২১.০৯.২০২৪
৭৯. কালীঘাট থেকে ফিরে জুনিয়র ডাক্তারদের নেতৃত্ব জানিয়েছিল পরিবহর মতো আরেকবার মাথায় হাত বুলিয়ে আন্দোলন শেষ করার চেষ্টা মানা হবেনা। তারা ডাক দিয়েছিল আরেক নাগরিক মিছিলের- সেন্ট্রাল পার্ক থেকে স্বাস্থ্য ভবন। একে বৃষ্টিবিঘ্নিত দিন, তাও মাত্র ঘন্টা কুড়ি আগে ঘোষণা, তার উপর শহরের বিভিন্ন অঞ্চলে ইতিপূর্বে নির্ধারিত কিছু গণমিছিল- সব মিলিয়ে আশা করা হয়েছিল খুব বেশি লোকজন হয়তো হবেনা।
করুণাময়ীতে মানববন্ধনের সময়ই অবশ্য এই থিওরি ভুল প্রমাণ হয়ে যায়। মানুষের ঢল নামে রাস্তায়- সঠিক সংখ্যা জানা নেই, তবে পনের-কুড়ি হাজার হলে অবাক হওয়ার কিছু নেই। মিছিল যখন স্বাস্থ্যভবনের কাছাকাছি, তখন তার ল্যাজ নবদিগন্ত ফ্লাইওভার পেরিয়ে চলে গেছে। মোড়ের মাথায় দাঁড়িয়ে সকলের উদ্দেশ্যে যে বক্তব্য রাখা হচ্ছে, মিছিলের শেষপ্রান্তে তার বিন্দুমাত্র শোনা যাচ্ছে না। এই মিছিলই প্রমাণ করে দেয় আরো একবার, বাংলা এখনো প্রতিবাদের ভাষা ভোলেনি।
৮০. মানুষের মধ্যে রাগ-ক্ষোভ পরিষ্কার বোঝা যাচ্ছিল। সব চেয়ে আশ্চর্যের বিষয়, মিছিলে ডাক্তারদের উপস্থিতি ১০%-র বেশি কখনোই নয়। তাও স্লোগানের অভাব হয়নি, শাঁখ-উলুধ্বনি উঠেছে মুহূর্মুহু। যেন কলিযুগের অবতার গণদেবতা স্বয়ং জাগ্রত হয়েছেন। নারী-পুরুষের সম্মিলিত কণ্ঠস্বর সেদিন শাসকের হৃদকম্প এনে দেওয়ার জন্য যথেষ্ট।
অথচ এত কিছু হওয়ার ছিল না। একটা হত্যা হয়েছে, প্রশাসন প্রশাসনের মতো কাজ করতো, অপরাধী চিহ্নিত করতো। তা না করে মিথ্যার উপর মিথ্যা চাপিয়ে মিথ্যার পাহাড় গড়ে তুলেছে প্রশাসন। তারপর বলেছে, একমাস হয়ে গেছে, এবার উৎসবে মেতে উঠুন। এই রাগটা এই অন্যায়ের বিরুদ্ধেই, এই অসংবেদনশীলতার বিরুদ্ধেই। একজন খুনিকে আড়াল করতে গিয়ে এইভাবে নিজের জালে নিজেই জড়িয়ে পড়া- এটা নির্ঘাত ষড়যন্ত্রই- রাম্বামের নয়, বিধাতার।
৮১. একদিকে যখন বাংলার বুকে জনজাগরণের ঢেউ উঠছে, তখন জুনিয়র ডাক্তারদের একটা অংশ রাজধানী দিল্লিতে গেছে। যে আরডিএ-গুলো সুপ্রিম কোর্টের প্রতিশ্রুতিতে আন্দোলন তুলে নিয়েছিল, তাদের বর্তমান অবস্থা সম্বন্ধে অবগত করতে এবং শীর্ষ আদালতে কপিলবাবুর সামনে খাপ খুলতে না পারা গীতা লুথরা ম্যাডামের বিকল্পের সন্ধানে। ন্যাশনাল মিডিয়ায় প্রেস মিট হয় এবং পশ্চিমবঙ্গের বর্তমান স্বাস্থ্যব্যবস্থার খতিয়ান তুলে ধরা হয় সেখানে, দিল্লির সমস্ত কলেজের প্রতিনিধিদের নিয়ে। সিনিয়র ডাক্তারেরাও যান নিজেদের বক্তব্য রাখতে। কীভাবে পশ্চিমবঙ্গ সরকার একটা প্রাতিষ্ঠানিক হত্যাকে ধামাচাপা দিচ্ছে এবং কীভাবে তাদের তত্ত্বাবধানে স্বাস্থ্য ব্যবস্থা বিনামূল্যে চিকিৎসার আড়ালে একটা দুর্নীতির চক্র গড়ে তুলেছে- এই সত্য জাতীয় মঞ্চে জানানো হলো- এটা একটা বিরাট পদক্ষেপ।
অন্যদিকে গীতা ম্যাডামের জায়গায় সিনিয়র অ্যাডভোকেট ইন্দিরা জয়সিং-কে শীর্ষ আদালতে লড়ার জন্য নিয়োগ করা হয়। প্রতিনিধিদল রাষ্ট্রপতির সঙ্গে দেখা করারও পরিকল্পনায় ছিল, বিভিন্ন কারণেই সে ব্যবস্থা কিছু করা যায়নি।
৮২. এদিকে আবার ডাক এসেছে কালীঘাট থেকে- পঞ্চম তথা শেষ বার। খুব পরিকল্পিত ভাবে নবী দিবসের জন্য স্থান হয়েছে আবার কালীঘাট, নবান্ন নয়। এবং শেষবারের রফা অনুযায়ী লাইভ বা ভিডিও কোনো পথেই হাঁটেনি সরকার, শুধু কার্যবিবরণী।
এখন সামনে বিকল্প ছিল দু’টো। মুখ্যমন্ত্রীর আহ্বান প্রত্যাখ্যান করা- কারণ তিনিই স্বাস্থ্যমন্ত্রী ও পুলিশমন্ত্রী এবং দু’টো বিভাগের দু’জন হেফাজতে। সেই পরিপ্রেক্ষিতে ওনার নিজের বিশ্বাসযোগ্যতাই প্রশ্নের মুখে। তার উপর লাইভ আলোচনা এখন গণদাবি!
এতদসত্ত্বেও ডাক্তারেরা আলোচনায় গেছে- জনস্বার্থে- কারণ একটা বৈঠকে না বসলে এই অচলাবস্থা কাটার নয়। যখন প্রশাসনকে উপরে ফেলার কথা আমরা বলছিনা, সহিংসতা বাদ দিয়ে অহিংস উপায়ে দাবি আদায়ের চেষ্টা করছি, সেখানে আলোচনাই একমাত্র গণতান্ত্রিক পথ। তদুপরি বারংবার বৈঠক ভেস্তে যাওয়ার দায়ভার রাজ্য ডাক্তারদের উপরই চাপাবে কোর্টে। তাই অবশেষে হলো বৈঠক- কালীঘাটে- আন্দোলনের সবচেয়ে বড় পয়েন্ট, আবার সবচেয়ে বড় আপোসও।
৮৩. বৈঠক চলেছে ঘন্টা দুই- দু’পক্ষের কার্যবিবরণী মেলানো হয়েছে ঘন্টা তিন- তার নির্যাস যা বেরোলো অনেকটা সাপের ছুঁচো গেলার মতো। প্রথম দাবিতে সরকার জানিয়েছে তাদের কিছু করার নেই, সব সিবিআইয়ের হাতে। দ্বিতীয় দাবিতে তারা ডিএমই ও ডিএইচএস-কে সরিয়ে দিতে রাজি, স্বাস্থ্যসচিবকে একসঙ্গে সরিয়ে দিল স্বাস্থ্য ব্যবস্থা ভেঙে পড়বে, তাই তিনি থাকছেন। যে বিনীত গোয়েলকে ক’দিন আগে অব্দি আসন্ন পুজোর জন্য সরানো যাচ্ছিল না, তাকে সরাতে রাজি হলো সরকার, ডিসি নর্থকেও সরানো হবে প্রতিশ্রুতি দেওয়া হয়। চতুর্থ ও পঞ্চম দাবি নিয়ে দেখাশোনা করার জন্য নির্দিষ্ট কমিটির সাথে আলোচনার নিদান দেওয়া হয়। আশা-নিরাশার দোলাচলে আলোচনা শেষ হয়- এইটুকু আশার আলো নিয়ে যে অন্তত দুর্নীতির মাথায় থাকা মানুষগুলোকে ঘটনার দায়ভার মাথায় নিয়ে সরতে হলো। পরের বার এই কুকীর্তি করার আগে একবার অন্তত তারা ভাববে…
৮৪. কিন্তু আগেই বলেছি শাসকের চামড়া আলাদা ধাতুর তৈরি। সে যারপরনাই নির্লজ্জ ও দু’কানকাটা। এই নব্য ডাক্তারের দল তার ছলনার সামনে নস্যি। মমতা সব দাবি শুনেছেন এবং সেসবেই সম্মতি জানিয়েছেন, যা তাঁর সরকারি দুষ্টচক্রের কাঠামোতে কোনো আঁচড়ই কাটবেনা। তিনি তাঁর দাবার বোড়েগুলোকে এঘর থেকে ওঘরে সরিয়েছেন শুধু। সিপি, ডিসি নর্থ, ডিএমই, ডিএইচএস- কারো বিরুদ্ধেই কোনো বিভাগীয় তদন্ত হয়নি, কোন শাস্তিমূলক ব্যবস্থা হয়নি। ডিএমই তাঁর স্বাস্থ্যভবনের ঘর ছেড়ে পাশের বাড়ি ইনস্টিটিউট অফ হেলথ এন্ড ফ্যামিলি ওয়েলফেয়ারের ঘরে চেয়ার আলো করে বসেছেন। সিপি হয়ে গেলেন স্পেশ্যাল টাস্ক ফোর্সের এডিজি- তাঁর জায়গায় এলেন এককালে মমতার বলা ‘সিপিএমের দালাল’ মনোজ বর্মা। এইরকম কিছু ঘরের আসবাব এদিক ওদিক করে ঘর সাজিয়ে নিলেন মমতা, আবার নতুন করে- বাজারে খবর রটে গেল, দাবি সব মানা হয়ে গেল!!
৮৫. অহংকারী মমতাকে রাস্তায় নামিয়ে আনা এবং তার থেকে অবশেষে এতগুলো পদের আধিকারিকের অপসারণ নিঃসন্দেহে আন্দোলনের একটা বড় প্রাপ্তি। কিন্তু সমাজে এই মানুষগুলোর রদবদলের কোনো প্রভাব পড়বে কি! সেই দুর্নীতিবাজ কিছু দালালই সেই পদে বসবে। যেখানে আসল মাথাই দুর্নীতির ঘাঁটি, সেখানে সততার আশ্বাস খোঁজাই তো প্রহসন মাত্র! একটা অরাজনৈতিক অহিংস আন্দোলন কখনো শাসককে গদি থেকে টেনে নামাতে পারে না। যদি বা নামিয়েও দেয়, যে পরবর্তী বিকল্প- তারই বা সততা কোথায়!
তার চেয়েও বড় আন্দোলনের প্রাপ্তি এই গণজাগরণ- এই আন্দোলন বহু মানুষের শিরদাঁড়ায় সাহস আর কণ্ঠে ভাষা এনে দিয়েছে। এই পাওনাটাই আসল। বাকি লড়াইটা আমরা ঠিক লড়ে নেব এটুকু বিশ্বাস আমাদের এসেছে। সেই সাহস দুর্নীতিবাজ শাসকের আসন টলমল করে দেওয়ার জন্য যথেষ্ট।।