১
কলেজে পড়তে অভীক পাখি দেখত জঙ্গলে জঙ্গলে ঘুরে। চাকরি পেয়ে সে সব মাথায় উঠেছিল, তবু ইচ্ছে ছিল ষোল আনা, তাই কুশল যখন ফোন করে বলল সামনের মাসে একটা সার্ভে শুরু হচ্ছে, এক বিরল প্রজাতির প্যাঁচার খোঁজে, তার খানিকটা দেশের বাইরে, এক কথায় রাজি হয়ে গেল। সে দেশে কাজ করেছে ও, ভাষাটা ভালোই বলতে পারে বলেই কুশল ওর কথা ভেবেছে।
অভীক একলা। পিছুটান নেই। বেরোতে অসুবিধা নেই। কেবল অফিসের বসকে একটা ধমক দিতে হয়েছিল – যে অফিস দু’সপ্তাহ আমাকে ছাড়া চলতে পারবে না, সে অফিসে আমার কাজ করা উচিত কি না, ভাবতে হবে… এই রকম আর কি!
পাহাড়ী ঢালে তাঁবু খাটিয়ে গ্রামে গ্রামে ঘুরে ঘুরে প্যাঁচা খোঁজে, কিন্তু পায় আর না। বয়স্ক লোকেরা ছবি দেখে, রেকর্ড করা ডাক শুনে বলতে পারে, এই বীভৎস ডাকে তারা ছোটোবেলায় ঘুম থেকে উঠে বসে কান্নাকাটি করত! ঠিক। এমনই সবাই লিখেছে বটে। জিম করবেট তো “মাই ইন্ডিয়া” বইতে লিখেছেন চুড়েল (পেত্নী)-এর চিৎকার।
শেষে কুশল বলল, “মনে হচ্ছে এ দিকে আর নেই। এক্সটিঙ্কট হয়ে গেছে। আরও ভেতরে যদি থাকে। ধর…” বলে ম্যাপ খুলে দেখাল, “এই যে কণ্টাকাঁই, তার পরে পিকুলদাঁড়ি আর শেষে দীঘলাগড়। পুরোটা ডেন্স ফরেস্ট। দিঘলাগড়েই আমাদের সার্ভে এরিয়া শেষ।”
“তাহলে চল, পা চালিয়ে আমরা তাড়াতাড়ি কণ্টাকাঁই যাই…”
কণ্টাকাঁইতে রেঞ্জ অফিসারকেই পাওয়া গেল। সবুজসুন্দর গাথানি। মজার মানুষ। হা হা করে হাসেন, খুব আড্ডা দিতে পারেন। বললেন, “টেন্ট-ফেন্টের প্রশ্নই নেই। আপনারা আমার গেস্ট। সব ব্যবস্থা করে দেব। আরে আমি মশাই এখানকার খানদানি ফরেস্টার। আমার বাবাও এই জঙ্গলের রেঞ্জার ছিলেন। জঙ্গল ভালোবাসতেন বলে দাদু আমার নাম রেখেছেন সবুজসুন্দর। দাদু ফরেস্ট গার্ড ছিলেন।”
এক বেলার মধ্যে সবুজ-দা হয়ে গেলেন ভদ্রলোক।
কণ্টাকাঁইয়ের আশেপাশের জঙ্গলে কাঙ্খিত প্যাঁচার খোঁজ পাওয়া গেল না। দু-দিন কাটিয়ে পরদিন ওদের যাবার কথা পিকুলদাঁড়ি। কুশলের মনে আশা – ওখানেই পাওয়া যাবে। পুরোনো বইপত্রে এ প্যাঁচার কথা রয়েছে।
সন্ধেবেলা জিনিসপত্র গোছাচ্ছে, সবুজদা এসে বললেন, “পিকুলদাঁড়ি গিয়ে কোনও লাভ নেই। বইয়ে যা লেখা আছে, তা পাবেন না। পঞ্চাশ-ষাট বছর আগে ছোটো শহর ছিল, বেড়ে বেড়ে বিশ্রী বিজনেস সেন্টার হয়ে গিয়েছিল। গত বছর দশেকে ওখানকার বিজনেস আবার বন্ধ – এখন তো আর পাহাড়ে গাছ কাটা বারণ। কেবল মাতাল আর গেঁজেলদের আড্ডা। সপ্তাহে এক-দুটো মার্ডার লেগেই আছে। অনেকে তো ছেড়ে চলেও গেছে।”
“কোথায় যাব তাহলে?” জানতে চাইল কুশল।
“যাবেন বোনামপল্লী,” বললেন সবুজদা। “আমার এরিয়াতে ওখানেই মোস্ট ডেন্স ফরেস্ট। ওখানেই চান্স সবচেয়ে বেশি।”
ম্যাপে খুঁজতে খুঁজতে কুশল বলল, “কই, বোনামপল্লী বলে তো কোনও…”
আঙুল দিয়ে দেখিয়ে সবুজদা বললেন, “পিকুলদাঁড়ি যাবার পথে এইরকম কোথাও একটা রাস্তাটা সাউথে গেছে, সেই রাস্তা ধরে নামতে হবে। ম্যাপে নাম পাবেন না। অনেক বছর আগে ওখানে বোনামপল্লী ছিল। এখন কিছুই নেই।”
অভীক জিজ্ঞেস করল, “কেন?”
হা হা করে হেসে সবুজদা বললেন, “কাল বলব, চলুন তো আগে।”
২
পিকুলদাঁড়ি গিয়েই বোঝা গেল কোনও কাজ হবে না। নোংরা অস্বাস্থ্যকর পরিবেশ, মানুষজন সব কেমন যেন, সব মিলিয়ে পনেরো মিনিটেই হাঁপ ধরে গেল। ওদের মুখের চেহারা দেখে সবুজদা রওয়ানা দিলেন বোনামপল্লীর দিকে।
পাহাড় বেয়ে কাঁচা রাস্তা নেমেছে গিরিখাতের কুটরি নদীতীর অবধি। আড়াইশো তিনশো বছর আগে বোনামপল্লী ছিল এখানকার রাজধানীর পল্লী। রাজধানীর নাম ছিল কৃপানগড়। পরে রাজা রাজধানী সরিয়ে নিয়ে যান দিঘলাগড়ে। খালি কৃপানগড় পড়ে থাকে পাহাড়ের মাথায়।
নদীতীরের ওপারে থাকে থাকে পাহাড় উঠেছে – প্রথম সারির পাহাড় নিচু, তার পরে আরও উঁচু, তার পেছনে আরও, এমনি করে সবার পেছনে, আকাশের গায়ে আঁকা বরফে ঢাকা এক সারি পাহাড়। একেবারে নিচের পাহাড়ের চুড়োয় একটা ধ্বংসাবশেষ দেখিয়ে সবুজদা বললেন, “ওই দেখুন। কৃপানগড় দুর্গ। এখন ওইটুকুই বাকি রয়েছে।”
কুশল বলল, “দুর্গ তো বিরাট হয়। আপনাদের দেশের দুর্গ আবার বেশ শক্ত পোক্ত। সবই যত্ন করে রাখা। এটার এরকম দুরবস্থা কেন?”
সবুজদা বললেন, “এটা অনেক আগেই নষ্ট হয়ে গেছে। দিঘলাগড়ের দুর্গও নয়-নয় করে প্রায় চার-সাড়ে চারশো বছরের পুরোনো। তখন থেকেই এটা পড়ে আছে। আশি-নব্বই বছর আগে কৃপানগড়ে আগুন লাগে। সমস্ত দুর্গটাই জ্বলে ছাই হয়ে যায়। ওইটুকুই আছে। তার পরেই বোনামপল্লীর লোকে ভয় পেয়ে এখান থেকে চলে গেছে। লোকাল লোকে মানে এই জায়গাটা খারাপ। তাই এখানে কেউ থাকে না। আশেপাশে কোনও ভিলেজ নেই, কোনও বসতি নেই।”
অভীক হেসে বলল, “আচ্ছা লোক আপনি! এমন আনলাকি জায়গায় আমাদের থাকতে বলছেন?”
সবুজদা এত জোরে হাসলেন, যে গাছ থেকে একটা ঘুঘু উড়ে গেল ফটফটিয়ে। বললেন, “আপনারা এসব সুপার্স্টিশনে বিশ্বাস করেন না। নইলে আনতাম না। তবে আপনারা যে প্যাঁচার ডাকের রেকর্ডিং এনেছেন – তা আমি নিজের শুনেছি এই জঙ্গলে। মেন রোড দিয়ে যেতে যেতে, রাতের বেলা। তবে ওখানে তো টেন্ট লাগাবার জায়গা নেই, তাই এলাম নদীর ধারে। যে দু’ দিন পিকুলদাঁড়িতে থাকবেন ভেবেছিলেন, এখানে থাকুন। ভালো লাগবে। ফুড নিয়ে ভাববেন না, আমি পাঠিয়ে দেব। দু’ দিন পরে আমার গাড়িতেই চলে যাবেন দিঘলাগড়।”
টেন্ট খাটিয়ে, লোকজন দিয়ে শুকনো কাঠকুটো জোগাড় করে দিয়ে, ওদের সঙ্গে দ্বিপ্রাহরিক ভোজন সেরে সদলবলে চলে গেলেন সবুজদা। যাবার সময় টিফিন-ক্যারিয়ার ভর্তি খাবার দিলেন রাতের জন্য। বললেন, “জঙ্গলে আগুন জ্বালেন না, তবু ফায়ারউড থাক। কখন কী হয়। খাবারটাও থাক, প্যাক্ড্ ফুড খেয়ে খেয়ে চলে নাকি মশাই! বলেছি, আপনারা আমার গেস্ট! সকালে আমার লোক আসবে ব্রেকফাস্ট নিয়ে। গুডলাক!”
সবুজদা চলে যাবার পরে জঙ্গলটা ঝিমিয়ে পড়ল। সূর্য আকাশের মাঝখানে। পাহাড়ে শীত শেষ হয়নি, রোদ্দুরে থাকলেও জ্যাকেট পরতে হয়। বিকেল হবার আগেই সব সরঞ্জাম গুছিয়ে নিল ওরা। অন্ধকারে দেখার বাইনোকুলার, ক্যামেরা, স্ট্যান্ড – এবং, প্যাঁচার ডাক রেকর্ড করার জন্য সাউন্ড রেকর্ডিং-এর যন্ত্রপাতি, লম্বা মাইক্রোফোন, সব সাজিয়ে নিল হাতের কাছে।
থমথমে জঙ্গলে দুজনে বসে। নদীর ওপারে পাহাড়ের মাথায় জঙ্গল থেকে মাথা উঁচিয়ে আছে দুর্গের ভাঙা মিনার। কুশল নদীর দিকে পেছন করে বসল। বলল, “অস্বস্তি হচ্ছে। একটা দুর্গ পুরোটা জ্বলে শেষ হয়ে গেল, ওইটুকু রয়ে গেল, তা হয় নাকি?”
নদীর দিকে পেছন করে বসলেও মজা কম। তাই দুজনেই নদীকে পাশে রেখে ফোল্ডিং চেয়ার ঘুরিয়ে মুখোমুখি বসল।
পাহাড়ে সন্ধে নামে হঠাৎ। এই জ্বলজ্বল করছে সূর্য, এই সূর্য পাহাড়ের ওপারে চলে গেল। ওমনি নিচের উপত্যকায় ছায়া এসে পড়ল। দেখতে দেখতে ঘনিয়ে এল অন্ধকার। এই জঙ্গলে হিংস্র জন্তু নেই বললেই চলে। একমাত্র পাহাড়ি চিতাবাঘ বরফের রাজ্যে থাকে। ক্রমে সূর্যের অভাব চোখে সয়ে গেল। আকাশ ছেয়ে গেছে তারায়। ফোল্ডিং চেয়ার আরও এলিয়ে দিয়ে দুজনে দৃষ্টি মেলে দিল আকাশের দিকে।
চারিদিক ঝিমঝিম করছে অন্ধকারে, রাতের জঙ্গল থেকে তারস্বরে চেঁচাচ্ছে ঝিঁঝিঁপোকা, দুই বন্ধু মৃদুস্বরে কথা বলছে, দূর থেকে কখনও ভেসে আসছে রাতচরা পাখির ডাক। কিন্তু সেই প্যাঁচা কোথায়, যার সন্ধানে আসা?
প্যাঁচার খোঁজে আসা, তাই বেশি রাত অবধি অপেক্ষা করা উচিত। দুই বন্ধু জেগেই রইল। অন্ধকারে।
মাঝরাতের কাছাকাছি তীব্র কর্কশ ডাকে চমকে উঠল দুজনে। ছোঁ মেরে মাইক্রোফোন হাতে নিয়ে তৈরি হয়ে রইল অভীক। আরও তিন বার ডাক এল, ওদের যন্ত্রবন্দী হয়ে রইল দুর্লভ প্যাঁচার কণ্ঠস্বর, যে ডাক শুনে রাতের বেলা ভীত গ্রামবাসীরা ভাবত পেত্নী এসেছে।
ক্যামেরা হাতে এদিক ওদিক ঘুরে এল দুজনে। কিন্তু দেখা দিল না পাখি। মাঝরাতের পরে উঁচু পাহাড়ের মাথার ওপরে আকাশটা উজ্জ্বল হয়ে উঠল। পুব আকাশে চাঁদ উঠেছে। পাহাড় পেরিয়ে মাঝ-আকাশে আসতে এখনও কিছু দেরি।
“আর অপেক্ষা করবি?” জিজ্ঞেস করল অভীক। কুশল মাথা নেড়ে বলল, “নাঃ,। শুয়ে পড়ি। কাল সকালে একবার ওই দুর্গে যাব। কিছু একটা টানছে। মনে হচ্ছে ইন্টারেস্টিং কিছু পাব।”
অভিক হেসে বলল, “গুপ্তধন?”
মাথা নেড়ে কুশল বলল, “না। চামচিকে বা বাদুড় জাতীয় কিছু ভাবছি।”
ব্যাটারি চালিত রিচার্জেব্ল লণ্ঠন বের করে দুজনে খেতে বসল। সামান্য আলোও জঙ্গলে অনেক। কিন্তু চার পাশে আলোর বৃত্তের বাইরেটা অদৃশ্য হয়ে গেল অন্ধকারে। নদীর কলকল শোনা গেলেও তার অস্পষ্ট সাদা ফেনাতোলা স্রোত আর দেখা যায় না, আর মাথার ওপরে ঝুঁকে পড়া গাছের পাতা কটার বাইরে আর সবই গাঢ় আঁধার।
অভীক লক্ষ করল কুশল খানিক পরে পরে যেন অন্যমনস্ক হয়ে যাচ্ছে। বলল, “কী হয়েছে?”
কুশল বলল, “কিছু শুনতে পাচ্ছিস?”
শুনতে? কী শুনবে? রাতের জঙ্গলের আওয়াজ মানে তো ঝিঁঝিঁপোকা আর…
হঠাৎ অভীকের খেয়াল হলো, জঙ্গলটা একেবারে নিস্তব্ধ। কোনও শব্দ নেই। কান-ফাটানো ঝিঁঝিঁপোকার ডাক কখন থেমে গেছে।
জিজ্ঞেস করল, “রাত বাড়লে ঝিঁঝিঁপোকা চুপ করে যায়?”
কুশল মাথা নাড়ল। চাপা গলায় বলল, “আস্তে করে বাঁ হাতে তোর টর্চটা নে তো।”
দুজনেরই হাতের কাছে টর্চ আছে। আস্তে আস্তে টর্চটা তুলে নিয়ে অভীক বলল, “কোনদিকে কী দেখব?”
কুশল তেমনই চাপা গলায় বলল, “আমার পেছন দিকে সরাসরি জ্বালা তো? মনে হচ্ছে কী যেন দাঁড়িয়ে আছে।”
অবাক হল অভীক, কিন্তু কুশল চিরকালই ঠাণ্ডা মাথা ছেলে। চট করে কিছুতে ভয় পায় না। তাই দ্বিরুক্তি না করে টর্চটা জ্বালাল। কিছু নেই।
কুশলও পেছনে ঘুরেছিল। বলল, “খালি মনে হচ্ছে পেছনে কি আছে।”
দুজনে আবার খাওয়ায় মন দিল। কিন্তু কুশলের অস্বস্তি কাটে না। খালি ঘুরে দেখে। একবার নিজের টর্চ জ্বালাল অভীকের পেছনের জঙ্গলের দিকে। কিছুই নেই।
অভীক খাওয়া শেষ করে থালা ধুয়ে নিল নদীর জলে। বলল, “চ’, শুয়ে পড়ি। রাত অনেক হয়েছে।”
কুশল মাথা নাড়ল। না। কিছু বলল না।
অভীক বলল, “কুশল, এখন রাত একটা বেজে গেছে। এখন ঘুমিয়ে না পড়লে আর সকালে উঠে দুর্গ দেখা যাবে না।”
কুশল বলল, “দুর্গ দেখতে হবে না। কাল সকালে এখান থেকে পালাব। অনেক হয়েছে।”
অভীক অবাক, অনেক দিন কুশলের সঙ্গে জঙ্গলে ঘুরেছে। এই রূপ দেখেনি কখনও। বলল, “আচ্ছা বেশ, কিন্তু টেন্টে ঢুকে বস। ফোল্ডিং চেয়ারটা ঢুকিয়ে নে।” মনে মনে ভাবল, “আমি স্লিপিং ব্যাগে ঢুকলে আর বসে থাকতে ইচ্ছে করবে না।”
কুশল চেয়ারটা টেন্টের মধ্যে নিয়ে এল, কিন্তু অভীকের ঘুম আসা অবধি চেয়ার ছেড়ে নড়ল না। অমনিই বসে রইল বাইরের দিকে চেয়ে।
৩
রাত তখন কটা খেয়াল নেই, কুশলের আলতো টোকায় ঘুম ভাঙল অভীকের। নিঃশব্দে উঠে বসল অভীক।
বাইরে অস্পষ্ট পায়ের শব্দ।
আলো নিভিয়ে শুতে গেছিল। তাঁবুর ভেতরে অন্ধকার। বাইরে আলো বেড়েছে। আধখানা চাঁদ পুবের পাহাড় টপকে দেখা দিয়েছে নিশ্চয়ই। রাত প্রায় চারটে। ভোর হতে দেরি নেই। রাতের সঙ্গে শিতও বেড়েছে। বাইরে নদীর জল থেকে অল্প বাষ্প উঠে কুয়াশার মতো ছেয়ে গেছে। তাঁবুর ফ্ল্যাপ নামায়নি কুশল। বাইরেটা যতটুকু দেখা যাচ্ছে কেউ নেই।
যথাসম্ভব নিঃশব্দে অভীক সোয়েটার পরে নিল, মাথায় দিল উলের টুপি। টর্চ নিয়ে হামা দিয়ে দুজনে তাঁবুর দরজার কাছে গেল। বাইরে, ঝকঝকে চাঁদের আলোয়, ওদের ফায়ারউডের স্তুপের কাছে ঘুরছে একটা বাচ্চা ছেলে!
অব্যক্ত একটা চুক্তির মতো দুজনে একসঙ্গে টর্চ জ্বালাল। হঠাৎ গায়ে আলো পড়তে ছেলেটা চমকাল না মোটেই। বরং আস্তে আস্তে ঘুরে দাঁড়িয়ে একটু হাসল।
অভীক এ দেশের ভাষা ভালোই বলে। তাই ও-ই বলল, “কে তুমি? এত রাতে এখানে কী করছ?”
ছেলেটা উত্তর দিল না। উলটে প্রশ্ন করল, “তোমরা কে? এখানে এসেছ কেন?”
কুশল আস্তে আস্তে বলল, “সবুজদা বলল যে, এখানে কোনও গ্রাম নেই, তাহলে এই ছেলেটা এখানে এল কী করে?”
অভীক টর্চ নিভিয়ে বাইরে বেরিয়ে উঠে দাঁড়াল। আবার টর্চ জ্বালিয়ে ছেলেটার পায়ের কাছে ফেলল যাতে চোখে আলো না পড়ে। এবার আর একটা জিনিস বোঝা গেল। ছেলেটা বৌদ্ধ ভিক্ষু। অভীক বলল, “তুমি বৌদ্ধ ভিক্ষু? শ্রামনেরা? এখানে কোথায় তোমার গুম্ফা?”
ছেলেটাও দু’পা ওদের দিকে এগিয়ে এল। বলল, “গুম্ফা এখানে না।”
ছেলেটার পা খালি। পাহাড়ে ঠাণ্ডার জন্য গরিবরাও জুতো পরে। কুশল বলল, “তোমার জুতো নেই?”
ছেলেটা বলল, “খুলে পড়ে গেছে। তোমরা এখানে কী করছ?”
অভীক বলল, “আমরা পাখি খুঁজতে এসেছি। প্যাঁচা। এখানে কোনও ভয়ানক প্যাঁচার ডাক শুনেছ? শুনতে লাগে যেন পেত্নি চেঁচাচ্ছে? আমরা কাল সন্ধেবেলা শুনেছি। দেখিনি।”
কুশল অভীককে থামিয়ে দিয়ে আবার জিগেস করল, “তুমি কি এর আগেও এখানে এসেছিলে? আমরা যখন খাচ্ছিলাম?”
ছেলেটা কুশলের দিকে তাকিয়ে বলল, “আমি তো এখানেই থাকি – সবসময়।”
“এখানে? এই জঙ্গলে?”
নদীর ওপারের পাহাড়ের দিকে আঙুল তুলে বলল, “না, ওই ওখানে।”
অভীক বলল, “ওই দুর্গের ধ্বংসের মধ্যে? ওখানে কী করে থাক? আর কে থাকে?”
মাথা নাড়ল ছেলেটা। “কেউ না। আমি একা।”
ইয়ার্কি মারছে। ওরা আবার তাকাল নদীর ওপারে। ভোরের আলো ফুটতে শুরু করেছে পুবের আকাশে, কিন্তু নদীর গিরিখাত এখনও অন্ধকারে ঢাকা। কৃপানগড়ের ধ্বংসাবশেষ প্রায় দেখাই যায় না।
অভীকের হঠাৎ কী মনে হল, বলল, “চলো, তোমার সঙ্গে তোমার থাকার জায়গা দেখে আসি।”
কুশল আঁৎকে উঠল। একবার বলতে গেল, “না,” কিন্তু অভীকের মাথায় কিছু ঢুকলে আর সেটা বেরোয় না। ছেলেটাকে বলল, “এক মিনিট। দাঁড়াও,” বলে তাঁবুতে ঢুকে গেল। বাধ্য হয়ে কুশলও গেল পিছু পিছু। বলল, “তুই এই অন্ধকারে ওই ছেলেটার পেছনে পেছনে কোথায় যাবি?”
“অন্ধকারে যাব না,” বলল অভীক। “তৈরি হয়ে বেরোতে বেরোতে আলো ফুটবে আরও।”
“তাই বলে, কথা নেই, বার্তা নেই, একটা ছেলের সঙ্গে বেরিয়ে…”
এবার অভীকের একটু রাগই দেখা গেল। “তোর ব্যাপারটা কী বলতো? কাল রাত থেকে কী হয়েছে তোর? এই একটা বাচ্চা ছেলে, তায় বৌদ্ধ ভিক্ষু – ট্রেইনি। নিপাট ভালোমানুষের দেশে নিপাট ভালো ধর্মের শিক্ষানবিশী – তাকেও ভয় পাচ্ছিস?”
কথাটা ঠিক। দেশটাই ভালো। চুরি ডাকাতি ছিনতাই হয় না। তার ওপর…
কুশল বলল, “তবু… সবুজদা কিন্তু বলেছিল এখানে কোনও গ্রাম টাম নেই।”
“গ্রাম নেই, মনাস্টেরি আছে নিশ্চয়ই কাছেপিঠে। আচ্ছা, ঠিক আছে। তোর যদি অস্বস্তি হয়, তাহলে তুই এখানে থাক। আমি ঘুরে আসি।”
এ কথার পরে আর থাকা যায় না। কুশলও তৈরি হয়ে নিল। ক্যামেরা, সাউন্ড রেকর্ডার, ইত্যাদি নিয়ে তৈরি হতে সময় লাগে, তার পরে টেন্ট গোছাতে হল। স্লিপিং ব্যাগ ছড়িয়ে রেখে বেরোনো ক্যাম্পিঙের নিয়মে বারণ। বাইরে বেরিয়ে অভীক বলল, “কই গেল ছেলেটা?”
বাইরে আলো বেড়েছে। ভোরও বলা যাবে না, ঊষা। কিন্তু ছেলেটা কই? নামটাও জিজ্ঞেস করা হয়নি। অভীক একটু গলা তুলে বলল, “এই ছেলে… লামা, আছো?”
ছেলেটা নেই।
কুশল বলল, “ভেগেছে। চ’ আমরাই ঘুরে আসি। যাব তো ঠিকই করেছিস।”
দুজনে নদীর পাড়ে গিয়ে দেখতে থাকল কোথায় পার হওয়া যায়। নদীতে জল বেশি নেই, কিন্তু খরস্রোতা। নিচে পাথর। ঠিক মতো পা না পড়লে, বা পিছলে গেলে সমস্যা হতে পারে। তাই যদি জলের ওপরেই শুকনো পাথরে পা রেখে রেখে পার হওয়া যায়, তাহলে ভালো।
কুশল নদীর উজানে এগোল, অভীক গেল স্রোত বরাবর।
কুশলের সঙ্গেই দেখা হল। একটা বড়ো পাথরের আড়াল থেকে বেরিয়ে এসে বলল, “এখানে নদী পেরোতে পারবে। এসো। তোমার বন্ধুকে ডাকো।”
দুজনে সাবধানে নদী পেরোল। গোল পাথরে পা হড়কানোর সম্ভাবনা আছে, তার ওপরে হাতে ভারি ভারি যন্ত্রপাতি। ওপারে দাঁড়িয়ে আছে ছেলেটা। কুশল বলল, “আরে, ও কখন পেরোল?”
অভীক বলল, “অন্য পাথরে পা রেখে পেরিয়েছে। আমরা হয়ত তখন দেখছিলাম না।” তার পরে ছেলেটাকে বলল, “চলো, কোন দিক দিয়ে যাব?”
ছেলেটা এগিয়ে গেল, দুজনে চলল ওর পেছনে।
নদীর ওপারে জঙ্গল ঘন। চলার পথ নেই বললেই চলে। ছেলেটা ছুটে ছুটে আগে আগে যাচ্ছে, পেছনে ওরা দুজন। পাহাড়টা খুব উঁচু না, কিন্তু খাড়া। ভারি ক্যামেরার ব্যাগ আর রেকর্ডিং-এর যন্ত্রপাতি নিয়ে চলা কঠিন।
দুর্গের ভাঙা অংশটায় পৌঁছে পেছনে তাকিয়ে মন ভরে গেল। অল্প আলোয় নিচে নদী ছুটে চলেছে, সামনের পাহাড় এবারে স্বচ্ছ হচ্ছে ধীরে ধীরে। দুর্গের প্রাচীরের যে টুকরোটা নদীর ওপার থেকেও দেখা যায়, তার দেওয়াল ভাঙা, কিন্তু ঘুরে অন্য দিক দিয়ে ঢুকতে হবে। কিন্তু তার চার দিকে আর কিছুই বাকি নেই। এমনকি দুর্গের প্রাচীর এই অংশর কোন দিক থেকে এসে কোন দিকে গিয়েছিল, ডাইনে না বাঁয়ে, সামনে না পেছনে, তা-ও বোঝার যো নেই।
কুশল আবার বলল, “বাকি আর কিছুই রইল না, কোনও চিহ্নটুকুও না, অথচ এই অংশটা রয়ে গেল, অদ্ভুত না?”
কিছু ভাবার সময় পাওয়া গেল না, ছেলেটা বেরিয়ে এল আবার, ঠোঁটে আঙুল দিয়ে চুপ করতে বলে ওদের হাতছানি দিয়ে ডাকল। সাবধানে ওর পেছনে পেছনে গিয়ে দুজনে ভাঙা দেওয়াল পার করে ঢুকল মিনারের মধ্যে। এই অংশটা দুর্গের উঁচু প্রহরা কেন্দ্র। বড়ো ঘরের মতো এর আকার আকৃতি। এক সময়ে এর ভেতর থেকে প্রহরীরা নজর রাখত বাইরের দিকে। ওপর দিকে যে ছোটো ছোটো জানলা ছিল, সেগুলো আর প্রায় নেই। দেওয়াল থেকে যে পাথরের টুকরোগুলো বেরিয়ে থাকত – প্রহরীদের ওপরে ওঠার সিঁড়ি – সেগুলোও আর বেশি বাকি নেই। ছেলেটা আঙুল তুলে অনেক ওপরে ওই রকম একটা পাথরের টুকরো দেখাল। বলল, “তোমরা যে প্যাঁচা খুজছ, সে ওই পাথরটার ওপরে বাসা করে আছে।”
উত্তেজিত কুশল আর অভীক অনেক চেষ্টা করেও ভালো করে দেখতে পেল না। বাসা একটা আছে। তাতে কোনও পাখির নড়াচড়াও দেখা গেল। ওদের চলাফেরাতেই বিরক্ত হয়ে পাখিটা বেরিয়ে এসে উড়ে গিয়ে বসল মিনারের দেওয়ালের ওপরে। নিঃসন্দেহে ওদের কাঙ্খিত প্যাঁচা। দু’চারটে ছবি উঠল। তার পরে উড়ে চলে গেল।
কুশল ব্যস্ত হয়ে ছেলেটাকে বলল, “এখান থেকে বেরিয়ে চলো। ও আমাদের আসায় বিরক্ত হয়েছে। বাসা ছেড়ে চলে যেতে পারে।”
ছেলেটা একটু ম্লান হেসে বলল, “তোমরা যাও। ও আমাকে দেখে বিরক্ত হয় না। তা ছাড়া আমি আর যাব কোথায়? আমি তো এখানেই থাকি।”
চারিদিকে চেয়ে অভীক বলল, “এখানে থাক? কী করে? এখানে তো কিচ্ছু নেই। শোও কোথায়? খাও কী?”
কুশল বলল, “তোমার সঙ্গের অন্য লোকজন কোথায়? তোমার গুম্ফা কোথায়?”
ছেলেটা বলল, “আমি একাই থাকি। আমার সঙ্গে কেউ নেই। আমার গুম্ফা ছিল উদ্রানগরে। সে অনেক দিন আগের কথা।”
কুশল চমকে বলল, “উদ্রানগর! সে তো অনেক দূর! সেখানকার গুম্ফা তো বিখ্যাত! সেখান থেকে তুমি এখানে এলে কেন? একাই এলে?”
ছেলেটা একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলল, “সে অনেক দিন আগের কথা। আমার বাবা-মার অনেকগুলো বাচ্চা, তাদের সবাইকে খেতে দিতে পারে না বলে আমাকে পাঠিয়েছিল উদ্রানগরের গুম্ফায়। লামা হতে। সে খুব কঠিন। বড়ো লামারা খেতে দিত না, মারত খুব। অনেকে পালিয়ে যেত। তারা কেউ ফিরে যেত নিজেদের গ্রামে, কেউ রাস্তায় মরে যেত। আমাকে একবার শাস্তি দিয়েছিল। আমি রাত্তিরে পালিয়ে গেছিলাম। পরদিন সকালে আমার সঙ্গে দেখা হল একজন লোকের সঙ্গে। লোকটা আমাকে বলল আমার সঙ্গে এসো, আমি তোমাকে বাড়ি নিয়ে যাব।
“ওর সঙ্গে এলাম এখানে। তখন এখানে দুর্গ ছিল না। কেবল ন্যাড়া পাহাড়। পাহাড়ের মাথায় রাজা দুর্গ বানাচ্ছে। লোকটা আমাকে মেরে মাটির গর্তে ফেলে দিল। ওইখানে।” বলে ছেলেটা মিনারের কোনার দিকে আঙুল দেখাল। বলল, “তার পরে এখানে দুর্গ তৈরি হল। রাজা নাম দিলেন কৃপানগড়। আর দুর্গ যে বানিয়েছিল, বোনামকৃষ্ণ গাথানি, তার নামে পল্লী বানালেন। বোনামপল্লী। তবে টিঁকল না। এখানে রাজা এক দিনও শান্তি পাননি। লোকে বলত ভূত আছে। অনেকেই দেখেছিল আমি রাতের বেলায় পথে পথে, এমনকি লোকের বাড়িতেও ঘুরে বেড়াই। শেষে রাজা যখন কানাঘুষোয় জানতে পারলেন যে এই দুর্গ বানাতে একটা বাচ্চা ছেলেকে মারা হয়েছিল, তখন বোনামকৃষ্ণকে ডেকে সব কথা জানলেন। বললেন অন্য দুর্গ বানাতে হবে। এই দুর্গ অভিশপ্ত। রাজার আদেশে বোনামকৃষ্ণ আর এদেশে বাড়ি বানাবার অনুমতি পায়নি। তবে এই দুর্গ ছিল অনেক দিন, অনেক বছর। শেষে একদিন রাজা অন্য কোথায় চলে গেলেন। আমি একা হয়ে গেলাম। রাতে আমি বোনামপল্লীতে ঘুরে বেড়াতাম। লোকে ভয় পেত। কেন জানি না। আমি তো কারো কিছু করিনি কখনও। শেষে যখন একদিন বাজ পড়ে দুর্গে আগুন লাগল, দেখতে দেখতে তিন দিন তিন রাতে দুর্গ পুড়ে ছাই হয়ে গেল, তখন কেবল এই মিনারটা রয়ে গেল। আর নদীর এপারে ওপারে বোনামপল্লীর সব লোক পালিয়ে গেল। আমি একা হয়ে গেলাম। রাতে জঙ্গলে ঘুরে বেড়াই, আর দিনে ঘুমিয়ে থাকি – ওখানে।” ছেলেটা আবার আঙুল দিয়ে দেখাল মিনারের মাটি।
তার পরে বলল, “এখন সূর্য উঠছে। আমাকে যেতে হবে। তোমরা থাকবে এখন এখানে? তোমাদের কাপড়ের বাড়িতে? তাহলে তোমাদের সঙ্গে রাতে কথা বলব। কেউ তো নেই, তাই কারোর সঙ্গে কথা বলতে পারি না…”
এতক্ষণ ওদের কথা বেরোচ্ছিল না। ছেলেটা থামার পর হা হা করে হেসে উঠল অভীক। কাঁধ থেকে ভারি ব্যাগ নামিয়ে মাটিতে রাখতে রাখতে বলল, “ভাল গল্প বলেছিস, ছেলে! দারুণ! এবার চল, তোর বাড়িটা কোথায় দেখে আসি।”
বলে মুখ তুলে দেখল কুশল হাঁ করে ছেলেটার দিকে দেখছে। অভীক কুশলের দৃষ্টি অনুসরন করে দেখল ছেলেটা কেমন আস্তে আস্তে মাটির নিচে ঢুকে গেল। বুক অবধি গিয়ে হাত তুলে বলল, “রাতে আসব।” তার পরে সবটাই চলে গেল মাটির নিচে।
জ্ঞান হারিয়ে অভীক পড়ে গেল মাটিতে। ভাগ্যিস মাইক্রোফোনটা ব্যাগের ওপরেই পড়েছিল, নইলে ভেঙেই যেত।
৪
সে এক সমস্যা। দুটো ভারি ব্যাগ, আর একটা অজ্ঞান মানুষ। কুশল একে একে খানিকটা নামে একবার দুটো ব্যাগ নিয়ে, তারপরে অভীককে ধরে ধরে, হিঁচড়ে, এমনকি পাঁজাকোলা করেও। আধঘণ্টায় যে পাহাড় চড়েছিল, নামতে লাগল প্রায় দু’ঘণ্টা। সকাল হয়ে গেছে। নদীর পাড়ে এসে কুশল ঠাণ্ডা জলের ঝাপটা দিয়ে অভীকের জ্ঞান ফেরাল। চোখ খুলেই অভীক বলল, “ক্যামেরাটা?” তার পরে উঠে বসে বলল, “ইশ, প্যান্টটার কী দশা করেছিস! আমাকে টেনে টেনে এনেছিস নাকি?”
কুশল রেগে বলল, “ইয়ার্কি! একটা বাচ্চা ছেলে দেখে অজ্ঞান হয়ে গেলি, তার আগে অবধি আমাকে বলছিলি – তোর কী হয়েছে বল দেখি?”
অভীকের খেয়াল হল। আবার তাকাল পাহাড়ের মাথায় দুর্গের দিকে। বলল, “ছেলেটা তাহলে সত্যিই ভূত!”
“ভূত তো বটেই। কিন্তু একটা বাচ্চা ছেলে ভূত,” বলল কুশল।
“তুই ভূত বিশ্বাস করিস?” অবাক হয়ে বলল অভীক।
কুশল হেসে বলল, “তুই করিস না?”
সজোরে ডাইনে বাঁয়ে মাথা নাড়তে গিয়ে থেমে গেল অভীক। নির্বাক চেয়ে রইল কুশলের দিকে। আর তখনই নদীর ওপারে, যেদিকে ওদের তাঁবু, সে দিক থেকে শব্দ পাওয়া গেল জিপের। জঙ্গলের মধ্যে থেকে আসছে।
“চ’, সবুজদা না আসলেও লোক পাঠিয়েছে, যেমন বলেছিল। নিজে নিজে নদী পেরোতে পারবি, না কি কোলে করে নিয়ে যেতে হবে।”
অভীক উঠে দাঁড়িয়ে বলল, “পারব। চল। ওপারে গিয়ে আগে প্যান্টটা চেঞ্জ তো করি।”
নদী পেরোতে পেরোতে কুশল বলল, “আমি কিন্তু আজ রাতে এখানে আর থাকব না। দীঘলাগড় রওয়ানা দেব। এই ভূতের রাজ্যে আমি আর থাকতে রাজি নই।”
অভীক বলল, “দরকারও নেই। আমাদের যা খোঁজার ছিল তা যে এখানে আছে তাও জেনে গেছি, বাসা করে তাও জানলাম। সুতরাং এখানে আর থাকার দরকার নেই।”
রেঞ্জ অফিসারের অ্যাসিস্ট্যান্ট দাওয়াং সেরিং যখন এসে পৌঁছলেন, তখন কুশল গোছগাছ করছে, আর অভীক টেন্টের ভেতরে। কুশল বলল, “আমাদের কাজ মিটে গেছে সেরিং-জী, পাখি এখানে পেয়েছি। কল রেকর্ড করেছি, ছবি পেয়েছি। নেস্ট করে তাও জানি। এখন আমরা যাব। আজই রওয়ানা দেব দীঘলাগড়।”
সেরিং গাড়ি থেকে ওদের জন্য টিফিন ক্যারিয়ার নামাচ্ছিলেন। থতমত খেয়ে বললেন, “আজই যাবেন? স্যার যে আমাকে বললেন কাল আপনাদের সঙ্গে মোলাকাত করতে আসবেন…”
তাঁবুর দরজা খুলে বেরিয়ে অভীক দু হাতের দুটো ব্যাগ নামিয়ে বলল, “টেন্ট খালি করে দিয়েছি, খেয়ে নিয়ে টেন্ট তুলে নেব, কেমন?”
সেরিং বললেন, “সে আমার লোক করবে, কিন্তু আপনারা চলে যাবেন? গাথানি স্যার খুব দুখ্ পাবেন। আমাকে বললেন বলতে…”
অভীক এগিয়ে এসে ক্যামেরা চালিয়ে বলল, “এই যে, সবুজদাকে বলবেন, পাখি পেয়েছি। ফিরে গিয়ে ই-মেইল করে পাঠাব।”
উৎসাহিত হয়ে সেরিং বললেন, “গাথানি স্যার খুব খুশ হবেন। কাল থেকে অনেক বার বলেছেন, হামার রেঞ্জে প্যাঁচা মিলবেই।” তারপরে চমকে গিয়ে বললেন, “এ কোথাকার ছবি?” হাত তুলে দুর্গ দেখিয়ে বললেন, “ওখানে?”
অভীক বলল, “হ্যাঁ। ভোরে গিয়েছিলাম।”
সেরিং কী বলতে গিয়ে থেমে গেলেন। কুশল সেরিং-এর হাত থেকে টিফিন ক্যারিয়ার নিয়ে বলল, “এটা ব্রেক-ফাস্ট? খিদে পেয়েছে।”
প্লেটে করে আলু পরোটা আর চাটনি নিয়ে দুজনে বসল, জোর করে সেরিং-এর হাতেও ধরিয়ে দেওয়া হল এক প্লেট।
কুশল জানতে চাইল, “আচ্ছা, গাথানি কোথাকার নাম? এ নাম তো আপনাদের দেশের না?”
মুখে পরোটা ভরে মাথা নাড়লেন সেরিং। বললেন, “ও আমাদের দেশের নাম না, ওরা এক সময়ে আমাদের দেশের লোক ছিল না। সে অনেক দিন আগের কথা, এই যে দেখছেন, কৃপানগড়, এই গড় বানানোর সময় রাজা দক্ষিণের দেশ থেকে কারিগর আনিয়েছিলেন। ওরা পাথরে গাঁথনির কাজ জানত। এই গাঁথনি থেকেই গাথানি নাম হয়েছে। যে লোক প্রথম এসেছিল, তার নাম ছিল বোনামকৃষ্ণ। ওর নামেই বোনামপল্লী নাম হয়েছিল। কিন্তু বোনামকৃষ্ণ ওদের দেশের এক ভয়াবহ কাণ্ড এখানে করেছিল। দুর্গ তৈরির আগে দুর্গের ভিতে একটা বাচ্চা ছেলেকে ধরে এনে বলি দিয়েছিল রাতের অন্ধকারে। সে ছেলে কে কেউ জানে না। কত শো বছর আগের কথা – কিন্তু লোকে বলে ওই জন্যই এই দুর্গ অভিশপ্ত। অনেকে বলত সে ছেলেকে নাকি দুর্গের আশেপাশে দেখা যেত। রাজা জানতে পেরে বোনামকৃষ্ণকে নির্বাসন দেন। ততোদিনে সে বড়োলোক হয়ে গেছে। তাই রাজার রাজত্ব ছেড়ে কিছুদিনের জন্য চলে গেলেও বেশি দূর যায়নি। ক্রমে লোকে সে কথা ভুলেও গেছে। তবে গাথানি নাম সত্ত্বেও ওরা কেউ আর বাড়ি বানায় না। সে ব্যবসা ওদের বোনামকৃষ্ণর সঙ্গেই শেষ হয়ে গেছে। বোনামপল্লী যে ওর পূর্বপুরুষের নামে তৈরি সে কথা গাথানি স্যার কাউকে বলে না। আপনারা বলবেন না, আমি বলেছি।”
ওরা সেদিনই গাথানির রেঞ্জ ছেড়ে চলে গিয়েছিল। এর পরে দিঘলাগড়ের আশেপাশে অনেক প্যাঁচা পাওয়া গেছিল বলে পরে ওরা আর বোনামপল্লী ফেরেনি। সবুজসুন্দর গাথানির সঙ্গেও আর দেখা হয়নি কোনও দিন।