১৪
দিন দশেক পরে দেবাঙ্কন এসে হাজির। বলল, “তোদের কফি ধ্বংস করতে এলাম। বাপরে বাপ, যা গেল! যাক, চার্জশিট হয়ে গেছে। সাংঘাতিক কনস্পিরেসি। সোমেশ্বর নাথ আর শ্যামলী খান বহুদিনের পার্টনার্স ইন ক্রাইম। আগেও নাকি এরকম করেছে। এখন সিবিআই তদন্ত করছে। তোদের আর ভয় নেই। ওদের জামিন হবে না। সিবিআই স্পেশাল কোর্ট জামিন না-মঞ্জুর করে দিয়েছে। অ্যাবস্কন্ডিং রিস্ক।”
“কী করত?” জানতে চাইল মিঞ্জিরি।
“প্রথমত একলা মহিলা বা পুরুষ খুঁজে বের করত। তারপরে, পার্টি বুঝে দুজনের একজন ঘনিষ্ঠ হত। সে ঘনিষ্ঠতা কতটা হবে, কী হবে, সব নির্ভর করত শিকারের ওপর। কারও হয়ত কেবল দেখাশোনা করা, কারও সঙ্গে বিয়ে… কারও সঙ্গে হয়ত আরও কিছু… কিন্তু মরে যাবার পরে পয়সাকড়ি হাতিয়ে পালাত। ওরা বলছে মরে যাবার পরে, কিন্তু আমাদের সন্দেহ ওটা খুন করার পরে। সমস্যা হলো এগুলো ওরা বিদেশেই করে বেড়িয়েছে — ব্রেজিল, জার্মানি, স্পেন, ইতালি… একা কোনও বৃদ্ধ বা বৃদ্ধা… মৃত্যু রিপোর্টেড হতে সময় লাগে… ততদিনে ওরা একেবারে দেশ ছেড়েই উধাও। ফলে ধরা পড়েনি। বেশিরভাগ এমন লোককে ধরত, যাদের চেনাজানার সার্কেল এতই ছোটো, যে কেউ হয়ত জানতই না যে তাদের বাড়িতে একজন মহিলা বা পুরুষ এসে বাসা বেঁধেছিল শেষ ক’দিন। তা-ও, সিবিআই খোঁজ করছে, ওই সব দেশে কোনও বৃদ্ধ-বৃদ্ধার মৃত্যুর সঙ্গে সন্দেহজনক কোনও ভারতীয়র খবর পেয়েছে কি না। পেলে কেস ইন্টার্ন্যাশনাল হয়ে যাবে। ইন্টারপোল আসবে!”
শ্রীপর্ণ বলল, “কী কাণ্ড, কিন্তু শানুর কী হলো? সত্যিই মেরে ফেলেছে?”
“তা-ই বলেছে। গ্রামের বাড়িদুটোতে তো কোথাও পাওয়া যায়নি। এখানে ফ্ল্যাটেও না। তবে মেরেছে এখানেই। দু’জনে ঠিক করেছিল, ওপিডানেই মারা সবচেয়ে সুবিধে — কারণ ওদের টাওয়ারে এখনও বেশি লোক নেই — ওই সময়ে ওদের ফ্লোরের বাকি সাতটা ফ্ল্যাটই খালি ছিল। ওপরে নিচে মিলিয়েও নাকি তিনটে ফ্ল্যাটে লোক থাকত। গ্রামে নিয়ে গেলে লোকে দেখতে পাবে, তারপরে মারা কঠিন। তাই ঠিক করে শহরেই মেরে ফেলে শ্যামলী ওখানে গিয়ে শান্তা হয়ে বসবে।
“কিন্তু তার আগে কিছু ঘটনা আছে। শান্তার সঙ্গে সোমেশ্বরের ব্রাসেলসেই পরিচয় করে। ওখানেই প্রেম, ওখানেই বিয়ে — শান্তা চৌধুরী এতদিন বিয়ে করেননি, জানতিস? না? ওয়েল, করেননি। সোমেশ্বরই প্রথম। প্রথমে প্ল্যান ছিল ব্রাসেলসেই শান্তাকে মেরে টাকাকড়ি নিয়ে পালানো। কিছুদিন পরে যখন বোঝা যায় যে শান্তা দেশে অনেক সম্পত্তির একচ্ছত্র মালিক, তখন মোডাস অপারেন্ডিতে বদল… এন্টার শ্যামলী খান। ওখানেই শান্তার বন্ধু হয়ে যায়। সোমেশ্বরের সঙ্গে কোনও চেনাজানা-ই ছিল না যেন। ওরা আলাদা করে শান্তাকে বুদ্ধি দেয় দেশে ফিরতে। সোমেশ্বর রিটায়ার করতে প্ররোচনা দেয়। স্বামী-স্ত্রী দেশে ফেরার কথা ঘোষণা করলে শ্যামলী চালাকি করে বলে, ও-ও ফিরতে চায়, যেন শান্তাকে ছাড়া ওর চলবে না। ততদিনে শান্তা পুরোপুরি শ্যামলী আর সোমেশ্বরের বুদ্ধিতে চলছে — শান্তার মাঝবয়সের ক্রাইসিস সব ওরা-ই সামলেছে। শান্তার মনে কী ছিল আমরা জানি না, তবে সম্ভবত আলাদা করে স্বামী হিসেবে সোমেশ্বর আর বন্ধু হিসেবে শান্তার ওপর ভরসা করতে শুরু করেছিল।
“দেশে ফিরে ওরা বেশ কিছুদিন ওপিডানের ফ্ল্যাটে থাকে। সম্পত্তির খতিয়ান নিয়ে সোমেশ্বর আর শ্যামলী ঠিক করে ওরা সবই নিয়ে নেবে। তাই শান্তাকে আর গ্রামে ফিরতেই দেবে না। যে কারণেই হোক, এত বছর শান্তা দেশে ফেরেনি, এবং পিসির দেখাশোনার জন্য টাকা পাঠিয়েই দায়িত্ব শেষ করেছিল। কে চিনতে পারবে, পারবে না, তার ওপর শান্তার জন্মদাগ — যেটার কথা দেশে কেউ জানে বা মনে রেখেছে কি না কে জানে… সেইজন্যই ঠিক করেছিল যে অন্তত আপাতত বেশ কিছুদিন শ্যামলী গলাবন্ধ, গা-ঢাকা জামাকাপড় ছাড়া পরবে না, আর যথাসম্ভব বাড়ি-বন্দি হয়েই থাকবে।
“বছরখানেক আগে ওরা শান্তাকে ঘুমের ওষুধ দিয়ে বেহুঁশ করে মুখে বালিশ চাপা দিয়ে মেরে ফেলল। সে সবের এভিডেন্স পাওয়া গেছে। বালিশটাও ওপিডানের ফ্ল্যাটেই ছিল। ওটা নিয়ে ওরা ভাবেনি। ফ্ল্যাট তো সোমেশ্বরের নামে। পরে কোনও সময় ডিসপোজ করে দিলেই হবে। ওপিডানে কারওর সঙ্গে ওদের ব্যক্তিগত পরিচয় ছিল না। শান্তা ফ্ল্যাট কিনেছিল ব্রাসেলস থেকে, এবং কেনার সময় এবং পরে বার কয়েক এসেছিল বটে, কিন্তু প্রোমোটার ছাড়া আর কারওর সঙ্গে পরিচয় হয়নি। সোমেশ্বর ফ্ল্যাটের মালিকানা পাবার পর ওদিকটা আর খতিয়ে ভাবেনি। ফ্ল্যাটের অরিজিনাল মালিকের ছবি ফাইল থেকে বের করে শ্যামলীর মুখের সঙ্গে মেলানো হবে, সেটা ভাবেইনি।”
“আর ভাবেনি শ্রীপর্ণর কথা,” বলল মিঞ্জিরি।
“জানতই না। শান্তা চৌধুরী সোমেশ্বরকে শ্রীপর্ণর সম্বন্ধে কিচ্ছু বলেননি। ফলে তোরা যেদিন প্রথম যুগলে হাজির হলি, বললি শান্তা চৌধুরীর বন্ধু, সেদিন নাকি দু’জনে একেবারে নার্ভাস হয়ে গেছিল। ঠিক করে কথাও বলতে পারেনি তোদের সঙ্গে, এবং খুব ভয় পেয়েছিল যে শ্রীপর্ণ যদি বুঝতে পেরে থাকে। পালিয়েছিল গ্রাম ছেড়ে। একটা হলিডে হোমে গিয়ে সাত দিন কাটিয়ে ফিরেছিল। তার পর থেকে তোদের অ্যাভয়েড করত।”
মিঞ্জিরি বলল, “তা ঠিক, পথে ঘাটে দেখা হলে মুখ ফিরিয়ে নিত, পারলে অন্য রাস্তায় চলে যেত… মুখোমুখি হয়ে গেলে হেসে ব্যস্ততা দেখিয়ে চলে যেত। তবে খুব ভয় পেয়েছে মনে হয়নি — কী, পর্ণো, বুঝেছিলে? ভালো অ্যাক্টর। প্রথম দিন কেমন আমার হাত ধরে বলল, তুমি এসো কিন্তু…”
দেবাঙ্কন বলল, “সেদিন প্রথমে নাকি বেশ ভয়ে ভয়েই ছিল। পরের দিন তোর সঙ্গে কথা বলে যখন মোটামুটি শিওর হয়েছিল, যে তোরা কিছু সন্দেহ করিসনি, তখনই তোকে ডেকেছিল, শ্রীপর্ণ। বাজিয়ে দেখতে…”
শ্রীপর্ণ বলল, “এবং সেদিন সোমেশ্বর ছিল না বলে গা-ঢাকা জামা পরেনি।”
দেবাঙ্কন বলল, “সোমেশ্বর ওকে শাড়ি পরতে দিত না, কিন্তু শ্যামলী ওটা তোকে টেস্ট করার জন্যই পরেছিল — একরকম চ্যালেঞ্জ — কেউ জানে না জন্মদাগের কথা… তুইও নিশ্চয়ই জানিস না। ক্রিমিনালরা অনেক সময় ওভার-কনফিডেন্ট হয়ে ভুল করে, এটা তার এক উৎকৃষ্ট উদাহরণ।”
শ্রীপর্ণ বলল, “আর সেদিনই আমার সামনে চটি-ও খুলেছিল। ওরা শানুর পায়ের ছটা আঙুলের কথা জানত না? হতে পারে না। ওটা কিন্তু গ্রামের অনেকেই জানত।”
দেবাঙ্কন একটু ধন্ধে পড়ে মাথা নাড়ল। “সে বিষয়ে কোনও কথা হয়েছে বলে আমি জানি না। ভালো কথা বলেছিস — সিআইডির ইনভেস্টিগেটিং অফিসারকে জানাব…”
মিঞ্জিরি বলল, “শানুকে নিয়ে কী করল?”
দেবাঙ্কন বলল, “রাত সাড়ে তিনটে নাগাদ ওরা মালপত্র বের করে। সোমেশ্বরের একটা বিশাল ছ’ফুট লম্বা বিদেশী ডাফেল ব্যাগ ছিল। অনায়াসে একটা গোটা মানুষকে ঢুকিয়ে নেওয়ার পরেও জায়গা থাকে। তাতে শানুর বডি শুইয়ে ওরই জামাকাপড় ভরে বডিটাকে ঢেকে দেয়। তারপরে তো জানিসই — ভোর চারটেয় গাড়ি নিয়ে বেরিয়ে যায়। তখনও চারিদিক অন্ধকার। ওপিডানে কেউ ওদের চেনে না, কেউ মাথা ঘামায়নি। গ্রামে পৌঁছে গাড়িটাকে পুরোনো বাড়ির খুব কাছাকাছি পার্ক করে। তখনও তো নতুন বাড়ি নেই। রাত্তিরে আবার দুজনে মিলে ধরাধরি করে ব্যাগটাকে নিয়ে যায় একটা অব্যবহৃত ঘরে। শ্যামলী শান্তা চৌধুরী হয়ে বিরাজ করতে থাকে। প্রথম দিকে বিশেষ বেরোত না। পরে যখন বোঝে, এখানে কারও অল্পবয়সী শান্তাকে মনে নেই, এবং সেরকম কোনও ছবি-টবিও নেই কোথাও, তখন বেরোতে থাকে, কিন্তু ওই — বড়ো সানগ্লাস আর গা-ঢাকা পোশাক পরে। এদিকে সোমেশ্বর ইঞ্জিনিয়ার টিঞ্জিনিয়ার কিস্যু না, কিন্তু সত্যিই বাড়ি তৈরি করতে জানে। সেজন্যই বিদেশী স্টাইলে বাড়ি ডিজাইন করে, যাতে নিজেই বেশিরভাগটা করতে পারে। মজুর লাগিয়ে মাটি খোঁড়ায়। বাড়ির দেওয়াল যেহেতু অনেকটাই ইঁটের নয়, হালকা কাচ এবং ফাইবারের, তাই গভীর ভিত করতে হয়নি। চার-ফুট গর্তই যথেষ্ট। আবার রাত্তিরে বাড়ির ঠিক মাঝখানে ব্যাগসুদ্ধু শান্তা চৌধুরীর বডি ফেলে সিমেন্ট দিয়ে চাপা দেয়। ওখানেই শান্তা চৌধুরী রয়েছেন এখন। সিমেন্টের ওপর মাটি, তার ওপর ইঁট। এ সব সোমেশ্বর নিজেই করেছে। ইঁট দিয়ে গর্তটা ভর্তি করে তার ওপর পাথরকুচি আর বেলেমাটি ফেলেছে। এর পরে আবার লোক ডেকে কংক্রিটের ভিত বানিয়েছে তার ওপরে।”
স্তম্ভিত শ্রীপর্ণ বলল, “বাপরে! এত কাণ্ড?”
ভুরু তুলে দেবাঙ্কন বলল, “সম্পত্তি কত জানিস? ওপিডানের ফ্ল্যাট বিক্রি করেই বাকি জীবন সুখে কাটত।”
মিঞ্জিরি একটু কাতর সুরে বলল, “তাহলে? ওটা তো পেয়েই গেছিল — ওটা নিয়ে সন্তুষ্ট থাকলেই হত। কী দরকার ছিল খুন করার?”
দেবাঙ্কন বলল, “ওটাই তো ওদের বৈশিষ্ট্য। লোভ, আর খুন। কিন্তু এখানে এসে যে শ্রীপর্ণর পাল্লায় পড়বে সেটা জানত না।”
শ্রীপর্ণ অন্য দিকে তাকিয়েছিল, কী ভাবছিল। মুখ তুলে তাকাল, কিছু বলল না। মিঞ্জিরি হঠাৎ খিলখিল করে হাসতে গিয়ে থেমে গেল। দেবাঙ্কন বলল, “কী হলো?”
মিঞ্জিরি হাসি থামিয়ে বলল, “স্যরি। উচিত হয়নি। হঠাৎ মনে হলো, ওই বাড়িতেই শানুর ডেডবডির ওপরে ভূতের ভয়ে কাতর শ্যামলী দিন রাত থাকত। সাধে কি সোমেশ্বরকে ছাড়া ওর চলত না!”
দেবাঙ্কন বলল, “উঠি, রাত হলো।”
মিঞ্জিরি তড়াক করে লাফিয়ে উঠে বলল, “তা কী করে হবে… না খেয়ে যাবে না।”
বিছানায় শুয়ে মিঞ্জিরি বলল, “তখন থেকে কিছু বলছ না — কী ভাবছ?”
একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে শ্রীপর্ণ বলল, “ভাবছি, বিয়ে-থা না করেই তো বেশ ছিল। বুড়ো বয়সে কেন হতভাগা সোমেশ্বরকে বিয়ে করতে গেল?”
মিঞ্জিরি বলল, “ভালো লেগেছিল নিশ্চয়ই? তা ছাড়া, বয়স হলে একটা সাপোর্ট লাগে। ভেবেছিল সোমেশ্বর সাপোর্ট দেবে।”
আলো নিভিয়ে মিঞ্জিরি শ্রীপর্ণর কাছে ঘেঁষে এল। “আমি একটা কথা ভাবছি। কথা দাও রাগ করবে না, তাহলে বলি।”
“বলো।”
“তোমার সঙ্গে যদি শানুর প্রেম হত, বিয়ে হত, তাহলেও বেচারাকে মরতে হত না…”
শ্রীপর্ণ চুপ করে রইল। বহুবার এর মধ্যে নিজেকে জিজ্ঞেস করেছে, ভালোবাসত কি ও শানুকে? না কি কেবল বয়ঃসন্ধির মোহ ছিল? নিজেকে সন্তুষ্ট করার মতো উত্তর পায়নি। নিজেকে ছিঁড়ে নিয়ে এল শানুর স্মৃতির হাত থেকে। পাশ ফিরল।
“তাহলে তোমার সঙ্গে কার বিয়ে হত?”
“হত কারও একটা… সে দিয়ে তোমার কী বাপু?”
“দেখাচ্ছি মজা…”
“উফফ, ছাড়ো… ভাল্লাগছে না।”
~খতম~