গাড়ীটা এসে দাঁড়ালো আউটডোরের সামনে। মারুতি ভ্যান। সঙ্গে আরো ৫-৭ জন বাইকে। সব মিলিয়ে হুড়মুড় করে প্রায় জনা দশেকের এক জনতা ঢুকে পড়লো আউটডোর বিভাগের ভিতরে। মুখে স্পষ্টতই আশঙ্কার ছাপ।
ব্যাপারটা কি?? যা জানা গেলো, ভদ্রলোক বেশ কয়েকদিন অনর্গল কথা বলে চলেছেন, বড় বড় কথা, ঘুম নেই, দেদার পয়সা বিলোচ্ছেন, সাংঘাতিক মুডে আছেন।
বললাম, তাহলে নামিয়ে আনুন, দেখি। ওদের বক্তব্য হলো, ভুলিয়ে ভালিয়ে এনেছি, কিন্তু এখন হাসপাতাল, তাও মানসিক হাসপাতাল দেখে নামতে চাইছেন না।
বললাম, এতজন আছেন, জোর করে নামিয়ে আনুন। দু-চারজন গিয়ে নানারকম নরম স্বরে বোঝাতে লাগলো, কিন্তু জোর-টোর বিশেষ কাউকে করতে দেখলাম না। বুঝলাম একশন-এ নামতে হবে, বেশ জটিল একশন!!
তখন আমি তুফানগঞ্জে মানে তুফানগঞ্জ মানসিক হাসপাতালে। সরকারী চাকরীতে প্রথম পোস্টিং। মানসিক হাসপাতাল হলেও আউটডোরই চালু ছিলো তখন। ২০০০-এর জানুয়ারীতে চালু হয়, আমি যোগ দিই ঐ বছরেরই ডিসেম্বরে। এখনো আউটডোরই আছে, তবে শুনেছি বড় ইনডোর (১০০ শয্যার) এর বাড়ী তৈরী হচ্ছে।
এইবারে একশনে নামার আগে আমাদের একমাত্র গ্রূপ ডি দুধকুমারদার সাথে একটু আলোচনা করে নিলাম। ফার্মাসিস্ট তাপসদাকে ইঞ্জেকশন তৈরীর কথা বলে গাড়ির কাছে এগোলাম। অন্য কিছু রোগীর বাড়ির লোকজনকেও ডেকে নিলাম, তবে ওই রোগীর বাড়ির লোকজন তখন প্রায় পঞ্চাশ হাত দূরে দাঁড়িয়ে।
গাড়ীতে উঁকি মেরে দেখলাম এক মাঝবয়সী, মোটাসোটা, প্রভাবশালী ভদ্রলোক লম্বা সিটের ঠিক মাঝখানে হাত-পা ছড়িয়ে বিরক্ত মুখে বসে আছে। নামার কথা বলায় সোজ্জা ‘না’ বলে দিল। তখন নাম কি, বাড়ী কোথায় এসব হাবিজাবি কথা বলতে বলতে একপায়ে গাড়ীর স্লাইডিং দরজাটা চেপে ধরে, হাত ধরে হ্যাঁচকা টান মারলাম। একটু দরজার দিকে এগিয়ে আসতেই জাপটে ধরে আরেকটু টান, ব্যাস, দেহটা একটু বাইরে আসতেই, দুধকুমারদা ও অন্য আরো কয়েকজন মুহূর্তে চ্যাংদোলা করে আউটডোরের বাইরের ঘরের খাটে এনে ফেললো। সিস্টার মালাদি সিরিঞ্জ হাতে রেডিই ছিলো। হতচকিত ভদ্রলোক কিছু বুঝে ওঠার আগেই ঝপাঝপ দু দুটো ইঞ্জেকশন একদম ওনার কোমরে ফুঁড়ে দেওয়া হলো। সঙ্গে আসা লোকজন তখন একটু সাহস ফিরে পেয়েছে। রোগীকে বাকি সামলানোর কাজটা ওরাই করলো।
ওষুধপত্র লেখা হল। চোদ্দ দিন ওষুধ খেয়ে তিনি যখন আবার এলেন দেখাতে, একেবারে অন্য মানুষ, উত্তেজনার আর ছিটেফোঁটাও নেই।
ভাবছেন অনেকে, কি এমন হয়েছিল ওনার?? খুব সোজা ভাষায়, ওনার ভীষণ ‘ফূর্তি’ হয়েছিলো, একেবারে বাঁধনছাড়া ফূর্তি, ইংরেজীতে বলা যায় EUPHORIA (ELATION ও বলা যেতে পারে!) আর এই ফূর্তিতে সামান্য বাধা পেলেই তৈরী হচ্ছিলো মারাত্মক উত্তেজনা, অসংলগ্ন আচরণ।
হ্যাঁ, এটা একধরনের মানসিক সমস্যা। এক্ষেত্রে বিষাদের ঠিক বিপরীত আচরণ করে থাকে মানুষ। মাত্রাতিরিক্ত উচ্ছাস, বাঁধনহীন অসংলগ্ন আচরণ, অত্যন্ত দ্রুত কথা বলা, বিষয় থেকে বিষয়ান্তরে যাওয়া, যা কখনোই মানুষটির আগের ব্যক্তিত্বের সাথে খাপ খায় না।
কিন্তু, এইসব মানুষেরা ভীষণ বিষণ্ণতাতেও আক্রান্ত হতে পারেন কখনো। এদের মানসিক অবস্থা অসম্ভব আনন্দ থেকে ভয়ঙ্কর মন খারাপের দুটি চূড়ান্ত অবস্থাতেই যেতে পারে। একে “বাই-পোলার ডিসঅর্ডার” বলা হয়, বা আবেগের দুই মেরুর অসুখও বলা যেতে পারে।
ভাগ, উপভাগ ইত্যাদি প্রসঙ্গে যাওয়ার কোনো উৎসাহ নেই। চিকিৎসা আছে, মূলতঃ ওষুধের চিকিৎসায় মনটাকে মাঝামাঝি পরিসরের মধ্যে রাখা সম্ভব, কিন্তু তা দীর্ঘস্থায়ী, অনেক ক্ষেত্রে জীবনভর।
এর আগে বিষাদের আলোচনা করেছিলাম আগে, কিন্তু আনন্দও যে অতি মারাত্মক হতে পারে তার ইঙ্গিত দেওয়াটাও দরকার ছিলো। না না, তাই বলে আনন্দ করবেন না, ফূর্তি করবেন না এমন নয়, অবশ্যই করবেন। কারণ….
কোনো মানসিক সমস্যাকে অসুখের পর্যায়ভুক্ত করতে দুটি প্ৰধাণ জিনিষের কথা মাথায় রাখতে হয়, ১) এই আচরণ নিয়মিত ভাবে সামাজিক সমস্যার কারণ হচ্ছে কিনা, আর ২) কাজের জায়গায় প্রাত্যহিক অসুবিধা তৈরী করছে কিনা!! ইংরেজি শব্দটি বেশ সুন্দর, socio-occupational impairment. তা নিয়মিত ভাবে না হলে ভাবতে বসে যাওয়ার কোনো কারণ নেই।
আর হ্যাঁ, এই আচরণের বা সমস্যার সাথে যদি কোনো নেশার জিনিষের সরাসরি সম্পর্ক থাকে, তা হলে পরিপ্রেক্ষিতটা অনেকটাই পাল্টে যায়।
এগুলো হলো সব আবেগজনিত সমস্যা, এরসঙ্গে উৎকন্ঠার সমস্যাও যুক্ত হতে পারে। আর সর্বোপরি আছে চিন্তার সমস্যা। এগুলোর মধ্যে সুক্ষ্ণ যোগাযোগ আছে।
সবশেষে বলি, তুফানগঞ্জ মানসিক হাসপাতালের ইনডোরে প্রথম যে রোগী চিকিৎসাধীন হয়ে এসেছিলো, তার আক্রমণে দুধকুমারদার হাত ভেঙ্গেছিলো, দুটো তিনটে পাঁজর ভেঙ্গেছিলো, সর্বোপরি ফুসফুসের একটি অংশে চোট লেগে, নিউমোথোরাকস (pneumothorax) হয়েছিল। সিস্টারও বেশ জখম হয়। আমি তখন তুফানগঞ্জ ছেড়ে চলে এসেছি। খবর পেয়েছিলাম। এরপর ইনডোরে ভর্তি বন্ধ হয়ে যায়।
কিন্তু এই কথাটা বলার উদ্দেশ্য এই নয় যে মানসিক অসুস্থতা থাকলেই মানুষ খুব হিংস্র হবেন, তারা খুব বিপজ্জনক, ইত্যাদি। এক্ষেত্রে পরিকাঠামোর সমস্যা ছিলো বলেই মনে হয়। খুব অল্প সংখ্যার মানুষই এইধরনের আচরণ করতে পারেন, তাদের সামলাতে হয়। কিন্তু বেশিরভাগটাই এমন নয়, বরং সাধারণ অন্য মানুষের মতোই। সহৃদয় ভাবে, এদের অধিকাংশ, হ্যাঁ শতকরা ৯৫ শতাংশেরও বেশী মানুষের চিকিৎসাই বাড়িতে করা যায়, এবং অতি অনায়াসে। বাকিদেরও সাময়িক সময়ের জন্য হাসপাতালবাসের প্রয়োজন হতে পারে। শুধু সমস্যাটা শুরু হওয়ার পরে প্রথমেই চিহ্নিত ও চিকিৎসা শুরু হওয়া জরুরী।