জন আর মাইকেলের গল্প কিন্তু এখনও শেষ হয় নি। সেটা ১৯৬৬ সাল। তাদের বয়স তখন ২৬। অলিভার স্যাকস্ আগেই তাদের কথা শুনেছিলেন। তিনি বাড়িতে তাদের দেখতে গেলেন। দেখলেন দুই ভাই একসাথে বসে আছে। তারা সবসময় একসাথে পাশাপাশি বসে থাকত। স্যাকস্ তাদের সাথে দেখা করে পকেট থেকে একটা দেশলাই বের করে কাঠিগুলো তাদের সামনে রাখা টেবিলের ওপর ছড়িয়ে দিলেন।
যেই কাঠিগুলো তাদের সামনে ছড়িয়ে গেল তাদের একজন সাথে সাথে বলে উঠল ১১১। অন্যজন প্রায় একই সাথে বলে উঠল ৩৭, ৩৭, ৩৭। স্যাকস সবে তাদের কাছে এসেছেন। তার ঘোর তখনও কাটে নি। কিছু বুঝে ওঠার আগেই তিনি অবাক হয়ে গেলেন। তারপর সময় নিয়ে সবকটা দেশলাই কাঠি গুনে দেখলেন তাদের সংখ্যা একদম ১১১। বুঝলেন তারা সবকটা কাঠিকে তিনটি ভাগে দেখে তাদের গুনছে। তাই ৩৭-৩৭-৩৭।
স্যাকস্ তাদের জিজ্ঞাসা করলেন, তারা এত সহজে অবলীলায় এটা করছে কিভাবে? দুজনে অবাক হয়ে জবাব দিল, কেন আমরা যে দেখতে পাচ্ছি! উল্টে তারা অবাক হয়ে গেল কেন স্যাকস্ তাদের মত দেখতে পাচ্ছেন না। দুজন অটিস্টিক ছেলে যারা সাধারণ গণিত কি তাই জানে না তাদের সামনে কাঠি ছড়িয়ে দেবার সাথে সাথে চোখের সামনে সংখ্যারা ভেসে উঠছে। আপনি এই দৃষ্টিকে কী বলবেন?
এতেও শেষ নয়। স্যাকস্ অনেক্ষণ তাদের সামনে বসে থাকলেন। দেখার জন্য যে এরপর তারা কী করে। তিনি দেখলেন যে তাদের একজন একটা ৬ অঙ্কের সংখ্যা বলছে। আরেকজন কিছুটা সময় নিয়ে, চোখজোড়া গোল করে অক্ষিকোটরে ঘুরিয়ে এনে কয়েক মিনিটের ব্যবধানে আরেকটা সংখ্যায় জবাব দিচ্ছে। তাদের নিজেদের মধ্যে অনেকক্ষণ ধরে এই সংখ্যার খেলা চলছে। স্যাকস্ তখন তা বুঝতে পারলেন না। তাই তারা যে ৬ অঙ্কের সংখ্যাগুলো বলছে তাদের লিখে বাড়ি নিয়ে এলেন। এসে দেখে তার তো চক্ষু চড়কগাছ! তারা সব প্রাইম নাম্বার বা মৌলিক সংখ্যা নিয়ে খেলা করছিল! ৬ অঙ্কের মৌলিক সংখ্যা, মুখের কথা নয়। অথচ তারা কী সহজে একটার পর একটা কয়েক মিনিটের ব্যবধানে ৬ অঙ্কের মৌলিক সংখ্যা বলে চলেছে।
স্যাকস্ বলেছেন ছোটবেলায় তারও সংখ্যার সাথে খুব সখ্যতা ছিল। এমন যেন সংখ্যারা তার বন্ধু। তার কাছে প্রাইম নাম্বারের একটা বই ছিল। সেই বই নিয়ে পরে একদিন তিনি আবার তাদের বাড়িতে গেলেন। তাদের খেলার মাঝে হঠাৎ করে তাদের চোখ এড়িয়ে বই দেখে একটা ৭ অঙ্কের মৌলিক সংখ্যা বললেন। সেই সংখ্যাটা শুনে তারা দুজনেই প্রথমে চুপ করে গেল। তারপর কিছুক্ষণ চোখ ঘুরিয়ে তাদের মুখে হাসি ফুটে উঠল। স্যাকস্ বুঝতে পারলেন এরপর তারা যেন তাকে আরও ভালোভাবে গ্রহণ করল। তারা বুঝল তিনি তাদের খেলার সঙ্গী।
চমকের এখানেই শেষ নেই। তারপর তারাও ৭ অঙ্কের মৌলিক সংখ্যা বলল। এরপর ৮ অঙ্কের। এতদিন তারা ৬ অঙ্কের সংখ্যার খেলাই খেলত কিন্তু স্যাকস্ এসে যেন তাদের মানসিক অ্যালগরিদম বদলে দিয়েছেন। তারা ১০ অঙ্কের মৌলিক সংখ্যা নিয়েও খেলতে লাগল। কিন্তু স্যাকসের পক্ষে তা অসুবিধের। কারণ তাঁর বইয়ে ৮ অঙ্কের বেশি মৌলিক সংখ্যার টেবিল নেই। সেটা ১৯৬৬ সাল। তখন বাজারে কম্পিউটার, স্মার্ট ফোন কিছুই নেই। তাই তিনি আর তাদের খেলায় অংশ নিতে পারলেন না।
কি আশ্চর্য ভেবে দেখুন তো? এই মৌলিক সংখ্যা নিয়ে বিজ্ঞানীদের প্রশ্নের শেষ নেই। যে মৌলিক সংখ্যাদের নিয়ে প্রবাদ হয়ে আছে ‘গোল্ডব্যাক কনজেকচার’। আজ থেকে প্রায় ২৮০ বছর আগে প্রুসিয়ান গণিতজ্ঞ গোল্ডব্যাক একটা তত্ত্ব দিয়েছিলেন যে ২ এর থেকে বড় যে কোনো যৌগিক সংখ্যাকে অন্য দুটি মৌলিক সংখ্যার যোগফল রূপে প্রকাশ করা যায়। যেমন 12 = 5 + 7, 18 = 7 + 11। কথাটা নাকি তিনি হেঁয়ালি করেই বলেন। তবু আজ পর্যন্ত কেউ একে ভুল প্রমাণ করতে পারে নি। গণিতজ্ঞরা মনে করেন এটা সত্যি। যে এটিকে প্রমাণ করতে পারবে তার জন্য একটি ব্রিটিশ কোম্পানি এক মিলিয়ন ডলার পুরস্কার ঘোষণা করেছে অনেকদিন আগেই। কয়েকদিন আগে পথিক গুহ আনন্দবাজারে লিখেছিলেন যে এক ভারতীয় গণিতজ্ঞ নাকি একে প্রমাণ করে ফেলেছেন। তা এখন সর্বসম্মত সিদ্ধান্তের অপেক্ষায়।
সেই এত বড় বড় মৌলিক সংখ্যা নিয়ে তারা অবলীলায় খেলে যাচ্ছে। তারা দেখতে পাচ্ছে সেইসব সংখ্যা তাদের চোখের সামনে। আশ্চর্য এই দৃষ্টি! এই দৃষ্টির কোনো ব্যাখ্যা স্যাকস্ দিতে পারেন নি। জানি না এখনও পর্যন্ত কেউ দিতে পেরেছেন কিনা। গোল্ডব্যাক কনজেকচারের মতই এটাও একটা ধাঁধাঁ।
প্রবাদপ্রতিম আর্জেন্তিনীয় কথাকার হর্হে লুই বোর্হেসের একটা অনবদ্য গল্প আছে। ‘ফুনেস দ্য মেমরিয়াস’। কয়েকদিন আগে ‘বাক্’ পত্রিকায় উৎসব রায় গল্পটির বাংলা অনুবাদ প্রকাশ করেন। বোর্হেইয়ান রচনার অনবদ্য উদাহরণ এই গল্পটি। এই গল্পের নায়ক ফুনেস একদিন ঘোড়া থেকে পড়ে গিয়ে মাথায় চোট পেয়ে স্থায়ী পক্ষাঘাতে আক্রান্ত হয়ে যায়। তারপর থেকে তার মস্তিষ্কে স্মৃতির ভান্ডার খুলে যায়। সব জমানো পুরনো স্মৃতি তার পুঙ্খানুপুঙ্খ ডিটেল নিয়ে তার চোখের সামনে ভেসে ওঠে।
আপনি দেখছেন টেবিলের ওপর একটি গ্লাসে মদ রাখা আছে। ফুনেস দেখছে সেই বাগানের সবকটি আঙ্গুরের লতা ও সবকটি আঙ্গুরের গুচ্ছ। আলাদা আলাদা ভাবে। অবিকল। ফুনেস একজায়গায় বলেছে, শুধু তার মস্তিষ্কে যত স্মৃতি আছে সারা পৃথিবীর মানুষের মনে তত স্মৃতি নেই। কথাটা হয়ত মিথ্যে নয়। তাই তার কাছে কোনো সংখ্যার নামকরণ কোনো বস্তুর নামে হতে পারে। যেমন সাত হাজারের নাম হতে পারে ‘সেই রেলগাড়িটি’। এটাই তার প্রস্তাব। যদিও ফুনেসের কাছে সে এক ‘স্মৃতির জঞ্জাল’। সে গল্পকথককে বলেছে, তোমাদের জেগে থাকা যেমন আমার স্বপ্নগুলো তেমন। দুঃসহ এই স্মৃতির ভার। অসাধ্য একে বহন করে চলা।
অলিভার স্যাকস্ তার ‘দ্য টুইন্স’ রচনাটিতেও বোর্হেসের এই গল্পটির উল্লেখ করেছেন। বোর্হেসের গল্পটি স্প্যানিশ ভাষায় প্রকাশিত হয় ১৯৪০ সালে। ইংরিজি অনুবাদ প্রকাশিত হয় ১৯৪৯ সালে। স্যাকস্ এই টুইনদের কথা বলছেন আগেই বলেছি ১৯৬৬ সালে। গল্প আর বাস্তবের মধ্যে কী মিল দেখুন! আপনি বোর্হেসের গল্পকে বলবেন ম্যাজিক রিয়ালিজম। কিন্তু এক্ষেত্রে দেখুন ম্যাজিক কিভাবে বাস্তবের জমিতে নেমে এসেছে। আমি জানি না বোর্হেস তেমনই কোনো স্মৃতিধর ফুনেসের দেখা পেয়েছিলেন কিনা কিংবা সত্যিই তেমন কোনো ইঙ্গিত তার বিপুল পাঠের কোথাও ছিল কিনা। থাকলে আমি আদৌ অবাক হব না। অথচ এই বোর্হেস হঠাৎ একদিন আবিষ্কার করলেন তিনি অন্ধ হয়ে যাচ্ছেন। বাকি সারা জীবন তিনি তাঁর অন্ধত্ব নিয়েই কাটান। তাঁর স্ত্রী তাঁকে বই পড়ে শোনাতেন।
স্যাকসের আরেকটি দারুন বই আছে ‘দ্য আইল্যান্ড অব দ্য কালারব্লাইন্ড’। সেই বইতে স্যাকসের এক প্রশান্ত মহাসাগরীয় উপদ্বীপের আদিবাসীদের নিয়ে অনুসন্ধানের কথা আছে। সেই উপদ্বীপের সবাই ছিল বর্ণান্ধ। তারা জন্ম থেকেই সাদা-কালো দেখে। তাদের পৃথিবীটাই ছিল ব্ল্যাক অ্যান্ড হোয়াইট। এক নির্জন উপদ্বীপে যুগের পর যুগে বাস করে নিজেদের রক্তের সম্পর্কিত মানুষের সাথে বারবার ‘ইন্টারব্রিড’ করে তারা সকলে সেই মিউট্যান্ট জিন যা কিনা বর্ণান্ধতার জন্য দায়ি তা বহন করে চলেছে।
প্রসঙ্গক্রমে উল্লেখ করা যায় যে জার্মান বিজ্ঞানী ভন হেলমলজ্ প্রথম আবিষ্কার করেন যে আমরা কিভাবে রঙ্গিন পৃথিবীকে দেখি তিনিও অসম্ভব এক দৃষ্টির অধিকারী ছিলেন। সঙ্গীতের অসম্ভব সমঝদার এই মানুষটি তাঁর চোখের চারপাশে সঙ্গীতের নোটেশন, অক্টেভ, সেস্টেট এদের চলে বেড়াতে দেখতেন। সঙ্গীত তাঁর কাছে ছিল একটা ভিসন। শুধু তিনি নন অনেকের কাছেই তাই। তিনি যখন সম্পূর্ণ অন্ধ হয়ে যান তারপরেই বীঠোফেন তাঁর শ্রেষ্ঠ সিম্ফনিগুলো রচনা করেছিলেন।
এই দেখা না দেখার রহস্যের কোনো শেষ নেই। মেন্ডেলিভ কিছুতেই পর্যায় সারণীর মৌলগুলোকে সাজাতে পারছেন না। বুঝতে পারছেন কিন্তু কিছুতেই তাদের টেবিলে রাখতে পারছেন না। ক্লান্তিতে ব্যর্থতায় তিনি অবসাদের শিকার হয়ে যান। এমনই এক রাতে ক্লান্তিতে ঘুমিয়ে পড়ে ভাঙ্গাচোরা ঘুমে স্বপ্ন দেখলেন। কে যেন মৌলগুলোকে তাঁর সামনে সাজিয়ে দিয়েছে। ঘুম ভেঙে চমকে উঠে গোটা পর্যায় সারণী লিখে ফেললেন। হুবহু। অবিকল। বাকিটা তো ইতিহাস। আপনি একে কী বলবেন? এ দৃষ্টি কি অন্তরঙ্গের না বহিরঙ্গের?
স্বামীজি একবারে একটা বইয়ের গোটা পাতা পড়তে পারতেন। আপনি আমি যেমন একটা শব্দ একবারে দেখি উনি একটা গোটা পাতা একেবারে দেখতে পেতেন। উনি পারতেন। যোগ ও সাধনায় তাঁর মনের দৃষ্টি ওই উচ্চতায় পৌঁছেছিল। একটা পিঁপড়ের কথা ভাবুন সে যদি সেন্ট্রাল অ্যাভিনিউ পার হবার চেষ্টা করে সে কতটুকু দেখবে? তাঁর দৃষ্টিক্ষেত্র কতটা হবে? পার হবার সময় আপনি যদি দেখেন আপনারই বা কতটা হবে? পার্থক্যটা বুঝুন। মানুষ সাধনায় অনেক কিছু পারেন। অতীত ভবিষ্যৎ দেখতে পান। আমাদের মুনিঋষিরা পারতেন। এটা মিথ্যে নয়। সঞ্জয় যে মহাভারতের যুদ্ধ দেখছেন সেটা গাঁজাখুরি নয়। তাঁর কিছু প্রেক্ষিত থাকতেও পারে। বিজ্ঞান সবকিছু ব্যাখ্যা করতে পারে না বলে আমরা যা কিছু অসম্ভব দেখছি বা শুনছি তা মিথ্যে নয়।
অবশ্যই এটা আমার বিশ্বাস। অলৌকিকের প্রতি, অব্যাখ্যাতর প্রতি আমার ধারণা। আপনি যদি আমার জগতের হোন তাহলে আসুন এবার আমরা অন্যরকম কিছু দেখার জগতে প্রবেশ করি। এতক্ষণ ধরে আমরা সেই আলোচনার জমি তৈরি করেছি মাত্র।
(চলবে)