গত হপ্তায় তিনজন তারকার পতন হলো। নিজ নিজ ক্ষেত্রে নায়ক ছিলেন প্রত্যেকেই। গত হপ্তায় মারা গেলেন দুজন বাঙালি চিকিৎসকও। কোভিড যুদ্ধের অন্যতম সেনানায়ক ছিলেন তাঁরা।
মৃত্যু সততই বেদনার। তার উপর, মানুষটি যদি কীর্তিমান হন, মারা যাওয়ার পরেও সেইসব কীর্তির রেশ মনের ভেতর হানা দিতে থাকে কেবলই। বারেবারে ভেসে ভেসে আসে উজ্জ্বল সোনালী স্মৃতি । অথচ, এ বাদেও মৃত্যু আছে। বস্তুত, সেরকম মৃত্যুই বেশি। সেরকম মৃত্যুই হামেহাল। জন এবং সাধারণের মৃত্যু। এলেবেলে আর অকিঞ্চিৎকরের মৃত্যু। যাঁদের মৃত্যুতে গৌরব অথবা গল্প, কোনোটাই নেই সেভাবে। একদা জন্ম হয়েছিল যে মানবশিশুর, আজকে তার দিন গুজরান সমাপণ হলো অবশেষে। ব্যাস। এটুকুই। তার বেশি বলবার বা গাইবার মতো কিছুই নেই সবিশেষে। ক্রন্দন অথবা নীরবতা ব্যতীত। কিংবা হয়তো… আছে। থাকে। গল্প। এক জীবনের। আপাত যৎকিঞ্চিৎ। অথচ তীব্র ঘটনা প্রবাহে ভরপুর। যে সব ঘটনার অন্যের কাছে মূল্য নেই কানাকড়িও। কিন্তু সেই সব দিনলিপি, নিকট পরিজনের কাছে বড় আদরের।
এইসব আমি শুনতে পাই। টর্চ জ্বেলে রোগীর ঠান্ডা চোখের মণি নেড়েচেড়ে দেখি যখন, এবং শেষমেশ মুখ ফিরিয়ে, মাথা নামিয়ে আত্মীয় পরিজনকে শোনাই তার মৃত্যু সংবাদ, তখন এক ঝটকায় সমস্তটা পাল্টে যায় হুড়মুড়িয়ে।
মানুষ বোকা নয়। মৃত্যুকে চিনতে পারার তার সময় লাগার কথা নয় এতটুকুও। তবুও, প্রতিবার, প্রত্যেকবার আমি দেখেছি ঠান্ডা হয়ে যাওয়া দেহকে আঁকড়ে ধরে চিকিৎসকের জন্য আশ্চর্য অপেক্ষা । দেখেছি কাতর দু’চোখে, মরিমরি আশা পাগলাটে।–“একটু দ্যাখেন না… একটু দ্যাখেন… কেমন করতেসিল মানুষটা হঠাৎ করে… শুনছো… শুনছোওওও… দ্যাখো, ডাক্তারবাবু আসছে…।”
বড্ডো ক্লান্তিকর মনে হয় আমার এইসব মুহূর্তগুলোকে। বড্ডো। কাষ্ঠমুখে, নির্লজ্জের মতো দৃঢ় কণ্ঠে বলতে হয় হাত ঝাঁকিয়ে — “সরুন। বেড থেকে নেমে আসুন। পেশেন্টকে দেখতে দিন ভাল করে…।” অথচ আমিও জানি, অথচ সেও জানে যে মানুষটা আর নেই। অথচ তবুও, প্রত্যেকবার এক তিল পরিমাণ আশা বেঁচে থাকে কোথাও না কোথাওতে। “হয়তো বাবু মরে নাই। নয়তো বাবু কেলান্ত হয়ে ঘুমাইতেসে।” সেই ‘হয়তো’-র আশাতেই সশব্দে জল ঢেলে দিতে হয় আমাকে।
এ সময়গুলোয় আমি অপরাধ বোধ করি তীব্র রকম। মনে হয়, স্তব্ধ থাকি কিয়দক্ষণ। মনে হয়, গল্পগাছা করি এলেমেলো। তাতে, যতটুকু অনুপল অন্তত বিলম্ব করা যায় যাক। ততক্ষণ অন্তত বেঁচে থাক মানুষটা খাতায় কলমে। একবার ঘোষণা করলেই তো ― শেষ। সবটুকু। এক ফুৎকারে। এক ঝটকাতে। শায়িত শরীরের ওপর পড়ে যাবে তখন মৃতের শীলমোহর। ‘শরীর’ থেকে ‘দেহ’ হয়ে যাবে লহমাতে।
তবুও বলতে হয়। বলতেই হয় ইনিয়ে বিনিয়ে। আর তখনই গল্পগুলো ফিরে ফিরে আসে। বিলাপে। ক্রন্দনে। যন্ত্রণায়। বুক চাপড়ানো আছাড়ি পিছাড়ি কান্নাতে। আর তারই ফাঁকে ফাঁকে উচ্চারিত হতে থাকে একটা সদ্য মরে যাওয়া মানুষের তাবৎ জীবন কাহিনী।
যখন ডাক্তার হইনি, এবং যখন বয়সও আমার হয়নি ততটা, তখন, সেইসব সময়ে এই উচ্চৈস্বরে কান্নার কলোরল আমার বিরক্তিকর ঠেকত বড্ডো। স্তম্ভিত হয়ে যাওয়া বড়কাকাকে দেখেছিলাম ধাক্কা দিচ্ছিল ছোটপিসিমণি, আর বলছিল –” কাঁদ মেজদা… একবার কাঁদ। পাথর হয়ে গেলি রে তুই মেজদা! বাবু আর ফিইরব্যেক নাই রে… কান্দ আমার সঙ্গে..।” দেখেছিলাম, বাবা দাঁড়িয়ে আছে ভাষাহীন মুখে। দেখেছিলাম , ঠাকুমা আলুথালু। আর মেঝেতে গড়াগড়ি কান্না চলছে মা আর কাকিমাদের।
তখন আমি ক্লাস ফোর। দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে দেখছিলাম সমস্তটাই সিঁড়ির তিন ধাপ ওপর থেকে রেলিংয়ে কনুই ঠেকিয়ে। আমার ভাল লাগছিল না। আমি, অনেক চেষ্টা করেও দেখলাম কান্না আসছিল না এতটুকু। বরং খেলতে যেতে ইচ্ছে করছিল টুম্পার সাথে। এখানে সবটাই বড্ডো কেমন যেন হাস্যকর আর বিচ্ছিরি। চলেও গিছলাম তাই। খেলতে। হাফপ্যান্ট টুম্পা শুধিয়েছিল মার্বেলগুলি ধুলোমুঠিতে নিয়ে–” তর দাদু মরে গ্যালো যে! তুই খেলবি?” আর আমি বলেছিলাম হাসতে হাসতে –” শুন্ ন্না, শুন ন্না! এ-ক-টা মজার কথা। বড়কাকা নাকি পাথর হৈ গ্যাছে। হি হি। পা-থ-র।” মৃত্যুর সাথে সেই ছিল আমার প্রথম পরিচয়লিপি।
তারপর, বড়সড় কোনো মৃত্যু চেখে দেখবার আগেই ডাক্তার হয়ে গেলাম দ্রুত। এবং জীবনে প্রথম মৃত্যু ঘোষণা করলাম ২০০৫-এর কোনো এক অগস্ট সেপ্টেম্বরে।
সেদিনটায় ঝটকা লেগেছিল বড্ডো। দুই বিনুনি, সাদা নাইটি এক কিশোরীর মারা যাবার খবর দিয়েছিলাম তারই মাকে। ভদ্রমহিলা তৎক্ষণাৎ ধড়াম করে উল্টে পড়ে গিছলেন। খাটের কোণায় মাথা লেগে হুলুস্থুলু। মৃতার বাবাও ছিলেন পাশেই। তিনিই তুলে জলটল দিলেন। আর ভদ্রমহিলা চোখ খুলে কি খুলেই অকস্মাৎ মেয়ের মুখটা দু হাতে চেপে ধরে ডাকতে শুরু করলেন–” সাহেরা? এই সাহেরা? বিটি আমার..! একবার চোখ খুলে দ্যাখ মা, একটিবার দ্যাখ। … সাহেরা? আব্বু এসছে তোর ফল নিয়ে। কেলা, আঞ্জির… দ্যাখ…। তোর যে ইস্কুল খুলেই পরীক্ষা রে বিটিয়া… তুই যে বলেছিলি অঙ্ক খাতা লাগবে…। কিনে দেব। সব কিনে দিব। জান আমার… সাহেরা বিটিয়ারাণী… লিপিস্টিক নিবি না? ভালোবাসিস কত তুই? নিবি না?”
সেই প্রথম আমার গল্প শোনা একটা মরে যাওয়া মানুষের। সেই প্রথম দেখতে পাওয়া গাছগুলোকে। একটা ফুরিয়ে যাওয়া মানুষের ভালো লাগা, তার মন্দ লাগা, তার পছন্দ অপছন্দ, তার অপূর্ণ মামুলি ইচ্ছা… সব খইয়ের মত টগবগিয়ে ছড়িয়ে পড়ছিল চারিপাশে। প্রত্যেকটা, এক একটা গল্পের বীজ। একটা টগবগানো মানুষ এখন থেকে গল্পই হয়ে গেল পুরোপুরি। এবারে কিন্তু আর উচ্চৈস্বর বিলাপ আমায় বিরক্ত করেনি এতটুকু। বরং, ধাক্কা দিয়েছিল জোরালো। আমি আচমকা অনুভব করেছিলাম একটা মারাত্মক সত্যিকে। যে সত্যির কথা আমাকে বলেনি কখনো কেউ। সকলে বলেছে, ডাক্তার হলো ভগবান। বলেছে–তোমরা ঈশ্বর। আল্লা। কিন্তু সেই প্রথম জানতে পেরেছিলাম, ডাক্তার আদতে মৃত্যুর ফরমানের ঘোষকও বটে।
তারপর তো যা হয়! এইসব ক্ষেত্রে! ক্লান্ত মন নিয়ে হোস্টেলে ফিরে গল্প শোনাচ্ছিলাম গামছা পরে বন্ধুদের। শোনাচ্ছিলাম মনখারাপের কথা। আর তাই থেকেই আড্ডা আরো ঘনীভূত হলো। ভূত, সাপ কিংবা মৃত্যুর টপিক হলে যেমন হয় আর কি। একবার কথা উঠলেই সক্কলে উপুড় করতে থাকে নিজের নিজের ঝুলি। সেসবই চলছিল। ভাঙা তক্তপোষ, ভাঁড়ের অ্যাশট্রে, খবরের কাগজ থেকে মেয়ের শরীর কেটে নেওয়া…। ওই তখনই সুভাষ বলেছিল ঘটনাটা। —” টাটা থেকে নিয়ে আসার পর বুঝলি, দাদার মাথাটা একদমই গিছলো। সারাক্ষণ হাত আঁকড়ে শুয়ে থাকতো কারুর না কারুর। খুঁতখুঁত করতো– যেও না। যেও না। বসে থাকো। লাস্টের দিকটায় তো প্যানিকই হয়ে গেল। ঘরে কেউ না থাকলেই নাকি মরে যাবে। বোঝ! তো, কেউ না কেউ সবসময় পাশে থাকতো। লাস্টের দিন আমি ছিলাম। তখন মাঝরাত। দাদা ঘুমাচ্ছে। আমার মাইনাস পেলো খুব। উঠতে যেতেই হাত চেপে ধরলো দাদা– যাস না! দেখি – চোখ মুখ বড় বড়। আমি বললাম পেচ্ছাপ করেই আসছি। তুই ঘুমা। অ্যাটাচ বাথ তো, বুঝলি? তো গেলাম আর এলাম। এসে দেখি… দাদা মরে গেছে। চোখমুখ শান্ত। আমি… আমি সব্য মাক্কালি বলছি… আজ তক্ আফসোস লাগে! কেন যে গেলাম! শালা…।”
পাঁচজন নব্য ডাক্তার আমরা এইসব ইন্দ্রিয়াতীত আজগুবি গল্প করছিলাম বসে বসে সেদিন। বিজ্ঞানে যেসবের কোনো মূল্য নেই একরত্তি। অথচ তারপর থেকে নাগাড়ে আশ্চর্য কিছু ঘটনা দেখতে দেখতে এইসব ইন্দ্রিয়াতীতেই একরকম অভ্যস্ত হয়ে গেছি আজকাল। একটা একটা করে মৃত্যু আমার জীবনে ঘটে, আর একটা একটা করে অদ্ভুত গল্পকে দেখতে পাই আমি। বুঝতে পারি… এ জীবনের সবচাইতে বড় সত্যটাকে জড়িয়ে পেঁচিয়ে কুয়াশার মতো কিছু কিছু অনুভূতি রয়ে গেছে আজও।
আদতে, আমি বড় হতভাগ্য একটি প্রাণী। চিকিৎসক হিসাবে অজস্র মৃত্যু দেখাটা তো সকল ডাক্তারেরই ভবিতব্য। কিন্তু আমার গল্পটা তার চাইতেও যন্ত্রণার। আমি, টিবি হাসপাতালের চিকিৎসক। এমন একটি হাসপাতাল, যার আন্ডারে উত্তরবঙ্গের সাতটি জেলার সমস্ত ড্রাগ রেজিস্ট্যান্ট টিবি রোগী। ফলত, আমার তাবৎ প্রহর, মৃত্যু সংবাদে ভরপুর। কখনো সে মৃত্যু ঘটে চোখের ঠিক সামনেটিতে, কখনো খবর পাই টেলিফোন মারফত। আর প্রত্যেকবার প্রতিটি মৃত্যু জন্ম দেয় একটা একটা নতুন গল্পের। আজকেও যেমন হলো। বাড়ি ফিরছিলাম ক্লান্ত শরীরে। সিঁড়ি ভেঙে ভেঙে শ্রান্তপদ। এক হাতে হেলমেট, অপর হাতে চাবি। ঠিক তখনই ফোনটা এলো। আননোন নাম্বার। ধরবো কি ধরবো না করেও ধরে ফেললাম শেষ মুহূর্তে। হ্যালো বলতেই খানিক খচর মচর শব্দ, আবছা বাইকের আওয়াজ আর মিষ্টি এলোমেলো ডাক পাখির।
এরকম আনাড়ি ফোনকলে আমি অভ্যস্ত। হরবখত আমায় এখান থেকে আর সেখান থেকে ফোন করে করে পাগল করে মারে রোগী বা রোগীর আত্মীয়-পরিজন। মোবাইল ফোনে যারা এখনও গুছিয়ে উঠতে পারেনি ভালো মত। ইতস্ততা কাটিয়ে পালটা হ্যালো বলার আগেই আমি শুনে নিই যাদের গার্হস্থ্যের টুকরা টাকরা ধ্বনি। আর এঁকে নিই মানসচিত্র। এটাও, এই ফোনকলটাও হয়তো তাই। আমি মুহূর্তকালের মধ্যেই কল্পনা করে নিলাম একটি ছোট্ট গ্রাম্য দাওয়া। দড়িতে মলিন শাড়ি ঝুলছে ছেঁড়া-গামছার ঠিক পাশটিতে। সজনে গাছে বেনেবৌ ডাকছে খুব। মেঠো রাস্তা দিয়ে পেরিয়ে যাচ্ছে মোটরবাইক। ভাতঘুম নেমে আসছে দ্বিপ্রাহরিক জনপদে।
মিললো না। একটি ইতস্তত কণ্ঠ বলে উঠল–” এ… ডক্টর সাব? ম্যায় ওয়াসিম…ওয়াসিম আক্রম … জব্বার কা বেটা…”
সারা উত্তরবঙ্গে আমার হাজার হাজার রোগী। তাদের সক্কলের নাম আর ছেলেপুলের সালতামামি মাথায় রাখতে পারি না সর্বদা। তবুও… কিছু কিছু থেকে যায়। যেমন এরা। জব্বার আর ওয়াসিম। বাপ আর ছেলে। বাপ রোগী। এক্সটেনসিভলি ড্রাগ রেজিস্ট্যান্ট টিবির। ছেলে, পাগলাটে, রগচটা পেশেন্ট পার্টি। বাপ এখানে ভর্তি ছিল যখন, ওয়াসিম বখেড়া করতো বহুত। ছবি তুলে রাখত প্রত্যেকটা ওষুধের। কথায় কথায় অভিযোগ আর অনুযোগ। তারপর… বদলে গেল ধীরে ধীরে। ছুটির দিন বোকার মত হেসে বলেছিল–” আব্বুকো থোড়া বোল দিজিয়ে ডক্টরসাহাব। আপ বোলনে সে য়কিন করে গা। বোলিয়ে কে ঠিক হো যায়েঙ্গে।”
সেই ওয়াসিম? কী হলো আবার আব্বুর? ওয়াসিম! হাঁ হাঁ… বোলো…
—আব্বু মর গ্যায়া ডক্টরসাব। সবকুছ ঠিক তো থা। ফির… আজ সুবাহ মর গ্যায়া।
ডাক্তার হিসাবে ইদানিং আমার একটা চোরের মতো বর্ম তৈরি হয়ে গেছে অজান্তেই। আচমকা কেউ পিঠে হাত রাখলেই ইনিয়ে বিনিয়ে বলি— না না, আমার কোনো দোষ নেই। ভগবানের দিব্যি। আমি কিছু করিনি। আজও তাই হলো। ঢোঁক গিলে লেকচার ঝাড়লাম বড়সড়— আরে আরে! ক্যায়সে! মতলব… দেখো ওয়াসিম, শায়দ আল্লা-পাককা এহি মর্জি থা। নেহি তো রমজানকে টাইম মে…। কেয়া করোগে ওয়াসিম, কৌশিশ তো বহুত কিয়া হামনে… মতলব…তুমনে ভি। সব মিলকর হামনে কোশিশ কিয়া। শায়দ আল্লামিয়াঁ কা হি…
ওয়াসিম কথাটা থামিয়ে দিল মাঝপথেই।– নেহি নেহি ডক্টরসাব। আপ তো বহোত চেষ্টা কিয়ে থে। ম্যায়নে দেখা। লেকিন…পাতা হ্যায় আপকো? … আজ ফজর সে পেহলে আব্বু নে বোলা, জলপাইগুড়িবালা ডক্টর কো ফোন করো বেটা। বোলো–ম্যায় ঠিক হো গ্যায়া হুঁ। … কাল তো শোয়ে ভি থে কিৎনি আচ্ছি সে। শোতে নেহি থে আব্বু। কাফ কা প্রবলেম হোতা থা। লেকিন… কাল শোয়েঁ। খুব শোয়েঁ। সুহুর মে ব্যায়ঠেঁ ভি হামারে সাথ… বাতেঁউতেঁ কিয়ে… ফির মর গ্যায়ে।
আবার সেই ঘটনা। আরো একবার। মরে যাওয়ার ঠিক আগের মুহূর্তে একটা জিন্দেগি বেঁচে নেওয়া চেটেপুটে। কাটিয়ে নেওয়া চন্দ লমহাঁ হাসিখুশীর। আর বলে যাওয়া, জীবনটা… মোটের ওপর ভালোই।
সেই যে সেই প্রিয়াঙ্কা রায়, আরেকজন এক্স ডি আর টিবি রোগী, মরে যাওয়ার ঠিক আগে পাক্কা কুড়িদিন পর যে ভাত খেয়েছিল চেটেপুটে… কিংবা অণীশ, অণীশ জয়সোয়াল, মারা যাওয়ার আগের সকালে খাট থেকে নেমে হাঁটাহাঁটি করেছিল দেড় মাসের পর… সব্বার গল্পগুলো এক।
এ বড় কঠিন রহস্য। এ বড় বিচিত্র এক ধাঁধা। মৃত্যু ঘোষণার ঠিক পরপরেই যেসবের সম্মুখীন হতে হয় আমাকে।—“মরে গেছে? নাই? হ্যাঁ? ডাক্তারবাবু? ও মরে গেছে? সকালেই যে ভাত খেল? বললো বাড়ি যাবো এইবার…। তাহলে? …. এই যো … তুমি … তুমি আর বাড়ি যাবে না? হ্যাঁ? দেখো না … এইদিকে দ্যাখো … যাবে না? ছুটকির যে বিয়ে ঠিক করলে? বিয়ে দেবে না…”
ধ্বস্ত, বিধ্বস্ত, বিপর্যস্ত, ক্লান্ত আমার কানের সামনে একটার পর একটা অভিনীত হতে থাকে মৃতের জীবনকাহিনী। তার আসক্তির অতীত, তার সাম্প্রতিক রসনা, তার পরিকল্পনা ভবিষ্যতের। আর… সেই আশ্চর্য গল্পের ভারে আরো অনেকটা আয়ু ফুরিয়ে যায় আমারও। আর বুঝতে পারি ভীষণ ভাবে, জীবনটা আদতে বড় সুন্দর। কীর্তিমান হোক কিংবা কায়ক্লেশ, জীবনটা আদতে উপভোগই করে সব্বাই। গড়ে গড়ে তোলে ছোট্ট ছোট্ট গল্প। জড়িয়ে মড়িয়ে থাকতে চায় সেসব ঘিরেই চির জনম। কিন্তু তারপর … মরেই যায়।
এইসব গল্পকে বুকের ভিতর নাগাড়ে জমিয়ে যাওয়া বড়ো কষ্টের। এ জীবনের সবচাইতে বড় সত্য হল মৃত্যু। আজ, নয়তো কাল, কিংবা পরশু। অথচ, সেই স্বাভাবিক সত্যটাই আমাদের বিচলিত করে সবচাইতে বেশি। এই যে তীব্র জড়িয়ে মড়িয়ে বাঁচা, এই যে মুহুর্মুহু আস্ফালন, উচাটন, অধিকারবোধ, এইটাও যে ফুরিয়ে যাবে সবটাই একদিনকে … এইটে মানতেই সবচাইতে বেশি আপত্তি আমাদের। মরে যাওয়ার পরেও তাই গল্পগুলো থেকে থেকে যায় ।
তোর বাবা জানিস…! বুল্টি তো একবার…। সেই যে জ্যেঠিমা একবার রান্নাঘরে…। এইরকম কত্তো কত্তো কাহিনী। দেওয়ালে, মেঝেতে, বস্ত্রে, সকড়িতে লেগে লেগে থাকা আলগোছে। মানুষটার লাগানো গাছটাতে এখনো শিউলি হয় খুব। মৌটুসিতে সে গাছে বাসা বেঁধেছে ছো-ট্ট। ডিম দিয়েছে কুশিকুশি। হয়ত… মানুষটাই আবার ফেরত এল বোধহয় মায়ার দুনিয়াতে।
এইসব আমি রেখেটেখে দিই। রেখে দিচ্ছি ভীষণ যত্ন করে ক্লান্ত বুকের ওমে। একদিন … গাছ পুঁতবো ঠিক।
জাস্ট, একটা ছবি এঁকে দিলেন।