বছর বত্রিশ-তেত্রিশ আগের ঘটনাটা মেডিক্যাল কলেজের। এ ঘটনার কুশীলবরা সবাই বর্তমান, তাই সাবধানে লিখতে হবে।
একদিন কাজ শেষে আমরা ক্যান্টিনে বসে আড্ডা দিচ্ছি বিকেলবেলা। পাঁচটা প্রায় বাজে, আড্ডা ভাঙব ভাঙব করছে, এমন সময় দূর থেকে দেখা গেল প্রায় টলতে টলতে হেঁটে আসছে ক__। কে যেন বলল, ক__ আসছে দেখ, মনে হচ্ছে নেশা করেছে।
আমরা নিঃশব্দে ক__য়ের আগমন প্রত্যক্ষ করলাম, ক__ ক্লান্তদেহে এসে বসল আমাদেরই টেবিলে, গলা তুলে বলল, “ভাত হবে, রে?”
ক্যান্টিনের ছেলেটা কাঁচুমাচু মুখে এসে বলল, “ভাত তো শেষ।”
ক__ বলল, “তাহলে দুটো টোস্ট দে, মাখন-চিনি।” বলে বলল, “অ্যাডমিশন ডে ছিল। কাল সকালে বাড়ি থেকে খেয়ে বেরিয়েছি সাতটায়। কাল সারাদিন, আজ – সব মিলিয়ে বোধহয় সাত আট কাপ চা খেয়েছি শুধু।”
ডাক্তারির অ্যাডমিশন এবং এমার্জেন্সির নিয়ম-কানুন নিয়ে আগে লিখেছি, যাঁরা জানেন না, তাঁদের জন্য দু-কথায় একটু বলে দিই, এবং সেই সঙ্গে সার্জারির অবস্থাও।
ডাক্তারিতে এমার্জেন্সি ডিউটি হয় চব্বিশ ঘণ্টার – এবং তার আগে-পরে কোনও ‘অফ’ থাকে না। অর্থাৎ, কারও যদি শুক্রবার এমার্জেন্সি ডিউটি থাকে, তাহলে বৃহস্পতিবারের ডিউটি শেষ করে (কপাল ভালো থাকলে রাতে) ঘুমিয়ে নিয়ে শুক্রবার সকাল আটটা থেকে শনিবার সকাল আটটা পর্যন্ত এমার্জেন্সি ডিউটি করতে হয়, এবং শনিবারর ডিউটি শুরু হয় শনিবার সকাল আটটায়। আমার ধারণা এটা সারা পৃথিবীতেই সত্যি – ভুল হলে কেউ শুধরে দেবেন। আগে লিখেছি, আমরা নিজেদের মধ্যে দিনের কাজ ভাগ করে নিতাম, তবে সার্জারিতে সত্যিই কাজ বেশি হতো। কারণ এমার্জেন্সিতে যত পেশেন্ট ভর্তি হত, সবারই তো অপারেশন লাগত – ফলে তার পরের দুটো দিনও গলদঘর্ম হতে হত।
এবং, ভুললে চলবে না, এমার্জেন্সি ডিউটি মানে তাৎক্ষণিক সমস্যার সমাধান। একই সঙ্গে সেদিন সারাদিন চলেছে আউটডোর। সেখানে যারা ভর্তি হয়েছে, তাদেরও অপারেশন দরকার – সেটা তক্ষুণি না করলেও চলবে বটে, কিন্তু পরদিন সকালেই স্থির হবে কার কবে অপারেশন হবে, এবং সারা দিন ধরে তাদের তৈরি করতে হবে তার পরদিনের ও-টির জন্য।
একই সঙ্গে সারা শনিবার যায় শুক্রবার দিনে-রাতে যাঁদের অপারেশন হয়েছে, তাঁদের পরিচর্যাও করতে – বলা বাহুল্য, যাঁরা হঠাৎ – এক্ষুনি অপারেশন না করলে প্রাণ সংশয় অবস্থায় প্রথম হাসপাতালের দ্বারস্থ হয়েছে, তাঁদের পরিচর্যা একটু বেশিই প্রয়োজন হয়।
সেদিনের এমার্জেন্সি একটু বেশিই ব্যস্ত ছিল, যার ফলে ক__ দু-দিনে চৌত্রিশ ঘণ্টা নাওয়া-খাওয়া-ঘুমোনোর সময় পায়নি। তবে এ-ও সত্যি, যে এরকম অ্যাডমিশন-এমার্জেন্সি এমন কিছু অজানা নয় ডাক্তারদের কাছে।
পাউরুটি টোস্ট খেতে খেতে ক__ তার কাজের ফিরিস্তি দিচ্ছিল। আমরা শুনছিলাম আর মনে মনে নিজেদের ধন্যবাদ দিচ্ছিলাম সার্জারি আমাদের পছন্দের বিভাগ নয় বলে – এমন সময় দূর থেকে দেখলাম হেঁটে আসছে খ__। খ__ আর ক__ একই “ইউনিটে” অর্থাৎ ডাক্তারির টিমে কাজ করে। আমাদের চেয়ে দু’বছরের সিনিয়র, তাই তাকে আমরা খ__-দা বলি, কিন্তু এখন লেখার সুবিধের জন্য শুধু খ__ লিখছি।
খ__ শুধু বয়সেই নয়, অবস্থানেও আমাদের সিনিয়র – কিন্তু বন্ধুস্থানীয়। পদমর্যাদাবলে যতটুকু সম্মান তাকে দেখানোর আমরা দেখাই, কিন্তু তা বলে ইয়ার্কি ফাজলামি মারতে দ্বিধা করি না।
দেখলাম, খ__-ও ক__-য়ের মতোই টলতে টলতে এসে আমাদের সামনে দাঁড়াল, তারপরে তেড়ে ক__-কে বকতে শুরু করল।
“কোনও কাণ্ডজ্ঞান আছে? এখানে বসে খেয়ে চলেছ? ওদিকে আমাকে ডি-এইচ-বি (ওয়ার্ডের নামের সংক্ষিপ্ত রূপ) থেকে নার্স ফোন করেছিল, কাল যে পেশেন্টগুলোর ও-টি (অপারেশন) হবে, তাদের কারও ব্লাড যায়নি, অ্যানেস্থেটিস্ট প্রি-অপ চেক-আপে এসে ফিরে গেছে… আর গত সপ্তাহের ওই পেশেন্ট-টা যার আজকে স্টিচ কেটে কাল ডিসচার্জের জন্য রেডি করার কথা ছিল, তাকে আজ চোখের দেখাটা কেউ দেখেনি।”
ক__ নির্বিবাদে পুরো বকুনিটা হজম করল। কিছুক্ষণ পরে যখন চেঁচামেচি করতে করতে খ__-য়ের দম শেষ হয়েছে, তখন গাঁক-গাঁক করে চেঁচিয়ে বলল, “শেষ হয়েছে? তাহলে এবারে আমি বলি? গতকাল সকালে নটার সময় সিবি-টপে (আর একটা ওয়ার্ডের নামের সংক্ষিপ্ত রূপ) ঢুকেছি তোমার সঙ্গে। তখন থেকে এই এতক্ষণ, এই দশ মিনিট আগে অবধি তোমার সঙ্গেই ছিলাম। কাল রাতে তোমরা কলেজ সুইটস-এ খেতে গেলে আমি সে সুযোগটাও পাইনি – ভেগু-জেজুটা (অপারেশনের নামের কথ্য অপভ্রংশ) খারাপ হয়ে গেল বলে ওর ফাইনাল ম্যানেজমেন্ট করছিলাম। আমি কখন যাব ডি-এইচ-বি?
“আর সেই সঙ্গে জিজ্ঞেস করি, তোমার পেয়ারের গ__-কে বলছ না কেন?”
বলা বাহুল্য, গ__ আর ক__ সমবয়সী এবং কর্মক্ষেত্রে সমগোত্রীয়।
ক__ বলে চলল, “গ__ তো কাল সকালে সিবি-টপে বলল, আউটডোর যাচ্ছি, আর পরে আমরা শুনলাম আউটডোরে বলেছিল, সিবি-টপ ও-টিতে যাচ্ছি। বিকেলে একবার এসে বলেছিল, ডি-এইচ-বি যাচ্ছি আজকের অ্যাডমিশন হওয়া দেখতে। তারপরে রাতে এসে একটা ওটি করে ঘুমিয়ে পড়ল সাইড রুমে। সকাল থেকে সেই যে ডি-এইচ-বি যাচ্ছি বলে বেরোল, আর তো দেখলাম না। এখন ওকেই গিয়ে বলো না, ডি-এইচ-বি-টা সামলাক।”
খ__ ওকে হাত দিয়ে ঠেলে বলল, “সরে বোস।” তারপরে ওর খালি করা জায়গাটায় বসে বলল, “ওরে ছেলে, কে আছিস, একটা চা দিয়ে যা।” তারপরে বলল, “যাকে বললে কাজটা হবে তাকেই বলেছি। গ__-কে বললে যদি হত, খুঁজে খুঁজে তোকে বলতে আসতাম?”
(শেষ)