ননা।