বাইশ তেইশ বছর আগের কথা। একদিন আউটডোরে বসে রোগী দেখছি এমন সময় দূরভাষের অতি মধুর আর্তনাদ! মুঠোফোন তখনও সর্বব্যাপী হয়নি। পুরনো আমলের কৃষ্ণবর্ণ ফোন। রিসিভার এতো ভারি যে ‘ছু়ঁড়িয়া মারিলে জোয়ান মানুষ খুন হয়’। কিয়ৎক্ষণের বাক্যালাপে ডাম্বেল নিয়ে ব্যায়ামের ফল হয়। ফোন তুললাম। আমাদের চিকিৎসা বিভাগের সর্বময় কর্তার ফোন। উনি জানালেন কোলকাতা থেকে আড়াই’শ কি.মি দূরের এক হাসপাতালে অবিলম্বে অস্থিশল্যচিকিৎসার অপারেশন চালু করতে হবে। ইউনিয়নের চাপে মহাপ্রবন্ধক মহোদয়ের নির্দেশ।
কর্তামহাশয় ‘অতি স্নেহ ভরে’ সেই দায়িত্ব এই অধমের হাতে সঁপে দিলেন। মহা চিন্তায় পড়লাম। আগেই বলেছি, অস্থিশল্যচিকিৎসার অপারেশন পুরোপুরি যন্ত্রপাতি নির্ভর। সঠিক যন্ত্রপাতি না থাকলে নিপুণ শল্য-চিকিৎসকও অসহায়। আর আমার মত অখাদ্য চিকিৎসকের কথাতো ছেড়েই দিলাম। আমি জানি যে ওই হাসপাতালে অস্থিশল্যচিকিৎসার কোন পরিকাঠামো নেই। এই অবস্থায় ওখানে অপারেশন শুরু করা মানে আত্মহত্যার সামিল। কিন্তু চাকরি জীবনে ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষ সর্বদাই সঠিক। সুতরাং ‘তাঁর নির্দেশ’ চাকরি বজায় রাখতে হলে মানতেই হবে।
অনতিবিলম্বেই দূরভাষে সেই হাসপাতালের সুপারের মধুর আহ্বান কর্ণগোচর হলো। কবে আমি ওই হাসপাতালে অপারেশন করতে পারবো? ওঁরা অধীর আগ্রহে অপেক্ষমান। আমি সবিনয়ে কোনো হাড় ভাঙ্গা রোগী ওই হাসপাতালে ভর্তি হলে আমায় জানাতে বললাম। দিনকয়েক বাদে ফোন এল হাত ভাঙ্গা নিয়ে একটি কিশোরী ওই হাসপাতালে ভর্তি হয়েছে। ওর অপারেশনের জন্য কোন সরবরাহকারী প্রয়োজনীয় প্লেট এবং স্ক্রু যোগান দেবে তার নাম ও ফোন নম্বর জানতে চাইলাম। উনি তা আমায় জানালে, সেই সরবরাহকারীকে ফোন করলাম। আমি ওঁকে বললাম যে শুধু প্লেট স্ক্রু দিয়ে তো অপারেশন হবে না। অন্যান্য প্রয়োজনীয় যন্ত্রপাতির কি ব্যবস্থা হবে? উনি জানালেন সব যন্ত্রপাতি উনি দিয়ে দেবেন। কোন অসুবিধা হবে না। আমি কিঞ্চিৎ আশ্বস্ত হলাম। আমি ওই হাসপাতালের সুপারকে ফোন করে রোগিনীর অ্যানাস্থেটিক ফিটনেস করিয়ে রাখতে বললাম।
দুদিন পরে আমি গিয়ে অপারেশন করবো স্থির করা হলো। কথা মতো অপারেশনের দিন ভোরের ট্রেন ধরে সকাল সকাল ওই হাসপাতালে পৌঁছে গেলাম। গিয়ে দেখি বেশ হৈ চৈ পড়েছে। ওই হাসপাতালে প্রথম অস্থিশল্যচিকিৎসার অপারেশন হবে বলে ইউনিয়নের কর্তাব্যক্তিরা সব উপস্থিত। তাঁদের আস্ফালনেই এটি সম্ভব হচ্ছে বলে তদ্জনিত বক্ষদেশস্ফিতি প্রকটভাবে দৃশ্যমান! ব্যাপার স্যাপার দেখে আমি কিঞ্চিৎ ঘাবড়েই গেলাম। এনাদের উপদ্রব মূল্য খুবই বেশি। পান থেকে সামান্য চুন খসলে বা না খসলেও, পেশিশক্তির প্রবল প্রতাপ প্রদর্শনে এঁরা সততই সঞ্চারমান থাকেন। আর অচেনা জায়গায় অপারেশন সবসময়ই একটু কঠিন। যাই হোক, প্রথমেই ওয়ার্ডে গেলাম রোগিনীকে দেখতে। দেখি চোদ্দো পনেরো বছরের এক প্রতিবন্ধী কিশোরী।
ছোটবেলায় আগুনে পুড়ে ওর শরীরের বাঁদিক পুরো ক্ষতিগ্রস্থ। বাঁ হাতটি কাঁধের কাছে অনেকটাই জুড়ে গিয়ে কাঁধের সঞ্চালন ভালো ভাবে হয় না। কনুইয়ের সঞ্চালনও সম্পূর্ণ স্বাভাবিক নয়। বাঁ হাতটি ডান হাতের তুলনায় শীর্ণ। বাঁ হাতের চামড়া পুরোটাই তেলতেলে পোড়ার চিহ্ন বহন করছে। ওর বাঁ হাতেরই পুরোবাহুর (forearm) রেডিয়াস আর আলনা দুটি হাড়ই বিশ্রী ভাবে ভেঙে গেছে। প্রতিবন্ধী এই অভাগিনী কন্যাটি বড়ো বড়ো দুটি চোখে আমার দিকে চেয়ে আছে। একদা নিম্নতম পদমর্যাদার কর্মী, এখন অবসরপ্রাপ্ত ওর বৃদ্ধ পিতাও আকুল হয়ে তাকিয়ে আছে। আমি রোগিনীকে অপারেশন থিয়েটারে পাঠাতে বলে নিজে অপারেশন থিয়েটারে ঢুকলাম।
পোশাক পরিবর্তন করে মূল থিয়েটারে ঢুকে কর্তব্যরত সিস্টারকে যন্ত্রপাতি কি কি আছে দেখাতে বললাম। উনি ফরসেপস্ দিয়ে তোয়ালে তুলে আমায় সব যন্ত্রপাতি দেখালেন। দেখে আমার চক্ষুস্থির হয়ে গেল! দেখি স্ক্রু প্লেটের বাক্স আর ড্রিল ছাড়া আর কিছুই নেই ! এগুলি ছাড়াও এই অপারেশনের জন্যে, রিট্রাকটর্ ( মাংস ও অন্যান্য টিস্যু সরিয়ে রাখতে), বোন হোল্ডিং ফরসেপস্ (হাড় ধরার জন্য), পেরিঅস্টিয়াম এলিভেটর (হাড়ের গায়ের পাতলা টিস্যুর স্তর সরাতে), রিডাকশন ফরসেপস্ (হাড়গুলি ঠিক ভাবে বসানোর জন্য) ইত্যাদি আরো অনেক যন্ত্রপাতির প্রয়োজন যেগুলি ছাড়া অপারেশন অসম্ভব! ওই হাসপাতালের সরবরাহকারী ভদ্রলোক আমায় কথা দিয়ে ছিলেন যে এই সব যন্ত্রপাতি উনি সরবরাহ করবেন। আমি প্রতিটি যন্ত্রের নাম ধরে ধরে ওঁকে বলেছিলাম। উনি আমায় আশ্বস্ত করেছিলেন। এখন কার্যক্ষেত্রে উনি আমায় আক্ষরিক অর্থেই ডুবিয়ে দিলেন। এই অবস্থায় অপারেশন বাতিল করা ছাড়া কোন উপায় নেই। কিন্তু ওই অভাগিনী কিশোরীর আকুল দুটি চোখ আমায় বিদ্ধ করছিল। আমি ও.টি.+র মেট্রনকে বললাম আপনার নিজস্ব কি কি যন্ত্রপাতি আছে আমায় দেখান। স্টোর রুমের আলমারি উনি খুলে দিলেন। দেখি অনেকগুলি অতি বড় বড় আর্টারি ফরসেপস্ রয়েছে। খোদায় মালুম এগুলি কি কাজে লাগে। এত বড় সাইজের যন্ত্র দেখলে আমরা হাতীর যন্ত্র বলি! তো সেই ‘হাতীর ফরসেপস্’ একগুচ্ছ দিদির হাতে দিলাম, একটা অস্টিওটোমও পেয়ে গেলাম। হঠাৎ সব যন্ত্রপাতির পেছনে দেখি একটি ল্যোমান উঁকি দিচ্ছে। আরিব্বাস ! এতো অবিশ্বাস্য! ল্যোমানস্ ফরসেপস্ একটি আদ্যিকালের রিডাকশন ফরসেপস্, মানে ভাঙ্গা হাড়কে ঠিক ভাবে বসিয়ে, প্লেট লাগিয়ে ধরে রাখতে কাজে লাগে, নাহলে ড্রিল করার সময় প্লেট ছিটকে যাবে। অতি জবড়জং বলে আজকাল আর ব্যবহার করা হয় না। আমি নিজে কখনও ব্যবহার করি নি। কিন্তু আজ আমার ভিখারির দশা! ওটিকেও বার করা হলো। আরও দুচারটি এটা ওটা যন্ত্র বেছে নিলাম। সবগুলিকে একসাথে জীবাণুমুক্ত করতে দেওয়া হলো। যা হয় হবে। ওই অতিঅভাগিনী কন্যাটির আকুল চোখ দুটি আমায় অস্থির করেছিল। ওর প্রত্যাশার দীপটিকে এক ফুৎকারে নিভিয়ে দেওয়ার অধিকার আমার নেই।
রোগিনীকে অপারেশন থিয়েটারে আনা হলো। আমার অবেদন বিশেষজ্ঞ সহকর্মী বন্ধুটি রোগিনীর আঘাতগ্রস্থ হাত কাঁধের কাছে পুরো খোলে না বলে ‘ব্রেকিয়াল ব্লক’ অ্যানাস্থেশিয়া দিতে কিছুটা দ্বিধায় ছিলেন। শেষ মেশ বলেই ফেললেন যে, ওটাও যদি আমিই দিই। আমার অবস্থা তখন বনফুলের গল্পের শ্রীপতি সামন্তের মতো! ঠিক আছে, যাহা বাহান্ন তাহা তিপ্পান্ন! রোগিনীকে অ্যানাস্থেশিয়াও আমিই দিলাম। তারপর হাত ধুয়ে নেমে পড়লাম। ততক্ষণে আমার যন্ত্রপাতি জীবাণুমুক্ত হয়ে এসে গেছে। একেবারে আক্ষরিক অর্থেই হাতে গরম! ছ্যাঁকা লাগছে!
সাবধানে ওই তেলতেলে চামড়ায় ছুরি বসালাম। হাড় ভাঙ্গা জায়গাগুলি বার করে ওই ‘হাতীর’ ফরসেপস্ দিয়েই রিট্রাকশন করলাম, আবার ওগুলিকেই বোন হোল্ডিং ফরসেপস্ হিসেবে কাজে লাগালাম। তারপর হাড়গুলি ঠিকমতো বসিয়ে ল্যোমানস্ ফরসেপস্ আর প্লেট দিয়ে ধরে ড্রিল করে স্ক্রু লাগিয়ে দিলাম। শেষমেশ হাড়গুলি ঠিকঠাকই বসাতে পেরেছিলাম। এরপর আস্তে আস্তে সব সেলাই করে দিলাম। সেদিন সেই অতি ভিখারির দশায় আমারে দু দন্ড শান্তি দিয়েছিল প্রাগৈতিহাসিক ল্যোমান!
ব্যান্ডেজ করে প্লাস্টারও করে দিলাম। চোখের ঢাকা খুলে রোগিনীকে বললাম অপারেশন শেষ, সব ঠিক আছে। দেখি কন্যার দুচোখে টলটল করছে অশ্রু বিন্দু।
রোগিনীকে থিয়েটার থেকে স্থানান্তরিত করা হল। যাওয়ার পথে এক্সরে করা হল। এক্সরেতে হাড়ের অবস্থান দেখলাম ঠিকঠাকই আছে।
ওই হাসপাতালে কোন অস্থিশল্যচিকিৎসক ছিলেন না কিন্তু একজন অত্যন্ত দক্ষ সাধারণ শল্যচিকিৎসক ছিলেন। উনি সানন্দে অপারেশনের পরবর্তী সময়ে রোগিনীকে দেখার দায়িত্ব নিয়েছিলেন। সব শেষ হলে কন্যাটির বৃদ্ধ পিতার সাথেও কথা বলে তাঁকে আশ্বস্ত করলাম।
এরপর সন্ধ্যায় ফেরার ট্রেনে উঠলাম। এরপর প্রতিদিন ওই শল্যচিকিৎসকের সাথেই রোগিনীর অবস্থা সম্পর্কে খোঁজ নিয়েছি। অপারেশন পরবর্তী দিনগুলোতে ওর কোন সমস্যা হয়নি। বারো দিনের পর সেলাই কেটে দেওয়া হয়েছিল। মাসদেড়েক পরে ওর প্লাস্টার খুলে দিয়ে ফিজিওথেরাপি শুরু করা হলো। মাসতিনেক পরে একবার আমায় দেখাতে এলো। এক্সরে দেখলাম হাড় সম্পূর্ণ জুড়ে গেছে আর হাতের সঞ্চালনাও খুবই সন্তোষজনক। ওই অভাগিনী প্রতিবন্ধী কন্যাটির ভেঙে যাওয়া হাড় যে হাতের আরও প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করেনি এটা খুব তৃপ্তি দিয়েছিল।
উজ্জ্বল হাসিমুখে কন্যাটি যখন আমার কাছ থেকে বিদায় নিল আমার একটা কথাই মনে হলো, ফিরে ফিরে চিত্তবীণায় দাও যে নাড়া,গুঞ্জরিয়া , গুঞ্জরিয়া দেয় সে সাড়া …আমার হাসি বেড়ায় ভাসি, তোমার হাসি বেয়ে বেয়ে, তুমি খুশি থাকো।
অসামান্য!
মানুষ আর ডাক্তার একীভূত!
অনেক ধন্যবাদ দাদা।
রবীন্দ্রনাথ, জীবনানন্দ আর ভালবাসা মিলে গেছে এক সূত্রে।
অনেক ধন্যবাদ, খুব ভালো থাকবেন।
এই তো চাই ডাক্তার! এই রকম ডাক্তারই চাই।
অনেক ধন্যবাদ স্যার, খুব ভালো থাকবেন।