এই কথায়, আশা করি, অনেকেই সহমত হবেন, যে, এই রাজ্যে শিক্ষাদীক্ষার হাল শোচনীয়। না না, আমি শিক্ষক-নিয়োগে দুর্নীতি বা টেট-উত্তীর্ণদের ইয়ে এসব বিতর্কিত প্রসঙ্গে যেতে চাইছি না, আমি জাস্ট বলতে চাইছি, আমাদের তথাকথিত শিক্ষিত-উচ্চশিক্ষিতদের হাল বেশ খারাপ।
এর জন্য বর্তমান রাজ্য সরকারকে দোষ দেওয়ার মানে হয় না। এঁরা যথাসম্ভব চেষ্টা করছেন। কিন্তু একটু ভেবে দেখুন, আজকে যাঁরা শিক্ষিত বা উচ্চশিক্ষিত, তাঁদের প্রায় সবাই প্রাথমিক-মাধ্যমিক পর্যায়ের শিক্ষাটি পেয়েছিলেন বাম আমলে – অর্থাৎ কিনা বুনিয়াদি পর্যায়ের শিক্ষা হয়েছিল সেই অন্ধকার বাম আমলে – অনেকের তো পুরো শিক্ষাকালই অতিক্রান্ত হয়েছিল সেই অন্ধকারাচ্ছন্ন যুগে – সে খামতি পূরণ হবে কোত্থেকে।
একটু উদাহরণ দিলেই ব্যাপারটা স্পষ্ট হয়ে যাবে।
ডাক্তারদের কথাই ধরুন। খাতায়কলমে উচ্চশিক্ষিত তো বটেই। এঁদের মধ্যে অনেকেরই আয়-টায় ভালো – এঁদের মধ্যে অনেকেরই যাকে বলে ”প্রপার্টি হ্যায়, ব্যাঙ্ক ব্যালেন্স হ্যায়, বাংলা (কুড়ি টাকার পাউচ অর্থে নয়) হ্যায়, গাড়ি হ্যায়” – কিন্তু মেজর একটা খামতি রয়েই গিয়েছে। শিক্ষার হাল এমনই যে ঠিক করে গুণতে শেখেনি।
মেডিকেল কাউন্সিল ভোটের কথাই ধরুন না। একজন ডাক্তারবাবু দিতে পারবেন সর্বোচ্চ সাতটি ভোট। কিন্তু কী দেখা গেল? দেখা গেল, একেকজন সাতের জায়গায় আটটি-ন’টি করে ভোট দিয়ে ফেলেছেন।
পড়তে না পারা – অর্থাৎ illiteracy – তার মতো গুণতে না জানার জন্যও একটি শব্দ রয়েছে – innumeracy.
তো ডাক্তারবাবুরা এমনই innumerate, যে সাতখানা ভোট দেওয়ার পর revise করতে গিয়ে গুণতে ভুল করেছেন – এবং সেই ভুলের সংশোধন করতে গিয়ে তড়িঘড়ি আরও একখানা ভোট দিয়ে ফেলেছেন, যাতে ব্যালটটাই বাতিল হয়ে গিয়েছে। revision বুঝলাম কী করে? সেটা স্পষ্ট, কেননা আগের সাতটি ভোট যে রঙের কালিতে, অষ্টম বা নবম চিহ্ন অন্য কালিতে – একাধিক ক্ষেত্রে তো সাতখানা ভোট পেনসিলে দিয়ে আট নম্বরটি কালিতে – কাজেই…
এমন ব্যালট একেবারে হাজারে হাজারে – ওই যে, হাজার হাজার ডক্টর হাজরা – ডাক্তারদের এই ভোটে বাক্যটি অব্যর্থ।
তা বলে সব ডাক্তারই কি এমন অসম্পূর্ণ শিক্ষার অধিকারী?
মোটেই না। দেখুন, একই ইশকুল থেকে পাস করে একজন ওয়াগন-ব্রেকার হন, আর আরেকজন সৎ পেশাদার।
ওই একই অন্ধকারাচ্ছন্ন বাম আমলে শিক্ষালাভ করে কিছু ডাক্তার – যেমনটা প্রত্যাশিত – গুণতে অবধি শেখেনি। এবং তাঁদের সেই অসম্পূর্ণ শিক্ষা ঠেলে নিয়ে গিয়েছে জয়েন্ট প্ল্যাটফর্ম অফ ডক্টর্স-এর দিকে। সংখ্যায় এঁরা অনেক এবং বাড়তি ভোটের কারণে ব্যালট বাতিল এঁদেরই হচ্ছে। তদুপরি, এঁরা এমনই নির্লজ্জ যে এরপরও এঁরা সেসব নিয়ে তর্ক করছেন, বুদ্ধিদীপ্ত ‘তৃণমূলপন্থী চিকিৎসক’-দের তরজায় মাতছেন। কী আর বলি!!
আবার সেই আমলে বুনিয়াদি শিক্ষা সম্পূর্ণ হলেও কিছু মানুষ ছিলেন সত্যিই অন্যরকম। যদ্দূর মনে হয়, তাঁদের বাড়ির শিক্ষা, মূল্যবোধ – এসবও অন্যরকম ছিল। এঁরা বুদ্ধিদীপ্ত ঝলমলে টাইপের। গভীর মূল্যবোধে বিশ্বাসী। এঁরা সমবেত হয়েছেন ‘তৃণমূলপন্থী চিকিৎসক’-দের পতাকাতলে। গুণতে ভুল সেসব তাঁদের হয় না। ব্যালট জাল হোক বা ভুয়ো – সাতের বেশি একটিও ভোট পড়েনি। দুর্ভাগ্যজনক, সদুদ্দেশ্য স্পষ্টভাবে সঠিক পথে প্রকাশিত হওয়া সত্ত্বেও স্রেফ ব্যালটটি জাল হওয়ার মতো তুচ্ছ কারণে এমন উজ্জ্বল কিছু চিকিৎসকের ভোট বাতিল হয়ে যাচ্ছে।
যা-ই হোক, ভোট গুণতে গিয়ে পঞ্চাশ শতাংশের বেশি ব্যালট বাতিল, এমন ঘটনা বাজারে বেশি শুনতে পাবেন না। গর্বিত হ’ন, প্লিজ।
মনে করুন সেই গর্বের সন্ধ্যার কথা। স্বাধীনতার পর হইহই করে গান্ধীজি এসেছেন শান্তিনিকেতনে। খাটাখাটুনি করে একটু যেন টায়ার্ড। রবীন্দ্রনাথ জিজ্ঞেস করছেন,
“মোহনবাবু,
কিসের দুঃখ, কিসের দৈন্য
কিসের লজ্জা, কিসের ক্লেশ?”
গান্ধীজি কিছু বলার আগের নেতাজি গেয়ে উঠলেন,
“আমরা ঘুচাবো তোমার কালিমা
মানুষ আমরা, নহি তো মেষ
বঙ্গ আমার জননী আমার
ধাত্রী আমার, আমার দেশ…”
অমনি সম্মিলিত সিটি-তে ভরে উঠল শান্তিনিকেতনের ঊষর প্রান্তর।
আহ্, আর কি কখনও তবে, এমনও সন্ধ্যা হবে…
হ্যাঁ হ্যাঁ, হচ্ছেই তো। রোজ দিনে-বিকেলে-সন্ধেয়…
উজ্জ্বল এক ঝাঁক পায়রা, থুড়ি উজ্জ্বল এক ঝাঁক তরুণ ডাক্তারবাবুদের সম্মিলিত ‘জয় বাংলা’ স্লোগানে ভরে উঠছে লবণহ্রদ…